কাত্যায়নী দেরি করলেন না, তাঁর ছেলেদের নিয়ে স্বামীর ভিটেয় ফিরে এলেন। সুকুমারীর ছেলেকে আদর করে কোলে নিয়ে বললেন, এ আমারই ছোট খোকা।
মেনকা আশ্চর্য মেয়ে, মোটেই লোভ নেই। কাত্যায়নী তাঁর ছোট সতিনের জন্য একটা মাসহারার ব্যবস্থা করতে চাইলেন, কিন্তু মেনকা বললে, কিছু দরকার নেই দিদি, আমার মায়ের ওখানে কোনও অভাব নেই। রাহাখরচ পর্যন্ত সে নিলে না। চলে যাবার সময় বললে,দিদি আপনি সধবা মানুষ, কর্তারা খবর পান আর না পান মাছ অবশ্যই খাবেন, নয়ত তাঁর অমঙ্গল হবে। আর আমার একটি অনুরোধ আছে—একটা বুড়ো হুলো বেড়াল রোজ এ বাড়িতে আসে, তাকে একটু দয়া করবেন। ভাতের সঙ্গে কিছু মাছ মেখে খেতে দেবেন, পারেন তো একটু দুধও দেবেন। আহা, বেচারা অথর্ব হয়ে গেছে।
কাত্যায়নী বললেন, তুমি কিচ্ছু ভেবো না বোন, তোমার হুলোকে আমি ঠিক খেতে দেব।
১৩৫৯(১৯৫২)
সত্যসন্ধ বিনায়ক
বিনায়ক সামন্ত হাসপাতালে মারা গেছে। অখ্যাত হলেও সে অসামান্য, মহাত্মা গান্ধীর মতন সে একগুঁয়ে সত্যাগ্রহী ছিল। তফাত এই—গান্ধীজী অবস্থা বুঝে রফা করতে পারতেন, কিন্তু বিনায়কের তেমন বুদ্ধি ছিল না। একজন অর্ধোন্মাদ নিজের খেয়ালে বা অন্যের প্ররোচনায় গান্ধীজীকে মেরেছিল। বিনায়ক মরেছে অসংখ্য লোকের দুর্নীতি আর নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে। তার মৃত্যুর জন্যে হয়তো আমরা সকলেই একটু আধটু দায়ী। আমরা বাধ্য হয়ে অনেক অন্যায় করে থাকি, আরও অনেক অন্যায় সয়ে থাকি তারই পরিণাম বিনায়কের অপমৃত্যু। মরা ভিন্ন তার গত্যন্তর ছিল না, কারণ কাণ্ডজ্ঞানহীন নিষ্পাপ একগুঁয়ে কর্মবীরের জগতে স্থান নেই। কিন্তু পাপাচরণ না করলে এই পাপময় সংসারে জীবনধারণ অসম্ভব এই মোটা কথাটা বিনায়ক বুঝত না।
যারা তাকে চিনত তাদের সকলেরই বিশ্বাস যে বিনায়কের মাথায় বিলক্ষণ গোল ছিল, ঠিক পাগল না হলেও তাকে বাতিকগ্রস্ত বলা যায়। কিন্তু সে যে অত্যন্ত সাধু আর দেশপ্রেমী ছিল তাতে কারও সন্দেহ নেই। অল্প বয়সে সে বিপ্লবীদের দলে যোগ দিয়েছিল, পরে স্বদেশী আর অসহযোগ নিয়ে মেতেছিল। তারপর একে একে কংগ্রেস কমিউনিস্ট প্রজা—সোস্যালিস্ট হিন্দুমহাসভা প্রভৃতি নানা দলে মিশে অবশেষে সে স্থির করেছিল, রাজনীতি অতি জঘন্য কুটিল পন্থা, সব দল ত্যাগ করে শুধু সত্যের শরণ নিতে হবে, প্রিয় বা অপ্রিয় যাই হোক শুধু সত্যেরই ঘোষণা করতে হবে, তার পরিণাম কি দাঁড়াবে ভাববার দরকার নেই। অর্থাৎ সর্বধর্মান পরিত্যজ্য, আর মা ফলেষু কদাচন—গীতার এই দুই মন্ত্রই সে মেনে নিয়েছিল।
বিনায়কের সঙ্গে অনেক কাল দেখা হয়নি, তারপর একদিন সে অদ্ভুত বেশে আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় উপস্থিত হল। পরনে ফিকে বেগুনী রঙের ধুতি—পাঞ্জাবি, কাঁধ থেকে একটা থলি ঝুলছে, তারও রঙ বেগুনী। আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলুম, ব্যাপার কি বিনায়ক, এখন কোন পার্টিতে আছ? বাইরে একটি দঙ্গল দেখছি, ওরা তোমার চেলা নাকি?
বিনায়ক বলল, ওদের ভেতরে আসতে বলব? দশ জন আছে, আপনার এই তক্তপোশে জায়গা না হয় তো মেঝেতেই বসবে।
অনুমতি দিলে বিনায়কের সঙ্গীরা ঘরে এসে কতক তক্তপোশে কতক মেঝেতে বসে পড়ল। তাদের বয়স ষোল থেকে ত্রিশের মধ্যে, সকলেরই বেগনী সাজ আর কাঁধে ঝুলি। চায়ের ফরমাশ দিচ্ছিলুম, কিন্তু বিনায়ক বলল, আমরা নেশা করি না, চা সিগারেট পান কিচ্ছু না।
বললুম, খুব ভাল, এখন আমাদের কৌতূহল নিবৃত্ত কর। নতুন পার্টি বানিয়েছ দেখছি, নাম কি, উদ্দেশ্য কি, সব খোলসা করে বল।
বিনায়ক বলল, আমাদের দলের নাম সত্যসন্ধ সংঘ। উদ্দেশ্য, নির্ভয়ে সত্যের প্রচার। এই ইলেকশনে আমরা লড়ব।
—বল কি হে! তোমাদের পার্টির মেম্বার ক—জন? টাকার জোর আছে? কংগ্রেস কমিউনিস্ট প্রজা—সোস্যালিস্ট হিন্দুমহাসভা এদের সঙ্গে লড়তে চাও কোন সাহসে? তোমাদের ভোট দেবে কে?
পরম ঘৃণায় মুখভঙ্গী করে বিনায়ক বলল, আমরা ইলেকশনে দাঁড়াব না, নিজের জন্যে বা বিশেষ কারও জন্যে ভোটও চাইব না। আমাদের উদ্দেশ্য ভোটারদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া, যাতে তারা ধূর্ত লোকের কথায় ভুলে অপাত্রে ভোট না দেয়।
—খুব সাধু সংকল্প। তোমাদের বেগনী সাজের মানে কি?
—বেগনী হচ্ছে সত্যের প্রতীক।
—এ যে নতুন কথা শোনাচ্ছ। সাদাই তো সত্যের রঙ।
—আজ্ঞে না। সাদা হচ্ছে সব চাইতে ভেজাল রঙ, সমস্ত রঙের খিচুড়ি, ফিজিক্স পড়ে দেখবেন। বুঝিয়ে দিচ্ছি শুনুন। কংগ্রেসের রঙ সাদা, কমিউনিস্টদের লাল, হিন্দুমহাসভার নারঙ্গী বা গেরুয়া। বৌদ্ধ জৈন শ্রমণদের রঙ হলুদে, পাকিস্তানী পীরদের সবুজ, জাহাজী খালাসী আর মোটর মিস্ত্রীদের নীল, এবং মেটে হচ্ছে চাষা আর মজুরের রঙ। বাকী থাকে বেগনী, সবচেয়ে সূক্ষ্ম তরঙ্গের রঙ, তাই আমরা নিয়েছি। আমাদের ম্যানিফেস্টো পড়ছি, মন দিয়ে শুনুন।
—হে দেশের লোক, স্ত্রী পুরুষ যুবা বৃদ্ধ ধনী দরিদ্র শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই, সাবধান সাবধান। যা বলছি আপনাদেরই মঙ্গলের জন্যে, আমাদের কিছুমাত্র স্বার্থ নেই। ইলেকশনে আপনারা অবশ্যই ভোট দেবেন, কিন্তু খবরদার, ফন্দিবাজ লোকের কথায় ভুলবেন না। যারা ভোট চাইবে তাদের সম্বন্ধে ভাল রকম খোঁজ নেবেন, কন্যাদানের পূর্বে ভাবী জামাই সম্বন্ধে যেমন খোঁজ নেন তার চাইতে ঢের বেশী খোঁজ ভোটদানের পূর্বে নেবেন। কারও উপরোধ শুনবেন না, বক্তৃতায় ভুলবেন না, খুব বিচার করে যোগ্যতম পাত্রকে ভোট দেবেন। কংগ্রেস, প্রজাতন্ত্রী, কমিউনিস্ট, হিন্দুমহাসভিস্ট ইত্যাদি হলেই লোকে ভাল হয় না, কোনও দলের মাতব্বর হলেই সে দেশের মঙ্গল করবে এমন কথা বিশ্বাস করবেন না। চোর ঘুষখোর কুচরিত্রকে ভোট দেবেন না, মাতাল গেঁজেল আফিমখোর লম্পট পরনারীসক্তকে ভোট দেবেন না। যারা বলে—রাতারাতি তোমাদের সব দুঃখ দূর করব, বেকার কেউ থাকবে না, সকলেই কাজ পাবে, বাড়ি পাবে, মজুর আর চাষীদের রোজগার ডবল হবে, খাদ্য বস্ত্র সবাই সস্তায় পাবে, ট্যাক্স কমবে,—সেই ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদীকে ভোট দেবেন না। যারা কোটিপতিদের বন্ধু, যাদের ছেলে জামাই ভাইপো কোটিপতিদের অফিসে চাকরি করে, যাদের ইলেকশনের খরচ কোটিপতিরা জোগায়, তারা ভোট চাইতে এলে দূর দূর করে হাঁকিয়ে দেবেন। যাদের প্ররোচনায় ছোট ছোট ছেলেরা ভোটের দালাল হয়ে পথে পথে চিৎকার করে, সেই শিশুমস্তকভক্ষকদের ভোট দেবেন না। যাদের নিজেদের বিচারের শক্তি নেই, বিদেশী প্রভুর হুকুমে ওঠে বসে, বিদেশী প্রভুর কোনও দোষই যারা দেখতে পায় না, সেই কর্তাভজাদের কথায় কান দেবেন না। যারা গরিব শিক্ষকদের জন্যে কুলী মজুরদের চাইতে কম মাইনে বরাদ্দ করে, অথচ হোমরা চোমরা অফিসারদের তিন—চার হাজার দিতে আপত্তি করে না, সেই একচোখা স্নবদের ভোট দেবেন না। বড় বড় কুকর্মের তদন্তের জন্য যারা কমিশন বসায় অথচ তদন্তের ফল চেপে রাখে, দুর্নীতির পোষাক সেই কুটিল লোকদের ভোট দেবেন না। যারা খাদ্যে ভেজাল দেয়, কালোবাজার চালায়, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, বিপন্ন ইসলাম আর বিপন্না গোমাতার দোহাই দেয়—