তিনকড়ি। আর একটি অনুরোধ। আমার বাড়িতে একটি পুরনো কাঁসর আছে—একটু ফেটে গেছে, কিন্তু আদত খাঁটী কাঁসা। এ জিনিসটা মন্দিরের কাজে লাগানো যায় না? সস্তায় দেব।
শ্যাম। নিশ্চয়ই নেব। ওসব সেকেলে জিনিস কি এখন সহজে মেলে?
… … … …
গণ্ডেরির ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইয়াছে। বিজ্ঞাপনের জোরে এবং প্রতিষ্ঠাতৃগণের চেষ্টায় সমস্ত শেয়ারই বিলি হইয়া গিয়াছে। লেকে শেয়ার লইবার জন্য অস্থির, বাজারে চড়া দামে বেচা-কেনা হইতেছে।
অটলবাবু বলিলেন–আর কেন শ্যাম-দা, এইবার নিজের শেয়ার সব কেড়ে নেওয়া যাক। গণ্ডেরি তো খুব একচোট মারলে। আজকে ডবল দর। দুদিন পরে কেউ ছোঁবেও না।’
শ্যাম। বেচতে হয় কে, মোলা কিছু তো হাতে রাখতেই হবে, নইলে ডিরেক্টর হবে কি করে?
অটল। ডিরেক্টরি আপনি করুন গে। আমি আয় হালায় থাকতে চাইনে। সিদ্ধেশ্বরীর কৃপায় আমার তো কার্যসিদ্ধি হয়েছে।
শ্যাম। এই তো সবে আরম্ভ। মন্দি্র, ঘরদোর, হাট-বাজার সবই তো বাকি। তোমাকে কি এখন ছাড়া যায়?
অটল। থেকে আমার লাভ? পেটে খেলে পিঠে সয়। এখন তো ব্রাদার-ইন কোম্পানির মরসুম চলল। আমাদের এইখানে শেষ।
শ্যাম। আরে ব্যস্ত হও কেন, এক যাত্রায় কি পৃথক ফল হয়? সন্ধ্যেবেলা বাবু এখন তোমাদের বাড়িতে,-গণ্ডেলিকেও নিয়ে যাব।
… … … …
দেড় বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। ব্রহ্মচারী অ্যাণ্ড ব্রাদার-ইন-ল কোম্পানীর আপিসে ডিরেক্টরগণের সভা বসিয়াছে। সভাপতি তিনকড়িবাবু, টেবিলে ঘুষি মারিয়া বলিতেছিলেন–আ-আ-আমি জানতে চাই, টাকা সব গেল কোথা। আমার তো বাড়িতেই টেকা ভার — সবাই এসে তাড়া দিচ্ছে। কয়লাওয়ালা বলে তার পঁচিশ হাজার টাকা পাওনা, ইটখোলার ঠিকাদার বলে বারো হাজার, তার পর ছাপাখানাওলা, শার্পার কোম্পানী, কুণ্ডু, মুখুজ্যে, আরও কত কে আছে। বলে আদালতে যাব। মন্দিরের কোথা কি তার ঠিক নেই—এর মধ্যে দু-লাখ টাকা ফুঁকে গেল? সে ভণ্ড জোচ্চোরটা গেল কোথা? শুনতে পাই ডুব মেরে আছে, আপিসে বড় একটা আসে না।’
অটল। ব্রহ্মচারী বলেন, মা তাঁকে অন্য কাজে ডাকছেন–এদিকে আর তেমন মন নেই। আজ তো মিটিংএ আসবেন বলেছেন।
বিপিন বলিলেন—ব্যস্ত হচ্ছেন কেন সার, এই তো ফর্দ রয়েছে, দেখুন না–জমি কেনা, শেয়ারের দালালি, preliminary expense, ইট-তৈরী, establishment, বিজ্ঞাপন, আপিস-খরচ–
তিনকড়ি। চোপ রও ছোকরা। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা।
এমন সময় শ্যামবাবু, আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন—ব্যাপার কি?
তিনকড়ি। ব্যাপার আমার মাথা। আমি হিসেব চাই।
শ্যাম। বেশ তো, দেখুন না হিসেব। বরঞ্চ একদিন গোবিন্দপুরে নিজে গিয়ে কাজকর্ম তদারক করে আসুন।
তিনকড়ি। হ্যাঁ, আমি এই বাতের শরীর নিয়ে তোমার ধাধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে মরি আর কি। সে হবে না—আমার টাকা ফেরত দাও। কোম্পানিতে যেতে বসেছে। শেয়ার হোল্ডাররা মারমার কাটকাট করছে।
শ্যামবাবু কপালে যুক্তকর ঠেকাইয়া বলিলেন—’সকলই জগন্মাতার ইচ্ছা। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। এতদিন তো মন্দির শেষ হওয়ারই কথা। কতকগুলো অতপর কারণে খরচ বেশী হয়ে গিয়ে টাকার অনটন হয়ে পড়ল, তাতে আমাদের আর অপরাধ কি? কিন্তু চিন্তার কোনও কারণ নেই, ক্রমশ সব ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা call-এর টাকা তুললেই সমস্ত দেনা শোধ হয়ে যাবে, কাজও এগোবে।’
গণ্ডেলি বলিলেন-‘আউর টাকা কোই দিবে না, আপকো থোড়াই বিশোআস করবে।’
শ্যাম। বিশ্বাস না করে, নাচার। আমি দায়মুক্ত, মা যেমন করে পারেন নিজের কাজ চালিয়ে নিন। আমাকে বাবা বিশ্বনাথ কাশীতে টানছেন, সেখানেই আশ্রয় নেব।
তিনকড়ি। তবে বলতে চাও, কোম্পানি ডুবল?
গণ্ডেরি। বিশ হাঁথ পানি।
শ্যাম। আচ্ছা তিনকড়িবাবু আমাদের ওপর যখন লোকের এতই অবিশ্বাস, বেশ তো, আমরা না হয় ম্যানেজিং এজেন্সি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার নাম আছে, সম আছে, লোকেও শ্ৰদ্ধা করে, আপনিই ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে কোম্পানি চালান না?
অটল। এইবার পাকা কথা বলেছেন।
তিনকড়ি। হ্যাঁঃ, আমি বদনামের বোঝা ঘাড়ে নিই, আর ঘরের খেয়ে বুনো মোষ তাড়াই।
শ্যাম। বেগার খাটবেন কেন? আমিই এই মিটিংএ প্রস্তাব করছি যে রায়সাহেব শ্ৰীযুক্ত তিনকড়ি ব্যানার্জি মহাশয়কে মাসিক ১০০০ টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে কোম্পানি চালাবার ভার অর্পণ করা হোক। এমন উপযুক্ত কর্মদক্ষ লোক আর কোথা? আর, আমরা যদি ভুলচুক করেই থাকি, তার দায়ী তো আর আপনি হবেন না।
তিনকড়ি। তা—তা—আমি চট করে কথা দিতে পারিনে। ভেবে-চিন্তে দেব।
অটল। আর দ্বিধা করবেন না রায়সাহেব। আপনিই এখন ভরসা।
শ্যাম। যদি অভয় দেন তো আর একটি নিবেদন করি। আমি বেশ বুঝেছি, অর্থ হচ্ছে সাধনের অন্তরায়। আমার সমস্ত সম্পত্তিই বিলিয়ে দিয়েছি, কেবল এই কোম্পানির ষোল শ খানেক শেয়ার আমার হাতে আছে। তাও সৎপাত্রে অর্পণ করতে চাই। আপনিই সেটা নিয়ে নিন। প্রিমিয়ম চাই না-আপনি কেনা-দাম ৩২০০ টাকা মাত্র দিন।
তিনকড়ি। হ্যাঁঃ, ভাল করে আমার ঘাড় ভাঙবার মতলব।
শ্যাম। ছি ছি। আপনার ভালই হবে। না হয় কিছু কম দিন, চব্বিশ শ—দু-হাজার—হাজার–
তিনকড়ি। এক কড়াও নয়।
শ্যাম। দেখুন, ব্রাহ্মণ হতে ব্রাহ্মণের দান-প্রতিগ্রহ নিষেধ, নইলে আপনার মত লোককে আমার অমনিই দেবার কথা। আপনি যৎকিঞ্চিৎ মূল্য ধ’রে দিন! ধরন—পাঁচ শ টাকা। ট্রান্সফার ফর্ম আমার প্রস্তুতই আছেনিয়ে এস তো বিপিন।