যক্ষিণী বলল, তুমি মেয়েমানুষ হয়ে গেলে কি করে?
কুবের বললেন, এ রকম হয়ে থাকে। বুধপত্নী ইলা আগে পুরুষ ছিলেন, হরপার্বতীর নিভৃত স্থানে প্রবেশের ফলে স্ত্রী হয়ে যান। বালী—সুগ্রীবের বাপ ঋক্ষরজা এক সরোবরে স্নান করে বানরী হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হক, স্থূণাকর্ণ, তুমি সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে বল।
যক্ষ বলতে লাগল। —মহারাজ, প্রায় তিন মাস হল কিছু শুনো কাঠ সংগ্রহের জন্য আমি নিকটবর্তী ওই অরণ্যে গিয়েছিলাম। দেখলাম, গাছের তলায় একটি ললনা বসে আছে আর আকুল হয়ে অশ্রুপাত করছে।
যক্ষিণী প্রশ্ন করল, মাগী দেখতে কেমন?
—সুন্দরী বলা চলে, তবে তোমার কাছে লাগে না। কাটখোট্টা গড়ন, মুখে লাবণ্যেরও অভাব আছে। মহারাজ, তারপর শুনুন। আমি সেই নারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভদ্রে, তোমার কি হয়েছে? যদি বিপদে পড়ে থাক তবে আমি যথাসাধ্য প্রতিকারের চেষ্টা করব।
সে এই আশ্চর্য বিবরণ দিল। —মহাশয়, আমি পঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডিনী, কিন্তু লোকে আমাকে রাজপুত্র শিখণ্ডী বলেই জানে। পূর্বজন্মে আমি ছিলাম কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা। স্বয়ংবরসভা থেকে ভীষ্ম আমাদের তিন ভগিনীকে হরণ করেছিলেন, তাঁর বৈমাত্র ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য। আমি শাল্বরাজের প্রতি অনুরক্তা জেনে ভীষ্ম আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শাল্ব বললেন, রাজকন্যা, আমি তোমাকে নিতে পারি না, কারণ ভীষ্ম তোমাকে হরণ করেছিলেন, তাঁর স্পর্শ নিশ্চয়ই তোমাকে পুলকিত করেছিল। তখন আমি ভগবান পরশুরামের শরণ নিলাম। তিনি ভীষ্মকে বললেন, তোমারই কর্তব্য অম্বাকে বিবাহ করা। ভীষ্ম সম্মত হলেন না। পরশুরাম তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না। ভীষ্মের জন্যই আমার নারীজন্ম বিফল হল এই কারণে ভীষ্মের বধকামনায় আমি কঠোর তপস্যা করলাম। তাতে মহাদেব প্রীত হয়ে বর দিলেন—তুমি পরজন্মে দ্রুপদকন্যা রূপে ভূমিষ্ঠ হবে, কিন্তু পরে পুরুষ হয়ে ভীষ্মকে বধ করবে। মহাদেবের বরে দ্রুপদ গৃহে আমার জন্ম হল। কন্যা হলেও রাজপুত্র শিখণ্ডী রূপেই আমি পালিত হয়েছি, অস্ত্রবিদ্যাও শিখেছি। যৌবনকাল উপস্থিত হলে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে আমার বিবাহ হল। কিন্তু কিছুদিন পরেই ধরা পড়ে গেলাম। আমার পত্নী দাসীকে দিয়ে তার মায়ের কাছে বলে পাঠাল—মাগো, তোমাদের ভীষণ ঠকিয়েছে, যার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছ সে পুরুষ নয়, মেয়ে।
এই দুঃসংবাদ শুনে আমার শ্বশুর হিরণ্যবর্মা ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি দূত পাঠিয়ে আমার পিতা দ্রুপদকে জানালেন, দুর্মতি, তুমি আমাকে প্রতারিত করেছ। আমি সসৈন্যে তোমার রাজ্যে যাচ্ছি, চারজন চতুরা যুবতীও আমার সঙ্গে যাচ্ছে, তারা আমার জামাতা শিখণ্ডীকে পরীক্ষা করবে। যদি দেখা যায় যে সে পুরুষ নয় তবে তোমাকে আমি অমাত্যপরিজনসহ বিনষ্ট করব।
পিতার এই দারুণ বিপদ দেখে আমি গৃহত্যাগ করে এই বনে পালিয়ে এসেছি। আমার জন্যই স্বজনবর্গ বিপন্ন হয়েছেন, আমার আর জীবনে প্রয়োজন কি। আমি এখানেই অনাহারে জীবন বিসর্জন দেব।
যক্ষরাজ, শিখণ্ডিনীর এই ইতিহাস শুনে আমার অত্যন্ত অনুকম্পা হল। আমি তাকে বললাম, তুমি কি চাও বল। আমি ধনপতি কুবেবের অনুচর, অদেয় বস্তুও দিতে পারি।
শিখণ্ডিনী বলল, যক্ষ, আমায় পুরুষ করে দাও।
আমি বললাম, রাজকন্যা, আমার পুরুষত্ব কয়েক দিনের জন্য তোমাকে ধার দেব, তাতে তুমি তোমার পিতা ও আত্মীয়বর্গকে দশার্ণরাজের ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তুমি এখানে এসে আমার পুরুষত্ব ফিরিয়ে দেবে। আমার শাপান্ত হতে আর বিলম্ব নেই, প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের জন্য আমি অধীর হয়ে আছি, অতএব তুমি সত্বর ফিরে এসো।
মহারাজ, শিখণ্ডিনী সেই যে চলে গেল তারপর আর আসে নি। সেই মিথ্যাবাদিনী দ্রুপদনন্দিনী ধাপ্পা দিয়ে আমার পুরুষত্ব আদায় করে পালিয়েছে, তার বদলে দিয়ে গেছে তার তুচ্ছ নারীত্ব।
যক্ষের কথা শুনে যক্ষিণী বলল, একটা অজানা মেয়ের কান্নায় ভুলে গিয়ে তোমার অমূল্য সম্পদ তাকে দিয়ে দিলে! নাথ, তুমি কি বোকা, কি বোকা!
কুবের বললেন, তুমি একটি গজমূর্খ গর্দভ গাড়ল। যাই হক, এখনই আমি তোমার পুরুষত্ব উদ্ধার করে দেব। চল আমার সঙ্গে।
সকলে পঞ্চাল রাজ্যে উপস্থিত হলেন। রাজধানী থেকে কিছুদূরে এক নির্জন বনে পুষ্পক রথ রেখে কুবের তাঁর এক অনুচরকে বললেন, দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডীকে সংবাদ দাও—বিশেষ প্রয়োজনে ধনেশ্বর কুবের তোমাকে ডেকেছেন, যদি না আস তবে পঞ্চাল রাজ্যের সর্বনাশ হবে।
শিখণ্ডী ব্যস্ত হয়ে তখনই এসে প্রণাম করে বললেন, যক্ষরাজ, আমার প্রতি কি আজ্ঞা হয়?
কুবের বললেন, শিখণ্ডী, তুমি আমার কিংকর এই স্থূণাকর্ণকে প্রতারিত করেছ, এর প্রিয়ার সঙ্গে মিলনে বাধা ঘটিয়েছ, যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা রক্ষা কর নি। যদি মঙ্গল চাও তবে এখনই এর পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ কর।
শিখণ্ডী বললেন, ধনেশ্বর, আমি অবশ্যই প্রতিশ্রুতি পালন করব, আমার বিলম্ব হয়ে গেছে তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। এই যক্ষ আমার মহোপকার করেছেন, কৃপা করে আরও কিছুদিন আমায় সময় দিন।
কুবের বললেন কেন, তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি?