অটল। বুঝলেন শ্যাম-দা? আমরা সকলে যেন ম্যানেজিং এজেণ্টদের কাছ থেকে কর্জ করে নিজের নিজের শেয়ারের টাকা কোম্পানিকে দিচ্ছি। আবার কোম্পানি ঐ টাকা ম্যানেজিং এজেণ্টসদের কাছে গচ্ছিত রাখছে। গাট থেকে এক পয়সাও কেউ দিচ্ছেন না, টাকাটা কেবল খাতাপত্রে জমা থাকবে।
শ্যাম। তার পর তাল সামলাবে কে? কোম্পানি ফেল হলে আমি মারা যাই আর কি! বাকী কলের টাকা দেব কোথা থেকে?
গণ্ডেরি। ডরেন কেনো? শেয়ার পিছ তো অভি দো টাকা দিতে হবে। ঢাই লাখ টাকার শেয়ারে সির্ফ পচাস হজার দেনা হোয়। প্রিমিয়াম মে সব বেচে দিক-সুবিস্তা হোয় তো আউর ভি শেয়ার ধরে রাখবো। বহুত মুনাফা মিলবে। চিম্ড়িমল ব্রোকারসে হামি বন্দোবস্ত কিয়েছি। দো চার দফে হম লোগ আপনা আপনি শেয়ার লেকে খেলবো, হাঁথ বদলাবে, দাম চড়বে, বাজার গরম হোবে। তখন সব কোই শেয়ার মাংবে, দাম কা বিচার করবে না। কবীরজী কি বচন শুনিয়ে–
ঐসী গতি সন্সারমে যে গাড়ির কি ঠাট
এক পড়া যব গাঢ়মে সবৈ যাত তেহি বাট।।
মানি হচ্ছে-সন্সারের লোক সব যেন ভেড়ার পাল। এক ভেড়া যদি খান্দেমে গির পড়ে
তো সব কোই উসিমে ঘুসে।
শ্যামবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন—’তার ব্রহ্মময়ী, তুমিই জান। আমি তো নিমিত্ত মাত্র। তোমার কাজ তুমিই উদ্ধার করে দাও মা-অধম সন্তানকে যেন মেরো না।’
গণ্ডেরি। শ্যামবাবু মন্দিল-উন্দিলকা কোম্পানি যো করনা হ্যায় কিজিয়ে। উসকি সাথ ঘই-এর কারবার ভি লাগায় দিন। টাকায় টাকা লাভ।
অটল। ঘই কি চিজ?
গণ্ডেরি। ঘই জানেন না? ঘিউ হচ্ছে আসলি চিজ যো গায় ভইস বকড়িকা দুধসে বনে। আউর নকলি যো হ্যায় মোঘই কহলাতা। চর্বি, চীনা-বাদাম তল ওগায়রহ্ মিলা কর্ বনায় যাতা। পর্ সাল হামি ঘই-এর কামে পঁচিশ হজার লাগাই, সাড়ে চৌবিশ হজার মুনাফা মিলে।
অটল। উ বিস্তর সাপ মেরেছিলেন বলুন!
গণ্ডেরি। আরে সাঁপ কাঁহাসে মিলবে? উ সব ঝট বাত।
অটল। আচ্ছা গণ্ডারজী—
গন্ডেরি। গণ্ডার নেহি, গণ্ডেরি।
অটল। হাঁ, হাঁ, গণ্ডেরিজী। বেগ ইওর পার্ডন। আচ্ছা, আপনি তো নিরামিষ খান, ফোঁটা কাটেন, ভজন-পূজনও করেন।
গণ্ডেরি। কেনো করবো না? হামি হর্ রোজ গীতা আউর রামচরিতমানস পঢ়ি, রামভজন ভি করি।
অটল। তবে অমন পাপের ব্যবসাটা করলেন কি বলে?
গণ্ডেরি। পাঁপড়? হামার কেনো পাঁপ হোবে? বেবসা তো করে কাসেম আলি। হামি রহি কলকাত্তা, ঘই বনে হাথরসমে। হামিন আঁখসে দেখি, ন নাকসে শুংখি-হলমানজী কিরিয়া। আমি তো সির্ফ মহাজন আছি–রূপয়া দে কর্ খালাস। সুদ লি, মনোফার আধা হিসসা ভি লি। যদি হামি টাকা না দি, কাসেম আলি দুসরা ধনীসে লিবে। পাঁপ হোবে তো শালা কাসেম আলিকা হোবে। হমার কি? যদি ফিন কুছ দোষ লাগে–জানে রন্ছোড়জী–হমায় পুন্ছি থোড়া-বহুত জমা আছে। একাদশী, শিউরাত, রামনওমীমে উপবাস, দান-খয়রাত ভি কুছু করি। আট আটঠো ধরমশালা বানোআয়া–লিলুয়ামে, বালিমে, শেওড়াফুলিমে–
অটল। লিলুয়ার ধর্মশালা তো আশরফিলাল ঠুনঠুনওয়ালা করেছে।
গণ্ডেরি। কিয়েছে তো কি হইয়েছে? সভি তো ওহি কিয়েছে। লোকন বানিয়ে দিয়েছে কোন্? তদারক কোন্ কিয়েছে? ঠিকাদার কোন্ লাগিয়েছে? সব হামি। আশরাফ হমার চাচেরা ভাই লাগে। আমি সলাহ দিয়েছি তব না রপয়া খরচ কিয়েছে!
অটল। মন্দ নয়, টাকা ঢাললে আশরাফ, পূণ্য হ’ল গণ্ডেরির।
গণ্ডেরি। কেনো হোবে না? দো দো লাখ রূপেয়া হর্ জগেমে খরচ্ দিয়া। জোড়িয়ে তো কেতনা হোয়। উস পর কমসে কম স’য়কড়া পাঁচ রপয়া তুমি তো হিসাব কিজিয়ে। হাম তত বিলকুল ছোড় দিয়া। আশরফিলালকা পুন, যদি সোলহ, সখিকা হোয়, মেরা ভি অসসি ইজার মোতাবেক হোনা চাহ্তা!
অটল। চমৎকার বাবস্থা! পণ্যেরও দেখছি দালালি পাওয়া যায়। আমাদের শ্যাম-দা গণ্ডেরি-দা যেন মানিকজোড়।
গণ্ডেরি। অটলবাবু আপনি দো চার অংরেজী কিতাব পঢ়িয়ে হামাকে ধরম কি শিখবেন? বঙ্গালী ধরম জানে না। তিস রূপেয়ার নোকরি করবে, পাঁচ পইসার হরিলুঠ দিবে। হামার জাত রূপয়া ভি কামায় হিসাবসে, পুন, ভি করে হিসাবসে। আপনেদের রবীন্দরনাথ কি লিখছেন–
বৈরাগ সাধন মুক্তি সো হমার নহি।
হামি এখন চলছি, রেস খেলনে। কোন্ট্রি গেরিল ঘোড়ে পর আজ দো-চারশও লাগিয়ে দিব।
অটল। আমিও উঠি শ্যাম-দা। আর্টিকেলের মুসাবিদা রেখে যাচ্ছি, দেখে রাখবেন। প্রসপেক্টস তো দিব্বি হয়েছে। একটু-আধটু বদলে দেব এখন। পরশু আবার দেখা হবে। নমস্কার।
বাগবাজারে গলির ভিতর রায়সাহেব তিনকড়িবাবুর বাড়ি। নীচের তলায় রাস্তার সম্মুখে নাতিবৃহৎ বৈঠকখানা-ঘরে গৃহকর্তা এবং নিমন্ত্রিতগণ গল্পে নিরত, অন্দর হইতে কখন ভোজনের ডাক আসিবে তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছেন। আজ রবিবার, তাড়া নাই, বেলা অনেক হইয়াছে।
তিনকড়িবাবুর বয়স ষাট বৎসর, ক্ষীণ দেহ, দাড়ি কামানো। শীর্ণ গোঁফে তামাকের ধোঁয়ায় পাকা খেজুরের রং ধরিয়াছে-কথা কহিবার সময় আরসোলার দাড়ার মত নড়ে। তিনি দৈব ব্যাপারে বড় একটা বিশ্বাস করেন না। প্রথম পরিচয়ে শ্যামবাবুকে বুজরুক সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, কেবল লাভের আশায় কম্পানিতে যোগ দিয়াছেন। কিন্তু আজ কালীঘাট হইতে প্রত্যাগত সদ্যঃস্নাত শ্যামবাবুর অভিনব মূর্তি দেখিয়া কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হইয়াছেন। শ্যামবাবুর পরিধানে লাল চেলী, গেরুয়া রঙের আলোয়ান, পায়ে বাঘের চামড়ার শিং-তোলা জুতা। দাড়ি এবং চুল সাজিমাটি দ্বারা যথাসম্ভব ফাঁপানো, এবং কপালে মস্ত একটি সিন্দূরের ফোঁটা।