কালিদাস তাঁর যক্ষের নাম প্রকাশ করেন নি, শাপের এক বৎসর শেষ হলে সে নিরাপদে ফিরতে পেরেছিল কিনা তাও লেখেন নি। মহাভারতে উদ্যোগপর্বে এক বনবাসী যক্ষের কথা আছে, তার নাম স্থূণাকর্ণ। সেই যক্ষ আর মেঘদূতের যক্ষ একই লোক তাতে সন্দেহ নেই। কালিদাস তাঁর কাব্যের উপসংহার লেখেন নি, মহাভারতেও যক্ষের প্রকৃত ইতিহাস নেই। কালিদাস আর ব্যাসদেব যা অনুক্ত রেখেছেন সেই বিচিত্র রহস্য এখন উদঘাটন করছি।
যক্ষপত্নীকে যক্ষিণী বলব, কারণ তার নাম জানা নেই। পতির বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে যক্ষিণী দিনযাপন করছিল। একটা বেদীর উপর সে প্রতিদিন একটি করে ফুল রাখত আর মাঝে মাঝে গুনে দেখত ৩৬৫ পূরণের কত বাকী। অবশেষে এক বৎসর পূর্ণ হল, কার্তিক মাসও শেষ হল, কিন্তু যক্ষের দেখা নেই। যক্ষিণী উৎকণ্ঠিত হয়ে আরও কিছুদিন প্রতীক্ষা করল, তারপর আর থাকতে না পেরে কুবেরের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।
কুবের বললেন, কে গা তুমি? খুব সুন্দরী দেখছি, কিন্তু কেশ অত রুক্ষ কেন? বসন অত মলিন কেন? একটি মাত্র বেণী কেন?
যক্ষিণী সরোদনে বলল, মহারাজ, আপনার সেই কিংকর যাকে এক বৎসরের জন্য নির্বাসনদণ্ড দিয়েছিলেন, আমি তারই দুঃখিনী ভার্যা। আজ দশ দিন হল এক বৎসর উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এখনও আমার স্বামী ফিরে এলেন না কেন?
কুবের বললেন, ব্যস্ত হচ্ছ কেন, ধৈর্য ধর, নিশ্চয় সে ফিরে আসবে। হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে। তার জোয়ান বয়েস, এখানে শুধু নাক—থেবড়া যক্ষিণী আর কিন্নরীই দেখেছে, বিদেশে হয়তো কোনও রূপবতী মানবীকে দেখে তার প্রেমে পড়েছে। তুমি ভেবো না, মানবীতে অরুচি হলেই সে ফিরে আসবে।
সজোরে মাথা নেড়ে যক্ষিণী বলল, না না, আমার স্বামী তেমন নন, অন্য নারীর দিকে তিনি ফিরেও তাকাবেন না। এই সেদিন একটি মেঘ এসে তাঁর আকুল প্রেমের বার্তা আমাকে জানিয়ে গেছে। প্রভু, আপনি দয়া করে অনুসন্ধান করুন, নিশ্চয় তাঁর কোনও বিপদ হয়েছে, হয়তো সিংহব্যাঘ্রাদি তাঁকে বধ করেছে।
কুবের বললেন, তুমি অত উতলা হচ্ছ কেন? তোমার স্বামী যদি ফিরে নাই আসে তবু তুমি অনাথা হবে না। আমার অন্তঃপুরে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে, আমি তোমাকে খুব সুখে রাখব।
যক্ষিণী বলল, ও কথা বলবেন না প্রভু, আপনি আমার পিতৃস্থানীয়। আপনার আজ্ঞায় আমার স্বামী নির্বাসনে গিয়েছিলেন, এখন তাঁর দণ্ডকাল উত্তীর্ণ হয়েছে, তাঁকে ফিরিয়ে আনা আপনারই কর্তব্য। যদি তিনি বিপদাপন্ন হন তবে তাঁকে উদ্ধার করুন, যদি মৃত হন তবে নিশ্চিত সংবাদ আমাকে এনে দিন, আমি অগ্নিপ্রবেশ করে স্বর্গে তাঁর সঙ্গে মিলিত হব।
বিব্রত হয়ে কুবের বললেন, আঃ তুমি আমাকে জ্বালিয়ে মারলে। বেশ, এখনই আমি তোমার স্বামীর সন্ধানে যাচ্ছি, রামগিরি জায়গাটা দেখবার ইচ্ছাও আমার আছে। তুমিও আমার সঙ্গে চল। ওরে, শীঘ্র পুষ্পক রথ জুততে বলে দে। আর তোরা দুজন তৈরি হয়ে নে, আমার সঙ্গে যাবি।
রামগিরি প্রদেশে একটি ছোট পাহাড়ের উপর যক্ষ তার আশ্রম বানিয়েছিল। সেখানে পৌঁছে কুবের দেখলেন, বাড়িটি বেশ সুন্দর, দরজা জানালাও আছে, কিন্তু সবই বন্ধ। কুবেবের আদেশে তাঁর এক অনুচর দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ওহে স্থূণাকর্ণ, এখনই বেরিয়ে এস, মহামহিম রাজরাজ কুবের স্বয়ং এসেছেন, তোমার বউও এসেছে।
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। কুবের বললেন, বাড়িতে কেউ নেই মনে হচ্ছে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া যাক।
যক্ষিণী বলল, অমন কাজ করবেন না মহারাজ। আমার স্বামী এই বাড়িতেই আছেন, আমি মাছ ভাজার গন্ধ পাচ্ছি, নিশ্চয় উনি রান্নায় ব্যস্ত আছেন, কেউ তো সাহায্য করবার লোক নেই। আমিই ওঁকে ডাকছি। ওগো, শুনতে পাচ্ছ? আমি এসেছি, মহারাজও এসেছেন। রান্না ফেলে রেখে চট করে বেরিয়ে এসো।
একটি জানালা ঈষৎ ফাঁক হল। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে উত্তর এলো, অ্যাঁ, প্রিয়ে তুমি এসেছ, প্রভু এসেছেন? কি সর্বনাশ, তাঁর সামনে আমি বেরুব কি করে?
আশ্চর্য হয়ে কুবের বললেন, কে গো তুমি? এখনই বেরিয়ে এসো নয় তো বাড়িতে আগুন লাগাব।
তখন দরজা খুলে একটি অবগুণ্ঠিতা নারীমূর্তি বেরিয়ে এল। কুবের ধমক দিয়ে বললেন, আর ন্যাকামি করতে হবে না, তোমার ঘোমটা খোল।
মাথা নীচু করে ঘোমটাবতী উত্তর দিল, প্রভু, এ মুখ দেখাব কি করে?
কুবের বললেন, পুড়িয়েছ নাকি? ভেবো না, শিব যাতে চড়েন সেই বৃষভের সদ্যোজাত গোময় লেপন করলেই সেরে যাবে।
যক্ষিণী হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে এক টানে ঘোমটা খুলে ফেলল। মাথা চাপড়ে নারীমূর্তি বলল, হায় হায়, এর চাইতে আমার মরণই ভাল ছিল।
কুবের প্রশ্ন করলেন, কে তুমি? সেই স্থূণাকর্ণ যক্ষটা কোথায় গেল? তুমি তার রক্ষিতা নাকি?
—মহারাজ, আমিই আপনার হতভাগ্য কিংকর স্থূণাকর্ণ, দৈবদুর্বিপাকে এই দশা হয়েছে, কিন্তু আমার কোনও অপরাধ নেই। প্রিয়ে, আমরা নিতান্তই হতভাগ্য, শাপান্ত হলেও আমাদের মিলন হবার উপায় নেই।
যক্ষিণী বলল, মহারাজ, ইনিই আমার স্বামী, ওই যে, জোড়া ভুরু রয়েছে, নাকের ডগায় সেই তিলটিও দেখা যাচ্ছে। হা নাথ, তোমার এমন দশা হল কেন? কোন দেবতাকে চটিয়েছিলে?
যক্ষ বলল, পরের উপকার করতে গিয়ে আমার এই দুরবস্থা হয়েছে। এই জগতে কৃতজ্ঞতা নেই, সত্যপালন নেই।