তিনকড়িবাবু তামাক-টানার অন্তরালে বলিতেছিলেন-দেখুন মজা, হিসেবই হল ব্যবসার সব। ডেবিট ক্রেডিট যদি ঠিক থাকে, আর ব্যালান্স যদি মেলে, তবে সে বিজনেসের কোনও ভয় নেই।
শ্যামবাবু। আজ্ঞে, বড় যথার্থ কথা বলেছেন। সেইজন্যেই তো আমরা আপনাকে চাই। আপনাকে আমরা মধ্যে মধ্যে এসে বিরক্ত করব, হিসেব সম্বন্ধে পরামর্শ নেব–
তিনকড়ি। বিলক্ষণ, বিরক্ত হব কেন। আমি সমস্ত হিসেব ঠিক করে দেব। মিটিংগুলো একটু ঘন ঘন করবেন। না হয় ডিরেক্টরস্ ফী বাবদ কিছু বেশী খরচ হবে। দেখুন, অডিটার-ফডিটার আমি বুঝি না। আরে বাপ, নিজের জমাখরচ যদি নিজে না বুঝলি তবে বাইয়ের একটা অর্বাচীন ছোকরা এসে তার কি বুঝবে? ভার। আজকাল সব কিপিং শিখেছেন! সে কি জানেন—একটা গোলকধাঁধা, কৈউ যাতে না থোক তারই চেষ্টা। আমি বুঝি রোজ কত টাকা এল, কত খরচ হ’লআর আমার মজদ রইল কত। আমি যখন আমড়াগাছি সবডিভিজনের ট্রেজারির চার্জে, তখন এক নতুন কলেজ-পা গোঁফকামানো ডেপুটি এলেন আমার কাছে কাজ শিখতে। সে ছোকরা কিছুই বোঝে না, অথচ অহংকারে ওরা। আমার কাজে গলদ ধরবার আস্পর্ধা। শেষে লিখলম কোল্ডহাম সাহেবকে, যে হয়, তোমরা রাজার জাত, দুম্বা দাও তাও সহ্য হয়, কিন্তু দেশী ব্যাঙাচির লাখি বরদাশত করব না। তখন সাহেব নিজে এসে সমস্ত বুঝে নিয়ে আড়ালে ছোকরাকে ধমকালেন। আমাকে পিঠ চাপড়ে হেসে বললেন—ওয়েল তিনকড়িবাবু, তুমি হলে কতকালের সিনিয়র অফিসর, একজন ইয়ং চ্যাপ তোমার কদর কি বুঝবে? তার পর দিলেন আমাকে নওগাঁয়ে গাঁজা-গোলার চাজে বদলি করে। যাক সে কথা। দেখুন, আমি বড় কড়া লোক। জবরদস্ত হাকিম বলে। আমার নাম ছিল। মন্দির টন্দির আমি বুঝি না, কিন্তু একটি আধলাও কেউ আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। রক্ত জল করা টাকা আপনার জিম্মায় দিচ্ছি, দেখবেন যেন–
শ্যাম। সে কি কথা! আপনার টাকা আপনারই থাকবে আর শতগুণ বাড়বে। এই দেখুন —আমি আমার যথাসর্বস্ব পৈতৃক পঞ্চাশ হাজার টাকা এতে ফেলেছি। আমি না হয় সর্ব ত্যাগী সন্ন্যাসী, অর্থে প্রয়োজন নেই, লাভ যা হবে মায়ের সেবাতেই ব্যয় করব। বিপিন আর এই অটল ভায়াও প্রত্যেকে পঞ্চাশ হাজার ফেলেছেন। গণ্ডের এক লাখ টাকার শেয়ার নিয়েছে। সে মহা হিসেবী লোক-লাভ নিশ্চিত না জানলে কি নিত?
তিনকড়ি। বটে, বটে? শুনে আশ্বাস হচ্ছে। আচ্ছা, একবার কোল্ডহাম সাহেবকে কনসট করলে হয় না? অমন সাহেব আঃ হয় না।
ঠাঁই হয়েছে—চাকর আসিয়া খবর দিল।
উঠতে আজ্ঞা হক ব্রহ্মচারী মশায়, আসন অটলবাবু চল হে বিপিন। তিনকড়িবাবু সকলকে অন্দরের বারান্দায় আনিলেন।
শ্যামবাবু বলিলেন-‘করেছেন কি রায়সাহেব, এ যে রাজসূয় যজ্ঞ। কই আপনি বসলেন না!
তিনকড়ি। বাতে ভুগছি, ভাত খাইনে দুখানা সুজির রুটি বরাদ্দ।
শ্যাম। আমি একটি ফেৎকারিণী-তন্ত্রোক্ত কবচ পাঠিয়ে দেব, ধারণ করে দেখবেন। শাক ভাজা, কড়াইয়ের ডাল—এটা কি দিয়েছ ঠাকুর, এঁচোড়ের ঘণ্ট? বেশ, বেশ? শোধন করে নিতে হবে। সুপক্ক কদলী আর গব্যঘৃত বাড়িতে হবে কি? আয়ুর্বেদে আছে-পনসে কদলং কদলে ঘৃতম। কদলীভক্ষণে পনসের দোষ নষ্ট হয়, আবার ঘৃতের দ্বারা কদলীর শৈত্যগুণ দূর হয়। পুঁটিমাছ ভাজা-বাঃ। রোহিতাদপি বোচকাঃ পুণ্টিকাঃ সদ্যভর্জিতাঃ। ওটা কিসের অম্বল বললে-কামরাঙা? সর্বনাশ, তুলে নিয়ে যাও। গত বৎসর শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে ঐ ফলটি জগন্নাথ প্রভুকে দান করেছি। অম্বল জিনিসটা আমার সয়ও না—শ্লেম্মার ধাত কি না। উস্প্, উস্প্, উস্প্। প্রাণায় আপনার সোপানায় স্বাহা। শয়নে পদ্মনাভনঞ্চ ভোজনে তু দিন। আর কর হে অটল।
অটল। (জনান্তিকে) আরম্ভের ব্যবস্থা যা দেখছি তাতে বাড়ি গিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হবে।
তিনকড়ি। আচ্ছা ঠাকুরমশায়, আপনাদের তন্ত্রশাস্ত্রে এমন কোন প্রক্রিয়া নেই যার দ্বারা লোকের—ইয়ে–মানমর্যাদা বা পেতে পারে?
শ্যাম। অবশ্য আছে। যখ কুলার্ণবে-অমানিনা মানদেন। অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হলে অমানী ব্যক্তিকেও মান দেন। কেন বলুন তো?
তিনকড়ি। হাঃ হাঃ, সে একটা তার কথা। কি জানেন, কোল্ডহাম সাহেব বলেছিলেন, বিধা পেলেই লাট সাহেবকে ধরে আমায় বড় খেতাব দেওয়াবেন। বার বার তো রিমাইন্ড করা ভাল দেখায় না তাই ভাবছিলুম যদি তন্ত্রে-মন্ত্রে কিছু হয়, মানিনে যদিও, তবুও–
শ্যাম। মনতেই হবে। শাস্ত্র মিথ্যা হতে পারে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন, এ বিষয়ে আমার সমস্ত সাধনা নিয়োজিত করব। তবে সগগুরু প্রয়োজন, দীক্ষা ভিন্ন এসব কাজ হয় না। গুরুও আবার যে সে হলে চলবে না। খরচ–তা আমি যথা সম্ভব অল্পেই নির্বাহ করতে পারব।
তিনকড়ি। হুঁ। দেখা যাবে এখন। আচ্ছা, আপনাদের আপিসে তো বিস্তর লোকজন দরকার হবে, তা–আমার একটি শালীপো আছে, তার একটা হিল্লে লাগিয়ে দিতে পারেন না? বেকার বসে বসে আমার অন্ন ধ্বংস করছে, লেখাপড়া শিখলে না, কুসঙ্গে মিশে বিগড়ে গেছে। একটা চাকরি জুটলে বড় ভাল হয়। ছোকরা বেশ চটপটে আর স্বভাব-চরিত্রও বড় ভাল।
শ্যাম। আপনার শালীপো? কিছু বলতে হবে না। আমি তাকে মন্দিরের হেড-পাণ্ডা করে দেব। এখনি গোটা-পনর দরখাস্ত এসেছে-তার মধ্যে পাঁচজন গ্রাজুয়েট। তা আপনার আত্মীয়ের ক্লেম সবার ওপর।