রাম রাম বাবু সাহেব,
আগন্তুক মধ্যবয়স্ক, শ্যামবর্ণ, পরিধানে সাদা ধুতি, লম্বা কাল বনাতের কোট, পায়ে বার্নিশ করা জুতা, মাথায় হলদে রঙের ভাঁজ-করা মলমলের পাগড়ি, হাতে অনেকগুলি আংটি, কানে পামার মাকড়, কপালে ফোঁটা।
শ্যামবাবু বলিলেন—’আসুন, আসুন-ওরে বাছা, আর একটা চেয়ার দে। এই ইনি হচ্ছেন অটলবাবু আমাদের সলিসিটর দত্ত কোম্পানির পার্টনার। আর ইনি হলেন আমার বিশেষ বন্ধু বাবু গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়া।
গণ্ডেরি। নোমেস্কার, আপনের নাম শুনা আছে, জান-পহচান হয়ে বড় খুশ হ’ল।
অটল। নমস্কার, এই আপনার জন্যই আমরা বসে আছি। আপনার মত লোক যখন আমাদের সহায়, তখন কোম্পানির আর ভাবনা কি?
গণ্ডেরি। হেঁ হেঁ, সোকোলি ভগবানের হিঞ্ছা। হামি একেলা কি করতে পারি? কুছু না।
শ্যাম। ঠিক, ঠিক। যা করেন মা তারা দীনতারিণী। দেখ অটল, গণ্ডেরিবাবু যে কেবল পাকা ব্যবসাদার তা মনে করো না। ইংরেজী ভাল না জানলেও ইনি বেশ শিক্ষিত লোক, আর শাস্ত্রেও বেশ দখল আছে।
অটল। বাঃ আপনার মত লোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বড় সুখী হলুম। আচ্ছা মশায়, আপনি এমন সুন্দর বাংলা বলতে শিখলেন কি করে?
গণ্ডেরি। বহুত বাগালীর সঙে হামি মিলা মিশা করি। বাংলা কিতাব ভি অন্হেক পঢ়েছি। বকিমচন্দ্, রবীন্দরনাথ, আউর ভি সব।,
এমন সময় বিপিনবাবু আসিয়া পৌঁছিলেন। ইনি একটু সাহেবী মেজাজের লোক, এককালে বিলাত যাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পরিধানে সাদা প্যান্ট, কাল কোট, লাল নেকটাই, হাতে সবুজ ফেল্ট হ্যাট। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ক্ষীণকায়, গোঁফের দুই প্রান্ত কামাননা। শ্যামবাবু উদগ্রীব হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—’কি হল?’
বিপিন। ডিরেক্টর হবেন বলেছেন, কিন্তু মাত্র দু-হাজার টাকার শেয়ার নেবেন। তোমাকে অটলকে আমাকে পরশু সকালে ভাত খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন। এই নাও চিঠি।
অটল। তিনকড়িবাবু হঠাৎ এত সদয় যে?
শ্যাম। বুঝলাম না। বোধ হয় ফেলে ডিরেক্টরদের একবার বাজিয়ে যাচাই করে নিতে চান।
অটল। যাক, এবার কাজ আরম্ভ করুন। আমি মেমোরান্ডম আর আর্টিকল্সের মুসাবিদা এনেছি। শ্যাম-দা, প্রসপেক্টসটা কি রকম লিখলেন পড়ুন।
শ্যাম। হাঁ, সকলে মন দিয়ে শোন। কিছু বদলাতে হয় তো এই বেলা। দুর্গা—দুর্গ,–
জয় সিদ্ধিদাতা গণেশ
১৯১৩ সালের ৭ আইন অনুসারে রেজিস্ট্রিত
শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড
মূলধন—দশ লক্ষ টাকা, ১০, হিসাবে ১০০,০০০ অংশে বিভক্ত। আবেদনের সঙ্গে অংশ-পিছ, ২, প্রদেয়। বাকী টাকা চার কিস্তিতে তিন মাসের নোটিসে প্রয়োজন-মত দিতে হইবে।
অনুষ্ঠানপত্র
ধর্মই হিন্দুগণের প্রাণস্বরূপ। ধর্মকে বাদ দিয়া এ জাতির কোনও কর্ম সম্পন্ন হয় না। অনেকে বলেন–ধর্মের ফল পরলোকে লভ্য। ইহা আংশিক সত্য মাত্র। বস্তুত ধৰ্মবৃত্তির উপযুক্ত প্রয়োগে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয়বিধ উপকার হইতে পারে। এতদর্থে সদ্য সদ্য চতুর্বর্গ লাভের উপায়স্বরূপ এই বিরাট ব্যাপারে দেশবাসীকে আহ্বান করা হইতেছে।
ভারতবর্ষের বিখ্যাত দেবমন্দিরগুলির কিরূপ বিপুল আয় তাহা সাধারণে জ্ঞাত নহেন। রিপোর্ট হইতে জানা গিয়াছে যে বঙ্গদেশের একটি দেবমন্দিরের দৈনিক যাত্রিসংখ্যা গড়ে ১৫ হাজার। যদি লোক-পিছু চার আনা মাত্র আয় ধরা যায়, তাহা হইলে বাৎসরিক আয় প্রায় সাড়ে তের লক্ষ টাকা দাঁড়ায়। খরচ যতই হউক যথেষ্ট টাকা উদবৃত্ত থাকে। কিন্তু সাধারণে এই লাভের অংশ হইতে বঞ্চিত।
দেশের এই বৃহৎ অভাব দূরীকরণার্থে ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ নামে একটি জয়েন্টস্টক কোম্পানি স্থাপিত হইতেছে। ধর্মপ্রাণ শেয়ারহোল্ডারগণের অর্থে একটি মহান, তীর্থ ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হইবে, জাগ্রত দেবী সমন্বিত সবহৎ মন্দির নির্মিত হইবে। উপযুক্ত ম্যানেজিং এজেন্টের হস্তে কার্য-নির্বাহের ভার ন্যস্ত হইয়াছে। কোনও প্রকার অপব্যয়ের সম্ভাবনা নাই। শেয়ারহোল্ডারগণ আশাতীত দক্ষিণা বা ডিভিডেণ্ড পাইবে এবং একাধারে ধর্ম অর্থ মোক্ষ লাভ করিয়া ধন্য হইবেন।
ডিরেক্টরগণ।-(১) অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ বিচক্ষণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায়সায়েব শ্রীযুক্ত তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। (২) বিখ্যাত ব্যবসাদার ও ক্রোরপতি শ্ৰীযুত গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়া। (৩) সলিসিটস দত্ত অ্যাণ্ড কোম্পানির অংশীদার শ্ৰীযুত অটলবিহারী দত্ত, M. A., B. L. (৪) বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মিস্টার বি. সি. চৌধুরী, B. Sc., A. S. S (U.S.A.) (৫) কালীপদাশ্রিত সাধক ব্রহ্মচারী শ্রীমৎ শ্যামানন্দ (ex-officio)।
অটলবাবু বাধা দিয়া বলিলেন—’বিপিন আবার নতুন টাইটেল পেল কবে?’
শ্যাম। আর বল কেন। পঞ্চাশ টাকা খরচ করে আমেরিকা না কামস্কাটকা কোথা থেকে তিনটে হরফ আনিয়েছে।
বিপিন। বা, আমার কোয়ালিফিকেশন না জেনেই বুঝি তারা শুধু শুধু একটা ডিগ্রী দিলে? ডিরেক্টর হতে গেলে একটা পদবী থাকা ভাল নয়?
গণ্ডেরি। ঠিক বাত। ভেক বিনা ভিখ মিলে না। শ্যামবাবু আপনিও এখন্সে ধোতি উতি ছেড়ে লঙোটি পিনহুন।
শাম। আমি তো আর নাগা সন্ন্যাসী নই। আমি হলুম শমিত্রের সাধক, পরিধেয়। হ’ল রাবর। বাড়িতে তো গৈরিকই ধারণ করি। তবে আপিসে প’রে আসি না, কারণ, ব্যাটারা সব হাঁ করে চেয়ে থাকে। আর একটু লোকের চোখ-সহা হয়ে গেলে সর্বদাই গৈরিক পরব। যাক, পড়ি শোন–