বাধা দিয়ে বললুম, হয়েছে হয়েছে, তোমার বক্তব্য বুঝেছি। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের মতন লোকও তোমার টেস্টে ফেল করবেন। শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ একদম খাঁটী মানুষ পাবে কোথায়? শুকদেব গোস্বামী গৌতম বুদ্ধ আর চৈতন্য মহাপ্রভুর মতন লোক দিয়ে বাজেট তৈরি হবে না, হরিণঘাটার দুধের ব্যবস্থাও হবে না। যারা কাজের লোক তাদের চরিত্রদোষ ধরলে চলে না। মাতাল আর লম্পট যদি অন্য বিষয়ে সাধু হয়, কোটিপতি যদি দাতা হয়, একটু আধটু চোর হলেও কেউ যদি বুদ্ধিমান সুবক্তা জনহিতৈষী হয় তবে তাকে ভোট দিলে অন্যায় হবে না, সচ্চরিত্র বোবা গোবরগণেশ দিয়ে দেশের কোন কাজ চলবে?
তক্তপোষে চাপড় মেরে বিনায়ক বলল, সব কাজ চলবে, সচ্চরিত্র খাঁটী লোক বিধানসভায় ঢুকে নিজের শক্তি দেখাবার সুযোগই এ পর্যন্ত পায় নি। দেশের লোক যদি হুঁশিয়ার হয়, অসাধু ধূর্তদের যদি ভোট না দেয়, তবেই ভালো লোক নির্বাচিত হবে এবং নিজের শক্তি দেখাবার সুযোগ পাবে।
—তোমাদের চলে কি করে? আগে তো তুমি ঘুঘুডাঙ্গা হাইস্কুলের মাস্টার ছিলে, এখনও আছো নাকি?
—সে ইস্কুল থেকে আমাকে তাড়িয়েছে। এখন একটা কোচিং ক্লাশ খুলেছি, এরাও ক’জন তাতে পড়ায়। এই ভূপেশ জিতেন আর শৈলেনের বাপদের অবস্থা ভাল, এদের রোজগারের দরকার নেই। এই বিনয় মেয়েদের গান শেখায়, আর এই সুবল বদরিনাথ চৌধুরীর ফার্মে চাকরি করে।
—বল কি হে! ভেজাল ঘি বিক্রীর জন্যে বদরিনাথ অনেকবার গ্রেপতার হয়েছে, বিস্তর ঘুষ আর তদবিরের জোরে প্রতিবার খালাস পেয়েছে।
—আপনি ঠিক জানেন?
—নিশ্চয়। আরে আমিই তো ওর উকিল ছিলুম।
বিনায়ক বলল, এই সুবল, তুই আজই কাজে ইস্তফা দিবি।
সুবল বলল, তা হলে খাব কি?
—দুদিন না খেলে মরবি না, চেষ্টা করে অন্য কোথাও কাজ জুটিয়ে নিবি।
আমি বললুম, ওহে বিনায়ক, তোমার সংকল্প অতি মহৎ তা তো বুঝলুম। আমাদের কাছে কি চাও বল।
—আপনাদের সব রকম সাহায্য চাই। প্রচারপত্র দিচ্ছি, চেনা লোকদের মধ্যে যত পারবেন বিলি করবেন, সত্যসন্ধ সংঘের উদ্দেশ্যটি সকলকে ভাল করে বুঝিয়ে দেবেন, আর আমাদের খরচের জন্যে যথাসাধ্য দান করবেন।
আমার বন্ধু হরিচরণবাবু বললেন, ভেরি সরি। আমাদের হচ্ছে পুঁটিমাছের প্রাণ, জলে বাস করি, হাঙর কুমির ঘড়েল রাঘব—বোয়াল সকলের সঙ্গেই সদভাব রাখতে হবে।
আর এক বন্ধু কালীচরণ বললেন, ঠিক কথা। নিউট্রাল থাকাই আমাদের পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ পলিসি। কর্তৃত্ব যারাই পাক আমাদের তাতে কি। কংগ্রেসীরা এতদিন বেশ গুছিয়ে নিয়েছে, এখন না হয় অন্য দল কিছু লাভ করুক।
আর এক বন্ধু শিবচরণ বললেন, শুনুন বিনায়কবাবু। আপনারা যা করছেন তার নাম সিডিশন, ব্রিটিশ যুগে একেই বলা হত ওয়েজিং ওআর, রাজদ্রোহ। এখন রাজা একটি নয়, এক পাল রাজা, বিধানসভায় আর লোকসভায় যখন যাঁরা গদি পান তাঁরাই আমাদের রাজা। ভোট যাকে খুশি দেব, তা তো কেউ দেখতে যাচ্ছে না, কিন্তু কোনও দলকেই চটাতে পারব না মশাই।
বিনায়ক প্রশ্ন করল, দাদা কি বলেন?
দাদা অর্থাৎ আমি বললুম, শোন বিনায়ক, এখানে যাঁরা আড্ডা দিচ্ছেন এঁরা সবাই আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, আর তোমরাও সাধুসজ্জন। তোমার মতন আমি পুরোপুরি সত্যসন্ধ নই, তবুও এই বৈঠকে মনের কথা খুলে বলতে আপত্তি নেই। আমরা হচ্ছি সংসারী লোক, দুনিয়ার সঙ্গে রফা করে চলতে হয়। এই দেখ না, শ্রীযুক্ত সুধাবিন্দু নন্দী বিধানসভায় দাঁড়াচ্ছেন। লোকটি যেমন মাতাল তেমনি লম্পট, দুটো খোরপোষের মামলা এখনও ঝুলছে। কিন্তু ইনি আমার একজন বড় মক্কেল। যদি শোনেন যে আমি তোমাদের সাহায্য করছি তবে আমাকে আর কেস দেবেন না। তারপর মিস্টার রাধাকান্ত বাসু, লোকসভার ক্যাণ্ডিডেট। বিখ্যাত চোর আর ঘুষখোর। কিন্তু তাঁর ছেলের সঙ্গে আমার ছোট মেয়ের বিবাহ স্থির হয়েছে। এখন যদি তোমার কথা রাখি তবে অমন ভালো সম্বন্ধটি ভেস্তে যাবে।
বিনায়ক বলল, জেনে শুনে চোর ঘুষখোরের ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেবেন?
—তাতে ক্ষতিটা কি, মেয়ে তো সুখে থাকবে। তা ছাড়া আমার বেয়াই মিস্টার বাসু চোর বলে আমার জামাইও যে চোর হবে এমন কথা সায়েন্সে বলে না, আবার দেখ, আমার বড় ছেলেটা কোনও গতিকে এম. এ. পাস করে বেকার বসে আছে আর কমরেডদের পাল্লায় পড়ে বিগড়ে যাচ্ছে। তার একটা ভাল পোস্টের জন্যে শ্রী গিরধারীলাল পাচাড়ী চেষ্টা করছেন। আমার বিশিষ্ট বন্ধু কিন্তু চুটিয়ে কালোবাজার চালান আর পাকিস্তানে চাল আটা তেল কাপড় পাচার করেন। তুমি কি বলতে চাও তাঁকে চটিয়ে দিয়ে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করব?
বিনায়ক বলল, তবে আপনাদের কাছে কোনও আশা নেই?
—দেখ বিনায়ক, তোমরা যে মহৎ ব্রত নিয়েছ তাতে আমার অন্তত খুব সিমপ্যাথি আছে। তবে বুঝতেই পারছ, আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছি। চাও তো কিছু টাকা দিতে পারি, কিন্তু সেটা যেন প্রকাশ না হয়।
বিনায়ক বলল, থাক, টাকা এখন চাই না। আচ্ছা, আমরা চললুম, নমস্কার।
দু সপ্তাহ পরে বিনায়ক আবার আমার কাছে এলো। আগের মতন বড় দল সঙ্গে নেই, মোটে তিন জন এসেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, খবর কি বিনায়ক, কাজ কেমন চলছে?
বিনায়ক বললে, শাস্ত্রে আছে, শ্রেয়স্কর ব্যাপারে বহু বিঘ্ন, তা অতি ঠিক। আমাদের দলের সাতজন ভেগেছে।