—বেশী কথা তোমরাই বলছ। আর দেরি ক’র না, যা জিজ্ঞাসা করেছি তার স্পষ্ট উত্তর দাও।
ডাক্তার তাঁর স্টেথোস্কোপের নল চটকাতে চটকাতে বললেন, দু—চার ঘন্টা হতে পারে, দু—চার দিনও হতে পারে, ঠিক বলা অসম্ভব। ইনজেকশনটা দিয়ে দি, আপনি অক্সিজেন শুঁকতে থাকুন, কষ্ট কমবে।
যথাকর্তব্য করে ডাক্তার অটলবাবুর বিধবা পুত্রবধূকে বললেন, হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে, আজ রাত বোধ হয় কাটবে না। নার্স ওঁর ঘরে থাকুক, আমি এই পাশের ঘরে রইলুম।
অটলবাবু অত্যন্ত হিসাবী লোক, আজীবন নানারকম কারবার করেছেন। তাঁর বয়স আশি পেরিয়েছে, শরীর রোগে অবসন্ন, কিন্তু বুদ্ধি ঠিক আছে। মরণ আসন্ন জেনে তিনি মনে মনে ইহলোকের ব্যালান্স—শীট এবং পরলোকের একটা আন্দাজী প্রসপেকটস খাড়া করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সুখং হি দুঃখান্যনুভূয় শোভতে
ঘনান্ধকারেষ্বিব দীপদর্শনম।
সুখাত্তু যো যাতি নরো দরিদ্রতাং
ধৃতঃ শরীরেণ মৃতঃ স জীবতি।।
—দুঃখ অনুভবের পরই সুখ শোভা পায়, যেমন ঘোর অন্ধকারে দীপদর্শন। কিন্তু যে লোক সুখভোগের পর দরিদ্রতা পায় সে শরীর ধারণ করে মৃতের ন্যায় জীবিত থাকে।
অটলবাবু ভাবলেন, ভুল, মস্ত ভুল। তিনি প্রথম ও মধ্য জীবনে বিস্তর সুখভোগ করেছেন, কিন্তু শেষ বয়সে অনেক দুঃখ পেয়েছেন। তাঁকে স্ত্রীপুত্রাদি আত্মীয়বিয়োগের শোক এবং ব্যবসায়ে বড় রকম লোকসান সইতে হয়েছে, সর্বস্বান্ত না হলেও তিনি আগের তুলনায় দরিদ্র হয়েছেন। বয়স যত বাড়ে সময় ততই ছোট হয়ে যায় ; অন্তিম কালে অটলবাবুর মনে হচ্ছে তাঁর সমস্ত জীবন মুহূর্তমাত্র, সমস্ত সুখ দুঃখ তিনি এক সঙ্গেই ভোগ করেছেন এবং সবই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুখভোগের পর দুঃখ পেয়েছেন—শুধু এই কারণেই সুখের চেয়ে দুঃখকে বড় মনে করবেন কেন? জীবনের খাতায় লাভ—লোকসান দুইই পাকা কালিতে লেখা রয়েছে, তাতে দেখা যায় তাঁর খরচের তুলনায় জমাই বেশী, মোটের উপর তিনি বঞ্চিত হন নি। অন্য লোকে যাই বলুক, তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন।
কিন্তু একটা খটকা দেখা যাচ্ছে। তিনি নিজে ভাগ্যবান হলেও যারা তাঁর অত্যন্ত প্রিয়জন ছিল তারা হতভাগ্য, অনেকে বহু দুঃখ পেয়ে অকালে মরেছে। তাদের দুঃখ অটলবাবু নিজের বলেই মনে করেন এবং তা লোকসানের দিকে ফেললে লাভের অঙ্ক খুব কমে যায়। শুধু তাই নয়, অন্যান্য যে সব লোককে তিনি আজীবন আশেপাশে দেখছেন তাদেরও অনেকে কষ্ট ভোগ করেছে। পূর্বে তাদের কথা তিনি ভাবেন নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারাও নিতান্ত আপনজন। তাদের দুঃখও যদি নিজের বলে ধরেন তবে জমাখরচ কষলে লোকসানই দেখা যায়।
অটলবাবু স্থির করতে পারলেন না তিনি জীবনে মোটের উপর সুখ বেশী পেয়েছেন কি দুঃখ বেশী পেয়েছেন। তিনি যদি ভক্ত হতেন তবে বলতে পারতেন—’ধন্য হরি রাজ্যপাটে, ধন্য হরি শ্মশানঘাটে’। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন—এই খ্রীষ্টানী প্রবোধবাক্যে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন নি। অটলবাবু শুনেছেন, যিনি পরমহংস তিনি সমস্ত জীবের সুখদুঃখ নিজের বলেই মনে করেন ; সুখ আর দুঃখে কাটাকাটি হয়ে যায়, তার ফলে তিনি সুখীও হন না দুঃখীও হন না। কিন্তু অটলবাবু পরমহংস নন, তা ছাড়া তিনি জগতে সুখের চেয়ে দুঃখই বেশী দেখতে পান। তিনি যদি দুঃখের দিকে পিছন ফিরে জীবন উপভোগ করতে পারতেন তবে রবীন্দ্রনাথের মতন বলতে পারতেন—
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি—
অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি
এই মহামন্ত্রখানি
চরিতার্থ জীবনের বাণী।
দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা—কিছু উপহার
মধুরসে ক্ষয় নাই তার।
তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে—
সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দে বিরাজে।
আরও বলতে পারতেন—
আমি কবি তর্ক নাহি জানি,
এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে—
লক্ষ কোটি গ্রহ তারা আকাশে আকাশে
বহন করিয়া চলে প্রকাণ্ড সুষমা,
ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে,
বিকৃতি না ঘটায় স্খলন…..
ভাগ্যদোষে অটলবাবু ভক্ত নন, কবি নন, ভাবুক নন, দার্শনিক নন, সরল বিশ্বাসীও নন। তিনি নানা বিষয়ে ঠোকর মেরেছেন কিন্তু কিছুই আয়ত্ত করতে পারেন নি। আজীবন সংশয়ে কাটিয়েছেন কিন্তু কোনও বিষয়েই নিষ্ঠা রাখতে পারেন নি। তাঁর মূলধন কি তাই তিনি জানেন না, লাভ—লোকসান খতাবেন কি করে? শুধু এইটুকুই বলতে পারেন—অনেকের তুলনায় তিনি ভাগ্যবান, অনেকের তুলনায় তিনি হতভাগ্য। এ সম্বন্ধে আর তিনি বৃথা মাথা ঘামাবেন না, জ্ঞান থাকতে থাকতে তাঁর ভবিষ্যৎটা একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন। তাঁর আর বাঁচবার ইচ্ছা নাই। তিনি মরলে কারও আর্থিক ক্ষতি বা মানসিক দুঃখ হবে না, যে অল্প আয় আছে তা বন্ধ হবে না, বরং ইনশিওরান্সের একটা মোটা টাকা ঘরে আসবে। তিনি এখন আত্মীয়দের গলগ্রহ মাত্র, তারা বোধ হয় মনে মনে তাঁর মরণ কামনা করে।
অটলবাবু কি আবার জন্মাবেন? তাঁর গতজন্মের কথা কিছুই মনে নেই। জাতিস্মর লোকের বিবরণ মাঝে মাঝে খবরের কাগজে পাওয়া যায়, কিন্তু তা মোটেই বিশ্বাস্য নয়। মালবীয়জীর যখন কায়কল্প চিকিৎসা চলছিল তখন এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা খবর পাঠাচ্ছিলেন—পণ্ডিতজীর পাকা চুল সমস্ত কাল হয়ে গেছে, নূতন দাঁতও উঠছে। নির্জলা মিথ্যা কথা লিখতে এঁদের বাধে না। যদি পুনর্জন্মের কথা মনে না থাকে তবে এক জন্মের রামবাবুই যে অন্য জন্মে শ্যামবাবু হয়েছেন তার প্রমাণ কি? তারপর স্বর্গ মর্ত্য। তিনি এক পাদ্রির কাছে শুনেছিলেন, যিশু খ্রীষ্টের শরণ নিলে অনন্ত স্বর্গ, না নিলে অনন্ত নরক। এ রকম ছেলেমানুষী কথায় ভুলবেন অটলবাবু এমন বোকা নন। আমাদের পুরাণে আছে, যার পাপ অল্প সে আগে অল্পকাল নরকভোগ করে, তারপর দীর্ঘকাল স্বর্গভোগ করে, পুণ্যক্ষয় হলে আবার জন্মায়। যার পুণ্য অল্প সে অল্পকাল স্বর্গবাসের পর দীর্ঘকাল নরকবাস করে, তার পর আবার জন্মায়। এই মত খ্রীষ্টানী মতের চেয়ে ভাল, কিন্তু মানুষের পাপ—পুণ্য, মাপা হবে কী করে? পাপ—পুণ্য তো যুগে যুগে বদলাচ্ছে। পঞ্চাশ—ষাট বৎসর আগে মুরগি খেলে পাপ হত, এখন আর হয় না। পুরাকালের হিন্দুরা অন্যান্য নিষিদ্ধ মাংসও খেত, ভবিষ্যতে আবার খাবে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সবাই বলে নরহত্যা মহাপাপ, কিন্তু এই সেদিন শান্ত শিষ্ট ভদ্রলোকের ছেলেরাও বেপরোয়া খুন করেছে, বুড়োরা উৎসাহ দিয়ে বলেছে—এ হল আপদধর্ম, সাপ মারলে পাপ হয় না, কে ঢোঁড়া কে কেউটে তা চেনবার দরকার নেই। পাপ—পুণ্যের যখন স্থিরতা নেই তখন স্বর্গনরক অবিশ্বাস্য।