—যক্ষরাজ, যে বিপদ আসন্ন ছিল তা কেটে গেছে। দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে যে যুবতীরা এসেছিল তারা আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে তাঁকে বলেছে, আপনার জামাতা পূর্ণমাত্রায় পুরুষ এবং ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা। এই কথা শুনে শ্বশুর মহাশয় অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে আমার পিতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং বিস্তর উপঢৌকন দিয়ে সদলবলে প্রস্থান করেছেন। যাবার সময় তাঁর কন্যাকে বোকা মেয়ে বলে ধমক দিয়ে গেছেন। আমি এই যক্ষ মহাশয়ের কাছে আর এক মাস সময় ভিক্ষা চাচ্ছি, তার মধ্যেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সমাপ্ত হবে। ভীষ্মকে বধ করেই আমি স্থূণাকর্ণের ঋণ শোধ করব।
কুবের বললেন, মহারথ ভীষ্মকে তুমি বধ করবে এ কথা অবিশ্বাস্য। তিনিই তোমাকে বধ করবেন, সেই সঙ্গে তোমার পুরুষত্বও বিনষ্ট হবে। ও সব চলবে না, তুমি এই মুহূর্তে স্থূণাকর্ণের পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ কর এবং তোমার স্ত্রীত্ব ফিরিয়ে নাও। নতুবা আমি সাক্ষীপ্রমাণ নিয়ে এখনই তোমার শ্বশুরের কাছে যাব। তোমার প্রতারণার কথা জানলেই তিনি সসৈন্যে এসে পঞ্চাল রাজ্য ধ্বংস করবেন।
ব্যাকুল হয়ে শিখণ্ডী বললেন, হা, আমার গতি কি হবে!
কুবের বললেন, ভাবছ কেন, তোমার ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন আছেন, পঞ্চপাণ্ডব ভগিনীপতি আছেন, পাণ্ডবসখা কৃষ্ণ আছেন। তাঁরাই ভীষ্মবধের ব্যবস্থা করবেন।
শিখণ্ডী বললেন, তা হবার জো নেই। ভীষ্ম পাণ্ডবদের পিতামহ, আর দ্রোণ তাঁদের আচার্য। এই দুই গুরুজনকে তাঁরা বধ করবেন না, এই কারণে ভীষ্মবধের ভার আমার উপর আর দ্রোণবধের ভার ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর পড়েছে।
কুবের কোনও আপত্তি শুনলেন না। অবশেষে নিরুপায় হয়ে শিখণ্ডী যক্ষকে পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ করে নিজের স্ত্রীত্ব ফিরিয়ে নিলেন। তখন কুবেরের সঙ্গে যক্ষ আর যক্ষিণী পরমানন্দে অকালপুরীতে চলে গেল।
বিষণ্ণমনে অনেকক্ষণ চিন্তা করে শিখণ্ডী (এখন শিখণ্ডিণী) কৃষ্ণসকাশে এলেন। দৈবক্রমে দেবর্ষি নারদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ বললেন, একি শিখণ্ডী, তোমাকে এমন অবসন্ন দেখছি কেন? দুদিন আগেও তোমার বীরোচিত তেজস্বী মূর্তি দেখেছিলাম এখন আবার কোমল স্ত্রীভাব দেখছি কেন?
শিখণ্ডী বললেন, বাসুদেব, আমার বিপদের অন্ত নেই।
নারদ বললেন তোমরা বিশ্রম্ভালাপ কর, আমি এখন উঠি।
শিখণ্ডী বললেন, না না দেবর্ষি, উঠবেন না। আপনি তো আমার ইতিহাস সবই জানেন, আপনার কাছে গোপনীয় কিছু নেই।
সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে শিখণ্ডী বললেন কৃষ্ণ, তুমি পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের সুহৃদ, আমার ভগিনী কৃষ্ণা তোমার সখী। আমাকে সংকট হতে উদ্ধার কর। বিগত জন্ম থেকেই আমার সংকল্প আছে যে ভীষ্মকে বধ করব, মহাদেবের বরও আমি পেয়েছি। কিন্তু পুরুষত্ব না পেলে আমি যুদ্ধ করব কি করে?
কৃষ্ণ বললেন, তোমার সংকল্প ধর্মসংগত নয়। নারী হয়ে জন্মেছ, অলৌকিক উপায়ে পুরুষ হতে চাও কেন? ভীষ্মকে বধ করবার ভার অন্য লোকের উপর ছেড়ে দাও। দেবর্ষি কি বলেন?
নারদ বললেন, ওহে শিখণ্ডী, কৃষ্ণ ভালই বলেছেন। শাল্বরাজ আর ভীষ্ম তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাতে হয়েছে কি? পৃথিবীতে আরও পুরুষ আছে। তুমি যদি সম্মত হও তবে আমি তোমার পিতাকে বলব, তিনি যেন কোন সৎপাত্রে তোমাকে অর্পণ করেন। তাতেই তোমার নারীজন্ম সার্থক হবে। তোমার পত্নীরও একটা গতি হয়ে যাবে সে তোমার সপত্নী হয়ে সুখে থাকবে।
শিখণ্ডী বললেন, অমন কথা বলবেন না দেবর্ষি। মহাদেব আমাকে যে বর দিয়েছেন তা অবশ্যই সফল হবে। কৃষ্ণ, তোমার অসাধ্য কিছু নেই, তুমি আমাকে পুরুষ করে দাও।
কৃষ্ণ বললেন, আমি বিধাতা নই যে অঘটন ঘটাব। সেই যক্ষের মতন কেউ যদি স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে অঙ্গ বিনিময় করে তবেই তুমি পুরুষ হতে পারবে। কিন্তু সেরকম নির্বোধ আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। দেবর্ষি, আপনি তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়ান, আপনার জানা আছে?
নারদ বললেন, আছে, তুমিও তাঁকে জান। শোন শিখণ্ডী, বৃন্দাবন ধামে কৃষ্ণের এক দূর সম্পর্কের মাতুল আছেন। তিনি গোপবংশীয়, নাম আয়ান ঘোষ। অতি সদাশয় পরোপকারী লোক, কিন্তু বড়ই মনঃকষ্টে আছেন, ধর্মকর্ম নিয়েই থাকেন, সংসারে আসক্তি নেই। তুমি তাঁর শরণাপন্ন হও।
শিখণ্ডী বললেন, বাসুদেব, তুমি আমার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করে শ্রীআয়ানকে একটি পত্র দাও, তাই নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাব।
কৃষ্ণ বললেন, পাগল হয়েছ? আমার নাম যদি ঘুণাক্ষরে উল্লেখ কর তবে তখনই তিনি তোমাকে বিতাড়িত করবেন। দেখ শিখণ্ডী, আমার অদৃষ্ট বড় মন্দ, অকারণে আমি কয়েকজনের বিরাগভাজন হয়েছি—কংস, শিশুপাল, আর আমার পূজ্যপাদ মাতুল এই আয়ান ঘোষ। এমন কি, আমার পুত্র শাম্বের শ্বশুর দুর্যোধনও আমার শত্রু হয়েছেন।
শিখণ্ডী বললেন, তবে উপায়?
নারদ বললেন, উপায় তোমারই হাতে আছে। নারীর ছলাকলা আর পুরুষের কূটবুদ্ধি দুটিই তোমার স্বভাবসিদ্ধ, তাই দিয়েই কাজ উদ্ধার করতে পারবে। চল আমার সঙ্গে, শ্রীআয়ানের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।
বৃন্দাবনের এক প্রান্তে লোকালয় হতে বহু দূরে যমুনাতীরে একটি কুটীর নির্মাণ করে আয়ান ঘোষ সেখানে বাস করেন। বিকাল বেলা নদীপুলিনে বসে তিনি রাবণরচিত শিবতাণ্ডব স্তোত্র আবৃত্তি করছিলেন, এমন সময় শিখণ্ডীর সঙ্গে নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন।