জিব দিয়ে একটা নৈরাশ্যের শব্দ করে ভজহরিবাবু বললেন, দিন দিন কি হচ্ছে বলুন তো! যা রোজগার করি তাতে খেতেই কুলায় না, ট্রামে বাসে দাঁড়াবার জায়গা নেই, আবার নতুন উপদ্রব জুটেছে বোমা। বড় ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে, ধমকাবার জো নেই, তার বন্ধুদের লেলিয়ে দিয়ে কোনদিন আমাকে ঘায়েল করবে।
মাস্টার মশায় বললেন, আট শ বৎসর দাসত্বের পরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন অনেকে একটু বেচাল আর অসামাল হবেই। অবাধ্যতা বোমা চুরি—ডাকাতি কালোবাজার ঘুষ সবই কিছুকাল সইতে হবে, অবশ্য প্রতিকারের চেষ্টাও করতে হবে। এই সমস্তই স্বাধীনতাযুগের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, অন্য দেশেও এমন হয়েছে।
চৌধুরী সাহেব ধমকের সুরে বললেন, তা বলে বেপরোয়া যাকে তাকে বোমা মারবে?
মাস্টার। এ সমস্তই আমাদের কর্মফল–
ভরদ্বাজবাবু তর্জনী নেড়ে বললেন, যা বলেছ দাদা। সবই প্রারব্ধ, পূর্বজন্মের পাপের ফল।
মাস্টার। আজ্ঞে না, ইহজন্মেরই কর্মফল। আমাদের ব্যক্তিগত কর্মের নয়, জাতিগত কর্মের। অত্যাচারী ইংরেজ আর তাদের এদেশী তাঁবেদারদের মারবার জন্য স্বদেশী যুগের বিপ্লবীরা বোমা ছুড়ত। আমরা তখন আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে বৈঠকখানায় বসে তাদের প্রশংসা করতাম। এখন আর ইংরেজের ভয় নেই, প্রকাশ্যে বলছি–মিউটিনিই প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ, খুদিরামই আদি শহীদ, সেই দেখিয়ে দিলে–দেব আরাধনে ভারত উদ্ধার, হবে না হবে না খোল তরবার।
ভরদ্বাজ। এই মতিগতির জন্যই দেশ উৎসন্নে যাচ্ছে। খুদিরাম আমাদের ধর্মবুদ্ধি নষ্ট করেছে, ছেলেদের খুন করতে শিখিয়েছে।
ভজহরি। বলেন কি মশায়! এই সেদিন মহাসমারোহে তাঁর মূর্তিপ্রতিষ্ঠা হয়ে গেল, দেশের বড় বড় লোক উপস্থিত হয়ে সেই মহাপ্রাণ বালকের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।
মাস্টার। গান্ধীজী বেঁচে থাকলে এতে খুশী হতেন না। জওহরলালও যেতে চান নি। পূর্বে তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে নেতাজী ভারত আক্রমণ করলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে লড়বেন। স্বদেশের মুক্তিকামী হলেই সকলের আদর্শ আর কর্তব্যবুদ্ধি সমান হয় না।
চৌধুরী। খুদিরাম তো ইংরেজকে মেরেছিল, কিন্তু এখন যে আমাদের গায়েই বোমা ফেলছে। একেও কর্তব্যবুদ্ধি বলতে চান নাকি?
ভজহরি। মাস্টার মশায়, আপনি কি খুদিরামের কাজ গর্হিত মনে করেন?
মাস্টার। আমি অতি সামান্য লোক, ধর্মাধর্ম বিচার আমার সাধ্য নয়। কর্মের ফল যা দেখতে পাই তাই বলতে পারি। খুদিরাম যখন বোমা ফেলেছিল তখন বড় বড় মডারেটরা ধিককার দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে এই ভয়ঙ্কর পন্থায় তাঁদের আস্থা নেই। খুদিরামের দল নিজের স্বার্থ দেখেনি, প্রাণের মায়া করেনি, ধর্মাধর্ম ভাবেনি, বিনা দ্বিধায় সরকারের সঙ্গে লড়েছিল। তারা শুধু ইংরেজকে বোমা মারেনি, মডারেট বুদ্ধিতেও ফাট ধরিয়েছিল। অনেক মডারেট আড়ালে বলতেন, বাহবা ছোকরা!
চৌধুরী সাহেব অধীর হয়ে বললেন, আপনি কেবল অবান্তর কথা বলছেন, আদালতে এ রকম বললে জজের ধমক খেতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই—ইংরেজ চলে গেছে, দেশনেতাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, এখন আবার বোমা কেন?
মাস্টার মশায় সবিনয়ে বললেন, আদালতে কখনও যাইনি সার। আপনার প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে পারি এমন বুদ্ধি আমার নেই। যা মনে আসছে ক্রমে ক্রমে বলে যাচ্ছি, দয়া করে শুনুন। যদি তাড়া দেন তবে সব গুলিয়ে ফেলব।
চৌধুরী। বেশ, বেশ, বলে যান।
মাস্টার। স্বদেশী যুগের সন্ত্রাসকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ তাড়ানো, বিদেশী শাসকরা চলে যাবার পর কি করতে হবে তা তারা ভাবে নি। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য যে—কোনও উপায়ে মানুষ মারা তারা পাপ মনে করত না। শ্রীকৃষ্ণ গীতায়, অর্জুনকে ধর্মযুদ্ধের উপদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু মহাভারতে অন্যত্র আড়াল থেকে বোমা মারতেও বলেছেন।
ভরদ্বাজ। কোথায় আবার বললেন? যত সব বাজে কথা।
মাস্টার। দ্রোণবধের জন্য মিথ্যা বলা এবং দুর্যোধনের কোমরের নীচে গদাঘাত বোমারই শামিল। সাধারণ ধর্ম আর আপদধর্ম এক নয়, অপৎকালে অনেকেই অল্পাধিক অধর্মাচরণ করে থাকেন। সন্ত্রাসকরা তাই করেছিল। পরে মহাত্মা গান্ধী যখন যুদ্ধের নূতন উপায় আবিষ্কার করলেন এবং তাতে সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনাও দেখা গেল তখন সন্ত্রাসকরা নিরস্ত হল। কিন্তু তারা হিংস্রতার জমি তৈরি করে গেল, বহু লোকের ধারণা হল যে রাজনীতিক উদ্দেশ্যে হিংস্র কর্মে দোষ হয় না, বরং তাতে বাহাদুরিও আছে। সাতচল্লিশ সালে দাঙ্গায় অনেক শান্তশিষ্ট হিন্দুসন্তান অসংকোচে খুন করতে শিখল। তার পর মহাত্মাজীও নিহত হলেন। অনেক গণ্যমান্য লোক চুপি চুপি বললেন, ভগবান যা করেন ভালর জন্যই করেন। এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিকামীদের আদি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অন্য উদ্দেশ্য দেখা দিয়েছে এবং তার জন্য হিংস্র—অহিংস্র নানা পন্থার উদ্ভব হয়েছে।
চৌধুরী। এখন একমাত্র উদ্দেশ্য শান্তি ও শৃঙ্খলা, তার পন্থা একই—জবরদস্ত গভর্নমেণ্ট।
মাস্টার। আজ্ঞে না। নানা লোকের নানা উদ্দেশ্য, কেউ চান রামরাজ্য, কেউ চান সমাজতন্ত্র, কেউ কিষাণ—মজদুরের রাজা হতে চান, কেউ চান সমভোগতন্ত্র বা কমিউনিজম। এঁরা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেন না যে ঠিক কি চান, এঁদের পন্থাও সমান নয়, কেউ আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে চান, কেউ তাড়াতাড়ি। কেউ মনে করেন বা মুখে বলেন যে যথাসম্ভব সত্য ও অহিংসাই শ্রেষ্ঠ উপায়, কেউ মনে করেন শঠে শাঠ্যং না হলে চলবে না, কেউ মনে করেন হিংস্র উপায়েই চটপট কার্যসিদ্ধি হবে। দেখতেই পাচ্ছেন, আজকাল কতগুলি দল হয়েছে –কংগ্রেস, তার মধ্যেও দলাদলি, সমাজতন্ত্রী, হিন্দু—মহাসভা কমিউনিস্ট, আরও কত কি। এদের মধ্যে ভাল মন্দ হিংস্র অহিংস্র সব রকম লোক আছে।