—বল কি! কোথায় গেল তারা?
—দুজন চাকরি নিয়ে দশটা পাঁচটা আপিস করছে, তাদের ফুরসত নেই। দুটি ছেলে বাপের ধমকে ঠাণ্ডা হয়ে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে। সেই বিনয় ছোকরা মেয়েদের যে গান শেখাত, প্রেমে পড়েছে, তারও কিছুমাত্র ফুরসত নেই। আরও দুজন আপনারই ভাবী বেয়াই মিস্টার রাধাকান্ত বাসু আর মুরুব্বী গিরধারীলাল পাচাড়ীর দালাল হয়ে শিঙে মুখে দিয়ে গর্জন করছে—ভোট দিন, ভোট দিন। সেদিন সন্ধ্যার সময় একটা গুণ্ডা এসে আমাকে শাসিয়ে গেছে।
—খুব মুশকিলে পড়েছ দেখছি। খরচের জন্যে কিছু টাকা নেবে?
—তা দিন, কিন্তু দান নয়, কর্জ। আপনি যদি আমাদের সংঘের সহযোগিতা করতেন তবেই দান নিতে পারতুম। টাকাটা যত শীঘ্র পারি শোধ করে দেব।
—সে তো ভাল কথা, তোমার আত্মসম্মান বজায় থাকবে। কিন্তু দেশব্যাপী দুর্নীতি আর তার পোষক বড় বড় লোকদের সঙ্গে তুমি পেরে উঠবে কি করে? কোনদিন হয়ত গুণ্ডার হাতে প্রাণ হারাবে। আমি বলি কি, তোমার এই হোপলেস ব্রতটা ছেড়ে দাও। ভাল অথচ নিরাপদ সৎকার্য তো অনেক আছে; তারই একটা বেছে নাও—আর্ত—ত্রাণ, রোগীর সেবা, গরিবের ছেলেমেয়ের শিক্ষা, পতিতার উদ্ধার—
—দেখুন মশাই, সব কাজ সকলের জন্যে নয়, আমি নিজের পথ বেছে নিয়েছি, না হয় একলাই চলব। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যারা প্রথমে দাঁড়িয়েছিল তারা কজন ছিল? অন্য নিরাপদ সৎকর্ম বেছে নেয় নি কেন? তারা প্রাণ দিয়েছে, আবার অন্য লোক তাদের স্থান নিয়েছে। আমার এই ব্রত হচ্ছে ধর্মযুদ্ধ, আমিই না হয় প্রথম শহিদ হব। দেখবেন আমার পরে আরও অনেক লোক এই কাজে লাগবে, প্রথমে অল্প, তার পরে দলেদলে, আচ্ছা, চললুম, নমস্কার।
দশদিন পরে সকালবেলা একটি ছেলে এসে বলল, দিনু—দা এই টাকার থলিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। সাড়ে সাত টাকা কম আছে, ওটা আমিই এরপর শোধ করে দেব।
টাকা নিয়ে আমি বললুম, না না, বাকীটা আর শোধ দিতে হবে না। বিনায়কের খবর কি?
—কাল রাত থেকে হাসপাতালে আছেন, বাঁচবার আশা নেই। শেষ রাত্রে আমার সঙ্গে একটু কথা বলেছিলেন, আপনার ধার শোধ দেবার জন্যে। আজ সকাল থেকে আর জ্ঞান নেই। বড্ড টাকার টানাটানি ছিল, প্রায় একমাস ধরে নামমাত্র খেতেন, অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। কাল সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান, সেই সময় রাধাকান্ত বোসের মোটর তাঁকে চাপা দেয়।
হাসপাতালে যখন পৌঁছলুম তখন বিনায়ক মারা গেছে। তার দলের তিনজন উপস্থিত ছিল।
বিনায়ককে যে টাকা দিয়েছিলুম তার সমস্তই সে ফিরিয়ে দিয়েছে, সাড়ে সাত টাকা ছাড়া। আমার সাহায্যের মূল্য সেই সাড়ে সাত। যদি দু—তিন হাজার তাকে দিতুম তাতেই বা সে কি করতে পারত? সে চেয়েছিল আন্তরিক সক্রিয় সাহায্য, তা দেওয়া আমার মতন লোকের পক্ষে অসম্ভব। বিনায়কের মহা ভুল, সে দুষ্কৃতিদের বিনাশ করতে চেয়েছিল, যে কাজ যুগে যুগে অবতারদেরই করবার কথা। পাগলা বিনায়ক, অনধিকার চর্চা করতে গিয়ে প্রদীপ্ত অনলে পতঙ্গের ন্যায় প্রাণ হারিয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের কথা, কিন্তু এরই নাম ভবিতব্য, আমাদের সাধ্য কি যে তার অন্যথা করি। নাঃ, আমাদের আত্মগ্লানির কারণ নেই।
১৮৭৯ শক (১৯৫৭)
সরলাক্ষ হোম
বরুণ বিশ্বাস একজন বড় অফিসার, যদিও বয়স ত্রিশের কম। ছেলেবেলায় মা বাপ মারা যাবার পর তাঁর পিতৃবন্ধু গদাধর ঘোষ তাকে পালন করেন। তিনি খুব ধনী লোক, বিস্তর খরচ করে বরুণকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বরুণ ছেলেটিও ভাল, ছ মাস হল আমেরিকা থেকে গোটাকতক ডিগ্রী নিয়ে ফিরে এসেছে। গদাধরের মেয়ে মাণ্ডবীর সঙ্গে তার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা আছে, তিন মাস পরে বিয়ে হবে।
গদাধর ঘোষ প্রতিপত্তিশালী লোক, মুরুব্বীর জোর খুব আছে। তাঁর চেষ্টায় বরুণ একটা বড় চাকরি পেয়ে গেছে—বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা, অর্থাৎ ডিরেক্টর অভ মংকি ডিপোর্টেশন। এই সরকারি বিভাগটির উদ্দেশ্য মহৎ। এদেশে মানুষ যা খায় বাঁদরও তাই খায়, তার ফলে মানুষের ভাগে কম পড়ে। সরকার স্থির করেছেন দেশের সমস্ত বাঁদর ক্রমে ক্রমে আমেরিকায় চালান দেবেন, সেখানে চিকিৎসা আর শারীরবিদ্যার গবেষণার জন্য মুখপোড়া রূপী মর্কট প্রভৃতি সব রকম শাখা মৃগের চাহিদা আছে। বানরনির্বাসনের ফলে দেশের খাদ্যাভাব কমবে, আমেরিকান ডলারও ঘরে আসবে। কিন্তু শ্রেয়স্কর কর্মে বহু বিঘ্ন। যাঁরা জীবহিংসার বিরোধী তাঁরা প্রবল আপত্তি তুললেন। বিদেশে গিয়ে বাঁদররা প্রাণ বিসর্জন দেবে এ হতেই পারে না। তাঁরা শ্রী হনুমানের আত্মীয়, ভারতীয় রামরাজ্যের প্রজা, মানুষের মতন তাঁদের বাঁচবার অধিকার আছে। ভারতবাসী যেমন গরুকে মাতৃবৎ দেখে তেমনি বাঁদরকে ভ্রাতৃবৎ দেখে। সরকার যদি নিতান্তই বানরনির্বাসন চান তবে এদেশেরই কোনও স্বাস্থ্যকর স্থানে তাদের জন্য উপনিবেশ নির্মাণ করুন, প্রচুর আম কাঁঠাল কলা ইত্যাদির গাছ পুঁতুন, ছোলা মটর বেগুন ফুটি কাঁকুড় ইত্যাদির খেত করুন, তদারকের ভাল ব্যবস্থা করুন। উদবাস্তুদের পুনর্বাসনে যে বেবন্দোবস্ত হয়েছে বাঁদরের বেলা তা হলে চলবে না। এই রকম আন্দোলনের ফলে বানরনির্বাসন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে, বরুণ বিশ্বাসের উপর হুকুম এসেছে এখন শুধু গনতি করে যাও, পরিসংখ্যান তৈরি কর। বরুণের অধীনে বিশ জন পরিদর্শক আছে, তারা জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ায় আর রিপোর্ট পাঠায়—বাঁদর এত, বাঁদরী এত, বাঁদরছানা এত। কলকাতার অফিসে এইসব রিপোর্ট ফাইল করা হয় এবং মোটা মোটা খাতায় তার খতিয়ান ওঠে।