ভজহরি। কংগ্রেসে হিংস্র লোক নেই?
মাস্টার। তা বলতে পারি না। দলের নীতি বা ক্রীড যাই হোক সকলেই তা অন্তরের সঙ্গে মানে না। সব দলেই এমন লোক আছে যাদের নীতি–মারি অরি পারি যে কৌশলে। অগস্ট বিপ্লবে অনেক কংগ্রেসী হিংস্র কাজ করেছিল। এখনও কংগ্রেসের মধ্যে এমন লোক আছে যারা প্রতিপক্ষকে যে—কোনও উপায়ে জব্দ করতে প্রস্তুত।
ভজহরি। কিন্তু কংগ্রেসের ওপর মহাত্মার প্রভাব এখনও রয়েছে। তারা যতই অন্যায় করুক কমিউনিস্টদের মতন বোমা ছোড়ে না।
মাস্টার। হিংস্র কমিউনিস্টদের তুলনায় হিংস্র কংগ্রেসী অনেক কম আছে তা মানি, কিন্তু সব কংগ্রেসী মনে প্রাণে অহিংস নয়, সব কমিউনিস্টও হিংস্র নয়। বিলাতে লাস্কি হালডেন বার্নাল প্রভৃতি মনীষীরা কমিউনিস্ট, কিন্তু তাঁরা অসৎ বা হিংস্র প্রকৃতির লোক নন, রাশিয়ার অন্ধ ভক্তও নন। এদেশেও যোশী—প্রমুখ কয়েকজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা হিংসার বিরোধী বলে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
চৌধুরী। মাস্টার মশায়, আপনার মতলবটা কি খোলসা করে বলুন তো। বোধ হচ্ছে আপনি কমিউনিস্ট দলের ভক্ত।
মাস্টার। কোনও দলেরই ভক্ত নই, মানুষকেই ভক্তি করি। কোন মানুষের সব কাজেরও সমর্থন করি না। দলের লেবেল দেখে বিচার করব কেন, মানুষ কেমন তাই দেখব। কমিউনিস্টদের কথাই ধরুন। অনেক লোক আছে যারা মার্কস প্রভৃতির মতে অল্পাধিক বিশ্বাস করে, সেজন্য নিজেদের কমিউনিস্ট বলে। এদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের বেশী প্রভেদ নেই। আবার অনেক কমিউনিস্ট গুপ্ত সমিতির সদস্য, তারা স্বদেশী যুগের সন্ত্রাসকদের মতন লুকিয়ে কাজ করে এবং দলের নেতাদের আদেশে চলে। এদের অনেকে রাশিয়ার তাঁবেদার বা অন্ধ ভক্ত। যেমন কংগ্রেসের মধ্যে তেমন কমিউনিস্ট দলের মধ্যে স্বার্থসর্বস্ব লোক আছে। অনেক কংগ্রেসী যেমন মন্ত্রীত্বকেই পরম কাম্য মনে করে, সেই রকম অনেক কমিউনিস্ট আশা করে যে ডিকটেটরী রাষ্ট্র স্থাপিত হলে সে একটা কেষ্টবিষ্টুর পদ পাবে। আবার অনেকে, বিশেষত ছেলেমেয়ে, শখের জন্যই কমিউনিস্ট নাম নেয়। এরা কিছুই বোঝে না, শুধু কতকগুলি মুখস্থ বুলি আওড়ায়। আবার এক দল বিশেষ কিছু না বুঝলেও তাদের নেতাদের আদেশে নানা রকম হিংস্র কর্ম করে এবং ভাবে যে দেশের মঙ্গলের জন্যই করছি। এমন দুর্বৃত্তও আছে যাদের কোনও রাজনীতিক মত নেই, কিন্তু সুবিধা পেলেই শুধু নষ্টামির জন্য ট্রাম বাস পোড়ায়, বোমাও ফেলে। ভর্তৃহরি বলছেন, ‘তে বৈ মানুষরাক্ষসাঃ পরহিতং স্বার্থায় নিঘ্নান্তি যে, যে তু ঘ্নান্তি নিরর্থকং পরহিতং তে কে ন না জানীমহে’—যারা স্বার্থের জন্য পরের ইষ্টনাশ করে তারা নররাক্ষস, কিন্তু যারা অনর্থক পরের অহিত করে তারা কি তা জানি না।
ভরদ্বাজ। মাস্টার, তোমার কথায় এই বুঝলুম যে অনেক লোক দেশের ভাল করছি ভেবেই হিংস্র কর্ম করে, যেমন স্বদেশী যুগের সন্ত্রাসকরা করত; অনেকে হুজুক বা বজ্জাতির জন্য করে, অনেকে স্বার্থসিদ্ধির জন্যই করে। কিন্তু দেশের জনসাধারণ হিংস্রতার বিরোধী, তারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, শুধু চায় অন্ন বস্ত্র স্বাচ্ছন্দ্য শান্তি আর সুশাসন। তোমাদের পলিটিক্সে তা হবে না। এই ধর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে প্রজাতন্ত্র সমাজতন্ত্র সমভোগতন্ত্র সমস্তই অচল ও অনাবশ্যক। দিল্লীতে যে ভারতশাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে তাতে কিছুই হবে না।
মাস্টার। কি রকম শাসনতন্ত্র চান আপনিই বলুন।
ভরদ্বাজ। ধর্মরাজ্য চাই। প্রথমেই রাজার আশ্রয় নিতে হবে। প্রত্যেক প্রদেশে একজন উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা থাকবেন, তাঁদের সকলের ওপরে একজন সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী সম্রাট থাকবেন। প্রদেশে ও কেন্দ্রে কেবল বিদ্বান সদব্রাহ্মণরা মন্ত্রী হবেন, তাঁরাই আইন করবেন রাজ্য চালাবেন। প্রজাদের কোনও সভা থাকবে না, রাম শ্যাম যদুর খেয়াল অনুসারে রাজ্য চলতে পারে না, তাতে কেবল ঝগড়া হবে। রাজারা সনাতন বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করবেন, মাঝে মাঝে যজ্ঞ করে প্রজাদের ধর্মকর্মে উৎসাহ দেবেন। মন্দিরে মন্দিরে দেবতার পূজা হবে, শঙ্খ ঘণ্টা বাজবে, ধূপের ধূম উঠবে। রাষ্ট্রের লাঞ্ছনা হবে গরু, বাঘ—সিংগি চলবে না। জাতীয় সংগীত হবে মোহমুদগর। ফাঁসি উঠে যাবে, পাপীদের শূলে দেওয়া হবে। অনাচারী নাস্তিক আর বিধর্মীরা রাজকার্য করবে না, তারা নগরের বাইরে বাস করবে।
মাস্টার। চমৎকার, যেন সত্যযুগের স্বপ্ন। আপনার এই ধর্মরাজ্যের সঙ্গে হিটলার— মুসোলিনির রাষ্ট্রের কিছু কিছু মিল আছে। শরিয়তী রাজ্য এবং গোঁড়া রোমান ক্যাথলিকদের আদর্শ খ্রীস্টীয় রাজ্যও অনেকটা এই রকম। কিন্তু পৃথিবীতে বহু কোটি সনাতনী থাকলেও আপনার আদর্শ ধর্মরাজ্য বা শরিয়তী—খিলাফতী রাজ্য বা হোলি রোমান এম্পায়ার আর হবার নয়।
ভরদ্বাজ। আচ্ছা বাপু, তুমিই বল কোন উপায়ে দেশে শান্তি আর সুশাসনের প্রতিষ্ঠা হবে।
মাস্টার। এমন উপায় জানি না যাতে রাতারাতি আমাদের দুঃখ ঘুচবে। মুষ্টিমেয় বিপ্লবী আর গুণ্ডা ছাড়া দেশের সকলে শান্তি আর শৃঙ্খলা চায় তা ঠিক, কিন্তু এই মুষ্টিমেয় লোক উদযোগী বেপরোয়া, জনসাধারণ অলস নিরুদ্যম কাপুরুষ। একটা দশ বছরের ছেলে ট্রামে উঠে যদি বলে—নেমে যান আপনারা, গাড়ি পোড়ানো হবে—অমনি ভেড়ার পালের মতন যাত্রীরা সুড়সুড় করে নেমে যাবে। অত প্রাণের মায়া করলে প্রাণরক্ষা হয় না। জড়পিণ্ড হয়ে শান্তি আর সুশাসন চাইলে তা মেলে না, শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলেও মেলে না, চেষ্টা করে অর্জন করতে হয়। বিপ্লবীদের যেমন দল আছে শান্তিকামী লোকেও যদি সেই রকম আত্মরক্ষা আর দুষ্টদমনের জন্য দল তৈরি করে তবেই দেশে শান্তি আসবে। তা না হলে মুষ্টিমেয় লোকেরই আধিপত্য হবে।