একটা থলি তুলে সরসী বলল, সের পাঁচ—ছয় ওজন হবে।
ঝিণ্টু বলল, পাঁচ শ টাকায় সওয়া ছ—সের, হাজার টাকায় সাড়ে বারো সের, লাখ টাকায় একত্রিশ মন দশ সের। ‘জ্ঞানের সিন্দুক’ বইএ আছে।
পিশাচ যোগীন বাঁড়ুজ্যেকে পাঁজাকোলা করে এনে মেঝেতে ফেলল।
ঝিণ্টু বলল, এও নেশা করেছে নাকি?
পিশাচ বলল, নেশা নয়, অজ্ঞান করে নিয়ে এসেছি, একটু ঠেলা দিলেই চাঙ্গা হবে। থাম, আগে আমি সরে পড়ি, নয়তো আমাকে দেখে আবার ভিরমি যাবে।
ঠেলা খেয়ে যোগীন বাঁড়ুজ্যে উঠে বসলেন। হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বললেন, দুর্গা দুর্গা, এ আমি কোথায়? একি, মিস সরসী মুখার্জী এখানে যে! উঃ, কত গহনা পরেছেন! আপনার বিবাহের নিমন্ত্রণে এসেছি নাকি?
মুখ নীচু করে সরসী বলল, খোকা, তুই বল।
ঝিণ্টু বলল, স্যার আপনি আমার এই সরসী পিসীমাকে বিয়ে করুন, ইনি আইবুড়ো মেয়ে, বয়স সবে পঁচিশ। দেখছেন তো, কত গয়না, আবার পাঁচ থলি টাকাও আছে, এক—একটা পাঁচ—ছ সের।
যোগীনবাবু বললেন, বাঃ খোকা, তুমি নিজেই সালংকারা পিসীকে সম্প্রদান করছ নাকি? তা আমার অমত নেই, মিস মুখার্জির ওপর আমার একটু টাঁনও ছিল। তবে কিনা ইনি হলেন মডার্ন মহিলা, তাই এগুতে ভরসা পাই নি। গহনাগুলো বড্ড সেকেলে, কিন্তু বেশ ভারী মনে হচ্ছে, বেচে দিয়ে নতুন ডিজাইনের গড়ালেই চলবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে কিছুই বুঝতে পারছি না, এখানে আমি এলুম কি করে?
সরসী বলল,সে কথা পরে শুনবেন। এখন বাড়ি যান, কাল সকালে এসে আমার দাদাকে বিবাহের প্রস্তাব জানাবেন। এই আংটিটা পরুন তা হলে ভুলে যাবেন না।
—ভুলে যাবার জো কি! কাল সকালেই তোমার দাদাকে বলব। এখন কটা বেজেছে? বল কি, পৌনে বারো! তাই তো, বাড়ি যাব কি করে, ট্রাম বাস সব তো বন্ধ।
ঝিণ্টু বলল, কিচ্ছু ভাববেন না, স্যার, একবারটি শুয়ে পড়ে চোখ বুজুন তো।
যোগীন বাঁড়ুজ্যে সুবোধ শিশুর ন্যায় শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেন। শিবামুখী চিমটের আওয়াজ শুনে পিশাচ আবার এল। ঝিণ্টু তাকে ইশারায় আজ্ঞা দিল—এঁকে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দাও!
বারোটা বাজল। সরসী বলল, দাদা বউদি এখনই এসে পড়বে। যাই, গহনাগুলো খুলে ফেলি গে, টাকার থলিগুলোও তুলে রাখতে হবে। তোর মোটে বুদ্ধি নেই, টাকা না চেয়ে নোট চাইলি না কেন? ঝিণ্টু বাবা আমার, কোনও কথা কাকেও বলিস নি।
—না, না, বলব কেন। এই যা, ঢুণ্ঢুদাসের কাছে একটা বেঁজি চেয়ে নিতে ভুলে গেছি। ইস্কুলের দারোয়ান রামভজনের কেমন চমৎকার একটি আছে, খুব পোষা, কাঁধের ওপর নেপটে থাকে।
—ভাবিস নি খোকা, যত বেঁজি চাস তোর পিসেমশাই তোকে কিনে দেবে। তুই আর জ্বর গায়ে জাগিস নি, শুয়ে পড়।
—কোথায় জ্বর। সে তো ঢুণ্ঢুদাসকে দেখেই সেরে গেছে।
—হ্যাঁরে খোকা, আমরা স্বপ্ন দেখছি না তো? সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি গহনা আর টাকা সব উড়ে গেছে?
—গেলই বা উড়ে। যোগীনবাবু আবার গড়িয়ে দেবে, টাকাও দেবে।
—যোগীনবাবুও যদি উড়ে যায়?
—যাক গে উড়ে। তুমি এই মটরভাজা একটু খেয়ে দেখ না, কেমন কুড়কুড়ে। বেশ করে চিবিয়ে গিলে ফেল, তা হলে কিছুতেই উড়ে যেতে পারবে না?
১৩৬২ (১৯৫৫)
শোনা কথা
আমাদের পাড়ায় একটি ছোট পার্ক আছে, চার ধারে একবার ঘুরে আসতে পাঁচ মিনিট লাগে। সকাল বেলায় অনেকগুলি বুড়ো ও আধবুড়ো ভদ্রলোক সেখানে চক্কর দেন। এঁদের ভিন্ন ভিন্ন দল, এক এক দলে তিন—চারজন থাকেন। প্রত্যেক দলের আলাপের বিষয়ও আলাদা, যেমন রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, অমুক সাধুবাবার মহিমা, শেয়ার বাজারের দূরবস্থা, আজকালকার ছেলেমেয়ে ইত্যাদি।
আশ্বিন মাস। একটি দলের কিছু পিছনে বেড়াচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি এল; পার্কে টালি দিয়ে ছাওয়া একটি ছোট আশ্রয় আছে, দলের চারজন তাতে ঢুকে পড়লেন। পূর্বে সেখানে দুটো বেঞ্চ ছিল, এখন একটা আছে, আর একটা চুরি গেছে। আমি ইতস্তত করছি দেখে একজন বললেন, ভিতরে আসুন না, ভিজছেন কেন, বেঞ্চে পাঁচজন কুলিয়ে যাবে এখন, একটু না হয় ঘেঁষাঘেঁষি হবে। বাংলায় থ্যাংক ইউ মানায় না, আমি কৃতজ্ঞতা সূচক দন্তবিকাশ করে বেঞ্চের এক ধারে বসে পড়লুম।
অনেক দিন থেকে এঁদের দেখে আসছি, কিন্তু কাকেও চিনি না। অগত্যা কাল্পনিক পরিচয় দিয়ে এঁদের বিচিত্র আলাপ বিবৃত করছি। প্রথম ভদ্রলোকটি–যিনি আমাকে ডেকে নিলেন–শ্যামবর্ণ, রোগা, মাথায় টাক, গোঁফ—কামানো, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি; চোখে পুরু কাচের চশমা, হাতে খবরের কাগজ। এঁকে দেখলেই মনে হয় মাস্টার মশায়। দ্বিতীয় ভদ্রলোকটিকে বহুকাল থেকে আমাদের পাড়ায় দেখে আসছি। এঁর বয়স এখন পঁয়ষট্টি, ফরসা রং, স্থূলকায়, একটু বেশী বেঁটে। পনর বৎসর আগে এঁর কালো গোঁফ দেখেছি, তার পর পাকতে আরম্ভ করতেই বার্ধক্যের লক্ষণ ঢাকবার জন্য কামিয়ে ফেলেন। সম্প্রতি এঁর চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু চামড়া খুব উর্বর, টাক পড়েনি। এই সুযোগে ইনি এখন আবক্ষ দাড়ি—গোঁফ এবং আকণ্ঠ বাবরি চুল উৎপাদন করেছেন, তাতে চেহারাটি বেশ ঋষি ঋষি দেখাচ্ছে। বোধহয় ইনি যোগশাস্ত্র, থিয়সফি, ফলিত জ্যোতিষ, ইলেকট্রোহোমিওপ্যাথি প্রভৃতি গূঢ় তত্ত্বের চর্চা করেন। এঁকে ভরদ্বাজবাবু বলব। তৃতীয় ভদ্রলোকটি দোহারা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, বয়স প্রায় ষাট; কাঁচা—পাকা কাইজারি গোঁফ; চেহারা সম্ভ্রান্ত রকমের, পরনে ইজের ও হাতকাটা কামিজ, মুখে একটি বড় চুরুট। সর্বদাই ভ্রূ একটু কুঁচকে আছেন, যেন কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। ইনি নিশ্চয় একজন উঁচুদরের রাজকর্মচারী ছিলেন। এঁকে বাবু বললে হয়তো ছোট করা হবে, অতএব চৌধুরী সাহেব বলব। চতুর্থ লোকটির বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, লম্বা মজবুত গড়ন, কালো রং, গায়ে আধময়লা খাদি পাঞ্জাবি। গোঁফটি হিটলারি ধরনে ছাঁটা হলেও দেখতে ভালমানুষ, সবিনয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে সঙ্গীদের কথা শোনেন, মাঝে মাঝে আনাড়ীর মতন মন্তব্য করেন। ইনি কেরানী কি গানের মাস্টার, কি ভোটের দালাল, তা বোঝা যায় না। এঁকে ভজহরিবাবু বলব।