ভরদ্বাজ। কেন, পুলিশ আর মিলিটারি কি করতে আছে?
মাস্টার। জনসাধারণ যদি সাহায্য না করে তবে তারাও হাল ছেড়ে দেবে।
চৌধুরী সাহেব প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন, হবে না, হবে না, আপনারা যে সব উপায় বলছেন তাতে কিছুই হবে না। আপনাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রে গোড়া থেকেই ঘূণ ধরেছে। গাছে না উঠতেই এক কাঁদি—কেন রে বাপু? জমিদার উচ্ছেদ করবার কি দরকার ছিল? তারাই তো দেশের স্তম্ভস্বরূপ, চিরকাল গভর্নমেণ্টকে সাহায্য করে এসেছে। নুনের শুল্ক আর মদ বন্ধ না করলে কি চলত না? ভাবুন দেখি, কতটা রাজস্ব খামকা নষ্ট করা হয়েছে! কিষাণ—মজদুরের উপর তো দরদের সীমা নেই, অথচ পেনশনভোগীদের কথা কারও মনে আসে না। তাদের কি সংসার খরচ বাড়েনি? রাজা মহারাজ সার রায়বাহাদূর প্রভৃতি খেতাব তুলে দিয়ে কি লাভ হল? এসব থাকলে বিনা খরচে সরকারের সহায়কদের খুশী করা যেত। রাজভক্ত প্রজাদের বঞ্চিত করা হয়েছে, অথচ মন্ত্রীরা তো দিব্যি ডি এস—সি, এল—এল ডি খেতাব নিচ্ছেন! আরে তোদের বিদ্যে কতটুকু? দেশনেতারা সবাই মন্ত্রী হতে চান। তাঁরা কেবল ভাবছেন কিসে ভোট বজায় থাকবে আর প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোষ বোস সেনদের জব্দ করা যাবে। আমি বলছি আপনাদের এই গভর্নমেণ্ট কিছুই করতে পারবে না, দেশশাসন এদের কাজ নয়।
মাস্টার। চৌধুরী সাহেব, আপনিও কমিউনিস্ট শাসন চান নাকি?
চৌধুরী। টু হেল উইথ কমিউনিস্ট কংগ্রেস হিন্দুসভা অ্যান্ড সোশ্যালিস্ট!
মাস্টার। তবে বলুন কি চান?
চৌধুরী। শুনবেন? উঁহু, শেষকালে আমার পেনশনটি বন্ধ না হয়। কোথায় গোয়েন্দা আছে তা তো বলা যায় না।
ভরদ্বাজ। চৌধুরী সাহেব, আমরা আপনার পুরানো বন্ধু, আমাদের বিশ্বাস করেন না?
চৌধুরী আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন দেখে আমি বললাম, আমি অতি নিরীহ লোক আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন।
চৌধুরী সাহেব কিছুক্ষণ আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। ভরসা পেয়ে বললেন, সুশাসনের একমাত্র উপায় বলছি শুনুন—রাজেন্দ্রজী পণ্ডিতজী আর সর্দারজী বিলেত চলে যান। সেখানে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে বলুন, প্রভু, ঢের হয়েছে, আমাদের শখ মিটে গেছে, আর স্বাধীনতায় কাজ নেই, আপনারা আবার এসে দেশ শাসন করুন। দু—শ বৎসর এখানে রাজত্ব করেছিলেন, আরও দু—শ বৎসর করুন, পিতার ন্যায় আমাদের জ্ঞানশিক্ষা দিন। তারপর যদি আমাদের লায়েক মনে করেন তবে নিজের দেশে ফিরে আসবেন।
মাস্টার। রোমানরা যখন ব্রিটেন থেকে চলে যাচ্ছিল তখন সেখানকার লোকেও এইরকম প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু তাতে ফল হয়নি, বর্বর জার্মানদের আক্রমণ থেকে নিজের দেশ রক্ষার জন্যই রোমানদের চলে যেতে হয়েছিল। এদেশের কোনও নেতা ইংরেজকে ফিরে আসতে বলবেন না, বললেও ইংরেজ আর আসতে পারবে না।
চৌধুরী সাহেব ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, তবে রইল আপনাদের ভারত, এদেশে আমি থাকব না, বিলেতেই বাস করব।
জিরাফের মতন গলা বাড়িয়ে ভজহরিবাবু মৃদুস্বরে বললেন, সার, আপনার আইভি রোডের বাড়িটা? বেচেন তো বলুন ভাল খদ্দের আমার হাতে আছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে দেখে আমি উঠে পড়লাম। ভরদ্বাজবাবু আমাকে বললেন, কই মশায়, আপনি তো কিছুই বললেন না!
আমি হাত জোড় করে উত্তর দিলাম, মাপ করবেন, কানে তালা লেগে আছে, গলা ভেঙে গেছে! এখন যেতে হবে রণজিৎ ভটচাজ ডাক্তারের কাছে। বসুন আপনারা নমস্কার।
১৩৫৬ (১৯৪৯)
শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড
মাঘ মাস ১৩২৬ সাল। এই মাত্র আরমানী গির্জার ঘড়িতে বেলা এগারটা বাজিয়াছে। শ্যামবাবু চামড়ার ব্যাগ হাতে ঝুলাইয়া জুডাস লেনের একটি তেতলা বাড়িতে প্রবেশ করিলেন। বাড়িটি বহু, পুরাতন, ক্রমাগত চুন ও রঙের প্রলেপে লোলচর্ম কলপিরকেশ বৃদ্ধের দশা প্রাপ্ত হইয়াছে। নীচের তলায় অন্ধকারময় মালের গুদাম। উপরতলায় সম্মুখভাগে অনেকগুলি ব্যবসায়ীর আপিস, পশ্চাতে বিভিন্ন জাতীয় কয়েকটি পরিবার পৃথক পৃথক অংশে বাস করেন। প্রবেশদ্বারের সম্মুখেই তেতলা পর্যন্ত বিস্তৃত কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশের দেওয়াল আগাগোড়া তাম্বলরাগচর্চিত–যদিও নিষেধের নোটিশ লম্বিত আছে। কতিপয় নেংটে ইন্দুর ও অরসোলা পরস্পর অহিংসভাবে স্বচ্ছন্দে ইতস্তত বিচরণ করিতেছে। ইহারা আশ্রমমগের ন্যায় নিঃশক, সিঁড়ির যাত্রিগণকে গ্রাহ্য করে না। অতরাল বতী সিথী-পরিবারের রান্নাঘর হইতে নির্গত হিঙের তীব্র গন্ধের সহিত নরদমার গন্ধ মিলিত হইয়া সমস্ত খান আমোদিত করিয়াছে। আপিস-সমূহের মালিকগণ তুচ্ছ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকিয়া কেনা-বেচা তেজি-মন্দি আদায়-উসুল ইত্যাদি মহৎ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হইয়া দিন যাপন করিতেছেন।
শ্যামবাবু তেতলায় উঠিয়া একটি ঘরের তালা খুলিলেন। ঘরের দরজার পাশে কালকে লেখা আছে-ব্রহ্মচারী অ্যাণ্ড ব্রাদার-ইন-ল, জেনার্ল মার্চেন্টস। এই কারবারের স্বত্বাধিকারী বয়ং শ্যামবাবু (শ্যামলাল গাগলী) এবং তাঁহার শ্যালক বিপিন চৌধুরী, বি. এস-সি। ঘরে কয়েকটি পুরাতন টেবিল, চেয়ার, আলমারি, প্রভৃতি আপিস-সরঞ্জাম। টেবিলের উপর নানাপ্রকার খাতা, বিতরণের জন্য ছাপানো বিজ্ঞাপনের স্তূপ, একটি পুরাতন থ্যাকার্স ডিরেক্টরি, একখণ্ড ইন্ডিয়ান কম্পানিজ অ্যাক্ট, কয়েকটি বিভিন্ন কম্পানির নিয়মাবলী বা articles, এবং অন্যবিধ কাগজপত্র। দেওয়ালে সংলগ্ন তাকের উপর কতকগুলি ধলিংসের কাগজমোড়া শিশি এবং শূন্যগর্ভ মাদুলি। এককালে শ্যামবাবু, পেটেন্ট ও বাদ্য ঔষধের কারবার করিতেন, এগুলি তাহারই নিদর্শন।