—পরীক্ষা করে দেখেছিলেন?
—দেখেছিলুম বইকি। আমার বয়স যখন চব্বিশ তখন আমার মেজকাকী তাঁর এক দূর সম্পর্কের বোনঝির সঙ্গে আমার সম্বন্ধ করলেন, আমাদের সমাজে কোর্টশিপের চলন তখনও হয় নি, অভিভাবকরাই সম্বন্ধ স্থির করতেন। আমার বাপ—মা তখন গত হয়েছেন, কাকাদের সঙ্গেই থাকতুম। আমি মেজকাকীকে বললুম বিয়েতে মত দেবার আগে তোমার বোনঝিকে আমার মনের কথা জানাতে চাই। কাকী বললেন, বেশ তো, যত খুশি জানিও, আমি না হয় আড়ালে থাকব। তার পর একদিন মেয়েটিকে আনা হল। আমি তাকে একটি লেকচার দিলুম।—শোন উজ্জ্বলা, আমি স্পষ্টবক্তা লোক, আমার কথায় কিছু মনে ক’রো না যেন। তুমি দেখতে ভালই, ম্যাট্রিক পাশ করেছ, শুনেছি গান বাজনা আর গৃহকর্মও জান। ওতেই আমি তুষ্ট। তুমিও আমাকে বিয়ে করলে ঠকবে না, একটি সুশ্রী বলিষ্ঠ বিদ্বান ধনবান আর অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্বামী পাবে আমার নতুন বাড়ির সর্বেসর্বা গিন্নী হবে, বিস্তর টাকা খরচ করতে পারবে। কিন্তু তোমাকে কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে হবে। দু—এক গাছা চুড়ি ছাড়া গহনা পরতে পাবে না, শৃঙ্গী নখী আর দন্তী প্রাণীর মতন সালংকরা স্ত্রীও ডেঞ্জারস। নিমন্ত্রণে গিয়ে যদি নিজের ঐশ্বর্য জাহির করতে চাও তো ব্যাঙ্কের একটা সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে যেতে পার। সাজগোজেও অন্য মেয়ের নকল করবে না, আমি যেমন বলব সেইরকম সাজবে। আর শোন—ছবি টাঙিয়ে দেওয়াল নোংরা করবে না, নতুন নতুন জিনিস আর গল্পের বই কিনে বাড়ির জঞ্জাল বাড়াবে না, গ্রামোফোন আর রেডিও রাখবে না। ইলিশ মাছ কাঁকড়া পেঁয়াজ পেয়ারা আম কাঁঠাল ত্যাগ করতে হবে, ওসবের গন্ধ আমার সয় না। পান খাবে না, রক্তদন্তী স্ত্রী আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না। সাবান যত খুশি মাখবে, কিন্তু এসেন্স পাউডার নয়, ওসব হল ফিনাইল জাতীয় জিনিস দুর্গন্ধ চাপা দেবার অসাধু উপায়। এই রকম আরও অনেক বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে তাকে বললুম, তুমি বেশ করে ভেবে দেখ, তোমার বাপ—মার সঙ্গে পরামর্শ কর, যদি আমার শর্ত মানতে পার তবে চার—পাঁচ দিনের মধ্যে খবর দিও। কিন্তু এক হপ্তা হয়ে গেল, তবু কোনও খবর এল না।
—বলেন কি!
—অবশেষে আমিই মেজকাকীকে জিজ্ঞাসা করলুম, ব্যাপার কি? তিনি পাত্রীর বাড়িতে তাগাদা পাঠালেন। তারপর আমি একটা পোস্টকার্ড পেলুম। পাত্রীর দাদা ইংরিজীতে লিখেছে—গো টু হেল।
—কন্যাপক্ষ দেখছি অত্যন্ত বোকা, আপনার মত বরের মূল্য বুঝল না।
—হাঁ, বেশীর ভাগই ওই রকম বোকা, তবে গোটাকতক চালাক কন্যাপক্ষও জুটেছিল। তাদের মতলব, ভাঁওতা দিয়ে আমার ঘাড়ে মেয়ে চাপিয়ে দেওয়া। তখন একটা নতুন শর্ত জুড়ে দিলুম—ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তবে তখনই তাকে বিদেয় করব। খোরপোষ দেব, কিন্তু আমার সম্পত্তি সে পাবে না। এই কথা শুনে সব ভেগে পড়ল। জ্ঞাতিশত্রুরাও রটাতে লাগল যে আমি একটা উন্মাদ। কিন্তু একটি মেয়ে সত্যই রাজী হয়েছিল। অত্যন্ত গরিবের মেয়ে, দেখতেও তেমন ভাল নয়। আমার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনে তখনই বললে যে, সে রাজী। আমি বললুম, অত তাড়াতাড়ি নয়, তোমার বাপ—মায়ের মত নিয়ে জানিও। পরদিন খবর এল বাপ—মাও খুব রাজী। আমার সন্দেহ হল। খোঁজ নিয়ে জানলুম, রূপ আর টাকার অভাবে তার পাত্র জুটছে না। বাপ—মা অত্যন্ত সেকেলে, মেয়েকে কেবল অভিশাপ দেয়। এখন সে শরৎ চাটুজ্যের অরক্ষণীয়ার মতন মরিয়া হয়ে উঠেছে, নির্বিচারে যার—তার কাছে নিজেকে বলি দিতে প্রস্তুত। মেয়ের বাপের সঙ্গে দেখা করে আমি বললুম, আপনার মেয়ে শুধু আপনাকে কন্যাদায় থেকে উদ্ধার করবার জন্যই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, আমার শর্তগুলো মোটেই বিচার করে দেখে নি। এমন বিয়ে হতে পারে না। এই নিন পাঁচ হাজার টাকা, আমি যৌতুক দিলুম, মেয়েকে আপনাদের পছন্দ মত ঘরে বিয়ে দিন। বাপ খুব কৃতজ্ঞ হয়ে বললে, আপনিই খুকীর যথার্থ পিতা, আমি জন্মদাতা মাত্র। মেয়েটি ভাল ঘরেই পড়েছিল, বিয়ের পর বরের সঙ্গে আমাকে প্রণাম করতে এসেছিল।
আমি বললুম, আপনি মহাপ্রাণ দয়ালু ব্যক্তি।
—তা মাঝে মাঝে দয়ালু হতে হয়, টাকা থাকলে দান করায় বাহাদুরি কিছু নেই। তার পর শুনুন। আমার বয়স বেড়ে চলল, পঁয়ত্রিশ পার হয়ে বুঝলুম আমার আদর্শের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে এমন কৃচ্ছ্রসাধিকা নারী কেউ নেই। তখন আমার একটা মানসিক বিপ্লব হল, যাকে বলে রিভলশন। এক নম্বর দাম্পত্য যখন হবার নয়, তখন দু নম্বরের চেষ্টা করলে দোষ কি? আমার অনেক আত্মীয় তো স্ত্রীর বশে বেশ সুখে আছে। স্ত্রৈণতাও সংসারযাত্রার একটি মার্গ। জগতে কর্তাভজা বিস্তর আছে, তারা বিচারের ভার কর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। যা করেন গুরুমহারাজ, যা করেন পণ্ডিতজী, যা করেন কমরেড স্তালিন আর মাও—সে—তুং। তেমনি গিন্নীভজাও অনেক আছে। তারা বলে, আমার মতামতের দরকার কি, যা করেন গিন্নী।
—কিন্তু আপনার স্বভাব যে অন্য রকম আপনার পক্ষে গিন্নীভজা হওয়া অসম্ভব।
—অবস্থাগতিকে বা সাধনার ফলে অসম্ভবও সম্ভব হয়। একটি সার সত্য আপনাকে বলছি শুনুন। যে নারী রাজার রানী হয়, বড়লোকের স্ত্রী হয়, নামজাদা গুণী লোকের গৃহিণী হয়, সে নিজেকে মহাভাগ্যবতী মনে করে, অনেক সময় অহংকারে তার মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু রানীকে বা টাকাওয়ালী মেয়েকে যে বিয়ে করে, কিংবা যার স্ত্রী মস্ত বড় দেশনেত্রী লেখিকা গায়িকা বা নটী, এমন পুরুষ প্রথম প্রথম সংকুচিত হয়ে থাকে। সে স্বনামধন্য নয়, স্ত্রীর নামেই তার পরিচয়, লোকে তাকে একটু অবজ্ঞা করে। কিন্তু কালক্রমে তার সয়ে যায়, ক্ষোভ দূর হয়, সে খাঁটি স্ত্রৈণ হয়ে পড়ে। এর দৃষ্টান্ত জগতে অনেক আছে।