আজ বরুণের হাতে কাজ কিছু নেই, মনেও সুখ নেই। সে তার অফিসঘরে ঘূর্ণিচেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে সিগারেট টানছে আর আকাশ পাতাল ভাবছে, এমন সময় সামনের বাংলা কাগজে এই বিজ্ঞাপনটি তার চোখে পড়ল—
যদি মনে করেন সময়টা ভাল যাচ্ছে না, মুশকিলে পড়েছেন, তবে আমার কাছে আসতে পারেন। যদি অবস্থা এমন হয় যে, উকিল ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার পুলিস জ্যোতিষী বা গুরুমহারাজ কিছুই করতে পারবেন না, তবে বৃথা দেরি না করে আমাকে জানান। এই ধরুন, আপনার সম্বন্ধী সপরিবারে আপনার বাড়িতে উঠেছেন, ছ মাস হয়ে গেল তবু চলে যাবার নামটি নেই। অথবা আপনার পিসেমশাই তাঁর মেয়ের বিয়ের গহনা কেনবার জন্য আপনাকে তিন হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু রেস খেলতে গিয়ে আপনি তা উড়িয়ে দিয়েছেন। অথবা পাশের বাড়ির ভবানী ঘোষাল আপনাকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছে, কিন্তু সে হচ্ছে ষণ্ডামার্কা গুণ্ডা আর আপনি রোগা—পটকা। কিংবা ধরুন আপনার স্ত্রীর মাথায় ঢুকেছে যে তাঁর মতন সুন্দরী ভূভারতে নেই, তিনি সিনেমা অ্যাকট্রেস হবার জন্য খেপে উঠেছেন, আপনি কিছুতেই তাঁকে রুখতে পারছেন না। কিংবা মনে করুন আপনি একটি মেয়েকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেবার পর অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ঘোরতর প্রেমে পড়েছেন, আগেরটিকে খারিজ করবার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ইত্যাদি প্রকার সংকটে যদি পড়ে থাকেন তো সোজা আমার কাছে চলে আসুন। শ্রীসরলাক্ষ হোম, তিন নম্বর বেচু কর স্ট্রীট, বাগবাজার, কলিকাতা। সকাল আটটা থেকে দশটা, বিকেল চারটে থেকে রাত নটা।
বিজ্ঞাপনটি পড়ে বরুণ কিড়িং করে ঘণ্টা বাজালে। লাল চাপকান পরা একজন আরদালী ঘরে এল, বরুণ তাকে বললে, মিস দাস। একটু পরে ঘরে ঢুকল খঞ্জনা দাস, বরুণের অ্যাসিস্টাণ্ট, রোগা লম্বা কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা ঢেউ তোলা রুক্ষ ফাঁপানো চুল, চাঁচা ভুরু, গোলাপী গাল, লাল ঠোঁট, লাল নখ, নখের ডগাটিকে দেখায় লানসেটের মতন সরু। সস্তা সিন্থেটিক ভায়োলেটের গন্ধে ঘর ভরে গেল।
বরুণ কাগজটা হাতে দিয়ে বললে, এই বিজ্ঞাপনটা পড়ে দেখ।
বিজ্ঞাপন পড়ে খঞ্জনা বললে, যাবে নাকি লোকটার কাছে? নিশ্চয় হামবগ জোচ্চোর, কিছুই করতে পারবে না, শুধু ঠকিয়ে পয়সা নেবে। আমার কথা শোন, দু নৌকোয় পা রেখো না, মাণ্ডবী আর তার বাপকে সোজা জানিয়ে দাও যে তুমি অন্য মেয়ে বিয়ে করবে।
—তার ফল কি হবে জান তো? আমার আড়াই হাজার টাকা মাইনের চাকরিটি যাবে। আমাদের চলবে কি করে? মাণ্ডবীর বাপ গদাধর ঘোষকে তুমি জান না, অত্যন্ত রাগী লোক।
—অত ভয় কিসের? তোমার সরকারী চাকরি, গদাই ঘোষ তোমার মনিব নয়, ইচ্ছে করলেই তোমাকে সরাতে পারে না। আর যদিই চাকরি যায়, অন্য জায়গায় একটা জুটিয়ে নিতে পারবে না?
বরুণ বললে, আজ বিকেলে এই সরলাক্ষ হোমের কাছে গিয়ে দেখি। যদি কোনও উপায় বাতলাতে না পারে তবে তুমি যা বলছ তাই করব।
এখন সরলাক্ষ হোমের পরিচয় জানা দরকার। লোকটির আসল নাম সরলচন্দ্র সোম। বি.এ পাস করে সে স্থির করলে আর পড়বে না, চাকরিও করবে না, বুদ্ধি খাটিয়ে স্বাধীনভাবে রোজগার করবে। প্রথমে সে রাজজ্যোতিষীর ব্যবসা শুরু করলে। কিন্তু তাতে কিছু হল না। কারণ সামুদ্রিক আর ফলিত জ্যোতিষের বুলি তার তেমন রপ্ত নেই, মক্কেলরা তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হল না। তার পর সে সরলাক্ষ হোম নাম নিয়ে ডিটেকটিভ সেজে বসল, কিন্তু তাতেও সুবিধা হল না। সম্প্রতি সে একেবারে নতুন ধরনের ব্যবসা ফেঁদেছে, মক্কেলও অল্পস্বল্প আসছে।
সরলাক্ষ হোমের বাড়িতে ঢুকতেই যে ঘর, সেখানে একটা ছোট টেবিল আর তিনটে চেয়ার আছে, মক্কেলরা সেখানে অপেক্ষা করে। তারপরের ঘরটি কনসল্টিং রুম, সেখানে সরলাক্ষ আর তার বন্ধু বটুক সেন গল্প করছে। বটুক সরলাক্ষর চাইতে বয়সে কিছু বড়, সম্প্রতি পাস করে ডাক্তার হয়েছে, কিন্তু এখনও কেউ তাকে ডাকে না। ঘরের ঘড়িতে পৌনে চারটে বেজেছে।
বটুক সেন বলছিল, খুব খরচ করে ব্যবসা তো ফাঁদলে। ঘর সাজিয়েছ, দামী পর্দা টাঙিয়েছ, উর্দি পরা বয় রেখেছ, কাগজে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছ। মক্কেল কেমন আসছে?
সরলাক্ষ বললে, দুটি একটি করে আসছে। বেশীর ভাগই স্কুলের ছেলে, ষোল টাকা ফী দেবার সাধ্য নেই, টাকাটা সিকেটা যা দেয় তাই নিই। একজন প্রেমে পড়েছে, কিন্তু সে অত্যন্ত বেঁটে বলে প্রণয়িনী তাকে গ্রাহ্য করছে না। আমি অ্যাডভাইস দিয়েছি—সকালে দু পায়ে দুখানা ইট বেঁধে দু হাতে গাছের ডাল ধরে আধ ঘণ্টা দোল খাবে, বিকেলে মাঠে মনুমেণ্টের মাথার দিকে তাকিয়ে এক ঘণ্টা ধ্যান করবে, ছ মাসের মধ্যে ছ ইঞ্চি বেড়ে যাবে। আর একটি ছেলে কাশী থেকে পালিয়ে এখানে ফুর্তি করতে এসেছে, টাকা সব ফুরিয়ে গেছে, বাপকে জানাতে লজ্জা হচ্ছে। আমি বলেছি—লিখে দাও, ছেলেধরা ক্লোরোফর্ম করে নিয়ে এসেছে, মিস্টার সরলাক্ষ হোম আমাকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, পত্রপাঠ এক শ টাকা পাঠাবেন। আর এই দেখ বটুক—দা—শ্রীগদাধর ঘোষ চিঠি লিখেছেন, আজ সন্ধ্যা সাতটায় আসবেন।
বটুক বললে, বল কি হে! গদাধর তো মস্ত বড় লোক, তার আবার মুশকিল কি হল? তাকে যদি খুশী করতে পার তো তোমার বরাত ফিরে যাবে।