—বাজে গল্প! তবে এই দেখ—
ঝিণ্টু চিমটে নেড়ে ঝন ঝন শব্দ করতেই ঢুণ্ঢুদাস চণ্ডের আবির্ভাব হল। সরসী ভয়ে কাঠ হয়ে চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। পিশাচ বলল, কি চাই খোকা?
ঝিন্টু হুকুম করল, গরম মটর ভাজা, বেশ বড় বড়। বেশী করে দিও, পিসীমাও খাবে।
পিশাচ অন্তর্হিত হল। একটু পরেই একটা কাগজের ঠোঙা শূন্য থেকে ধপ করে ঘরের মেঝেতে পড়ল। সদ্য ভাজা বড় বড় মটরে ভরতি, এখনও গরম রয়েছে। এক মুঠো নিয়ে ঝিণ্টু বলল, পিসীমা, একটু খেয়ে দেখ না।
সরসী গালে হাত দিয়ে বলল, অবাক কাণ্ড! বাপের জন্মে এমন দেখিনি, শুনিও নি। কিন্তু তুই কি বোকা রে খোকা। কোথায় দশ—বিশ লাখ টাকা, মস্ত বাড়ি, দামী মোটর গাড়ি, এই সব চাইবি, তা নয়, চাইলি কিনা হাঁসজারু আর মটর ভাজা! ছি ছি ছি। আচ্ছা, তোর ওই চিমটেটা একবারটি আমাকে দে তো।
পিসীর উপর ঝিণ্টুর কোনও দিনই বিশেষ টান নেই। ভেংচি কেটে বলল, ইস দিলুম আর কি! এই শেয়ালমুখো চিমটে আমি কারুক্কে দিচ্ছি না। তোমার কোন জিনিস দরকার বল না, আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
—তুই ছেলেমানুষ, গুছিয়ে বলতে পারবি না।
—আচ্ছা, আমি ঢুণ্ঢুদাসকে ডাকছি। তুমি যা চাও আমাকে বলবে, আর আমি ঠিক সেই কথা তাকে বলব।
অগত্যা সরসী রাজী হল। ঝিণ্টু চিমটে নাড়তেই আবার পিশাচ এসে বলল, কি চাই?
ঝিণ্টু বলল, চটপট বলে ফেল পিসীমা, এক্ষুনি হয়তো বাবা মা এসে পড়বে।
ঝিন্টুর জবানিতে সরসী যা চাইলে তার তাৎপর্য এই। —আগে ওই জানোয়ারটাকে বিদেয় করতে হবে। তারপর দুর্লভ তালুকদার নামক এক ভদ্রলোককে ধারে আনতে হবে। তিনি কানপুরে উলেন মিলে চাকরি করেন। বাসার ঠিকানা জানা নেই।
হাঁসজারু আর পিশাচ অন্তর্হিত হল।
ঝিণ্টু বলল, কানপুরের ভদ্রলোককে এনে কি হবে পিসীমা?
—তাকে আমি বিয়ে করব।
—বিয়ে করবে কি গো! তুমি তো বুড়ো ধাড়ী হয়েছ।
—কে বলল, বুড়ো ধাড়ী! আমার বয়স তো সবে পঁচিশ।
—মা যে বলে তোমার বয়েস চৌত্রিশ—পঁয়ত্রিশ?
—মিথ্যে কথা, তোর মা হিংসুটে, তাই বলে। আর আমি তো আইবুড়ো মেয়ে, বয়েস যাই হোক বিয়ে করব না কেন?
পিশাচ ফিরে আসবার আগে একটু পূর্বকথা বলা দরকার। বারো—তেরো বছর পূর্বে সরসী যখন কলেজে পড়ত তখন দুর্লভ তালুকদারের সঙ্গে তার ভাব হয়। দুর্লভ বলেছিল, আমার একটি ভাল চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে, পেলেই তোমাকে বিয়ে করব। কিছুদিন পরে দুর্লভ চাকরি পেয়ে কানপুরে গেল। সেখান থেকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখত—বড় মাগগি জায়গা, তোমার উপযুক্ত বাসাও পাই নি, মাইনে মোটে দু শ টাকা, দুজনের চলবে কি করে? আশা আছে শীঘ্রই, সাড়ে তিন শ টাকার গ্রেডে প্রমোশন পাব, ভাল কোয়াটার্সও পাব। লক্ষ্মীটি সরসী, তত দিন ধৈর্য ধরে থাক। তার পর ক্রমশ চিঠি আসা কমতে লাগল, অবশেষে একেবারে বন্ধ হল। সরসী বুঝল যে দুর্লভ মিথ্যাবাদী, কিন্তু তবু তাকে সে ভুলতে পারে নি।
পিশাচ একটি মোটা লোককে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে ধপ করে মেঝেতে ফেলে বলল, এই নাও খোকা, তোমার পিসীর বর। এখন বেহুঁশ হয়ে আছে, একটু পরেই চাঙ্গা হবে।
দুর্লভের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ঝিণ্টু বলল, উঃ, মামাবাবু, ক্লাব থেকে ফিরে এলে যে রকম গন্ধ বেরোয় সেই রকম লাগছে। ও ঢুণ্ঢু মশাই, একে জাগিয়ে দাও না।
পিশাচ বলল, নেশায় চুর হয়ে আছে। কানপুরের একটা বস্তিতে ওর ইয়ারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল, সেখান থেকে তুলে এনেছি। এই উঠে পড় শিগগির।
ঠেলা খেয়ে দুর্লভের চেতনা ফিরে এল। চোখ মেলে বলল, তোমরা আবার কে?
ঝিণ্ঢু বলল, পিসীমা, যা বলবার তুমি একে বল।
—আমি পারব না, তুই বল খোকা।
—ও মশাই শুনছেন? এ হচ্ছে আমার সরসী পিসীমা, আইবুড়ো মেয়ে। একে আপনি বিয়ে করুন।
দুর্লভ বলল, আহা কি কথাই শোনালে। বিয়ে কর বললেই বিয়ে করব?
পিশাচ বলল, করবি না কি রকম? তোর বাবা করবে।
একটি পৈশাচিক চড় খেয়ে দুর্লভ বলল, মেরো না বাবা, ঘাট হয়েছে। বেশ, বিয়ে করছি, পুরুত ডাকো। কিন্তু বলে রাখছি, অলরেডি আমার একটি বাঙালী স্ত্রী আর খোট্টা জরু আছে। সরসী যদি তিন নম্বর সহধর্মিনী হতে চায় আমার আর আপত্তি কি। সবাই মিলে এক বিছানায় শুতে হবে কিন্তু।
সরসী বলল, দূর করে দাও হতভাগা মাতালটাকে।
ঝিণ্টুর আদেশে পিশাচ দুর্লভকে তুলে নিয়ে চলে গেল। ঝিণ্টু বলল, আচ্ছা পিসীমা, তোমার আপিসে তো অনেক ভাল ভাল বাবু আছে, তাদের একজনকে আনাও না।
একটু ভেবে সরসী বলল, আমাদের হেড অ্যাসিস্ট্যাণ্ট যোগীন বাঁড়ুজ্যের স্ত্রী দু বছর হল মারা গেছে। যোগীনবাবু লোকটি ভাল, তবে কালচার্ড নয়, একটু বয়সও হয়েছে। বড্ড তামাক খায়, কথা বললে হুঁকো হুঁকো গন্ধ ছাড়ে। তা কি আর করা যাবে, অত খুঁত ধরলে চলে না, সব পুরুষই মোর অর লেস ডার্টি। কিন্তু যোগীনবাবু রাজী হবে কি? মোটা বরপণ পেলে হয়তো—
ঝিণ্টু বলল, বরপণ কি? গয়না আর টাকা? সে তুমি ভেবো না পিসীমা, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।
চিমটে বাজিয়ে পিশাচকে ডেকে ঝিণ্টু বলল, পিসীমার আপিসে সেই যে যোগীন বাঁড়ুজ্যে কাজ করে—ঠিকানাটা কি পিসীমা? তিন নম্বর বেচু মিস্ত্রী লেন—সেইখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে এস। আর শোন, পিসীমাকে একগাদা গয়না আর অনেক টাকা দাও।
সরসীর সর্বাঙ্গ মোটা মোটা সোনার গহনায় ভরে গেল, পাঁচটা থলিও ঝনাত করে তার পায়ের কাছে পড়ল। পিশাচ চলে গেল।