তিনকড়ি। আমি এ-এ-আশি টাকা দিতে পারি।
শ্যাম। তথাস্তু। বড়ই লোকসান হ’ল, কিন্তু সকলই মায়ের ইচ্ছা।
গণ্ডেরি। বাহ্বা তিনকৌড়িবাবু বহুত কিফায়ত হুয়া!
তিনকড়িবাবু, পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিয়া সদ্যঃপ্রান্ত পেনশনের টাকা হইতে আটখানা আনকোরা দশ টাকার নোট সন্তর্পণে গনিয়া দিলেন। শ্যামবাবু পকেটস্থ করিয়া বলিলেন-‘তবে এখন আমি আসি। বাড়িতে সত্যনারায়ণের পজা আছে। আপনিই কোম্পানির ভার নিলেন এই কথা স্থির। শুভমস্তু–মা-দশভূজা আপনার মঙ্গল করুন।’
শ্যামবাবু প্রস্থান করিলে তিনকড়িবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—লোকটা দোষে গুণে মানুষ। এদিকে যদিও হাম্বগ, কিন্তু মেজাজটা দিলদরিয়া। কোম্পানির ঝক্কিটা তো এখন আমার ঘাড়ে পড়ল। কমাস বাতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলাম, কিছুই দেখতে পারি নি, নইলে কি কোম্পানির অবস্থা এমন হয়? যা হোক উঠে-পড়ে লাগতে হল—আমি লেফাফা-দুরস্ত কাজ চাই, আমার কাছে কারও চালাকি চলবে না।’
গন্ডেরি। অপনের কুছু তকলিফ করতে হোবে না। কোম্পানি তো ডুব গিয়া। অপ্কোভি ছুটি।
তিনকড়ি। তা হলে কি বলতে চাও আমার মাসহারাটা–
গণ্ডেরি। হাঃ হাঃ, তুমভি রপয়া লেওগে? কাঁহাসে মিলবে বাতলাও। তিনকৌড়ি বাবু শ্যামবাবুকা কারবারই নহি সমঝা? নব্বে হাজার রূপয়া কম্পনিকা দেনা। দো রোজ বাদ লিকুইডেশন। লিকুইডের সিকিণ্ড কল আদায় করবে, তব দেনা শুধবে।
তিনকড়ি। অ্যা, বল কি? আমি আর এক পয়সাও দিচ্ছি না।
গণ্ডেলি। আলবত দিবেন। গরমিণ্ট কান পকড়্কে আদায় করবে। আইন এইসি হ্যায়।
তিনকড়ি। আরও টাকা যাবে। সে কত?
অটল। আপনার একলার নয়। প্রত্যেক অংশীদারকেই শেয়ার পিছু ফের দু-টাকা দিতে হবে। আপনার পুর্বের ২০০ শেয়ার ছিল, আর শ্যামদার ১৬০০ আজ নিয়েছেন। এই ১৮০০ শেয়ারের ওপর আপনাকে ছত্রিশ শ টাকা দিতে হবে। দেনা শোধ, লিকুইডেশনের খরচা-সমত চকে গেলে শেষে সামান্য কিছু ফেরত পেতে পারেন।
তিনকড়ি। তোমাদের কত গেল?
গণ্ডেরি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ সঞ্চালন করিয়া বলিলেন—কুছভি নহি, কুছভি নহি। আরে হামাদের ঝড়তি-পড়তি শেয়ার তো সব শ্যামবাবু লিয়েছিল—আজ আপনেকে বিক্কিরি কিয়েছে।
তিনকড়ি। চোর—চোর চোর। আমি এখনি বিলেতে কোণ্ডহাম সাহেবকে চিঠি লিখছি–
অটল। তবে আমরা এখন উঠি। আমাদের তো আর শেয়ার নেই, কাজেই আমরা এখন ডিরেক্টর নই। আপনি কাজ করুন। চল গণ্ডেরি।
তিনকড়ি। অ্যাঁ
গণ্ডেরি। রাম রাম!
ভারতবর্ষ, মাঘ ১৩২৯ (১৯২২)
ষষ্ঠীর কৃপা
ষষ্ঠীপূজোর পর সুকুমারী তার ছেলেকে পিঁড়ির ওপর রেখে স্বামীকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিলে। সুকুমারীর বয়স চব্বিশ, তার স্বামী গোকুল গোস্বামীর চুয়ান্ন।
গোকুলবাবু বললেন, ইঃ, কি চমৎকার দেখাচ্ছে তোমাকে সুকু, যেন উর্বশী স্নান করে সমুদ্র থেকে উঠে এলেন!
সুকুমারী হাত জোড় করে বললে, তোমার পায়ে পড়ি এইবার আমাকে রেহাই দাও। সাত বৎসর তোমার কাছে এসেছি, তার মধ্যে ছটি সন্তান প্রসব করেছি। পাঁচটি গেছে, একটি এখনও বেঁচে আছে। আমি আর পারি না, শরীর ভেঙে গেছে। আবার যদি পোয়াতী হই তো মরব, এই খোকাও মরবে।
গোকুলবাবু সহাস্যে বললেন, বালাই, মরবে কেন। সন্তান জন্মায়, বাঁচে, মরে, সবই ভগবানের ইচ্ছা অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মফল। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার ফল ভোগ শেষ হয়েছে, ফাঁড়া কেটে গেছে, এখন আর কোনও ভয় নেই।
গোকুলচন্দ্র গোস্বামী শেওড়াগাছির সবরেজিস্ট্রার। খুব আরামের চাকরি, কাজ কম, তাঁর বসতবাড়ির কাছেই কাছারি। গোকুলবাবু পণ্ডিত লোক, অনেক শাস্ত্র জানেন, বাংলা ইংরেজী নভেলও বিস্তর পড়েছেন। অবস্থা ভাল, দেবত্র সম্পত্তি আছে, বেনামে তেজারতিও করেন। সাত বৎসর পূর্বে ইনি হিমালয়ের সমস্ত তীর্থ পর্যটনের পর মানস সরোবর আর কৈলাস দর্শন করেছিলেন। ফিরে এসে ঘোষণা করলেন যে তাঁর জন্মান্তর হয়েছে, আগেকার স্ত্রী পুত্র কন্যার সঙ্গে সম্বন্ধ রাখা চলবে না, নতুন সংসার পাতবেন। তার কোনও বাধা হল না, অত্যন্ত গরিবের মেয়ে অনাথা সুকুমারী তাঁর ঘরে এল। প্রথম স্ত্রী কাত্যায়নী তিন ছেলে নিয়ে কলকাতায় তাঁর ভাইএর বাড়িতে গিয়ে রইলেন। স্বামীর কাছ থেকে কিছু মাসহারা পান, তা ছাড়া কোনও সম্বন্ধ নেই। দুই মেয়ের বিয়ে আগেই হয়ে গিয়েছিল, তারা শ্বশুরবাড়িতে থাকে।
স্বামীর প্রবোধবাক্য শুনে সুকুমারী বললে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমাকে ভুলিও না। কাগজে পড়েছি জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় বেরিয়েছে, দিল্লীর মন্ত্রীরাও তা ভাল মনে করেন। তুমি এত খবর রাখ, এটা জান না? কলকাতায় গিয়ে মন্ত্রীদের কাছ থেকে শিখে এস।
গোকুলবাবু বললেন, তারা ছাই জানে।
—তবে বড় মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করো, তিনি তো শুনেছি ডাক্তার।
—পাগল হয়েছ নাকি সুকু? ছি ছি ছি, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশের কুলবধুর মুখে এই কথা! অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী, একটুখানি লেখাপড়া শিখে খবরের কাগজ পড়ে এইসব পাপচিন্তা তোমার মাথায় ঢুকেছে। কৃত্রিম উপায়ে জন্মরোধ করা একটা মহাপাপ তা জান? প্রজাবৃদ্ধির জন্যই ভগবান স্ত্রী—পুরুষ সৃষ্টি করেছেন; গর্ভধারণ হচ্ছে স্ত্রীজাতির বিধিনির্দিষ্ট কর্তব্য। ভগবানের এই বিধানের ওপর হাত চালাতে চাও?
—শুনেছি আজকাল ঘরে ঘরে চলছে, তাই প্রাণের দায়ে বলছি। আমি মুখখু মানুষ, কিছুই জানি না, ন্যায়—অন্যায়ও বুঝি না, কিন্তু ভগবানের ওপর হাত না চালায় কে? ভগবান লেংটা করে পাঠিয়েছিলেন, কাপড় পরছ কেন? দাড়ি কামাও কেন? দাঁত বাঁধিয়েছ কেন?