বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে শার্লেমেনের, এবং পরে ফ্রান্সে চার্লস ৯-এর, এবং আঠারো শতকে অস্ট্রিয়ায় মারিয়া তেরেসার সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়একইভাবে। সমাজসংস্থাই বেশ্যাবৃত্তিকে দরকারি করে তোলে। যেমন শপেনহায়ার সাড়ম্বরে বলেছিলেন : ‘একপতিপত্নীক বিয়ের বেদিতে বেশ্যারা হচ্ছে নরবলি’। লেকি, ইউরোপি নৈতিকতার ঐতিহাসিক, একই ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন কিছুটা ভিন্নভাবে : ‘চূড়ান্ত রকমের পাপ, তারাই হচ্ছে সদগুণের শ্রেষ্ঠতম অভিভাবক’। গির্জা এবং রাষ্ট্র একইভাবে নিন্দা করেছে ইহুদিদের সুদের কারবার ও বেশ্যাদের বিবাহবহির্ভূত কামের; কিন্তু আর্থিক ফটকাবজি ও বিয়ের বাইরের প্রেম ছাড়া সমাজ চলতে পারে নি; তাই এসব কাজ ছেড়ে দেয়া হয় হীনবর্ণদের ওপর, যাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ঘেটোতে বা নিষিদ্ধপল্লীতে। ইহুদিদের মতো বেশ্যাদেরও বাধ্য করা হয় পোশাকের ওপর পরিচয়সূচক চিহ্ন ধারণ করতে; পুলিশের কাছে তারা ছিলো অসহায়; তাদের অধিকাংশের জীবন ছিলো কঠিন। তবে অনেক বেশ্যা ছিলো স্বাধীন; অনেকে বেশ ভালো আয় করতো। যেমন ঘটেছিলো গ্রিক অভিজাত গণিকাদের কালে বীরত্বব্যঞ্জকতার কালের বিলাসবহুল জীবনযাত্রাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যপূর্ণ নারীর সামনে খুলে দিয়েছিলো সুযোগসুবিধার নানা দরোজা, যা দিতে পারতো না ‘সতীনারী’র জীবন।
ফ্রান্সে অবিবাহিত নারীর অবস্থা ছিলো একটু অদ্ভুত : দাসীত্বে আবদ্ধ স্ত্রীর সাথে তার স্বাধীনতা ছিলো চমকপ্রদভাবে বিপরীত; সে ছিলো একজন অসামান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তবে আইন তাকে যা দিয়েছিলো, লোকাচার তাকে বঞ্চিত করে তার সব কিছু থেকে; তার ছিলো সব নাগরিক অধিকার। তবে এগুলো ছিলো বিমূর্ত ও শূন্যগর্ভ; তার আর্থনীতিক স্বাধীনতা ছিলো না, সামাজিক মর্যাদাও ছিলো না; সাধারণত বয়স্ক অবিবাহিত কন্যাটি জীবন কাটিয়েদিতো পিতার পরিবারের ছায়ায় বা তার মতোদের সাথে যোগ দিতে সন্ন্যাসিনীদের মঠে, যেখানে সে আনুগত্য ও পাপ ছাড়া আর কোনো রকমের স্বাধীনতার দেখা পেতো না–যেমন অবক্ষয়ের কালের রোমের নারীরা স্বাধীনতা পেয়েছিলো শুধু পাপের মধ্য দিয়ে। নেতিবাচকতা তখনও ছিলো নারীর নিয়তি, যেহেতু তাদের মুক্তি ছিলো নেতিবাচক।
এমন অবস্থায় নারীর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নেয়া, বা নিতান্ত তার উপস্থিতি জ্ঞাপন করাও ছিলো স্পষ্টতই বিরল। শ্রমজীবী শ্ৰেণীদের মধ্যে অর্থনীতিক পীড়ন দূর করে দিয়েছিলো লিঙ্গের অসাম্য, তবে এটা ব্যক্তিকে বঞ্চিত করেছিলো সব সুযোগ থেকে; অভিজাত ও বুর্জোয়াদের মধ্যে নারীরা ছিলো চোখ রাঙানির তলে : নারীর ছিলো শুধু পরগাছার জীবন; তার কোনো শিক্ষা ছিলো না; শুধুমাত্র অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই সে পারতোকোনো বাস্তব পরিকল্পনা নিতে ও বাস্তবায়িত করতে। রাণীদের ও রাজপ্রতিভূদেরই ছিলো এ-দুর্লভ সুখ; তাদের সার্বভৌমত্ব তাদের উন্নীত করতোনিজেদের লিঙ্গ থেকে ওপরে। ফ্রান্সে সালিক আইন নারীদের নিষিদ্ধ করে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে; তবে স্বামীদের পাশে থেকে, বা স্বামীদের মৃত্যুর পরে, তারা কখনো কখনো মহাভূমিকা পালন করেছে, যেমন, পালন করেছেন সেইন্ট ক্লোতিলদা, সেইন্ট রাদেগোঁদ, এবং কাস্তিলের ব্লাশ। সন্ন্যাসিনীদের মঠে বাস নারীদের মুক্ত করতো পুরুষ থেকে : কিছু মঠাধ্যক্ষা ছিলেন খুবই ক্ষমতাশালী। এলোইজ মঠাধ্যক্ষা হিশেবে যতোটা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ততোটা খ্যাতিই অর্জন করেছিলেন প্রেমের জন্যে। যে-অতীন্দ্রিয় সম্পর্ক তাদের জড়িয়ে রাখতো ঈশ্বরের সাথে, তার থেকে নারী-আত্মা লাভ করতে সব প্রেরণা ও পুরুষ-আত্মার শক্তি; এবং সমাজ তাদের প্রতি যে-ভক্তি দেখাতো, তা তাদের শক্তি যোগাতো কঠিন সব কাজ সম্পন্ন করতে। জোয়ান অফ আর্কের দুঃসাহসিক কাজে রয়েছে কিছুটা অলৌকিকতা; এছাড়া এটা ছিলো এক সংক্ষিপ্ত ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসিক কাজ। তবে সিয়েনার সেইন্ট ক্যাথেরিনের কাহিনী তাৎপর্যপূর্ণ; এক স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে বাস করে সিয়েনায় তিনি অর্জন করেন মহাসুখ্যাতি তার সক্রিয় হিতসাধনের সংকল্পের মধ্য দিয়ে। ঐশ্বরিক অধিকার বলে রাণীরা এবং উজ্জ্বল গুণাবলির জন্য সন্তরা লাভ করতেন এমন সামাজিক সমর্থন, যা তাদের সমর্থ করতো পুরুষের সমান হয়েকাজ করতে। এর বিপরীতে অন্য নারীদের কাছে চাওয়া হতো বিনীত নিশ্চুপতা।
মোটামুটিভাবে, মধ্যযুগের পুরুষ নারী সম্পর্কে পোষণ করতো বিরূপ ধারণা। প্রণয়াবেদনমূলক কবিতার কবিরা প্রেমকে করে তুলেছিলেন মর্যাদাসম্পন্ন; রম্যা দ্য লা রোজ-এ তরুণদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে দয়িতাদের তুষ্টিতে আত্মনিয়োগ করার জন্যে। তবে এ-সাহিত্যের (ক্রবাদুরদের সাহিত্য দিয়ে অনুপ্রাণিত) বিপরীতে ছিলো বুর্জোয়াপ্রেরণার সাহিত্য যাতে নারীদের আক্রমণ করা হয়েছে হিংস্রভাবে : উপকথা, রম্যোপাখ্যান এবং গাথায়তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে আলস্যের, ছেনালিপনার এবং কামুকতার। তাদের নিকৃষ্টতম শত্রু ছিলো যাজকেরা, যারা দোষ চাপাতো বিয়ের ওপর। গির্জা বিয়েকে পরিণত করেছিলো এক পবিত্র ভাবগম্ভীর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, আবার তা নিষিদ্ধ করেছিলো খ্রিস্টীয় অভিজাতদের জন্যে : ‘নারী নিয়েঝগড়া’র মূলেই ছিলো একটা অসঙ্গতি। বহু যাজক নারীদের দোষত্রুটি, বিয়ের মধ্যে পুরুষের শহিদত্বের যন্ত্রণা, ও আরো বহু কিছু সম্পর্কে লিখেছে’ বিলাপ’ ও তীব্র ভৎসনা; এবং তাদের বিরোধীপক্ষ দেখাতে চেয়েছে নারীর শ্রেষ্ঠত্ব। এ-ঝগড়া চলেছে পঞ্চদশ শতক ধরে, যতোদিন না আমরা দেখতে পাই প্রথম একজন নারী তার লিঙ্গের পক্ষে কলম ধরেছেন, যখন ক্রিস্তিন দ্য পিসা তাঁর এপিত্র ও দিয়ো দ’আমুর-এ চালান যাজকদের বিরুদ্ধে এক প্রাণবন্ত আক্রমণ। পরে তিনি মত দেন যে যদি বালিকাদের ঠিকভাবে শিক্ষা দেয়া হতো, তাহলে তারাও ছেলেদের মতো ‘বুঝতে পারতো সব কলা ও বিজ্ঞানের সূক্ষতা’। ওই সাহিত্যিক যুদ্ধের ফলে নারীদের অবস্থার কোনোই বদল ঘটে নি; ওই ‘ঝগড়া’ ছিলো এমন এক প্রপঞ্চ, যা সামাজিক প্রবণতাকে বদলে দেয়নি, বরং ঘটিয়েছে তার প্রতিফলন।