দুদিন পরে গোকুলবাবু বললেন, ভাগ্যিস এসে পড়েছ মেনকা, তাই দুটো খেতে পাচ্ছি, ছেলেটাও বেঁচে আছে। চমৎকার মেয়ে তুমি। আমি বলি কি, এখানে এসেই যখন আমাদের ভার নিয়েছ তখন পাকা করেই নাও, গিন্নী হয়ে ঘর আলো করে থাক।
মেনী বললে, ইশ, আপনার যে সবুর সইছে না দেখছি। ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, লোকে বলবে কি? দিদির জন্যে শোকটা একটু কমুক, অশৌচ শেষ হক, শ্রাদ্ধ—শান্তি চুকে যাক, তারপর ও কথা বলবেন।
শ্রাদ্ধ চুকে গেল, কিন্তু গোকুলবাবুর স্বস্তি নেই, মেনকার রকম সকম বড় সন্দেহজনক ঠেকছে। চুপ করে থাকতে না পেরে তিনি বললেন, হ্যাঁগা মেনকা, তোমার স্বভাব—চরিত্র তো ভাল মনে হচ্ছে না। আইবুড়ো মেয়ে, বলি তোমার দুধ আসে কি করে? আমি দেখেছি তুমি খোকাকে খাওয়াও। ছেলেপিলে হয়েছে নাকি? স্পষ্ট করে বল বাপু, যতই সুন্দরী হও, নষ্ট মেয়ে আমি বিয়ে করতে পারব না।
মেনী হেসে বললে, লুকিয়ে দেখা হয়েছে বুঝি। ভয় নেই গোসাঁই ঠাকুর, আমার চরিত্রে এতটুকু খুঁত পাবে না, আমি একবারে খাঁটী, যাকে বলে অপাপবিদ্ধা। অত শাস্ত্র পড়েছ পয়স্বিনী কন্যার কথা জান না? আমি হচ্ছি তাই। মাঝে মাঝে দুধ আসে, তিন—চার মাস থাকে, আবার দিনকতক বন্ধ হয়। তোমার ভাগ্য ভাল যে এরকম একটা মেয়ে তোমার ঘরে এসেছে, তাই তোমার আধ—মরা ছেলেটা বেঁচে গেল, নিজের মায়ের দুধ তো ভাল করে খেতেই পায় নি।
গোকুলবাবুর মনের খুঁতখুঁতনি দূর হল না। কিন্তু মেনকার রূপ তাঁকে যাদু করেছে। ভাবলেন, স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি, যা থাকে কপালে, মেনকাকে ছাড়তে পারব না। দু মাস যেতে না যেতেই বিয়ে হয়ে গেল।
গোকুলবাবুর অশান্তি বাড়তে লাগল। মেনকা রোজ রাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে কোথায় যায়? রবিবারেও দুপুরে দু তিন ঘণ্টা তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, হয়তো রোজই বেরিয়ে যায়। গোকুলবাবু স্ত্রৈণ হয়ে পড়েছেন, তৃতীয় পক্ষের রূপসী স্ত্রীকে চটাতে চান না। তবুও একদিন বলে ফেললেন, হ্যাঁগা, তুমি মাঝে মাঝে কোথায় উধাও হও?
মেনকা বললে, সে খোঁজে তোমার দরকার কি, আমি তো জেলখানার কয়েদী নই। তুমি রোজ সন্ধ্যেবেলা কোথায় আড্ডা দিতে যাও আমি কি তা জানতে চাই?
গোকুলবাবু স্থির করলেন, চুপ করে থাকা উচিত নয়, জানতে হবে কার কাছে যায়। তিনি একটা টর্চ কিনে শোবার ঘরে এমন জায়গায় রাখলেন যাতে টের না পায় অথচ তিনি চট করে সেটা হাতে নিতে পারেন। রাত্রে তিনি ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলেন। মেনকা দুপুর রাতে বিছানা থেকে উঠে নিঃশব্দে বাইরে গেল, গোকুলবাবুও খালি পায়ে তার পিছু নিলেন।
উঠন পার হয়ে খিড়কির দরজা খুলে মেনকা বাড়ির পিছন দিকের একটা ছোট চালা ঘরে ঢুকল। সেখানে কাঠ কয়লা আর ঘুঁটে থাকে। মেনকার পরনে সাদা শাড়ি, সেজন্য অন্ধকারেও তাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু চালা ঘরের ভেতরে গিয়ে সে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। টর্চের আলো ফেলে গোকুলবাবু দেখলেন মেনকা নেই, একটা সাদা বেড়াল শুয়ে আছে, চারটে বাচ্চা তার দুধ খাচ্ছে।
চার দিকে আলো ঘুরিয়ে গোকুলবাবু ডাকলেন, মেনকা!
মেনী বললে, কেন? চেঁচিও না, আমার বাচ্চারা ভয় পাবে।
মেনকার রূপান্তর দেখে গোকুলবাবুর মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে গেল, হাত থেকে টর্চ খসে পড়ল। কিন্তু অন্ধকারেও তাঁর দৃষ্টিশক্তি বিশেষ কমল না, তিনি আশ্চর্যও হলেন না, শুধু মর্মাহত হয়ে বললেন, রাধামধব, ব্রাহ্মণের বাড়িতে জারজ সন্তান!
মেনী বললে, আহা কি আমার ব্রাহ্মণ রে! নিজের মুখটা না হয় দেখতে পাচ্ছ না, পিছনে হাত দিয়ে দেখ না একবার।
গোকুলবাবু পিছনে হাত দিয়ে দেখলেন তাঁর একটি প্রমাণ সাইজ ল্যাজ বেরিয়েছে! তাতেও তিনি আশ্চর্য হলেন না, অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, কুলটা মাগী, কতগুলো নাগর আছে তোর?
—অত আমার হিসেব নেই।
—এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে দূর হয়ে যা।
—তুমি আমাকে তাড়াবার কে হে গোসাই? জান না, আমাদের হল মাতৃতন্ত্র সমাজ, যাকে বলে ম্যাট্রিআর্কি। আমাদের সংসারে মদ্দাদের সর্দারি চলে না, তারা একেবারে উটকো, শুধু ক্ষণেকের সাথী।
গোকুলবাবু প্রচণ্ড গর্জন করে মেনীকে কামড়াতে গেলেন। মেনী একলাফে সরে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল—উরর্যাঁও। (মার্জার—ভাষাবিৎ শ্রীদীপংকর বসু মহাশয় বলেন, এই রকম শব্দ করে মার্জার জননী তার দুরস্থ সন্তানদের আহ্বান করে।)
মেনীর রুচির বৈচিত্র্য আছে, সে হরেক রকম পতির ঔরসে হরেক রকম অপত্য লাভ করেছে। তার ডাক শুনে নিমেষের মধ্যে সাদা কালো পাঁশুটে পাটকিলে ডোরা—কাটা প্রভৃতি নানা রঙের বেড়াল ছুটে এসে বললে, কি হয়েছে মা? মেনী বললে, এই বজ্জাত হুলোটাকে দূর করে দে।
মেনীর সাতটা জোয়ান বেটা বাঘের মতন লাফিয়ে হুলোদশাগ্রস্ত গোকুলবাবুকে আক্রমণ করলে। তিনি ক্ষতবিক্ষত হয়ে করুণ রব করে লেংচাতে লেংচাতে পালিয়ে গেলেন।
তিন দিন পরে গোকুলচন্দ্র গোস্বামীর প্রথমা পত্নী কাত্যায়নী দেবী এই চিঠি পেলেন। —পূজনীয় বড়দিদি, আমি আপনার অভাগিনী ছোট বোন, তৃতীয় পক্ষের সতিন মেনকা। কাল রাত্রে গোঁসাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করে বিবাগী হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। যাবার সময় পইতে ছিঁড়ে দিব্যি গেলে বলে গেছেন, আর কদাপি ফিরে আসবেন না, সংসারে তাঁর ঘেন্না ধরে গেছে। তাঁর বিষয়সম্পত্তি দেখা আমার সাধ্য নয়, অতএব আপনি পত্রপাঠ আপনার ছেলেদের নিয়ে এখানে চলে আসুন, নিজের বিষয় দখল করুন। সুকুদিদি একটি ছেলে রেখে গেছেন, এখন তার বয়স ন—দশ হবে। খাসা ছেলে, দেখলেই আপনার মায়া হবে। আমি আর এখানে থাকব না, আপনি এলেই সব ভার আপনাকে দিয়ে আমার মায়ের কাছে চলে যাব। ইতি সেবিকা মেনকা।