- বইয়ের নামঃ নারী
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
নিষিদ্ধ নারী মুক্ত নারী
ভূমিকা
নারী প্ৰথম বই আকারে বেরিয়েছিলো ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো, এবং মেলার শেষ দিকে বেরোতে-না-বেরোতেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো প্রথম সংস্করণ। শুরু থেকেই নারী উপভোগ করে অশেষ জনপ্রিয়তা, এবং প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় বদ্ধ প্রথাগতদের, ও উল্লসিত অনুপ্রাণিত করে ভবিষ্যৎমুখিদের। বইটি অল্প সময়েই বদলে দেয় নারী সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা। তখনও অনেক বাকি ছিলো। লেখার, সংস্করণ পরম্পরায় আমি যোগ করতে থাকি নতুন নতুন বিষয়; বেরোতে থাকে একের পর এক পুনর্মুদ্রণ। নারী নন্দিত হয়েছিলো ব্যাপকভাবে, এবং হয়ে উঠেছিলো মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য। আমিও লক্ষ্য হয়ে উঠি আক্রমণের। প্রকাশের তিন বছর পর জানতে পারি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বইটি নিষিদ্ধ করার, তারপর অনেক দিন কিছু শুনি নি; হঠাৎ ১৯ নভেম্বর ১৯৯৫-এ আমার অনুজ টেলিফোনে জানায় যে নারী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদী সরকার তখন বিপন্ন, তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে, চলছে তীব্র আন্দোলন; পতনের আগে তাড়াহুড়ো ক’রে তারা নিষিদ্ধ ক’রে যায় বইটি। বইটিকে যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা আমি নিশ্চিতভাবে জানতে পারি। পরদিন পত্রিকা পড়ে। নারী নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছিলো, কিন্তু প্ৰতিবাদে আমাদের কোনো সরকারই বিচলিত হয় না, আটলতায় তারা অদ্বিতীয়। বাংলাবাজার পত্রিক প্রথম পাতায় প্ৰকাশ করে দীর্ঘ প্রতিবেদন, যার শিরোনাম ছিলো ‘নারী বাজেয়াপ্ত, লেখক হুমায়ুন আজাদ বললেন আমার হাসি পেয়েছে, একদিন ওরাই অনুতপ্ত হবে; বিভিন্ন পত্রিকায় লে রোতে থাকে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়। সংবাদ-এ সম্পাদকীয় বেরোয় ‘নারী’, ডেইলি স্টার-এ সম্পাদকীয় বেরোয় ‘এ ফুলিশ ব্যান’; আমেরিকার “উইমেন্স ওয়ার্ল্ড” দীর্ঘ প্ৰবন্ধ প্ৰকাশ করে ‘ঢাকা ব্যান্স হুমায়ুন আজাদস নারী’ নামে। এমন বহু সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় বেরিয়ে জানায় যে বইটির নিষিদ্ধকরণ তারা মেনে নেন নি। বিবেকের কাছে আমাদের কোনো সরকার কখনো পরাস্ত হয় নি; জাতীয়তাবাদীরাও হয় নি।
নারী নিষিদ্ধ করা কি ঠিক হয়েছে?– আমার মনে প্রশ্ন জাগে। আমি বিনোদনকারী নই; আমার অনেক কিছুই আপত্তিকর প্রথাগতদের কাছে; আমি তো কিছুই মেনে নিই নি, যা তাদের পুজোর বিষয়। আমার সব বইই কি নিষিদ্ধ হতে পারে না? কিন্তু প্রকৃত বইকে কেউ নিষিদ্ধ করে রাখতে পারে না; যারা নিষিদ্ধ করে, তারা ধ্বংস হয়, বেঁচে থাকে বই। এ-পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়েছে যতো প্রকৃত বই, সেগুলোর কোনাটিই লুপ্ত হয়ে যায় নি, আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে; দেখিয়ে দিয়েছে যারা নিষিদ্ধ করেছে, তারাই ছিলো ভ্ৰান্ত। কী অপরাধে নিষিদ্ধ করেছে বইটি? সরকার আমাকে কিছুই জানায় নি; তাই আমি দু-একজন অনুরাগীকে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করি। কাগজপত্র পেয়ে আমি বেদনার্ত হই; দেখি নারী নিষিদ্ধকরণের আদেশ প্রচারিত হয়েছে। একজন সহকারী সচিবের স্বাক্ষরে, যে নারী। আদেশে বলা হয়েছে ‘পুস্তকটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তথা মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী আপত্তিকর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় সরকার কর্তৃক ফৌজদারী কার্যবিধির ৯৯ “ক” ধারার ক্ষমতা বলে বর্ণিত পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত হইল…।’ সাথে দু-পাতার একটি সুপারিশ, যা করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুটি বিশেষজ্ঞ–একটি দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগের, আরেকটি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক:- তারা এ-বিশাল বইটি থেকে ১৪টি বাক্য উদ্ধৃত ক’রে পরামর্শ দিয়েছে : উপরোক্ত উদ্ধৃতি ও মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বইটি বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করা যায়।’ এতো বড়ো বইটি পড়ার শক্তি ওই দুই মৌলবাদীর ছিলো না; তারা বইটি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে পরামর্শ দেয় নিষিদ্ধ করার। ওইগুলোর মধ্যে রয়েছে– ‘নারীর প্রধান শক্ৰ এখন মৌলবাদী’, ‘১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্বমুহুর্তে সৌদি আরবের মতো আদিম পিতৃতন্ত্রও নারীদের ঘর থেকে বের করে লাগিয়েছে নানা কাজে’ ধরনের বাক্য। নারীর নিষিদ্ধকরণ আমি মেনে নিই নি, বইটি নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৫-এ আবেদন করি উচ্চবিচারালয়ে; আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, ইদ্রিসুর রহমান, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির, শিরীন শারমিন চৌধুরী। বইটি নিষিদ্ধকরণ আদেশকে কেনো অবৈধ বলে গণ্য করা হবে না, ৭ দিনের মধ্যে তার কারণ দর্শানোর জন্যে স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আরো দুজনকে নির্দেশ দেয় উচ্চবিচারালয়। বামন কুৎসিত মৌলবাদী একটি লোক আমার সাথে দেখা করে, সে জানায় তারই আবেদনে নিষিদ্ধ হয়েছে নারী, আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। তারপর কেটে যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর; কিছুই শোনা যায় না, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, মামলার কথা প্ৰায় ভুলে যাই।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০০০-এ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এক ডিভিশন বেঞ্চে নারীর মামলাটি গ্রহণ করার আবেদন করেন; তাব আবেদন গৃহীত হয়ে যায। আমি কৃতজ্ঞ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছে। আমি জানতামও না তিনি আবেদন করেছেন, পরের দিন জানতে পারি; তারপর দ্রুত এগোয় মামলাটি; ৭ মার্চ ২০০০-এ দুজন বিচারপতি রায় দেন যে নারী নিষিদ্ধকরণ আদেশ অবৈধ। আমি উপস্থিত ছিলাম, প্রথম বুঝতে পারি নি যে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হযে গেছে। যখন বুঝতে পারি তখন উল্লসিত হয়ে উঠতে পারি নি, আমি বেদনা বোধ করতে থাকি দেশের কথা ভেবে। এ কী বদ্ধ অন্ধ সমাজের লেখক আমি, যেখানে অবৈধভাবে একটি বই নিষিদ্ধ হয়ে থাকে বছরের পর বছর ; এটি যে একটি ঐতিহাসিক যুগান্তরকারী রায়, তা বুঝতে পারে নি আমাদের পত্রিকাগুলোও পরের দিন দেখি তারা মেতে আছে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে, চিন্তা ও বক্তব্য প্রকাশের আমাদের রয়েছে যে-সাংবিধানিক অধিকার, যা মেনে চলছিলো না। সরকারগুলো, আমাদের উচ্চবিচারালয় যে বক্তব্য প্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা বুঝে উঠতে পারেন নি তাঁরা। অশুভ তাঁরা বোঝেন, শুভ বোঝেন না। নারী সম্ভবত বাঙলাদেশে একমাত্র বই যেটি উচ্চবিচারালয়ের আদেশে পেয়েছে। পুনপ্রকাশের অধিকার; এটি এক বিরাট ঘটনা- শুধু নারীর জন্যে নয়, বাঙলাদেশের চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতার জন্যেও। কোনো মৌলিক লেখকই মেনে নিতে পারে না প্রথাগত বিশ্বাস, সিদ্ধান্ত, নির্দেশ; তার কাজ ওসব বিশ্বাস সিদ্ধান্ত নির্দেশ অতিক্রম করে যাওয়া, যদিও আমাদের লেখকেরা প্রথাগত বিশ্বাস সিদ্ধান্ত নির্দেশেই স্বস্তি বোধ করেন। রাষ্ট্রের উচিত নয় কোনো ভাবাদর্শ অধিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া; কেননা সমস্ত ভাবাদৰ্শই ভুল ও অচিরস্থায়ী। ধর্মানুভূতি এক বাজে কথা, এটা বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রমাণ সম্ভব নয়। রাষ্ট্র বিশ্বাস করতে পারে ভুতপ্রেতে, কিন্তু কোনো মননশীল মানুষের পক্ষে তা মেনে নেয়া অসম্ভব। পৃথিবী এখন যেসব বিশ্বাস পোষণ করে, তার সবই ভুল, কেননা সেগুলো পৌরাণিক; রাষ্ট্রগুলো আজো আমাদের পৌরাণিক জগতে বাস করতে বাধ্য করে। আমি পৌরাণিক সংস্কৃতি ও অসভ্যতা থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই; নারীর পাতায় পাতায় সেই অভিলাষ রয়েছে। অজস্র পাঠক অপেক্ষা ক’রে ছিলেন নারীর জন্যে; আমি সুখী যে বইটি আবার তাদের হাতে পৌঁছোলো।
হুমায়ুন আজাদ
অবতরণিকা : তৃতীয় সংস্করণ
বিশশতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি পৌঁছে আজ খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা;- গ্ৰহ ভ’রে মানুষ আজ মত্ত পাশবিক আচরণে; মানুষ হনন ক’রে চলছে মানুষ; মানুষ বন্দী আর পীড়ন ক’রে চলছে মানুষকে। কয়েক বছর আগে নারী লিখেছিলাম মানুষের পরাভূত লিঙ্গটির মুক্তির প্রস্তাব হিশেবে; এখন দেখছি মানুষের হাত থেকে উদ্ধার করা দরকার নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গকেই। আমি পেশাদার নারীউন্নয়নজীবী নই; নারীর উন্নয়নের জন্যে আমি সংস্থা খুলি নি; আমি লিখেছি। একটি বই। বইটির খ্যাতি আমাকে যেমন সুখী করে, তেমনি অভিভূত করে এজন্যে যে বইটি নারীসম্পর্কে আমাদের প্রথাগত দৃষ্টি অনেকখানি বদলাতে সাহায্য করেছে। তবে এটি শুধু নারীমুক্তির প্রস্তাব নয়; এটি মানুষ প্রজাতিরই মুক্তির প্রস্তাব। বইটিতে আমি প্রথাগত প্ৰায়-সমস্ত চিন্তা আর ভাবাদর্শ বাতিল করেছি; কেননা প্রথাগত চিন্তাধারা মানুষের মুক্তির বিরোধী। কোনো কিছুরই শাশ্বত মহত্ত্বে আমার বিশ্বাস নেই; কোনো কিছু মহৎ বলে প্রচারিত ব’লেই তা বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে হবে, তাও আমি মনে করি না। তাই প্রথাগত সমস্ত কিছু সম্পর্কেই আমি প্রশ্ন তুলেছি; বৈজ্ঞানিক রীতিতে বাতিল করেছি। পৃথিবী জুড়েই মানুষ নিজের কাঠামোতে বাঁচে না; বেঁচে থাকতে বাধ্য হয় অন্যের কাঠামোতে; ওই কাঠামো তাকে বন্দী ক’রে রাখে। অন্যের কাঠামোতে সবচেয়ে বেশি বাস করে নারী; অন্যের কাঠামোতে বাস করে করে নারী বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।
মানুষের এক বড়ো সমস্যা ভাবাদর্শ। মানুষকে বিভিন্ন ভাবাদর্শের মধ্যে বাস করতে হয়; এবং মানুষকে শেখানো হয়েছে যে ভাবাদর্শের মধ্যে বাস করাই শ্ৰেষ্ঠ কাজ। তবে মানুষ জন্মেছে মানুষরূপে বাস করার জন্যে, ভাবাদর্শ যাপনের জন্যে নয়। ভাবাদর্শের এক মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে তা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে; যেমন আজকাল দেখা দিচ্ছে মৌলবাদী ভাবাদর্শ। মৌলবাদী ভাবাদর্শ হচ্ছে বন্দী করার ভাবাদর্শ; তা একগোত্র মধ্যযুগীয় মানুষের দখলে আনতে চায় মানবসমাজকে। মৌলবাদ মানুষের বিকাশের বিরোধী; আর মৌলবাদ যেহেতু পীড়নবাদ, তাই পীড়ন করে সব কিছুকে। নারী তার পীড়নের প্রধান লক্ষ্য। মৌলবাদ প্রতিষ্ঠিত হ’লে নারীর মুখ আর দেখা যাবে না;–তাকে পথে দেখা যাবে না, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাবে না; একেবারেই দেখা যাবে না কোনো কর্মস্থলে। নারী হবে নিষিদ্ধ; আর সব কিছু হবে নারীর জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু পৃথিবীটা মানুষের–নারীর ও পুরুষের; উভয়ে মিলেই বিকাশ ঘটাবে সভ্যতা ও মানুষের। তাই দরকার মৌলবাদ সম্পর্কে সাবধান থাকা; বিশেষ ক’রে নারীকে সাবধান থাকতে হবে; কেননা ওই মতবাদে নারী সত্তাহীন প্ৰাণী।
বাঙলাদেশ প্রতিমুহূর্তে হয়ে উঠছে পূৰ্ববতী মুহুর্তের থেকে অধিক মধ্যযুগীয়; খুব দ্রুত এখানে লোপ পাচ্ছে মুক্তচিন্তার অধিকার। দিকে দিকে এখন প্রচার পাচ্ছে পুরোনো বুলি; পুরোনো বুলির অসার মহত্ত্বে সবাই এখন মুগ্ধ। সবাই ভয় পাচ্ছে সত্যকে, আর মিথ্যেকেই আঁকড়ে ধরছে সত্য বলে। এর মূলে রয়েছে বাঙলাদেশের রাজনীতি, যা মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে চলছে। এ-রাজনীতি নারীকে ঠেলে দিচ্ছে চরম অন্ধকারের দিকে। ষাটের দশকেও নারীরা যতোটা অগ্রসর ছিলো, এখন আর তা নেই; তারা পিছিয়ে পড়ছে-চিন্তা ও জীবনের সব দিকে; শিক্ষিত নারীরাও আজকাল যে-সব বিশ্বাস পোষণ করেন, তার থেকে শোচনীয় অপবিশ্বাস আর হয় না। এমন এক ধারণা প্রচলিত হচ্ছে এখন যেনো পৃথিবীতে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে; আমাদের কাজ ওই সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলে জীবন সার্থক করা। কিন্তু সত্য হচ্ছে মানুষ আরো কয়েক কোটি বছর টিকে থাকবে; তার ভবিষ্যৎ গত তিন হাজার বছরের নির্দেশে চলতে পারে না।
অতীত হচ্ছে অতীত :- অতীতকে জানতে হবে, কিন্তু অতীতের বিধানে চলা হাস্যকর ও শোককর। কিন্তু অতীত আমাদের ওপর বোঝার মতো চেপে আছে; দিন দিন তার বোঝা আরো বাড়ছে। মানুষকে আমি ওই বোঝা থেকে মুক্ত দেখতে চাই; তাই নারীতে প্রবলভাবে পেশ করা হয়েছে অতীত বিরোধিতা। মানুষ কতোটা মুক্ত তার একটি মানদণ্ড হচ্ছে সে অতীত থেকে কতোটা মুক্ত। বইটি শুধু নারীমুক্তির প্রস্তাব নয়; এটি বর্তমান সভ্যতাকেই বদলে দেয়ার প্রস্তাব। তাই নারী যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে; তেমনি, খুবই সচেতন আমি, প্রতিপক্ষও জুটেছে প্রচুর। আমি নিয়মিত প্ৰগতিবিরোধী প্রতিপক্ষের সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করি। কিছু আগে এক মৌলবাদীগোত্র আমাকে মুরতাদ, শব্দটির কী অর্থ আমি জানি না, উপাধি দিয়েছে; একটি গোত্র হত্যার সংক্ষিপ্ত তালিকায় রেখে আমাকে সম্মানিত করেছে। আমার মাতৃভূমি হয়ে উঠেছে এমনই মর্মস্পশী ও ভয়াবহ। বাঙালি মুসলমানের এটা এক বড়ো দুৰ্ভাগ্য; তারা বিকশিত হতে চায় না; তারা জীবিত প্ৰতিভাদের হত্যা করতে চায়,–আমি অবশ্য প্রতিভা নাই–, আর মৃতদের মাজারে মোমবাতি জ্বলে। কেউ কেউ কাজ করছে আরো নিপুণভাবে; তারা গোপনে চক্রান্ত করছে বইটির বিরুদ্ধে; যাতে বইটিকে বিলুপ্ত করে দেয়া যায়, তার উপায় খুঁজছে তারা। আমি আশা করবো অমন কলঙ্ক ঘটবে না।
এ-সংস্করণে যোগ করা হলো একটি পরিচ্ছেদ, যার নাম ‘ধর্ষণ’। এটি যোগ করার কারণ ধর্ষণ নারীপীড়নের চরম রূপ; এবং এখনকার বাঙলাদেশ ধর্ষণপ্রবণ। যখন পরিচ্ছেদটি লিখছিলাম, তখনই ব্ৰজমোহনে দলবেঁধে ছাত্ররা ধর্ষণ করে একটি ছাত্রীকে; আর দিনাজপুরে পুলিশ দলবেঁধে ধর্ষণ ও হত্যা করে একটি কিশোরীকে, যার ফলে দেখা দেয় গণঅভ্যুত্থান; নিহত হয় দশজন বিবেকী পুরুষ। এছাড়াও বইটিতেই করা হয়েছে নানা সংশোধন ও সংযোজন, যা বইটিকে দিয়েছে পরিশুদ্ধ রূপ।
হুমায়ুন আজাদ
অবতরণিকা [অংশ] – প্ৰথম সংস্করণ
নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী : কথাটি ভার্জিনিয়া উলফের, যিনি নিজের বা নারীর জন্যে একটি নিজস্ব কক্ষ চেয়েছিলেন, কিন্তু পান নি। ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছে প্রতিপক্ষের সবাই; শুধু যার সম্পর্কে আলোচনা, সে-ই বিশেষ সুযোগ পায় নি অংশ নেয়ার। প্রতিপক্ষটির নাম পুরুষ, নিজের বানানো অলীক বিধাতার পার্থিব প্রতিনিধি; আর পুরুষমাত্রই প্রতিভাবান, তার বিধাতার চেয়েও প্রতিভাদীপ্ত;–অন্ধ ও বধির, লম্পট ও ঋষি, পাপী ও প্রেরিতপুরুষ, দালাল ও দার্শনিক, কবি ও কামুক, বালক ও বৈজ্ঞানিক, অর্থাৎ পুরুষপ্রজাতির সবাই অংশ নিয়েছে নারী সম্পর্কে অন্তত একটি শ্লোক রচনায়। ওই সব শ্লোক অশ্লীল আবর্জনার মতো। প্রতিপক্ষ কখনো কারো মূল্য বা অধিকার স্বীকার করে না; এমনকি অস্তিত্বই স্বীকার করে না অনেক সময়। তাই পুরুষেরা নারী সম্পর্কে কয়েক হাজার বছরে রচনা করেছে যে-সব শ্লোক-বিধি-বিধান, তার সবটাই সন্দেহজনক ও আপত্তিকর। পুরুষ নারীকে দেখে দাসীরূপে, ক’রে রেখেছে দাসী; তবে স্বার্থে ও ভয়ে কখনো কখনো স্তব করে দেবীরূপে। পুরুষ এমন প্ৰাণী, যার নিন্দায় সামান্য সত্য থাকতে পারে; তবে তার স্তব সুপরিকল্পিত প্রতারণা। পুরুষ সাধারণত প্রতারণাই ক’রে এসেছে নারীকে; তবে উনিশশতক থেকে একগোত্র পুরুষ লড়াই করেছেন নারীর পক্ষে।
পুরুষ নারীকে সাজিয়েছে অসংখ্য কুৎসিত অভিধায়; তাকে বন্দী করার জন্যে তৈরি করেছে। পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্র; উদ্ভাবন করেছে ঈশ্বর, নিয়ে এসেছে প্রেরিতপুরুষ; লিখেছে ধর্মগ্রন্থ, অজস্র দর্শন, কাব্য, মহাকাব্য; সৃষ্টি করেছে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ও আরো অসংখ্য শাস্ত্ৰ। এতো অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয় নি কোনো সেনাবাহিনী। এর কারণ পুরুষের যৌথচেতনায় মহাজাগতিক ভীতির মতো বিরাজ করে নারী। তাই নারীর কোনো স্বাধীনতা স্বীকার করে নি পুরুষ। পুরুষ এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে, যা নারীকে সম্পূর্ণ বন্দী করতে না পারলে ধ্বংস হয়ে যাবে ব’লে পুরুষের ভয় রয়েছে। এর নাম পিতৃতান্ত্রিক, বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা। পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার প্রথম শোষকশ্রেণী পুরুষ, প্রথম শোষিতশ্রেণী নারী। এ-সভ্যতার সব কেন্দ্ৰেই রয়েছ পুরুষ। পুরুষ একে সৃষ্টি করেছে তার স্বার্থে ও স্বপ্ন অনুসারে, এবং কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে। পুরুষতন্ত্রের সৌরলোকের সূর্য পুরুষ; নারী অন্ধকার। পুরুষ সব কিছু তৈরি করেছে নিজের কাঠামোতে;- তার বিধাতা পুরুষ, প্রেরিতপুরুষ পুরুষ, প্রথম সৃষ্টি পুরুষ; নারী ওই পুরুষের সংখ্যাতিরিক্ত অস্থিতে তৈরি পুতুল। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় পুরুষ মুখ্য, নারী গৌণ; পুরুষ শরীর, নারী ছায়া; পুরুষ প্ৰভু, নারী দাসী; পুরুষ ব্ৰাহ্মণ, নারী শূদ্রী। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা পুরুষের জয়গানে ও নারীর নিন্দায় মুখরিত। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় শয়তানের চেয়েও বেশি নিন্দিত নারী; শয়তান পুরুষ ব’লে তার জন্যেও গোপন দরদ রয়েছে পুরুষের, কিন্তু কোনো মায়া নেই নারীর জন্যে।
পৃথিবীতে শুধু নারীই শোষিত নয়, অধিকাংশ পুরুষও এখনো শৃঙ্খলিত ও শোষিত। তবে শোষিতশৃঙ্খলিত নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য : সব শ্রেণীর পুরুষ বন্দী ও শোষিত নয়, কিন্তু সব শ্রেণীর নারীই বন্দী ও শোষিত। নারীশোষণে বুর্জোয়া ও সর্বহারায় কোনো পার্থক্য নেই; বুর্জোয়া পুরুষ শুধু সর্বহারা শ্রেণীটিকে শোষণ করে না, শোষণ করে তার নিজের শ্রেণীর নারীকেও; আর সর্বহারা পুরুষ নিজে শোষিত হয়েও অন্যকে শোষণ করতে দ্বিধা করে না, সে শোষণ করে নিজের শ্রেণীর নারীকে। বিত্তবান শ্রেণীর নারী পরগাছার পরগাছা, বিত্তহীন শ্রেণীর নারী দাসের দাসী। শোষণে সব শ্রেণীর পুরুষ অভিন্ন; শোষণে মিল রয়েছে মার্কিন কোটিপতির সাথে বিকলাঙ্গ বাঙালি ভিখিরির, তারা উভয়েই পুরুষ, মানবপজাতির রত্ন। নারীমাত্রই দ্বিগুণ শোষিত। মাওসেতুং আর গিনির সেকো তোরের দুটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। মাও বলেছেন, ‘বিপ্লবের আগে চীনের পুরুষদের বইতে হতো সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, ও সাম্রাজ্যবাদের তিনটি পর্বত, আর চীনের নারীদের বইতে হতো চারটি পর্বত–চতুর্থটি পুরুষ।‘ সেকো তোরে তীব্র ভাষায় বলেছেন, গিনির নারীরা ‘ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী [দ্ৰ নিউল্যান্ড (১৯৭৯, ১১১)]। ওই নারীরা গিনীয় ও ফরাশি উভয় জাতের পুরুষদের দ্বারাই শোষিত। নারীর প্ৰভু ও শোষক সব পুরুষ; অন্ধও নারীর শোষক, উন্মাদও নারীর প্রভু। পুরুষতন্ত্র সমস্ত জাতিধৰ্মবৰ্ণশ্রেণী অতিক্রম ক’রে যায়। কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণী নারীর শোষক নয় ব’লে, পুরুষতন্ত্রই যেহেতু নারীর শোষক, তাই সামাজিক বিপ্লবের ফলে পুরুষ মুক্তি পেলেও নারী মুক্তি পায় না, নারীকে মুক্তি দেযা হয় না। ফরাশি বিপ্লব ভুলে যায় নারীর কথা; সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা প্রযোজ্য হয় শুধু পুরুষের ক্ষেত্রে; আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও কিছু দিনের মধ্যেই তার সব প্রতিশ্রুতি ভুলে নারীকে জড়ায় পুরুষতন্ত্রের শেকলে–সৰ্বাহারার একনায়কত্বে একনায়কত্ব করে পুরুষতন্ত্র। তাই নারীই এখন বিশুদ্ধ শোষিত ও সর্বহারী। তার ন্যূনতম যা দরকার, তা হচ্ছে মুক্তি।
পুরুষতন্ত্র নারীকে নিয়োগ করেছে একরাশ ভূমিকায় বা দায়িত্বে। নারীকে নিয়োগ করেছে কন্যা, মাতা, গৃহিণীর ভূমিকায়; এবং তাকে দেখতে চায় সুকন্যা, সুমাতা, সুগৃহিণীরূপে। কোনো নিম্নপদকে অসার মহিমা দিতে হ’লে পদগুলোকে সুভাষিত করতে হয়; পুরুষতন্ত্ৰও নারীর ভূমিকাগুলোকে সুভাষিত করেছে, সেগুলোর সাথে জড়িয়ে দিয়েছে বড়ো বড়ো ভাব। তবে ওই ভূমিকাগুলোর গৃঢ় তাৎপর্য একটি শব্দেই প্রকাশ পায় : শব্দটি দাসী। এ-অঞ্চলে দেবী শব্দটি দাসীরই সুভাষণ। পুরুষতন্ত্র শুধু বলপ্রয়োগ ক’রে অধীনে রাখতে চায় নি নারীকে, তাকে স্তবস্তৃতিও পান করিয়েছে। পুরুষ কখনো মনে করে নি যে তার জীবনের সার্থকতা পুত্র, পিতা, গৃহস্থ হওয়াতেই; বরং এ-ভূমিকাগুলো পেরিয়ে যাওয়াকেই মনে করেছে পৌরুষ; কিন্তু নারীর সার্থকতা নির্দেশ করেছে কয়েকটি তুচ্ছ ভূমিকা পালনে। পুরুষ নারীকে গৃহে বন্দী করেছে, তাকে সতীত্ব শিখিয়েছে, সতীত্বকে নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকেই ক’রে তুলেছে নিজের গৌরব। পুরুষ উদ্ভাবন করেছে নারী সম্পর্কে একটি বড়ো মিথ্যা, যাকে সে বলেছে চিরন্তনী নারী। তাকে বলেছে দেবী, শাশ্বতী, কল্যাণী, গৃহলক্ষ্মী, অর্ধেক কল্পনা; কিন্তু পুরুষ চেয়েছে ‘চিরন্তনী দাসী’। পশ্চিমে নারীরা শোষিত, তবে মানুষ-পুরুষ দ্বারা শোষিত; আমাদের অঞ্চলে নারীরা শোষিত পশু-পুরুষ দ্বারা। এখানে পুরুষেরা পশুরই গোত্রীয়, তাই বঙ্গীয়, ভারতীয়, আর পূর্বাঞ্চলীয় নারীরা যে-শোষণপীড়নের শিকার হয়েছে, পশ্চিমের নারীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। বাঙলায় নারীরা এখনো পশুদের দাসী। পশ্চিমে নারীমুক্তির যে-আন্দোলন চলছে, তার ঢেউ এখানে এসে এখনো ভালোভাবে লাগে নি। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাঙলায় নারীদের শিক্ষার যে-ধারা শুরু হয়, তার উদ্দেশ্য নারীকে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত করা নয়, তার লক্ষ্য উন্নতজাতের স্ত্রী বা শয্যাসঙ্গিনী উৎপাদন। নারীশিক্ষাও প্ৰভু পুরুষেরই স্বার্থে। বিবাহ এখানে নারীদের পেশা। বাঙলাদেশে যারা নারীদের কল্যাণ চান, তারা মনে করেন নারীর কল্যাণ শুভবিবাহে, সুখী গৃহে; স্বামীর একটি মাংসল পুতুল হওয়াকেই তারা মনে করেন নারীজীবনের সার্থকতা। স্বামী যদি ভাতকাপড় দেয়, তার ওপর দেয় লিপষ্টিক নখপালিশ ইত্যাদি, এবং আর বিয়ে না করে, করলেও অনুমতি নিয়ে করে, বা তালাক না দিয়ে চার স্ত্রীকেই দেখে ‘সমান চোখে’, তাহলেই নারীকল্যাণপিপাসুরা পরিতৃপ্ত, ও তাদের আন্দোলন সফল ভেবে ধন্য বোধ করেন। তাঁরা আসলে পুরুষতন্ত্রের শিকার; তারা নারীকে দেখতে চান সচ্ছল দাসীরূপে। নারীর জন্যে এর চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছু হ’তে পারে না। তারা মানুষ হিশেবে নারীর অধিকার আদায্যের আন্দোলন করেন না, তাদের আন্দোলন হচ্ছে স্বামীতন্ত্রের কাছে স্ত্রীতন্ত্রের আবেদননিবেদন। বিয়ে, স্বামী, সন্তান, গৃহ, সুখ, প্ৰেম মধুর বাজে কথা; এগুলোতে নারীর মুক্তি নেই, এগুলোতেই বন্দী নারী। পশ্চিমের নারীবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেছে এসব। নারীবাদীরা পশ্চিমের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে দিয়েছে একটা বড়ো নাড়া, ও বদলে দিয়েছে অনেকটা, যদিও তাদের চূড়ান্ত সাফল্য আজো সুদূরে। পুরুষতন্ত্রের মতো কয়েক হাজার বছরের একটি বড়ো রকমের চক্রান্তকে, পীড়ন যন্ত্রকে, দু-চার দশকে, বা দু-এক শতকে নিক্রিয় ক’রে দেয়া অসম্ভব।
পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বয়স কয়েক সহস্ৰক; কিন্তু পৃথিবী ও মানবপ্রজাতি, যদি কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, টিকে থাকবে আরো কয়েক কোটি বছর। তাই পুরুষতন্ত্রই শাশ্বত ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ, এটা ভাবার কারণ নেই। বাঙলাদেশের এক অবরুদ্ধ সুলতানা নারীস্থানের বা নারী তন্ত্রের যে-স্বপ্ন দেখেছিলো, তা যে ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে না, বা নারীপুরুষের সাম্যভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না, এমন ধারণা অযৌক্তিক। পশ্চিমের নারীবাদীরা গত চার দশকে, সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর (১৯৪৯) প্রকাশকাল থেকে, নারীবিষয়ক যে-সব গ্রন্থ লিখেছেন, সেগুলোর অসাধারণত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই। তাদের ব্যাখ্যা, ভাষ্য, প্ৰস্তাব মেধাপ্রতিভা, ও সাহসের উজ্জ্বল উদাহরণ। নারী সম্পর্কে তাদের মূল বক্তব্য এখনো আমাদের এখানে এসে পৌঁছে নি; বা মধ্যযুগের অধিবাসী আমরা এখনো এতোটা সাহসী হতে পারি নি যে তাদের বক্তব্য নিৰ্ভয়ে পেশ করবো। পুরুষতন্ত্রের নানা রকম পুলিশ এখানে নানাভাবে সক্রিয়। নারীবাদের ঠিক সংবাদ আমরা পাই নি, তবে বিকৃত সংবাদ পেয়েছি অনেক; এবং এখানকার পুরুষতন্ত্র একথা প্রচার করতে সফল হয়েছে যে নারীবাদ হচ্ছে বিকার। নারী-অধিকারবাদীরাও এখানে নারীবাদের কথা শুনলে ভয় পান, নিজেদের নারীবাদী বলতে নববধুর মতো লজ্জা বোধ করেন। তাদের কাছে নারীবাদী এক কামুক নারী, যার কাজ পুরুষ থেকে পুরুষে ছোটা। এটা সত্যের চরম অপলাপ, নারীবাদের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের অশ্লীল অপপ্রচার। যিনি নারীপুরুষের সাম্যে ও সমান অধিকারে বিশ্বাস করেন, তিনিই নারীবাদী। আমাদের নারী-অধিকারবাদীরা নারীর অধিকারের চেয়ে স্ত্রীর অধিকার নিয়েই বেশি ব্যস্ত, তাঁরা স্ত্রীবাদী বা ভদ্রমহিলাবাদী। আমাদের অঞ্চলের দুটি গোত্র–হিন্দু ও মুসলমান–পুরুষতন্ত্রের প্রচণ্ড পুরোধা। পশ্চিমের নারীবাদীরা খুব ভদ্র মহিলা নন, তিরষ্কারকে আর তারা পুরুষতন্ত্রের একচেটে সম্পত্তি বলে মনে করেন না; তাই তাঁরা নিয়মিতভাবে তিরষ্কার করেন পুরুষদের। এক জাতের পুরুষদের তাঁরা বলেন মেল শভিনিষ্ট পিগ বা আত্মম্ভরী পুংশুয়োর বা পুংগর্বী শুয়োর, আমাদের অঞ্চলে সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থ, ধর্মীয় কারণে পুংগর্বীদেরই প্রাধান্য। তাই নারীবাদ যে এখানে নারীর মতোই নিষিদ্ধ থাকবে, এটা স্বাভাবিক । আমি এ-বইতে প্ৰকাশ করতে চেয়েছি নারীবাদীদের মূল বক্তব্য ও প্রস্তাবগুলো; বাঙলা ভাষা ও বাঙলাদেশের নারীদের পরিচয় থাকা দরকার এর সাথে।
বইটি লেখার জন্যে আমি নির্ভর করেছি। বহু বিদেশি বইয়ের ওপর। অনেক বই থেকে সরাসরি নিয়েছি : দ্য বোভোয়ার ও কেইট মিলেটির কাছে আমি বিশেষ ঋণী। তথ্যবিশ্লেষণের উৎস নির্দেশ করেছি। ব্যাপকভাবেই, তবে বইটিকে উৎসনির্দেশভারক্লান্ত না করার কথাও মনে রেখেছি। ব্যবহার করেছি উৎসনির্দেশের সাম্প্রতিক রীতি, পাদটীকার বদলে বইয়েয় শরীরেই নির্দেশ করা হয়েছে উৎস। যেমন : [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৫৪০)] বোঝায় সিমোন দ্য বোভোয়ারের ১৯৪৯-এ প্রকাশিত বইয়ের ৫৪০ পৃষ্ঠায় মিলবে তথ্য বা বিশ্লেষণটি; এবং ওই বই সম্পর্কে সব তথ্য পাওয়া যাবে রচনাপঞ্জিতে। এ-বইয়ে গ্রন্থনাম ছাপা হয়েছে বাঁকা অক্ষরে, আর প্রবন্ধ, গল্প, কবিতার নাম ছাপা হয়েছে একক উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরে। নারীর অর্ধেকের বেশি ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিলো সাপ্তাহিক পূর্বাভাস, ও খবরের কাগজ-এ।
নারীর প্রকাশ যে-সাড়া জাগিয়েছে, তা আমাকে অভিভূত করেছে। ১৯৯২-এর একুশের বইমেলায় এক সপ্তাহে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়; বহু পাঠক বইটি সংগ্ৰহ করতে এসে হতাশ হযে ফিরেছেন। বইটিতে সম্ভবত প্ৰকাশ পেয়েছে তাদের মনের কথা, ঘোষিত হয়েছে তাঁদের ইশতেহার।
হুমায়ুন আজাদ
অবতরণিকা : দ্বিতীয় সংস্করণ
নারী পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সবচেয়ে নিষিদ্ধ সপ্ৰাণ বস্তু। পুরুষ নারীকে আজো বস্তু, উপভোগ্যতম বস্তু, ব’লেই গণ্য করে; দিকে দিকে তাকে নিষিদ্ধ ক’রে রাখতে চায়, এবং তার জন্যে নিষিদ্ধ করে রাখতে চায় সব কিছু। এক উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রের মধ্যে বাস করি আমরা, যেখানে নারী অতিনিষিদ্ধ, নারীর অধিকার দাবি যেখানে দ্রোহিতা, নারী যেখানে দাসী ও ভোগ্যসামগ্ৰী। আমরা আজো আছি প্ৰথা, মধ্যযুগ ও তার নির্মম বিধিবিধানের মধ্যে। আমি প্রথাবিরোধী; প্ৰথা মানুষকে পশুস্তরে আটকে রাখে, বিকশিত হ’তে দেয় না; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নিরন্তর বিকশিত হওয়াই মনুষ্যত্ব। আজ প্রচণ্ডভাবে প্রথার প্রত্যাবর্তন ঘটানো হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে; প্রথার পক্ষে কথা বললে এখন অজস্র মুকুট মেলে, প্রথার বিরুদ্ধে গেলে জোটে অপমৃত্যু। রাষ্ট্রলিপ্সু রাজনীতিকেরা মানুষকে আজ উৎসর্গ ক’রে দিচ্ছে প্রথার পায়ে; ক্ষমতার জন্যে তারা মানুষকে পশুতে পরিণত করতেও প্ৰস্তৃত। তবে মানুষ প্রথার মধ্যে বাঁচতে পারে না, পশুও পারে না। প্রথা চিরজীবী নয়, কোনো প্রথা হাজার বছর ধরে চলে এসেছে ব’লেই তা শাশ্বত নয়; কোনো প্ৰথা মহাকাশ থেকে নামে নি, পুরুষতন্ত্রই সৃষ্টি করেছে সমস্ত প্ৰথা। তবে প্রথার স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটে না, প্রগতিশীল মানুষেরাই অবসান ঘটায় প্রথার। পৃথিবীতে কিছুই শাশ্বত চিরকালীন নয়। পৃথিবী টিকে থাকবে আরো কয়েক কোটি বছর, প্ৰথা আর পঞ্চাশ বছরও হয়তো টিকবে না; এক শতাব্দী পর উত্তরপুরুষদের কাছে আমাদের সমস্ত বিশ্বাসকে মনে হবে হাস্যকর অপবিশ্বাস। নারী বইটি আমি লিখেছি মানুষের এক বড়ো অংশের ওপর থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত নিষেধ তুলে নেয়ার জন্যে, নারীকে নিষিদ্ধ বস্তু থেকে মানুষের অধিকার দেয়ার জন্যে; আমাদের অন্ধকার অঞ্চলের সমস্ত প্রথার অবসান ঘটানোর জন্যে। নারী এখন এ-অঞ্চলে বিপন্ন; তার যে-সামান্য অধিকার কয়েক শতকে স্বীকার করা হয়েছে, তাও বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। চারপাশে প্রতিক্রিয়াশীলতা আজ প্রবল; প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রথম শিকার নারী। প্রতিক্রিয়াশীলেরা সমাজ দখল ক’রে প্রথমেই সমাজ থেকে বের ক’রে দেয় নারীকে, অর্থাৎ তার সব অধিকার বাতিল ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে তাকে ক’রে তুলে পুরুষের দাসী ও ভোগ্যবস্তু। বাঙলাদেশে নারী মুক্তি পায় নি, তবে তাকে শক্ত শেকল পরানোর আয়োজন চলছে আজ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কাজ ক’রে চলছে নারীর বিরুদ্ধে; এবং রয়েছে মধ্যযুগীয় মৌলবাদীরা, যারা নারীর দীক্ষিত শত্ৰু । আমাদের অঞ্চলের প্রগতিশীলেরাও প্রথাগত, তাদের ভেতরেও কুসংস্কারের অন্ত নেই; নারীবাদের কথা শুনলে তারাও মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন। তাদের প্রগতিশীলতা পুরুষপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রগতিশীলতা, সেখান থেকে নারী নির্বাসিত । এ-বইটি প্রথা ও পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আমি চাই নারীপুরুষের সার্বিক সাম্য।
নারী যে-সাড়া জাগিয়েছে, তা অভূতপর্ব। তবে এটাই স্বাভাবিক। তরুণবাঙলা আজ প্রথা পেরিয়ে যেতে চায়। প্রথাভাঙার কোনো পদ্ধতিকে আমরা সুস্থ সজীব রাখতে পারি নি; এখন প্রথাভাঙার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি নারী । নারী সহজ সুখকর বই নয়, তবুও যে এর প্রথম সংস্করণ ও পুনর্মুদ্ৰণ অল্প সময়ে নিঃশেষিত হয়ে যায়, তার কারণ প্রথাভাঙার সময় এসে গেছে। বইটিতে আমাদের বদ্ধ সমাজের পাঠকেরা বোধ করেছেন মুক্তি : যে-বিষয়ে অপরাধবোধ, দ্বিধা ও কপটতার সাথে কথা বলা বাঙালির স্বভাব, সে-বিষয়ের সমস্ত দরোজা আমি খুলে দিয়েছি। নারী নামক নিষিদ্ধ ও রুদ্ধ গৃহটি সম্ভবত বাঙলা ভাষায় এই প্রথম সম্পূর্ণ খুলে দেয়া হলো। অনেক তরুণী আমাকে জানিয়েছে। এ-বই পড়েই তারা জেনেছে তাদের একটি শরীর আছে, শরীরে নানা প্রত্যঙ্গ রয়েছে। এ ছাড়া আর যা জেনেছে তা জানার কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবে নি। এখন তাদের জন্মান্তর ঘটেছে। দ্বিতীয় সংস্করণে বইটির আয়তন বাড়লো, তবে যতোটা বাড়ানোর ইচ্ছে ছিলো ততোটা বাড়লো না : যুক্ত হলো দুটি নতুন পরিচ্ছেদ–নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা’, এবং নারীদের নারীরা ; নারীদের উপন্যাসে নারীভাবমূর্তি; আর ‘নির্ঘণ্ট’। প্রথম সংস্করণের মুদ্রণক্রটি সংশোধিত হলো, তবু কয়েকটি তুচ্ছ ত্রুটি চোখ এড়িয়ে রয়েই গেলো। বিভিন্ন পরিচ্ছেদে কিছুটা সংযোজনবর্জনও করা হয়েছে। ইচ্ছে ছিলো ‘মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটু : অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু’ পরিচ্ছেদটি বাড়ানোর; তাঁর অন্যান্য বই, বিশেষ করে, লেটার্স ব্রিটেন ডিউরিং এ শর্ট বেসিডেন্স ইন সুইডেন, নরওয়ে অ্যান্ড ডেনমার্ক সম্পর্কে আলোচনার; কিন্তু তা আর হলো না। শুধু এটুকু জানানো যেতে পারে যে এ-পত্ৰগুচ্ছের কাছে ঋণী রোম্যান্টিক কবিরা; আর কোলরিজের বিখ্যাত ‘কুবলা খান’ লেখা হয়েছিলো ওলস্টোনক্র্যাফটের পত্রগুচ্ছের ভাব ও কিছু শব্দ সরাসরি নকল ক’রে।
হুমায়ুন আজাদ
নারী, ও তার বিধাতা : পুরুষ
কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে। পুরুষের এক মহৎ প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথ, বলেছেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি।‘ রোম্যানটিকের চোখে নারীমাত্রই দায়িতা বা মানসসুন্দরী, তাই তার চোখে পড়েছে শুধু নারীর চারপাশের বর্ণ, গন্ধ, ভূষণ, যাতে নারীকে সাজিয়েছে পুরুষ। নারীর জন্যে পুরুষসুলভ করুণা, এবং পুরুষ হওয়ার গর্বও তিনি বোধ করেছেন গভীরভাবে। পুরুষ প্রেম আর আলিঙ্গনেও ভুলতে পারে না সে প্ৰভু, নারীর স্রষ্টা। পুরুষের অহমিকা এখানে প্রকাশ পেয়েছে চমৎকারভাবে, নারীসৃষ্টিতে তিনি বিধাতার সাথে পুরুষের ভাগ দাবি করেছেন; এবং অস্বীকার করেছেন নারীর সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’ বলে। তার চোখে নারীর অর্ধেক তো কল্পনা বটেই, আর ওই মানবী টুকুও কল্পনা; অর্থাৎ নারী এক সম্পূর্ণ অবাস্তব সত্তা বা ভাব। তাঁর চোখে নারীর কোনো জৈব অস্তিত্ব নেই। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা নারী সৃষ্টি না করলেও নারী ধারণাটি পুরোপুরি পুরুষের সৃষ্টি : পুরুষ নারীকে নানা শব্দে শনাক্ত করেছে, নারীর সংজ্ঞা রচনা করেছে, সংজ্ঞার ভাব ব্যাখ্যা করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে, নারীর জন্যে বিধি প্রণয়ন করেছে, এবং নিযুক্ত করেছে নিজের কামসঙ্গী ও পরিচারিকার পদে। পুরুষের চোখে নারী বিকৃত মানুষ, অসম্পূর্ণ সৃষ্টি, একরাশ বিকাবের সমষ্টি, এক আপেক্ষিক প্ৰাণী; অর্থাৎ নারীর অস্তিত্ব নিরপেক্ষ স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীকে নির্দেশ করা সম্ভব শুধু কোনো ধ্রুব সত্তার সাথে তুলনা করে। পুরুষ হচ্ছে ওই নিরপেক্ষ ধ্রুব সত্তা। পুরুষ নারীকে মানুষ হিশেবেই স্বীকার করে না। অধিকাংশ ভাষায় ‘মানুষ’ বা ‘মানুষজাতি’ বোঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হয় যে-সব শব্দ, সেগুলো ‘পুরুষ’ বোঝায়। ‘ম্যান’ বা ‘ম্যানকাইন্ড’ পুরুষবাচক; আর ‘ওম্যান’ বেশ নিন্দাসূচক। বাঙলায় ‘মানুষ’, ‘লোক’ পুরুষ বোঝায় না বলে মনে হ’তে পারে; কিন্তু ‘মেযেমানুষ’, ‘মেয়েলোক’ বললে বোঝা যায়। আপাতত লিঙ্গবাদী বাঙলা ভাষাও লিঙ্গবাদী, পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ এতেও প্ৰচণ্ড। বাঙলায় ‘নারীবাচক’ সমস্ত শব্দই কদৰ্থক, বা নির্দেশ করে কামশোষণ। নারী, স্ত্রী, রমণী, ললনা, অঙ্গনা, কামিনী, বনিতা, মহিলা, বামা, নিতস্বিনী, সুন্দরী প্রভৃতি শব্দে কামঙ্গুধার দাগ স্পষ্ট ৷ ‘মেয়েমানুষ’, ‘মেয়েলোক’, ‘মেয়েছেলে’ বললে বোঝায় একটি স্ত্রীলিঙ্গ পশু। পুরুষতন্ত্র নারীর যে-ভাবমূর্তি তৈরি করেছে কয়েক সহস্রকের সাধনায়, তাতে ‘নারী’ বললে মানুষ বোঝায় না; বোঝায় একধরনের মানুষ, যা বিকৃত, বিকলাঙ্গ, অতিরিক্ত, বা না-পুরুষ।
নারী কাকে বলে? দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৩৫) বলেছেন, এর উত্তরে একধরনের পুরুষ বলে, ‘নারী হচ্ছে জরায়ু, ডিম্বকোষ; নারী হচ্ছে স্ত্রীলোক।‘ পুরুষ এমন অসংখ্য সংজ্ঞা দেয় নারীর, যার সবটাই নিন্দাসূচক। কোনো কোনো নারীকে দেখিয়ে তারা বলে, সে নারী নয় যদিও তার জরায়ু-স্তন-যোনি সবই রয়েছে। ওই নারীর মধ্যে তারা দেখতে পায় নারীত্বের অভাব, চিরন্তন নারীত্বের উনতা। তারা চায় নারী হবে নারী, থাকবে নারী, আর হয়ে উঠবে নারী। পুরুষ চায় শাশ্বতী নারী, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। চিরন্তনী বা শাশ্বতী হচ্ছে পুরুষের এক চিরকালীন চক্রান্ত বা ক্ষুধা। সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে/চিরন্তনীর অভাব মেটাতে হবে’, তবে কোটি মন্বন্তরেও তিনি ভুলতে পারবেন না শাশ্বতীকে; পুরুষের কামনার সাথে না মিললে নারীমাত্রই পুরুষের কাছে সামান্যা : জরায়ু-যোনি-স্তনের সমষ্টি, নিজের লিঙ্গে ও যৌনতায় বন্দী পশু। পুরুষ ও স্ত্রী বা নর ও নারী ব্যাকরণে দুটি সুষম রূপ বোঝালেও জীবনে বোঝায় দুটি ভিন্ন মেরু। পুরুষ ও নারী নির্দেশ করে দ্বিমুখি বৈপরীত্য : পুরুষ বোঝায় সমস্ত সদর্থক বা অস্তিবাচক গুণ, আর নারী বোঝায় কদৰ্থক বা নঞর্থক বৈশিষ্ট্য। পুরুষ বোঝায় স্বাভাবিকত্ব, আদর্শ রূপ; নারী বোঝায় অস্বাভাবিকত্ব, বিকৃত রূপ। এলেন সিজো পুরুষ-নারীর দ্বিমুখি বৈপরীত্যের একটি তালিকা রচনা করেছেন, যাতে ধরা পড়েছে পুরুষ-নারী সম্পর্কে পিতৃতান্ত্রিক দ্বিমুখি চিন্তাধারা। তালিকাটি নিম্নরূপ [দ্র মোই (১৯৮৫, ১০৪)] :
পুরুষ — নারী
সক্রিয় : অক্রিয়
সূৰ্য : চন্দ্র
সংস্কৃতি : প্রকৃতি
দিন : রাত্রি
পিতা : মাতা
বুদ্ধি : আবেগ
বোধগম্য : দুবোধ্য, স্পর্শকাতর
বিশ্বনিয়ন্ত্ৰক : করুণ
এ-তালিকার দ্বিমুখি বৈশিষ্ট্যে ধরা পড়েছে পুরুষতন্ত্রের মূল্যবোধ। ওই বোধে পুরুষ সব সময় নির্দেশ করে মানুষের সদগুণগুলো, আর নারী নির্দেশ করে নঞর্থকগুলো। তালিকাটি আরো বাড়ানো যেতে পারে, এবং তাতেও দেখা যাবে পুরুষতন্ত্র যাকে ভালো মনে করে, অনেক সময়ই খামখেয়ালিভাবে, তাই হচ্ছে পুরুষের গুণ; আর যা কিছুকে ভালো মনে করে না, তাই নারীর বৈশিষ্ট্য। ‘পৌরুষ’ হচ্ছে মহাজাগতিক সদগুণের সমষ্টি, এর বিপরীত নারীত্ব হচ্ছে অনন্ত নঞর্থকতা। যে-কোনো সাধারণ অভিধানে, যে-কোনো ভাষায়, ‘পুরুষ’, ‘নারী’ বা ‘স্ত্রী’ অন্তর্ভুক্তিগুলো দেখলে বোঝা যায় পুরুষ কতো স্বর্গীয় আর নারী কতো নারকীয়। ‘পুরুষ’ হচ্ছে ‘নর, মনুষ্য, আত্মা, ঈশ্বর, পরমব্ৰহ্ম’, ‘পুরুষত্ব’ হচ্ছে ‘পৌরুষ, উদ্যম, তেজ, পুরুষের রতিশক্তি’। ‘নারী’ হচ্ছে ‘রমণী, স্ত্রীলোক, পত্নী’, ‘নারীধর্ম’ হচ্ছে ‘সতীত্ব মমতা বাৎসল্য প্রভৃতি নারীসুলভ গুণ’; ‘স্ত্রী’ হচ্ছে ‘পত্নী, জায়া, নারী, রমণী, বামা, কামিনী’, ‘স্ত্রীচরিত্র’ হচ্ছে ‘নারীজাতির প্রকৃতি বা স্বভাব’; ‘স্ত্রীধর্ম’ হচ্ছে ‘রজঃ, ঋতু, স্ত্রীলোকের কর্তব্য’ [দ্র শৈলেন্দ্র (১৯৬৪)]।
ইংরেজি ভাষা নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব নির্দেশে আরো দক্ষ। ওয়েবস্টারের তৃতীয় নতুন আন্তর্জাতিক অভিধান (১৯৬৬) অনুসারে ‘manly’ হচ্ছে ‘having qualities appropriate to a man : not effeminate or timorous; bold, resolute, open in conduct or bearing’, ‘belonging or appropriate in character to a man’, ‘of undaunted courage: gallant, bold; একই অভিধানে ‘womanly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘marked by qualities characteristic of a woman’, ‘possessed of the character or behavior befitting a grown woman’, ‘characteristic of, belonging to, or suitable to a woman’s nature and attitudes rather than to a man’s’। র্যানডম হাউজের ইংরেজি ভাষার অভিধানে (১৯৬৭), ‘manly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘strong, brave, honorable, resolute, virile’ as ‘qualities usually considered desirable in a man’ আর ‘womanly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘like or befitting a woman; feminine; not masculine or girlsh’, ‘in the manner of, or befitting, a woman’ [দ্র মিলার ও সুইফ্ট্ (১৯৭৬)]। এসব সংজ্ঞায় দেখা যায় পুরুষ বোঝায় মানুষের সব সদগুণ, আর নারী বোঝায় নঞর্থক বৈশিষ্ট্য। তাই পুরুষের সবচেয়ে বেশি অপমান বোধ হয় তাকে লম্পট, চোর, পশু, বদমাশ, গাধা-ধরনের কিছু বললে নয়, তাকে নারী বা মেয়েমানুষ বলা হ’লে।
পুরুষ শুধু নিজেকে নয়, নিজের দেহকেও মনে করে বিশুদ্ধ, উন্নত, আদর্শ কাঠামো; আর নারীদেহকে গণ্য করে বিকৃত, একধরনের প্রতিবন্ধকতা বা কারাগার, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘কুসুমের কারাগার’। ওই দেহের কোনো মাংসকৃত্তি তার কাছে বিশুদ্ধ বৃত্ত, কোনো ত্ৰিভূজ বিশুদ্ধ ত্রিভুজ, কোনো রন্ধ বিশুদ্ধ রন্ধ, কিন্তু তা কামনার সময়ে; উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর ওই দেহকে তার মনেহয় প্ৰতিবন্ধী। আরিস্তাতল বলেছেন, ‘নারী কিছু গুণের অভাব্যবশতই নারী; আমরা মনে করি নারীস্বভাব স্বাভাবিকভাবেই বিকারগ্রস্ত।‘ সন্ত টমাসের মতে, নারী হচ্ছে ‘বিকৃত পুরুষ’, ‘এক আকস্মিক সত্তা’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৫)]। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম ধর্মে নারীসৃষ্টির যে-উপাখ্যান বলা হয়েছে, তাতে নারীশরীর হয়ে উঠেছে পুরুষশরীরেব একটি ‘অতিরিক্ত অস্থি’র পুনর্বিন্যাস। তাই তার দেহ পুরুষের কামনা জাগালেও শুরু থেকেই নিন্দিত। বাইবেলের আদিপুস্তক-এ নারীসৃষ্টির বিজ্ঞানটুকু এমন : সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ঘোর নিদ্রায় মগ্ন করিলে তিনি নিদ্রিত হইলেন; আর তিনি তাহার একখান পঞ্জর লইয়া মাংস দ্বারা সেই স্থান পূরাইলেন। সদাপ্ৰভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন ও তাঁহাকে আদমের নিকটে আনিলেন। তখন আদম কহিলেন, এবার হইয়াছে; ইনি আমার অস্থির অস্থি ও মাংসের মাংস; ইঁহার নাম নারী হইবে, কেননা ইনি নর হইতে গৃহীত হইয়াছেন।‘ নিজের শরীরের জন্যে নারী ঋণী পুরুষের কাছে, আর যে-হাড়ে সে গঠিত ব’লে কথিত, তাও অপরিহার্য, সম্মানজনক নয়। পুরুষ নারীমূর্তি তৈরি করেছে নিজের কল্পনার বক্র হাড়ে, এবং যুগ যুগ ধ’রে তার নিন্দা করছে। একটি হাদিসে আছে : স্ত্রীগণকে সদুপদেশ দাও, কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তারা সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে ওপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বাঁকা–যদি ওকে সোজা করতে যাও তবে ও ভেঙ্গে যাবে, যদি ছেড়ে দাও তবে আরো বাঁকা হবে।’ [দ্র রফিকউল্লাহ (১৯৭৯, ১৮২)]। প্রতিটি ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানের চেতনায় নারী হচ্ছে একটি অশীল বক্র হাড়। বলা হয়ে থাকে যে হাওয়া বা ইভ মানবজাতির মাতা, কিন্তু ধর্মগ্রন্থেও–যেহেতু এগুলো পুরুষতন্ত্রেরই অনুশাসন বই–থাকে মারাত্মক স্ববিরোধিতা। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানের ধর্মগ্রন্থে হাওয়া বা ইভের আগেই আদমকে তৈবি ক’রে উল্টে দেয়া হয়েছে মানুষজন্মের স্বাভাবিক রীতি; নারীকে জন্ম দেয়া হয়েছে পুরুষের দেহ থেকে, অর্থাৎ পুরুষই হয়ে উঠেছে নারীজাতির মাতা! হাওয়া বা ইভের ধারণাটির উৎপত্তি হয়েছে আদি-বাইবেলেরও আগে, ইহুদিদের প্রাচীন পুরাণে। ইহুদিদের প্রাচীন পুরাণ অনুসারে বিধাতা আদমের জন্যে একটি ‘সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, পতিপরায়ণা, সতীসাধ্বী’ ভাৰ্য্য সৃষ্টির জন্যে তিন-তিনবার উদ্যোগ নেয়; এবং প্রতিবারই কোনো-না-কোনো বিপত্তি ঘটে। আদমের প্রথম ভাৰ্যার নাম লিলিথ, এমন এক করালী নারী যার ওপর আরোহণের সাধ্য নেই কোনো পুরুষের। আদমের সাথে তার একেবারেই মিল হয় নি, কেননা লিলিথ সঙ্গমের সময় আদমের নিচে শুতে রাজি হয় নি। তার যুক্তি ছিলো, সে আর আদম দুজনেই ধুলোয় তৈরি, তাই সমান; সুতরাং সে কেনো আদমের নিচে শোবে? উত্তেজিত আদম তাকে ধর্ষণেব চেষ্টা করলে সে মন্ত্র উচ্চারণ করে হাওয়ায় মিশে যায়। এরপর বিধাতা আদমের দ্বিতীয় ভার্যা (প্রথম হাওয়া) তৈরি করা শুরু করে। কিন্তু আকস্মিকভাবে আদম ওই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া দেখে ফেলে, এবং সৃষ্টির দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ঘেন্না বোধ করে। এতে বিধাতা প্ৰথম হাওয়াকে নিরুদ্দেশ করে ফেলে, এবং আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করে দ্বিতীয় হাওয়াকে যে এখন বিখ্যাত [দ্রা ফিজেস (১৯৭০, ২৭)]। পৃথিবীর তিনটি প্রধান পিতৃতন্ত্রের বদ্ধমূল কুসংস্কার হচ্ছে যে নারী বিকলাঙ্গ, পুরুষের অতিরিক্ত অস্থিতে নির্মিত।
পুরোনো কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের রূপ দিয়েছেন আদিম পিতৃতন্ত্রের এক প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী উত্তরপুরুষ। তার নাম সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনি অর্জন করেছেন আধুনিক কালের অন্যতম স্রষ্টার মহিমা; উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নিজের সমস্ত কালো কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে উপস্থিত করেছেন তিনি, তাই তাঁকে কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে পারে নি, বরং কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক রূপ দেখে শান্তি বোধ করেছে। ফ্রয়েডের মতে, নারী হচ্ছে এমন মানুষ যার কোনো একটি প্রত্যঙ্গ হারিয়ে গেছে। একে তিনি বলেছেন ‘খোজাগূঢ়ৈষা’। কোন মহান প্রত্যঙ্গটি হারিয়েছে? নারী হারিয়ে ফেলেছে তার ‘শিশ্ন’। প্রায় সব আদিম সমাজই শিশ্নের মহিমায় বিশ্বাস করে; পুরুষের শিশ্ন তাদের চোখে লাঙ্গল, যা কর্ষণ করে, আর নারীর যোনি হচ্ছে জমিতে লাঙলের দাগ। সংস্কৃতে ‘লাঙ্গল’ আর ‘লিঙ্গ’ একই ধাতু থেকে উৎপন্ন শব্দ। ‘সীতা’ ও ‘রাম’-এর মতো পবিত্ৰ শব্দও আসলে যোনি ও লিঙ্গের ধারণা বহন করে। ‘সীতা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘হলরেখা’ বা ‘লাঙ্গলের ফলার দাগ’, আর ‘রাম’ শব্দটি এসেছে ‘রম’ ধাতু থেকে, যার এক অর্থ ‘চাষ করা, কর্ষণ করা’, ও আরেক অর্থ ‘রমণ’ [ দ্র নরেন্দ্রনাথ (১৯৭৫, ১০০, ১১০)]। তাই আদিম কাল থেকেই পুরুষের চোখে লিঙ্গই সম্রাট। পুরুষের বড়ো গৌরবের ধন তার দু-উরুর মধ্যস্থলে আন্দোলিত প্রত্যঙ্গটি, যার সাহায্যে সে পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করে আসছে। সে রাজা, ওটি তার রাজদণ্ড। নারী যেহেতু হারিয়ে ফেলেছে রাজদণ্ড, তাই ফ্রয়েডের মতে নারীস্বভাবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘শিশ্নাসূয়া’; অৰ্থাৎ নারীর জীবন কাটে নিরন্তর পুরুষাঙ্গটিকে ঈর্ষা করে। শিশ্নাসূয়া ধারণার মধ্য দিয়ে আদিম বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানরূপে। ফ্রয়েড যাকে নির্দেশ করেছিলেন নারীর শাশ্বত বৈশিষ্ট্য ব’লে, সে-খোজাগূঢ়ৈষার উৎপত্তি তাঁর ধর্মীয় কুসংস্কারে, এবং ভিয়েনায় তিনি যে-রোগিনীদের চিকিৎসা করতেন, তাদের পারিবারিক-সামাজিক জীবনে। ফ্রয়েড নারীর যে-সব বৈশিষ্ট্যকে জৈবিক, সহজাত ও শাশ্বত ব’লে স্থির করেছিলেন, সেগুলো মূলত বিশেষ সাংস্কৃতিক কারণের পরিণতি। ‘শিশ্নাসূয়া’ বলতে তিনি যা বুঝতেন, তা হচ্ছে পুরুষ-অসূয়া । পুরুষ যে-সব সুযোগসুবিধা ভোগ করে, তাতে পুরুষকে ঈর্ষা করা স্বাভাবিক; কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে নারী ঈর্ষা করে পুরুষের নির্বোধ প্রত্যঙ্গটিকে । রোকেয়া, বাঙলার একমাত্র শুদ্ধ নারীবাদী, নানা রচনায় পুরুষকে আক্রমণ করেছেন, দাবি করেছেন পুরুষের সমান অধিকার । ফ্রয়েড তাকে পেলে সুখী বোধ করতেন; এবং শনাক্ত কবতেন একজন শিশ্নাসূয়াগ্ৰস্ত রোগিণীরূপে! যা বোঝেন নি বৈজ্ঞানিক, তা ঠিকমতো বুঝেছিলেন রোকেয়া (১৯৭৩, ২৯, পাদটীকা) : ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষদের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ।’ ফ্রয়েডের খোজা গূঢ়ৈষা ও শিশ্নাসূয়া ধারণা দুটির উদ্ভব ঘটেছে। এ-বিশ্বাস থেকে যে নারী পুরুষের থেকে জৈবিকভাবে নিকৃষ্ট । তিনি পুরোনো কুসংস্কারকে পরিণত করেছেন আধুনিক অপবিজ্ঞানে। নারীকে ক’রে তুলেছেন নিজেরই শরীরের শিকার। জিহোভার মতো বলেছেন, ‘অ্যানাটমি ইজ হার ডেস্টিনি–শরীরই তার নিয়তি ।’ কুসংস্কার ও বিজ্ঞানের প্রতিভাবান এ-মিশ্রণকারী যে নারীকে বোঝেন নি, তা স্বীকার করেছেন নিজেই; বলেছেন, ‘নারী-আত্মা সম্পর্কে আমার তিরিশ বছরের গবেষণা সত্ত্বেও একটি মহাপ্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি নি; প্রশ্নটি হচ্ছে নারী কী চায়?’
যে-পুরুষতন্ত্র নারীকে সৃষ্টি করেছে, নির্দেশ করেছে প্রতিবন্ধীরূপে, তাকে যে সে কোনো মূল্য দেবে না, বিবেচনা করবে না স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে, তা অবধারিত। তাই পুরুষ নারীকে সংজ্ঞায়িত করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে নিজেকে মানদণ্ড ক’রে। পুরুষ ধ্রুব, নারী আপেক্ষিক। মিশলে বলেছেন, ‘নারী, এক আপেক্ষিক সত্তা।‘ পুরুষের মতে, পুরুষ নারীকে ছাড়াই ভাবতে পারে নিজের কথা; কিন্তু নারী পারে না পুরুষকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে। তাই নারী হচ্ছে তা, পুরুষ তাকে যা মনে করে : পুরুষ তাকে মনে করে যৌনসামগ্ৰী। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে যোনি, যৌনবস্তু, কামের পরিতৃপ্তি; এর বেশি নয়, কম নয়। পুরুষ নারীকে নির্দেশ করে, নারীর স্বাতন্ত্র্য বোঝায় নিজের সাথে তুলনা ক’রে । পুরুষ হচ্ছে অনিবাৰ্য, অপরিহার্য, অবধারিত; আর নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, সংখ্যাতিরিক্ত [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৬)]। নারী যে মানুষ, কোনো কিছুর সম্পর্কে না এসেও তার একটি নিজস্ব সত্তা আছে, এটা পুরুষতন্ত্র স্বীকার করে নি। নারীর মূল্য তার মাংসের জন্যে, তার ভূমিকার জন্যে-স্ত্রী, মাতা, দাসী হিশেবে; এর বেশি নয়। সারা এলিস লিখেছেন, ‘তারা (নারীরা) তাদের গঠনে ও পৃথিবীতে তাদের অবস্থান অনুসারে আপেক্ষিক প্রাণী’ [দ্র বাঙ্ক (১৯৭৪, ৫)]। নারীর মাংস চিরকালই পুরুষের কাছে সবচেয়ে সুস্বাদু; বাঙলার রাধা চিৎকার করেছে, ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’; আর বিলেতের রাজকবি টেনিসন পুরুষের সমস্ত ক্ষুধায় উত্তেজিত হয়ে লিখেছেন, ‘পুরুষ শিকারী, নারী শিকার’ [দি প্রিন্সেস, ১৮৪৭]। তাই পুরুষ অন্য যা-কিছু হতে প্ৰস্তুত, শুধু নারী ছাড়া।
পুরুষ গৌরব বোধ করে যে সে পুরুষ, কারণ সে সব কিছুর প্রভু। অন্ধ, বিকলাঙ্গ, নির্বোধ পুরুষও অধিষ্ঠিত শ্রেষ্ঠ নারীর ওপরে; একটি অন্ধ বিকল নির্বোধি পুরুষও অসহায় ক’রে তুলতে পারে শ্রেষ্ঠ নারীকে। ইহুদিরা ভোরবেলা প্রার্থনা করে, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, যেহেতু তিনি আমাকে নারী করেন নি’; আর একই সময় তাদের নারীরা কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলে, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে তাঁর নিজের ইচ্ছানুসারে সৃষ্টি করেছেন।‘ প্লাতো দু-কারণে তাঁর দেবতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন; প্রথমত তারা তাকে স্বাধীন মানুষ করেছে, ক্রীতদাস করে নি; দ্বিতীয়ত তাঁকে পুরুষ করেছে, নারী করে নি। কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কতা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এ জন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে’ [ দ্র ৪ : ৩৪]। পুরুষ তার সুবিধা শান্তির সাথে ভোগ করার জন্যে দিয়েছে তাকে শাশ্বত ধ্রুব ভিত্তি; তারা তাদের প্রাধান্যকে পরিণত করেছে ঐশী অধিকারে। শুধু পার্থিব পুরুষের শক্তিতে তারা সন্তুষ্ট থাকে নি, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আবিষ্কার করেছে ও কাজে লাগিয়েছে অলৌকিক পরমপুরুষকে। পুরুষেরা বিধান প্রণয়ন করেছে, তাতে একচেট সুবিধা দেয়া হয়েছে পুরুষকে; তারপর তারা নিজেদের বানানো বিধানকে উন্নীত করেছে চিরন্তন নীতিমালায়। তারা মুখর হয়েছে নারীনিন্দায়। তারতুলিয়ান লিখেছেন, ‘নারী, তুমি শয়তানের দ্বার। তুমি তাঁকে বিপথগামী করেছে যাকে শয়তানও সরাসরি আক্রমণের সাহস করে নি। তোমার কারণেই ঈশ্বরের পুত্রকে মরতে হয়েছে; তুমি সব সময় শোকাকুল ও ছিন্নবস্ত্রে থাকবে।‘ সন্ত জন ক্রাইসোসটম বলেছেন, ‘সমস্ত বর্বর পশুর মধ্যেও নারীর মতো ক্ষতিকর আর কিছু নেই।‘ হাদিসে আছে : ‘নারীর চেয়ে ক্ষতিকর কোনো দুৰ্যোগ আমি রেখে যাচ্ছি না’ [দ্র হিউয়েজ (১৮৮৫)] বা ‘পুরুষের পক্ষে নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না।’ [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ১৮৭)]। কোৎ বলেছেন, নারীত্ব হচ্ছে ‘প্রলম্বিত শৈশব’, যা নারীর মনকে দুর্বল করে রেখেছে। বালজাক লিখেছেন, ‘নারীর নিয়তি ও পরম গৌরব হচ্ছে পুরুষের হৃদয়ে স্পন্দন জাগানো…নারী অস্থাবর সম্পত্তি এবং ঠিকমতো বলতে গেলে নারী হচ্ছে পুরুষের সহায়ক।‘ তিনি আরো বলেছেন, ‘বিবাহিত নারী হচ্ছে ক্রীতদাসী, যাকে সিংহাসনে বসিয়ে রাখতে হবে’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৪২)]। খুব কম নারীকেই পুরুষ সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছে, কিন্তু দাসী ক’রে রেখেছে সবাইকে। এমনকি ক্ষমতাশালী রানীরাও তাদের স্বামীদের কাছে পরিচারিকার মতোই আচরণ করেছে, যেমন রানী ভিক্টোরিয়া। নারীদের মধ্যে কোনো দান্তে নেই, শেক্সপিয়র নেই, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ নেই, নিউটন-আইনস্টাইন নেই, ভিঞ্চি-পিকাসো নেই, প্লাতো-আরিস্ততল-মার্ক্স নেই, কোনো প্রেরিতপুরুষ তো নেই-ই; কিন্তু সত্য হচ্ছে পুরুষদের মধ্যেও এঁদের মানের লোক বেশি নেই; এবং প্রশ্ন হচ্ছে থাকবে কী করে? নারীরা আজো পুরুষদের থেকে নিকৃষ্ট; এর কারণ এ নয় যে তারা সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট, এর কারণ তাদের নিকৃষ্ট হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের পরিস্থিতিই তাদের নিকৃষ্ট করে রেখেছে। শূদ্ৰদের ক’রে রাখা হয়েছে শূদ্ৰ, তাদের বাধ্য করা হয়েছে নিম্নবৃত্তিতে; কিন্তু এ থেকে সিদ্ধান্তে পোঁছানো যায় না যে শূদ্ররা শুধু নিম্নবৃত্তিরই উপযুক্ত। নারীকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বলা যায় না নারী অশিক্ষিত; তাকে বিজ্ঞান থেকে বহিষ্কার ক’রে বলা যায় না নারী বিজ্ঞানের অনুপযুক্ত। তাকে শাসনকার্য থেকে নির্বাসিত ক’রে বলা যায় না নারী শাসনের যোগ্যতাহীন। নারীর কোনো সহজাত অযোগ্যতা নেই, তার সমস্ত অযোগ্যতাই পরিস্থিতিগত, যা পুরুষের সৃষ্টি বা সুপরিকল্পিত এক রাজনীতিক ষড়যন্ত্র।
লৈঙ্গিক রাজনীতি
নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক হচ্ছে সঙ্গম, যাতে একজনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আরেকজন। সব কিছুই রাজনীতি ব’লে যাঁরা মনে করেন, তাঁরাও মাংসের ভেতরে মাংসের অনুপ্রবেশকে রাজনীতি ব’লে মনে করেন না। সঙ্গমক্রিয়াকে দ্য বোভোয়ার (১৯৪, ৫৩-৫৪) বৰ্ণনা করেছেন এভাবে : নারী যখন ইচ্ছুকও হয়, তখনো পুরুষই নারীকে অধিকার করে, নারী অধিকৃত হয়। এটা হয় আক্ষরিকার্থেই, বিশেষ কোনো প্রত্যঙ্গের সাহায্যে বা বলপ্রয়োগে পুরুষ নারীকে কাবু করে, তাকে ঠিকমতো আটকে ধরে; পুরুষই সম্পন্ন করে সঙ্গমের প্রয়োজনীয় অঙ্গসঞ্চালন। পতঙ্গ, পাখি, ও স্তন্যপায়ীদের মাঝে পুরুষ বিদ্ধ করে নারীকে। বিদ্ধকরণের ফলে নারীর অভ্যন্তরতা ধর্ষিত হয়। পুরুষের আধিপত্য প্রকাশ পায় সঙ্গমের আসনেই;– অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই পুরুষ থাকে নারীর ওপরে। পুরুষ যে-প্রত্যঙ্গটি ব্যবহার করে সেটি একটি বস্তু, তবে উত্তেজিত অবস্থায় সেটি হয়ে ওঠে হাতিয়ার, কিন্তু নারীর প্রত্যঙ্গটি থাকে এক নিষ্ক্রিয় আধার। বোভোয়ারের বর্ণনায় সঙ্গম হয়ে উঠেছে একধরনের সমর। কিন্তু বোভোয়ার একে যুদ্ধ বলেন নি, বা নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্কের প্রকৃতি বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করেন নি এর চেয়েও ভয়ানক শব্দটি- রাজনীতি। কিন্তু সঙ্গমও একধরনের রাজনীতি, তাতে শক্তির আধিপত্য ও অধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। সঙ্গম থেকে নারীপুরুষের সমস্ত সম্পর্ককে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোতে ব্যাখ্যা করেছেন কেইট মিলেট তাঁর সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯) বা লৈঙ্গিক রাজনীতি গ্রন্থে। দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ (১৯৪৯) গ্রন্থে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন নারীকে, বিশ্বাসও করেছেন তিনি সমাজতন্ত্রে, আশা করেছেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হ’লে নারী তাঁর স্বাধিকার পাবে। পরে হতাশ হয়েছেন, দেখেছেন সমাজতন্ত্রও পুরুষতন্ত্র। বোভোয়াবের বইয়ের ঠিক দু-দশক পরে বেরোয় কেইট মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি, যেটি সম্ভবত সব সময়ের সবচেয়ে সাহসী, এবং একমাত্র বেস্টসেলার, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। মিলেট সাহিত্য-সমাজ-সভ্যতা ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক থেকে চরম বাহ্যিক সম্পর্ক হচ্ছে শক্তির সম্পর্ক, যার নাম তিনি দিয়েছেন লৈঙ্গিক রাজনীতি। কেইট মিলেট তীব্র, তীক্ষু, প্রখর ও প্রচণ্ড; এবং বিস্ময়করভাবে মননশীল।
শুরুতেই মিলেট হেনরি মিলারের সেক্সাস, নরম্যান মেইলারের অ্যান আমেরিকান ড্রিম, জাঁ জোনের দি থিফ্স্ জর্নাল ও আওয়া্র লেডি অফ দি ফ্লাওয়ার্স থেকে নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক সঙ্গমে লৈঙ্গিক রাজনীতির পরিচয় দিয়েছেন; দেখিয়েছেন সঙ্গমেও সক্রিয় থাকে আধিপত্য ও ক্ষমতা (বা শক্তি)। এটা শুধু জৈব ও শারীরিক ক্রিয়া নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঙ্গম হচ্ছে লৈঙ্গিক রাজনীতি। প্রশ্ন উঠবে। সঙ্গমের মতো অন্তরঙ্গ মিলনকে এবং নারীপুরুষের সম্পর্ককে রাজনীতির সীমার মধ্যে আনা যায় কিনা? এটা নির্ভর করে ‘রাজনীতি’ বলতে কী বুঝি আমরা, তার ওপর। রাজনীতি বলতে মিলেট বুঝিয়েছেন ক্ষমতাসংগঠন বা বিন্যাসকে, যার সাহায্যে একদল মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে আরেক দল মানুষকে। শুধু এ-রাজনীতি ধারণার সাহায্যেই বোঝা সম্ভব নারীপুরুষের ঐতিহাসিক ও বর্তমান অবস্থান বা মৰ্যাদা। ‘রাজনীতি’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ, তবে নারীপুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আপত্তিকর বা অশ্লীল মনে হতে পারে অনেকের কাছে; কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে যে অশ্লীল এখন সত্য আর সত্য এখন অশ্লীল! আগে জন্মসূত্রেই একদল আধিপত্য করতো আরেক দলের ওপর, এখন করে না; কিন্তু এখনো, পুরোনো কাল থেকেই, চলছে জন্মাধিকারবশতই মানুষের একদলের ওপর আরেক দলের আধিপত্য; সেটা লিঙ্গের, নারীপুরুষের, এলাকায়। এখন, ও ঐতিহাসিকভাবে, নারীপুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার। পৃথিবী জুড়েই চলছে, কিন্তু চোখে পড়ে না বা স্বীকার করা হয় না যে জন্মাধিকার বলেই পুরুষেরা শাসন করছে নারীদের। এ-পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চমৎকার একধরনের ‘আভ্যন্তর ঔপনিবেশিকতা’। এর কারণ হচ্ছে সমস্ত পুরোনো ও আমাদের ‘সভ্যতা’ পিতৃতান্ত্রিক। এটা এতো স্পষ্ট যে চোখে পড়ে না : সামরিক, শিল্পকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান, রাজনীতিক কাৰ্যালয়, পুলিশ,-সমাজের ক্ষমতার সমস্ত এলাকাই পুরুষের হাতে। রাজনীতির মূলকথা হচ্ছে ক্ষমতা। ওই ক্ষমতা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে; আর অলৌকিক ঈশ্বর, রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রণালয়, সমস্ত নীতি ও মূল্যবোধ, দর্শন ও শিল্পকলা সবই পুরুষের তৈরি। পিতৃতন্ত্রের বড়ো ষড়যন্ত্র হচ্ছে যে পুরুষ আধিপত্য করবে নারীর ওপর। আবহমান কাল ধ’রে পথিবী জুড়ে এটা চলছে। পিতৃতন্ত্র নারীর ওপর আধিপত্য করার জন্যে গ্ৰহণ করেছে সার্বিক পরিকল্পনা। মিলেট (১৯৬৯, ২৬-৫৮) সেগুলোকে ভাগ করেছেন : [এক] ভাবাদর্শগত, [দুই] জৈবিক, [তিন] সমাজতাত্ত্বিক [চার] শ্রেণী, [পাঁচ] আর্থ ও শিক্ষাগত, [ছয়] বলপ্রয়োগ, [সাত] নৃতাত্ত্বিক : পুরাণ ও ধর্ম, ও [আট] মনস্তাত্ত্বিক ভাগে। এগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিলে বোঝা যাবে পিতৃতন্ত্রের পুরুষাধিপত্যের ক্রূর পরিকল্পনা কতো ব্যাপক।
[এক] ভাবাদর্শ
কোনো সরকার ক্ষমতায় আসে দু-উপায়ে; সকলের সম্মতিতে, বা বলপ্রয়োগে। মানুষকে কোনো একটি ভাবাদর্শে দীক্ষিত করতে পারলে তাদের সম্মতি পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। লৈঙ্গিক রাজনীতি পুরুষ-নারী দু-লিঙ্গেরই সম্মতি আদায় করে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। পিতৃতন্ত্র পুরুষ ও নারীর জন্যে যে-মেজাজ, ভূমিকা, ও অবস্থান স্থির করে, সামাজিকীকরণের ফলে তা মেনে নেয় তারা। পুরুষই শ্রেষ্ঠ, এমন একটি কুসংস্কার বদ্ধমূল ক’রে তোলে পুরুষতন্ত্র, তাই অবস্থানগতভাবে পুরুষ পায় উচ্চ মর্যাদা, নারী পায় নিম্ন মর্যাদা। পুরুষ তা মেনে নেয় ও ভোগ করে তার জন্ম-অধিকার ব’লে, আর নারীও তা বিশ্বাস ও স্বীকার করে। মেজাজ গড়ে তোলে মানুষের ব্যক্তিত্ব। পুরুষতন্ত্র আপন স্বার্থে লিঙ্গ-অনুসারে পরিকল্পিত বিশেষ ছকে বেঁধে দিয়েছে নারীপুরুষের ব্যক্তিত্বকে; স্থির হয়ে গেছে যে পুরুষ হবে আক্রমণাত্মক, বুদ্ধিমান, বলশালী, ফলপ্ৰদ, আর নারী হবে নিষ্ক্রিয়, মূর্খ, বশমানা, সতী ও অপদার্থ। এর প্রকাশ দেখা যায় নারীপুরুষের লৈঙ্গিক ভূমিকায়। পিতৃতন্ত্র তাদের জন্যে তৈরি করেছে বিশদ বিধিমালা, স্থির করে দিয়েছে কীভাবে আচরণ করবে নারীপুরুষ : কেমন অঙ্গভঙ্গি করবে, ও পোষণ করবে কী প্রবণতা। স্থির করে দিয়েছে যে নারী দেখবে ঘরসংসার, পালন করবে সন্তান; আর পুরুষ অর্জন করবে অন্যান্য সাফল্য। এতে নারী রয়ে গেছে পশুর স্তরেই, পশুরাও সন্তান লালনপালন করে; আর পুরুষ উন্নীত হয়েছে মানুষের স্তরে;–যে-সব কাজ বিশেষভাবেই মানবিক, তার সবই রাখা হয়েছে পুরুষের জন্যে। পুরুষকে দেয়া হয়েছে উচ্চ অবস্থান, যা তাকে করেছে প্ৰভু আর তার ভূমিকা যেহেতু প্রভুর, তাই তার মেজাজও হয়ে উঠেছে পুভুর অর্থাৎ আধিপত্যবাদী। নারীর ভূমিকা দাসীর, তাই তার মেজাজও অধীনস্থের। পুরুষের চোখে নারীর ভূমিকা চারটি : মাতা, কন্যা, বধু; এ-তিনটির কোনোটি না হ’লে নারী হয় উর্বশী অর্থাৎ পতিতা। শুধু নারীরূপে নারী কোনো মর্যাদা পায় না।
[দুই] জৈবিক
পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম, সাধারণ বিশ্বাস, এবং অনেকাংশে বিজ্ঞানও, মনে করে যে নারীপুরুষের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাদের শারীরিক পার্থক্য। সংস্কৃতি যে মানুষের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা গোপন ক’রে পুরুষতন্ত্র প্রচার যে সংস্কৃতি বিকাশ ঘটায় স্বভাবের। এমন ধারণা তৈরি করা হয়ে গেছে যে পৌরুষ ও নারীত্ব সহজাত; কিন্তু নারীপুরুষের নারীত্ব ও পৌরুষ কোনো সহজাত ব্যাপার নয়, তাদের অবস্থান ও মর্যাদা পুরোপুরি অস্বাভাবিক। পুরুষের শরীর পেশল হয, এটা অনেকটা জৈবিকা; তবে সাংস্কৃতিকভাবেই খাদ্য, ব্যায়াম প্রভৃতির সাহায্যে নিজের পেশি গঠনে উৎসাহ দেয়া হয় পুরুষকে। যদি ধ’রেও নেয়া হয় যে পেশিতে পুরুষেবা অধিকার জন্মগত, তবু পেশি কোনো রাজনীতিক অধিকারের ভিত্তি হতে পারে না। পুরুষাধিপত্য পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়; নির্ভরশীল কিছু অজৈবিক মূল্যবোধের ওপর। আধুনিক কালে পেশির মূল্য বেশ ক’মে গেছে। চিরকাল পেশির ওপর নির্ভর করেছে গরিবেরা, তাদের পেশিতে শক্তি না থাকলেও। পিতৃতন্ত্র শরীরের ওপর দেয় বিশেষ গুরুত্ব; আর পিতৃতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করেন মানুষের শারীরিক কারণেই পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ছিলো অনিবার্য। তবে এটা মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে মানবসমাজের শুরুতেই পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে নি; এর আগে ছিলো প্রাকপিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যাতে নারীরই গুরুত্ব ছিলো বেশি; কারণ নারী সন্তান জন্ম দেয়। প্রথমে জন্ম দেয়ার ব্যাপারটিই ছিলো বড়ো; কিন্তু পরে পিতৃত্বের ব্যাপারটি বড়ো হয়ে উঠলে সমাজ পিতৃতন্ত্রের দিকে বাঁক নেয়। সন্তান জন্মদানে নারীর ভূমিকাকে গৌণ ক’রে সন্তান উৎপাদনের গৌরব দেয়া হয় শুধু পুরুষলিঙ্গকে। পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম পিতৃতন্ত্রকে সুগঠিত করে পুরুষ ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি ক’রে; এ-ধর্ম বিতাড়িত বা বিচ্যুত করে আগের দেবীদের। পিতৃতান্ত্রিক ধর্মশাস্ত্র পুরোপুরি পুরুষাধিপত্যবাদী; এর মূল দায়িত্বই হচ্ছে পিতৃতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত ও রক্ষা করা। ভূমিকা, মেজাজ, ও বিশেষ করে অবস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্যের মূলে কোনো জৈব কারণ নেই, রয়েছে সাংস্কৃতিক কারণ। কিন্তু যুগেযুগে বহু পুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে জৈব কারণেই পুরুষ শ্ৰেষ্ঠ। অনেক চতুর পুরুষ আবার শ্ৰেষ্ঠ-নিকৃষ্ট তত্ত্বের বদলে পেশ করে পার্থক্যতত্ত্ব। যেমন, বাকলে নামক এক পুরুষ প্ৰবন্ধ লিখেছেন ‘বিজ্ঞানের ওপর নারীর প্রভাব’ নামে। তিনি প্রকাশ্যে পুরুষাধিপত্যবাদী নন, তাই তিনি পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট না বলে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষ একে অন্যের থেকে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট নয়, তারা ‘পৃথক’! তিনি নারীর মন কেটেছেটে দেখিয়েছেন যে নারীর পক্ষে পুরুষের আর পুরুষের পক্ষে নারীর সমস্ত যোগ্যতা আয়ত্ত করা অসম্ভব। তিনি প্রমাণ করেন যে প্রকৃতি নারীকে করেছে বোধিবাদী আর পুরুষকে উপাত্তবাদী বা অভিজ্ঞতাবাদী। প্রকৃতি নারীকে দিয়েছে বোধি আর পুরুষকে বুদ্ধি; তাই নারী যদিও পুরুষের মতো স্পষ্ট ক’রে কিছুই দেখতে-বুঝতে পারে না, তবে নারী অনুভব করে খুব তাড়াতাড়ি [দ্র ব্লক (১৯৫৮, ৫৮)]! কিন্তু পুরুষের জগতে অনুভবের কোনো মূল্য নেই, সব মূল্য দেখার আর বোঝার!
পুরুষনারীর মধ্যে যদি থাকে কোনো সহজাত অসাম্য, তা প্রমাণ করার উপায় হচ্ছে তাদের সমান সুযোগসুবিধা দেয়া ও দেখা কোথায় রয়েছে কোন লিঙ্গের সহজাত অপকর্ষ। এমন পরিবেশ এখন কোথাও নেই। এখন নারীপুরুষের স্বভাব নিয়ে যে-সব গবেষণা হচ্ছে, তাতে দেখা যায় মেয়েলি-পুরুষালি হিশেবে যা-কিছুকে শাশ্বত ব’লে ধ’রে নেয়া হয়েছে, সে-সব আসলে সাংস্কৃতিক। বাঙলায় একটিই শব্দ আছে: লিঙ্গ, ইংরেজিতে আছে দুটি : সেক্স, ও জেন্ডার। সাম্প্রতিক লিঙ্গবিশেষজ্ঞরা, যেমন কালিফোর্নিয়া লিঙ্গশনাক্তি কেন্দ্রের রবার্ট জে স্টোলার, নির্দেশ করেছেন ‘সেক্স’ ও ‘জেন্ডার’-এর পার্থক্য। ‘সেক্স’ জৈব, আর ‘জেন্ডার’ মনস্তাত্ত্বিক, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক। ‘পুরুষ’, ‘নারী’ বললে বোঝায় জৈবলিঙ্গ [সেক্স], আর ‘পুরুষালি’, ‘মেয়েলি’, ‘পুরুষসুলভ’, ‘নারীসুলভ’ বোঝায় সাংস্কৃতিক লিঙ্গ জেন্ডার। সাংস্কৃতিক লিঙ্গ ও জৈবলিঙ্গ অবিচ্ছেদ্য নয়; পুরুষ হতে পারে মেয়েলি, নারী হতে পারে পুরুষালি। স্টোলার বলেছেন, ‘বাহ্যিক জননেন্দ্ৰিয়গুলো (শিশ্ন, অণ্ডকোষ, মুষ্ক) যদিও সাহায্য করে পৌরুষবোধে, তবে এর জন্যে কোনোটিই প্রয়োজনীয় নয়, সবগুলোর একত্রে প্রয়োজন তো নেই-ই।… সাংস্কৃতিক লিঙ্গ নির্ধারিত হয় জন্মোত্তর বিভিন্ন শক্তির দ্বারা, বাহ্যিক জননেন্দ্ৰিয়গুলোর গঠন যাই-হোক-না কেনো’ [“দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৩০)]। এখন তো মনে করাই হয় যে মানবভ্রূণ আদিতে থাকে নারী; গর্ভধারণের কিছু পরেই শুধু মাত্র একটি ওয়াই ক্রোমোসোমের ক্রিয়ায় ভ্রূণটি পুরুষে পরিণত হয়। নারীপুরুষ মেয়েলি বা পুরুষালি গুণ নিয়ে জন্ম নেয় না; জন্মের পরে সমাজসংস্কৃতির চাপে তারা অর্জন করে মনোলৈঙ্গিক ব্যক্তিত্ব।
জন্মের পরে মানুষকে আবার জন্ম দেয়া হয়; মানুষমাত্রই দ্বিজ। জন্মের পর থেকে শুরু হয় পুত্রকে পুরুষ আর কন্যাকে নারীরূপে দ্বিতীয় জন্ম দেয়া: এবং নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে দুই সংস্কৃতির অধিবাসী। তাদের জীবন, জগৎ অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। শৈশব থেকেই বাবা-মা, সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা শেখায় মেজাজ কেমন হবে তাদের; তারা হাসবে, দাঁড়াবে, বসবে কীভাবে; পালন করবে তারা কী ভূমিকা, আর কার হবে কী মর্যাদা বা অবস্থান। তাই নারী ও পুরুষ নারী ও পুরুষ হয়ে জন্ম নেয় না, সামাজিকীকরণপ্রক্রিয়ায় তাদের নারী ও পুরুষ ক’রে তোলা হয়। পিতৃতন্ত্রের জৈবিক ভিত্তি দুর্বল; তাই নারীকে নারী ও পুরুষকে পুরুষ ক’রে তোলার জন্যে চলে ধারাবাহিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। তাদের, শৈশব থেকেই, অভ্যস্ত ক’রে তোলা হয় নারী বা পুরুষের ভূমিকায়। প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক, আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখি বা আত্মসমৰ্পণাত্মক; তাই ছেলেরা হয় মাস্তান আর মেয়েরা থাকে একটি রন্ধ নিয়ে বিব্রত। এটা যে সাংস্কৃতিক ব্যাপার, তা স্বীকার না ক’রে পিতৃতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের পৌরুষ বাস করে তার একটি ঝুলন্ত নির্বোধ প্রত্যঙ্গে ও তার নিচে থলের ভেতরের একজোড়া অণ্ডকোষে! আধুনিক সব সংস্কৃতিই ধ’রে নেয় সক্রিয়তা বা আক্রমণাত্মকতা হচ্ছে পৌরুষ, নিষ্ক্রিয়তা বা ভীরুতা হচ্ছে নারীত্ব। তবে মার্গারেট মিড তিনটি আদিম সমাজে লিঙ্গ ও মেজাজ (১৯৩৫), দক্ষিণ সমুদ্র থেকে (১৯৩৯), নর ও নারী (১৯৫৫) প্রভৃতি গ্রন্থে দেখিয়েছেন এটা সব সংস্কৃতির জন্যেও সত্য নয়। তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় নারীপুরুষের প্রকৃতি সম্পর্কিত গবেষণায় দেখিয়েছেন নারীপুরুষের সক্রিয়তা/নিষ্ক্রিয়তা ধ্রুব বিশ্বজনীন ব্যাপার নয়। ওই এলাকার আরাপেশদের নারীপুরুষ উভয়ই ‘মেয়েলি’ ও ‘মাতৃসুলভ এবং নিক্রিয়; এর কারণ তাদের ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয় একে অন্যকে সহায়তা করতে। আবার মুন্ডুণ্ডমরদের নারীপুরুষ উভয়ই প্ৰচণ্ড, আক্রমণাত্মক, ‘পুরুষালি’; এবং চামবুলিদের নারীরা আধিপত্যপরায়ণ, আর পুরুষেরা অধীনতাপরায়ণ [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১২০)]। তাই পুরুষের পৌরুষ আর নারীর নারীত্ব বা মেয়েলিপনা জৈবিক তো নয়ই, এমনকি সৰ্ব্বজনীনও নয়।
[তিন] সমাজতাত্ত্বিক
পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নানা রকম সংস্থা, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে পরিবার। সমাজ ও রাষ্ট্র নরনারীদেব সব সময় সরাসরি শাসন করতে পারে না, তাই পিতৃতন্ত্র পরিবারের সাহায্যে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ব্যক্তিকে। তাদের বাধ্য করে পিতৃতন্ত্রের বিধি মেনে চলতে। পরিবার কাজ করে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিরূপে: পরিবার তার সদস্যদের খাপ খাওয়ায় পিতৃতন্ত্রের আদর্শের সাথে। পরিবার অনেকটা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্টের ভেতরে রাষ্ট্র; আর পরিবার-রাষ্ট্রের পতি হচ্ছে পরিবারের প্রধান পুরুষটি। রাষ্ট্র পরিবারের প্রধান পুরুষটির মাধ্যমে শাসন করে নাগরিকদের। এ-শাসনের বিশেষ শিকার নারীরা। যে-সব পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের আইনসঙ্গত নাগরিক অধিকারও দেয়া হয়েছে, সেখানেও দেখা যায় নারী শাসিত হয় পরিবারের দ্বারাই। রাষ্ট্রের সাথে সাধারণত নারীদের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না, বা থাকে খুবই সামান্য।
পিতৃতন্ত্রের তিনটি সংস্থা–পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত, ও পরস্পরনির্ভরশীল। টিকে থাকার জন্যে পিতৃতন্ত্র পরিবারের প্রধান পুরুষটিকেই দিয়েছে সমস্ত কর্তৃত্ব; এবং তা ধর্মীয় বিধানের সাহায্যে বিধিবদ্ধ করেছে। মনুসংহিতায় [৯:৩] বলা হয়েছে, ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি’ : কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে নারীকে; নারী স্বাধীনতার অযোগ্য। ইহুদিধর্মে পিতা পেয়ে থাকে পুরোহিতের অধিকার; বাইবেলে সদাপ্ৰভু নারীকে বলে, ‘সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করিবে [মানবজাতির পাপে পতন : আদিপুস্তক]; ক্যাথলিকদের বিধান হচ্ছে ‘পিতাই পরিবারের কর্তা’; কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কর্তা’ [৪:৩৪]; এবং হাদিসে পুরুষকে দ্বিতীয় বিধাতায় পরিণত করা হয়েছে : ‘যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে’ [ দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮১)]। আধুনিক সরকারগুলো মেনে চলে এসব বিধানই; সব ক্ষেত্রেই পুরুষকে গণ্য করে পরিবারের প্রধানরূপে।
পিতৃতন্ত্রে পিতা কুলপতি; তিনিই সব কিছুর মালিক। পিতা মালিক তার স্ত্রীর বা স্ত্রীদের, সন্তানদের; পিতার অধিকার রয়েছে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রহারের, এমনকি বিক্রি ও হত্যার! পিতৃতন্ত্রে আত্মীয়তার ধারা পুরুষপরম্পরায় প্রবাহিত হয়; উত্তরাধিকার নির্ণয় করা হয় পুত্রপৌত্রাক্রমে। দুহিতা ও দৌহিত্রাক্রম এক সময় হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। গোত্ৰতা অনুসারে নারীপরম্পরার উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তিব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ক্রিয়াকলাপ, রোমের পত্রিয়া পোতেসতেস অনুসারে, প্রথম নির্দেশ করেছিলেন হেনরি মেইন। তাঁর মতে পরিবারের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুরুষটি সার্বভৌম। তার আধিপত্য জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রসারিত; আর ওই আধিপত্য তার সন্তানাদি, তাদের ঘরবাড়ি থেকে দাসদাসীর ওপর বিস্তৃত। আদিম পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে জ্যেষ্ঠ পুরুষটির একনায়কত্বের অধীনে সবাই ও সব কিছু-স্ত্রী, সন্তান, জমিজমা, সজীব বা অজীব সম্পত্তি, দাসদাসী প্রভৃতি। মেইন অবশ্য মনে কবতেন যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বিশ্বজনীন ব্যাপার, কিন্তু তা নয়। অনেকেই মনে করেন যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ পরে, নারীদের অধিকার ধীরেধীরে হরণ করে। সাম্প্রতিক পিতৃতন্ত্রে পুরুষের আধিপত্য কিছুটা কমানো হয়ছে নারীদের কিছুটা অধিকার দিয়ে; যেমন দেয়া হয়েছে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার। তবে তারা এখনো স্বামীদের অস্থাবর সম্পত্তিই রয়ে গেছে। পিতৃতন্ত্র পরিবারকে দেয় একটি বড়ো দায়িত্ব, আর পরিবার সেটি পালন করে চমৎকারভাবে। পরিবারকে দেয়া হয় তার সন্তানসন্ততিদের সামাজিকীকরণের ভার। পরিবার পিতৃতন্ত্রের আদর্শানুসারে গড়ে তোলে পুত্র ও কন্যাদের, শিখিয়ে দেয়। তারা পালন করবে। কোন ভূমিকা, কার মেজাজ হবে কেমন, আর অবস্থান হবে কোথায়। রয়েছে পিতৃতন্ত্রের আরো নানা সংস্থা-বিদ্যালয়, পুরোহিত, প্রচারমাধ্যম, এবং কী নয়? প্রতিষ্ঠা করা হয় জীবনের সমস্ত এলাকায় পুরুষাধিপত্য, নারীকে করা হয় অধীন। পিতৃতন্ত্র নারীর সতীত্বের ও সন্তানের বৈধতার ওপর দিয়ে থাকে চরম গুরুত্ব; এর কারণও পুরুষাধিপত্য অক্ষুন্ন রাখা। এর সাহায্যে সন্তান ও মাতাকে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ক’রে তোলা হয় পুরুষের ওপর।
[চার] শ্রেণী
লিঙ্গের ক্ষেত্রে বর্ণ দুটি : ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্র। পুরুষ ব্ৰাহ্মণ, নারী শূদ্র বা পুরুষ বুর্জোয়া, নারী প্রলেতারিয়েত। তবে লিঙ্গের এলাকায় শ্রেণী ব্যাপারটি ঢাকা থাকে ধুয়োজালে, তাই সত্য সহজে চোখে পড়ে না। যে-সমাজে মানুষের অবস্থান বা মর্যাদা নির্ভর করে সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষাগত পরিস্থিতির ওপর, সেখানে কিছু নারী কিছু পুরুষের ওপরে মর্যাদা পায়; এ-কারণেই ঘোলাটে হয়ে ওঠে লিঙ্গগত শ্রেণীর ব্যাপারটি। একটি উদাহরণ দিই। হিন্দুসমাজের একজন শূদ্র চিকিৎসক বা আইনজীবী শিক্ষা ও অর্থের কারণে একজন ব্ৰাহ্মণ চাষীর থেকে বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ব্ৰাহ্মণটি বর্ণের কারণেই ভোগ করে বেশি মর্যাদা। নিম্নবর্ণের চিকিৎসক বা আইনজীবী অর্থ ও শিক্ষা দিয়েও ওই মর্যাদা আয়ত্ত করতে পারে না, বরং ভোগ করে মানসিক যন্ত্রণা। ঠিক তেমনই একটি শ্রমিক বা রিকশাআলা নিজের পৌরুষের জন্যেই উচ্চ শ্রেণীর নারীর থেকেও বেশি মর্যাদা পায় বা দাবি করে। তৈক্তিরীয় সংহিতায় আছে, ‘সর্বগুণান্বিতা নারীও অধমতম পুরুষের থেকে হীন।’ ইসলামে একজন পুরুষ দুজন নারীর সমান; ওই পুরুষটি যে-ই হোক, ওই দুই নারী যারাই হোক। কোরানে আছে : ‘তোমাদের পছন্দ মতো দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে, আর যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তবে একজন পুরুষ ও দুজন স্ত্রীলোক’ [২ : ২৮২]; তাই একটি বিকলাঙ্গ ভিখিরিও একজন মহিলা রাষ্ট্রপতির দ্বিগুণ মৰ্যাদাসম্পন্ন। পাকিস্তানে একটি পুরুষ চোরকে শনাক্ত করতে দরকার হয় দুটি নারীপুলিশ! জনহীন কক্ষে নারী প্রধান মন্ত্রীও অসহায় হয়ে উঠতে পারে তার ভূত্যের কাছে; ভূত্য হয়ে উঠতে পারে প্রভু আর নারী প্রধান মন্ত্রী দাসী। যে-অঞ্চলে পিতৃতন্ত্র যতো উগ্র, সেখানে নারীর শ্ৰেণী-অবস্থান ততো নিচে ও ততো স্পষ্ট। পাশ্চাতো পিতৃতন্ত্র কিছুটা নমনীয় ব’লে সেখানে নারীর শ্রেণীগত অবস্থান ততোটা নিচে নয়, কিন্তু প্রাচ্যে উগ্র অনমনীয় পিতৃতন্ত্র নারীকে শূদ্র করে রেখেছে। হিন্দু আর মুসলমানদের একটি বড়ো অংশ উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রের ধারক বলে এ-দু-সমাজে আজো নারীদের শ্রেণীগত অবস্থান অত্যন্ত নিচে।
পিতৃতন্ত্রের একটি সুন্দর ষড়যন্ত্র হচ্ছে নারীদের এক শ্রেণীকে লাগিয়ে রাখা আরেক শ্রেণীর বিরুদ্ধে; বেশ্যার বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা সতীকে, কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা গৃহিণীকে। একদল ঈর্ষা করে আরেক দলের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তাকে; আবার আরেক দল নিরাপত্তা মৰ্যাদার অবরোধের মধ্যে বাস ক’রে ঈর্ষা করে অন্য দলের স্বাধীনতা ও মুক্তিকে। পুরুষ বিচরণ করে ঘরে-বাইরের দু-জগতেই; আর নিজের সামাজিক আর্থনীতিক ক্ষমতার সাহায্যে নারীদের দু’দলকে লিপ্ত রাখে চিরশত্ৰুতায়। নারী জন্মসূত্রে কোনো এক বিশেষ পরিবার ও শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু আসলে নারী কোনো পরিবার বা শ্রেণীর সাথেই অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নয়। নারী যেহেতু আর্থিকভাবে পুরুষনির্ভর, তাই যে-কোনো শ্রেণীর সাথে তার সম্পর্ক অস্থির ও অনিশ্চিত, যে-কোনো সময় তা ছিন্ন হয়ে নারী নেমে যেতে পারে নিম্নতম শ্রেণীতে। নারীর কখনোই শ্রেণী-উন্নতি ঘটে না; যদি জন্মশ্রেণীতে থাকতে না পারে, তাহলে ঘটে তার শ্রেণী-অবনতি। হিন্দুসমাজে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ বলে দু-রকম বিয়ে রয়েছে। নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর বিয়ে প্রতিলোম বিবাহ; এবং উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর বিয়ে অনুলোম বিবাহ। অনুলোম বিবাহে উচ্চবর্ণের পুরুষকে বিয়ে ক’রেও নারীর বর্ণোন্নতি ঘটে না, আর প্রতিলোম বিবাহের ফলে নারীর ঘটে বর্ণচ্যুতি; অর্থাৎ সমাজচ্যুতি। জর্মনিতেও ছিলো একই রীতি। মধ্যযুগে জার্মনিতে একজন নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যখন উচ্চশ্রেণীর নারীকে বিয়ে করতো, প্রতিলোম বিয়ের মতো নারীটি থাকতো জাতিচ্যুত; আবার নিম্নশ্রেণীর নারী যখন কোনো উচ্চশ্রেণীর পুরুষকে বিয়ে করতো তখন সে স্বামীর শ্রেণীতে উঠতো না [দ্র ভূপেন্দ্রনাথ (১৯৪৬, ৮৬-৮৯)]। মুসলমানদের মধ্যেও একই রকম ঘটে; উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা দাসীসম্ভোগে উৎসাহ বোধ করে, ধর্মে তার বিধানও রয়েছে, এবং বাধ্য হয়ে বিয়েও করে; কিন্তু ওই নারীটির শ্রেণী-উন্নতি ঘটে না। এখনো শিক্ষিত কোনো নারী যদি বিয়ে করে কোনো অশিক্ষিত পুরুষকে, তবে পুরুষটির উন্নতি ঘটে না; সৃষ্টি হয় এক কেলেঙ্কারি, নারীটি সমাজের তলদেশে নেমে যায়। তার কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। শুধু নিজের ওপর নির্ভর করতে হ’লে খুব কম নারীই শ্রমিক শ্রেণীর চেয়ে কোনো উচ্চশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। কোটিপতির স্ত্রী একদিনে দাসী হয়ে উঠতে পারে। তাই তারা পরগাছার মতো জীবন ধারণ করে–তারা হয় পরগাছার পরগাছা; এবং নিজেদের রক্ষার জন্যেই হয়ে ওঠে রক্ষণশীল, যারা তাদের ভরণপোষণ করে তাদের সমৃদ্ধির সাথে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের জীবনকে জড়িয়ে রাখার। দাস যেমন প্রভুর সমৃদ্ধিকে মনে করে নিজের সমৃদ্ধি নারীও স্বামীর বা পুত্রের, অর্থাৎ পুরুষের, সমৃদ্ধিকে মনে করে নিজের সমৃদ্ধি। তারা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবতেও পারে না।
[পাঁচ] আর্থ ও শিক্ষা
নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পিতৃতন্ত্র সমস্ত আর্থ কর্তৃত্ব রেখেছে পুরুষের হাতে। সমস্ত পিতৃতন্ত্ৰেই, হিন্দু-ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমান, নারীর কোনো আর্থ অস্তিত্ব নেই। কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কর্তা,… আর এজন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে’ [৪:৩৪]। নারী নিজের অধিকারে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে বা সম্পত্তির মালিক হতে পারতো না। এখন এ-বিধি কিছুটা শিথিল হয়েছে, কিন্তু তাতে নারীর আর্থভিত্তি শক্ত হয় নি। নারী চিরকালই খেটেছে, পুরুষের চেয়ে বেশিই খেটেছে; কিন্তু তার পারিশ্রমিক পায় নি। আধুনিক ভদ্র পিতৃতন্ত্রে নারী কিছুটা আর্থ অধিকার পেয়েছে, কিন্তু সেখানেও নারীরা পুরুষের সমান পারিশ্রমিক পায় না। অর্থের ওপরই যেখানে নির্ভর করে সম্মান ও স্বাধীনতা, সেখানে এর অভাবের পরিণতি মারাত্মক। তারই শিকার নারী। নারীদের অধীনতার মূল কারণ আর্থিক পরনির্ভরতা; অর্থের অভাবেই তারা পরাশ্রিত। নারীরা খেখানে কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়, বেতন পায় পুরুষদের থেকে কম; উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরাও কম যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষদের থেকে কম বেতন পায়। চাকুরিতে তাদের উন্নতিও ঘটে না। আধুনিক পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নারীদের রাখা হয় সংরক্ষিত শ্রমশক্তি হিশেবে। বিপদে পড়লে উগ্র পিতৃতান্ত্রিক দেশগুলোও অবরোধ ও বোরখার ভেতর থেকে বের করে আনে তাদের সতীসাধ্বী নারীদের। যুদ্ধ বা সংকটের সময় পুরুষতন্ত্র ঘর থেকে বের ক’রে এনে নানা কাজে লাগায় নারীদের, আবার শান্তির সময় তাদের দলবেঁধে ঢোকোনো হয়। ঘরে। তখন বলা হয় গৃহই নারীর নিজের ভুবন, নারীই গৃহের শান্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিমের দেশগুলো নারীদের লাগায় সমস্ত কাজে–এমনকি সৈনিকদের চিত্ত ও শরীরবিনোদনের কাজে, এবং যদ্ধের পর ঢোকায় ঘরে। ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ঘটে যুদ্ধের থেকেও তাৎপৰ্যপূর্ণ এক ঘটনা। যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে সৌদি আরবের মতো কঠোর পিতৃতন্ত্ৰও নারীদের ঘর থেকে বের ক’রে লাগায় নানা ‘সেবামূলক’ কাজে। যুদ্ধের সময় গৌণ হয়ে যায় পিতৃতন্ত্রের বিধান; কিন্তু যুদ্ধশেষেই তা আবার প্রবলভাবে জেগে ওঠে, নারীদের পালে পালে ঢোকানো হয় ঘরে । যুদ্ধের পরে সৌদি পিতৃতন্ত্র নারীদের সাথে আদিম আচরণ করতে ভোলে নি; তাদের এমনকি গাড়ি চালানোর অধিকারও দেয় নি। কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত নারী বিদ্রোহ করেন, নিজেরা গাড়ি চালিয়ে বেড়িয়ে পড়েন; সৌদি পিতৃতন্ত্র তাঁদের গ্রেফতার করে, চাকুরিচ্যুত করে, এবং আরো নানা হিংস্ৰ শাস্তি দেয়, যা বাইরের জগত আজো জানতে পারে নি। সমাজতান্ত্রিক দেশে নারীদের অধিকাংশই নিয়োজিত নিচের শ্রেণীর কাজে, তবে কিছু পেশায় সেখানে নারীদের আধিক্য রয়েছে, যেমন চিকিৎসায়। কিন্তু এখানেও পিতৃতন্ত্র কৌতুক করে নারীদের নিয়ে। যে-পেশায়ই নারীরা ঢোকে, হ্রাস পায় সে-পেশারই মূল্য, কমে যায় বেতন। নারীরা যেমন বিনাবেতনে পরিবারের সেবা করে, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজও মনে করে যে নারীর চাকুরি হচ্ছে সেবা । পুরুষের কাছে সেবা প্রত্যাশা করা হয় না, কিন্তু নারী যেখানেই কাজ করে সেখানেই তার কাছে সেবা চাওয়া হয়, যেনে টাকার তার কোনো দরকার নেই। নারীকে অসহায় ক’রে রাখার জন্যে এটা এক সুন্দর চক্রান্ত ।
নারীর আর্থ স্বাধীনতাকে দেখা হয় কুটিল সন্দেহের চোখে । তাই পিতৃতন্ত্রের সমস্ত সংস্থা প্রচার চালায় নারীর, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীর, পেশাগ্রহণের বিরুদ্ধে। নিম্নবিত্ত নারী নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই, তারা তো নিম্নকাজের জন্যেই জন্মেছে, খুব সস্তায় পাওয়া যায় তাদের; কিন্তু বড়োই উদ্বিগ্ন তারা মধ্যবিত্ত নারীকে নিয়ে। পরিবার, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান, প্রচারমাধ্যম ও আরো নানা সংস্থা তিরষ্কার করতে থাকে পেশাজীবী নারীদের। বাঙলার প্রথম উচ্চশিক্ষিত নারীরা পিতা, বা স্বামীর পবিবারের আদেশে, বা সামাজিক নিন্দায় পেশাগ্ৰহণ থেকে বিরত থেকেছেন বা পেশাগ্রহণে বিলম্ব করেছেন: অনেকে বিয়ের পর বিয়েকেই পেশারূপে গণ্য ক’রে আর্থিক চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। নিম্নশ্রেণীর নারীদের কাজ নিয়ে পিতৃতন্ত্রের দুশ্চিন্তা নেই, বরঙ তারা কাজ না করলেই আতংকিত বোধ করে করে পিতৃতন্ত্র; কারণ তারা শস্তা। তারা মধ্যবিত্ত নারীদের মতো ভয়াবহ নয়, তাদের নিয়ে কোনো ভয় নেই। মধ্যবিত্ত নারীরা যদি কাজ করে-বিচার, চিকিৎসা, অধ্যাপনা করে, আমলা হয়, তাহলে তা পিতৃতন্ত্রের বা পুরুষতন্ত্রের আর্থ ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটাকেই ভেঙে দিতে পারে। পেশাজীবী নারীরা আসলে নিযুক্ত থাকে দুটি পেশায়;— তাদের ঘরসংসার দেখতে ও সন্তান পালন করতে হয়, আর পালন করতে হয় পেশার দায়িত্ব। পেশাকে তারা পুরোপুরি পেশা হিশেবে নিতে পারে না, পরিবারই হয়ে থাকে তাদের মূলপেশা। পৃথিবী জুড়ে নারীরা যে-সব পেশায় এখন জড়িত, তা শ্রমিকের পেশা: তাই তাদের নির্দেশ করা যায় সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রধান শ্রমিক শ্রেণীরূপে।
পৃথিবী জুড়ে নারী এখনো শিক্ষা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে; আর যারা শিক্ষা পাচ্ছে, তারাও ঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না। পুরুষতন্ত্র তাদের সে-শিক্ষাই দিতে আগ্রহী, যা নারীদের নারী ক’রে রাখে, যা পরিশেষে কল্যাণে আসে পুরুষের। পুরুষ প্রথমে নারীদের লেখাপড়া শেখাতেই রাজি হয় নি, বা মূর্খের মতো কিছুটা ধর্মশাস্ত্ৰ শিখিয়েছে; পরে যখন বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে, তখনো বের করেছে বিশেষ একধরনের নারীশিক্ষা। উনিশশতকের বাঙলার নারীশিক্ষার এ-রূপ সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসু (১৮৭৪, ৪৭-৪৮) বলেছেন, ‘স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ শিক্ষা দেওয়া হইতেছে, তাহা তাহাদিগকে কেবল অশ্লীল গল্প ও নাটক পাঠে পারগ করে’, আর ‘তাহারা কেবল কার্পেটই বুনছে, কার্পেটই বুনছে। যদি তাহা না করিয়া পিরাণ শিলাই করিতে শিখে, তাহা হইলেও জানিলাম যে, কিছু উপকারে আইল।‘ পুরুষ নিজের স্বার্থে নারীদের যে শিক্ষা দেয়, তা হয়ে ওঠে এমনই নিরর্থক ও হাস্যকর। পুরুষদের একটি যুক্তি হচ্ছে নারীর দেহ সব রকম শিক্ষার উপযুক্ত নয়। ক্রীতদাস একসময় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। প্রভুর দর্শনে, নারীরাও প্রচার করে পুরুষের দর্শন। এর পরিচয় পাওয়া যায় শিক্ষিতা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর উক্তিতে। এ-আধুনিকাও মনে করেন, ‘গৃহধর্ম নারীজীবনের সারবস্তু, যাহার জন্য সমাজে নারীর স্থান ও মান’, আর নারীর দেহ খুবই পেলাব, তাই তিনি ‘বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে’ বলেছেন যে ‘পরীক্ষা দেওয়াই নারীজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নহে।’ এ-আধুনিকার মতে, বঙ্গরমণীর শরীর মন ও ভবিষ্যৎ জীবনের গঠন স্মরণ রাখিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কঠিন সংগ্রামে তাহাদের যোগ দিতে না দেওয়াই ভালো।‘ কারণ ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষের ভবিষ্যৎ জীবন এমন স্বতন্ত্র ছাচে ভগবান টালিয়াছেন, তখন শেষ পর্যন্ত তাহাদের একই রকম শিক্ষা দেওয়া কখনই সমীচীন নহে’ [ দ্র ইন্দিরা (১৯২০, ১৩-১৫)। এ হচ্ছে নারীর কণ্ঠে পুরুষতন্ত্রের উক্তি, বা দাসীর মুখে প্রভুর ভাষা। আধুনিক পিতৃতন্ত্রগুলো এখন নারীদের জন্যে উচ্চশিক্ষার সমস্ত দরোজা খুলে দিয়েছে; তবে নারীপুরুষের উচ্চশিক্ষার বিষয় ও মানে পরিকল্পিত পার্থক্য রাখতে তারা ভোলে নি। শৈশব থেকেই পিতৃতন্ত্র ঠিক ক’রে দেয় ছেলেরা ঢুকবে কোন দরোজা দিয়ে আর মেয়েরা কোন দরোজা দিয়ে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু নারীর বিষয় কিছু পুরুষের বিষয়। মনে করা হয় যে নারীরা পড়বে মানববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার কিছু গৌণ বিষয়; আর পুরুষেরা পড়বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রকৌশল, ব্যবসাশাস্ত্র প্রভৃতি। আজকের পৃথিবীতে মান-সম্মান-অর্থ রয়েছে। পুরুষের বিদ্যাগুলোতে; আর এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে রাজনীতিক আধিপত্য বা শক্তি। পিতৃতন্ত্র লিঙ্গানুসারে মর্যাদা স্থির করে; যে-সমস্ত এলাকায় পুরুষের আধিপত্য সেগুলো ভোগ করে অবিমিশ্র মর্যাদা, আর যেগুলোতে পুরুষের প্রাধান্য নেই বা রয়েছে নারীর অংশ, সেগুলোর মর্যাদা কম। তাই মানববিদ্যা পায় কম মর্যাদা, কেননা এগুলোতে পুরুষাধিপত্য নেই; আর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, ব্যবসা, সামরিক বাহিনী পায় নিরঙ্কুশ মর্যাদা, কেননা এগুলোতে পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ অপ্রতিহত।
[ছয়] বলপ্রয়োগ
পিতৃতন্ত্র নিজের আদর্শ বিশ্বজনীনভাবে বাস্তবায়নের জন্যে প্রধানত আশ্রয় নেয় সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার; কিন্তু দরকার হলে বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে না। সামাজিকীকরণের পেছনে বলপ্রয়োগের ভয়টাকে সব সময়ই জাগিয়ে রাখে; ত্রস্ত ক’রে রাখে সবাইকে, যাতে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয় পিতৃতন্ত্রের অনুশাসন। অধিকাংশ পিতৃতন্ত্র বলপ্রয়োগ ক’রে থাকে তার আইনপদ্ধতির মাধ্যমে; আইনপদ্ধতি হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা। যেমন, ইসলামে যৌনবিধি লংঘনের শাস্তি খুব কঠোর। বিধান হচ্ছে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবে রখনো একজন মোল্লার নেতৃত্বে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয় ব্যভিচারিণীদের। আগে অনেক সমাজে পুরুষের ব্যভিচারকে কোনো অপরাধ ব’লেই ধরা হতো না। যখন অপরাধ গণ্য করা হতো, তখন সেটাকে মনে করা হতো কোনো পুরুষের সম্পত্তির ওপর অন্য পুরুষের হস্তক্ষেপ বলে। ব্যভিচারের শাস্তির বিধিও ছিলো একক শ্রেণীর জন্যে একেক রকম; যেমন জাপানে সামুরাইরা নিজেদের মহিমা রাখার জন্যে হত্যা করতে বাধ্য হতো তাদের ব্যভিচারিণী স্ত্রীদের; কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের তেমন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। প্ৰায় সব সমাজেই দেখা গেছে নিম্নশ্রেণীর কোনো পুরুষ যখন উচ্চ শ্রেণীর নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে, তখন শিরচ্ছেদ করা হয়েছে দুজনেরই; কিন্তু উচ্চশ্রেণীর পুরুষ যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে নিম্নশ্রেণীর নারীর সাথে, তখন নারীটি অসতী ব’লে সমাজচ্যুত হ’লেও পুরুষটির কোনো শাস্তি হয় নি। এখনো এই নিয়ম। নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যখন উচ্চশ্রেণীর নারীর সাথে ব্যভিচারে জড়িত হয়, তখন তারা অপরাধ করে উচ্চশ্রেণীটির বিরুদ্ধে, তাই তারা দুজনেই পায় চরম শাস্তি। এটা দ্রোহিতার শাস্তি, চলে ব্যভিচারের নামে।
পিতৃতন্ত্র তার বলপ্রয়োগের অধিকার অর্পণ করেছে পুরুষের ওপর। সমাজের নিম্নশ্রেণীর পুরুষেরা তাদের এ-অধিকার নিয়মিত প্রয়োগ ক’রে থাকে; আর উচ্চশ্রেণীর পুরুষেরা তা শারীরিকভাবে প্রয়োগ না করলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রয়োগ করে ভালোভাবেই। পুরুষ মানেই সে পীড়নের অধিকার রাখে, যদিও সে পীড়ন নাও করতে পারে-এটা তার স্বাধীনতা; আর পিতৃতন্ত্র নারীকে এমনভাবে দীক্ষা দেয় যেনো সে পীড়নের শিকার হাতে বাধ্য থাকে, পীড়নকে সঙ্গত বলে মেনে নেয়। কোনো পুরুষ যখন কোনো নারীকে আক্রমণ করে, নারীটি সশস্ত্ৰ হ’লেও সহজেই অসহায় হয়ে পড়ে, কেননা পিতৃতন্ত্র তাকে শারীরিক মানসিকভাবে এভাবেই তৈরি করেছে। পিতৃতন্ত্রের নারীর ওপর বলপ্রয়োগের হিংস রূপ হচ্ছে বলাৎকার বা ধর্ষণ। আমাদের দেশে বলাৎকার নিয়মিত ঘটনা, যাতে প্ৰকাশ পায় আমাদের পিতৃতান্ত্রিক হিংস্রতা। অধিকাংশ বলাৎকারের ঘটনাই লোকলজ্জার ভয়ে নারীরা প্ৰকাশ করে না। আগে অনেক সমাজে বলাৎকারকে কোনো নারীর ওপর পীড়ন ব’লেও গণ্য করা হতো না, গণ্য করা হতো এক পুরুষের কাছে আরেক পুরুষের অপরাধ বলে, যাতে একটি পুরুষ দূষিত করেছে আরেকটি পুরুষের নারীসম্পত্তি। ফ্রয়েড তো এমন সিদ্ধান্তেই তার অনুসারীদের পোঁছে দেন যে বলাৎকার নারীর জন্যে এক ধরনের সুখ! ধর্ষণ লিঙ্গরাজনীতির এক চরম রূপ। সাহিত্যেও বলাৎকার ব্যাপারটি পুরুষেরা উপভোগ করে থাকে, লেখকেরাও ধর্ষণ বর্ণনার সময় উপভোগ করেন নারীকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করার সুখ।
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসেও মুক্তি ও যুদ্ধের থেকে অনেক সময় বড়ো হয়ে উঠেছে ধর্ষণ। সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১, ১৫১) থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। পাকিস্তানি মেজরটি বিলকিসকে শারীরিক ধর্ষণের আগে ধর্ষণ করে মানসিকভাবে, যা শারীরিক ধর্ষণের থেকে অনেক বেশি হিংস্র। মানসিক ধর্ষণের রূপটি এমন :
‘আমাকে একটা কথা বলো, হিন্দুরা কি প্রতিদিন গোসল করে?’
নীরবতা।
‘হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটু গন্ধ?’
নীরবতা।
‘তাদের জায়গাটা পরিষ্কার?’
নীরবতা।
‘আমি শুনেছি, মাদী কুকুরের মতো। সত্যি।’
‘নীরবতা।
‘শুনেছি, হয়ে যাবার পর সহজে বের করে নেয়া যায় না?’
নীরবতা।
‘আমাকে কতক্ষণ ওভাবে ধরে রাখতে পারবে?’
ধর্ষণের আগে এই যে মানসিক ধর্ষণ ও জাতিবিদ্বেষ, এতে শুধু পাকিস্তানি মেজরটি অংশ নেয় নি, অংশ নিয়েছেন লেখক নিজে ও সমগ্র পিতৃতন্ত্র। এমন পুরুষ পাওয়া যাবে না যে বাস্তবে না হ’লেও মনে মনে কোনো নারীকে বলাৎকার করে নি। পিতৃতন্ত্রের নারীবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে বিপুল পরিমাণে রচিত নারীবিদ্বেষমূলক সাহিত্যে। ভারতে, চীনে, জাপানে ও ইউরোপে লেখা হয়েছে। এ-ধরনের বিপুল সাহিত্য। পিতৃতন্ত্র নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে নানাভাবে : ভারতে সতীদাহ, চীনে কাঠের জুতো, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে মেয়েদের ভগান্ধুর কেটে ফেলা নিষ্ঠুরতার উদাহরণ। নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের শেষ নেই। পুরুষ চায় নারীকে সব সময় ত্রাসের মধ্যে রাখতে।
[সাত] নৃতাত্ত্বিক : পুরাণ ও ধর্ম
পিতৃতন্ত্র নারী সম্পর্কে পোষণ করে যে-সব বদ্ধমূল ধারণা, নারী তার কোনোটিরই স্রষ্টা নয়। ওই সব ধারণা সৃষ্টি করেছে পুরুষ। নারীর যে-ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার বছরে, তার শিল্পীও পুরুষ। নারীর ওই ভাবমূর্তি পুরুষ সেভাবেই তৈরি করেছে, যা পুরুষের চাহিদা মেটায়। নৃতত্ত্ব, ধর্মীয় ও সাহিত্যিক পুরাণে রূপায়িত হয়ে আছে নারী সম্পর্কে পুরুষতন্ত্রের বিচিত্র ধারণা। পুরুষতন্ত্রের নারীধারণার মূলকথা নারী নিকৃষ্ট; কেননা নারীর শরীর ভিন্ন। নারীকে পুরুষ নিজের গোত্রের ব’লে মনে করে নি, মনে করেছে। ‘অপর’ বা শত্রু; তাই তাকে পীড়ন করার জন্যে তার ওপর বিস্তার করেছে। ব্যাপক আধিপত্য। তাকে বলেছে বিকলাঙ্গ, ঘেন্না করেছে তাকে কলুষিত বা অশুচি বলে; রেখেছে নিজের পবিত্র সীমা থেকে দূরে। নারীর যৌন বা শারীর ব্যাপারগুলোকে বিশ্বজনীনভাবেই গণ্য করা হয় অশুচি ব’লে, যার পরিচয় পাওয়া যায় পুরাণে, ধর্মগ্রন্থে, সাহিত্যে। নারীদের সৃষ্টিশীল পর্বের একটি নিযামত ব্যাপার ঋতুস্রাব। পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে একে অত্যন্ত অশুচি ব’লে বার বার উল্লেখ করে নারীকে দেখানো হয়েছে একটি অসুস্থ অশুচি প্রাণীরূপে, যদিও ব্যাপারটি রোগও নয় অশুচিতাও নয়। আদিম সমাজে ঋতুকালে নারীদের গ্রামের প্রান্তে কুঁড়েঘরে রাখা হয়; এবং সভ্য সমাজেও এ-সময় নারীকে গণ্য করা হয় অস্পৃশ্য। নারী ঋতুকালে যে-যন্ত্রণা বোধ করে, তার অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক, কিন্তু তা-ই পুরুষতন্ত্রের বিধিবিধানের ফলে শারীরিক হয়ে ওঠে।
আদিম সমাজে নারীর যোনিকে মনে করা হয় একটি ক্ষত। তারা বিশ্বাস করে ওই স্থানে কোনো পাখি বা সাপ গর্ত খুঁড়ে ক্ষত সৃষ্টি ক’রে গেছে; তাই মাসে মাসে ওই ঘা থেকে রক্ত চোয়ায়। ফ্রয়েডীয়রাও মনে করেন নারী হচ্ছে খোজা। অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র নারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে দেখে ঘৃণার চোখে; কিন্তু নিজের অঙ্গটিকে দেখে গর্ব ও গৌরবের চোখে। আদিম ও আধুনিক সব সমাজেই শিশ্ন বা পুরুষাঙ্গকে মনে করা হয় পৌরুষের অপরাজেয় ঝাণ্ডা। একে নিয়ে পুরুষের গর্ব গৌরব ও উদ্বেগ অশেষ। বাঙলা ‘পুরুষাঙ্গ’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, শব্দটিতে প্রকাশ পেয়েছে বাঙালির জাতীয় বিশ্বাস : পুরুষের সব অঙ্গই পুরুষাঙ্গ, কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বাদ দিয়ে নির্বোধ প্রত্যঙ্গটিকেই দেয়া হয়েছে পুরুষের সম্মান ও গৌরব। এতে বোঝা যায় বাঙালি একে কতো মহৎ মনে করে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এর যে-সব নাম রয়েছে, যেমন ‘সোনা’, ‘ধন’, সেগুলোও নির্দেশ করে এটি কতো অমূল্য। সব পিতৃতন্ত্রই নারীকে নিষিদ্ধ ক’রে রেখেছে পবিত্র এলাকা থেকে; তারা যুদ্ধ ও ধর্মীয় অনেক বস্তু ছুঁতে পারে না, এমনকি খাদ্যও স্পর্শ করেতে পারে না। আদিম সমাজে, এবং আমাদের সমাজেও, পুরুষের সাথে নারীদের খাওয়া নিষেধ। এ-বিধানের মূলে রয়েছে এমন ভয় যে দূষিত নারী থেকে কোনো ব্যাধি সংক্রমিত হবে পুরুষের দেহে। নারী খাদ্য প্রস্তুত করে, কিন্তু পুরুষের সাথে খেতে পারে না; অনেক সমাজে খাবার পরিবেশনও করতে পারে না। প্রত্যেক পিতৃতন্ত্রেই পুরুষ আগে, বেশি ক’রে, ও ভালোটা খায়; আর যেখানে তারা একসাথে খায়, সেখানেও নারী পরিবেশন করে, পুরুষ খায়।
প্ৰত্যেক পুরুষতন্ত্র কুমারীত্ব ও কুমারীত্বমোচনকে ঘিরে রেখেছে একরাশ আচার ও নিষেধে। অনেক আদিম সমাজে কুমারীত্ব নিয়ে রয়েছে চমৎকার বিপরীত মনোভাব! একদিকে প্রত্যেক পিতৃতন্ত্র একটি অক্ষত যোনি পাওয়ার জন্যে ব্যগ্র, কেননা পুরুষেরা নিজের জিনিশ অব্যবহৃত টাটকা অবস্থায় পেতে চায়; আবার অনেক সমাজ সতীচ্ছদসম্পন্ন অক্ষত যোনিকে ভয়ঙ্কর ভয়ও পায়। কোনো কোনো সমাজে কুমারীত্বমোচনকে এমন ভয়ঙ্কর শুভ কাজ ব’লে মনে করা হয় যে পুরুষটি তার নারীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করতে ভয় পায়, সে ওই পবিত্র কাজের দায়িত্ব তুলে দেয় তার চেয়ে শক্তিমান বা বয়স্ক কারো ওপর। পুরুষতান্ত্রিক পুরাণ এমন এক সোনালি যুগের কথাও বলে যখন আবির্ভাব ঘটে নি নারীর। বাস্তবে এটা রূপ নেয়। নারীসঙ্গ পরিহারের। পুরুষের পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী নিষিদ্ধ: সাম্প্রতিক পিতৃতন্ত্রে সমস্ত শক্তিমান সংঘই পুরুষ সংঘ। পুরুষ সংঘগুলো হচ্ছে পুরুষপ্রাধান্য রক্ষার দুর্গ।
আদিম সমাজের নারীবিদ্বেষ এক সময় রূপ পায় পৌরাণিক উপাখ্যানে; এবং আরো পরে তাকে দেয়া হয় নৈতিক, সাহিত্যিক, এমনকি বৈজ্ঞানিক রূপ। অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান নারীর বিরুদ্ধে সরাসরি অপপ্রচার। পশ্চিমের দুটি বিখ্যাত পৌরাণিক উপাখ্যান হচ্ছে প্যান্ডোরার সিন্দুক ও বাইবেলের মানুষের পতনের কাহিনী। এ-দুটিই নারীবিদ্বেষের অসামান্য উপাখ্যান। নারী অশুভ; এমন একটি আদিম বিশ্বাস এ-উপাখ্যান দুটিতে সাহিত্যিক ও ধর্মীয় রূপ পেয়ে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত প্রভাবশালী। প্যান্ডোরা সম্ভবত ছিলো ভূমধ্যসাগরীয় কোনো উর্বরতার দেবী, যে পরে মহিমাচ্যুত ও নিন্দিত হয়। কবি হেসিয়ডের মতে প্যান্ডোরাই প্রথম সূচনা করে কাম বা যৌনতার, এবং ওই কামের পাপেই পৃথিবী থেকে লোপ পায় সে-স্বর্ণযুগ, ‘যখন মানবজাতি পৃথিবীতে যাপন করছিলো নিষ্পাপ জীবন, যখন মানুষকে করতে হতো না কোনো শ্রমসাধ্য কাজ, এবং ভুগতে হতো না রোগে৷’ (দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৫১)}। হেসিয়ডের মতে, প্যান্ডোরাই ‘সূচনা নারকীয় নারীজাতির, যে-মহামারীকে নিয়ে বাস করতে হচ্ছে পুরুষদের।‘ নারীকে দায়ী করা হয়েছে পুরুষের দুর্দশার জন্যে; এ-দুর্দশার মূল কারণরূপে দেখানো হয়েছে কামকে, যা হচ্ছে নারীর একান্ত অনন্য জিনিশ। হেসিয়ড আরো বলেছেন, প্যান্ডোরা বা নারী এক ভয়াবহ প্রলোভন, ‘যার আত্মা কুকুরীর, যার কামনাবাসনার নৃশংসতায় দেহ জীর্ণ হয়।‘ জিউস ওই ফাঁদকে পাঠায় ‘পুরুষকে ধ্বংস করার জন্যে।’ পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে বিধাতা, এবং রেখেছে নিজের পক্ষে। নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে পিতৃতন্ত্র রচনা করেছে নারীর উদ্ভবের ও তার স্বভাব সম্পর্কে অশালীন উপাখ্যান; এবং তার ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে কামের সমস্ত কলুষ, যৌনতার সমস্ত পাপ। পুরুষতন্ত্ৰ কামকে যখন মহিমান্বিত করে, তখন শিশ্নকে দেবতায় পরিণত করে; আর যখন নিন্দা করে, তখন যোনির কুৎসায় মুখর হয়। গ্রিকরা যখন কামকে গৌরব দেয়, তখন তারা উর্বরতার উৎসরূপে পুজো করে পুরুষাঙ্গের; যখন তারা কামকে নিন্দা করে তখন তিরষ্কার করে প্যান্ডোরোকে। পিতৃতন্ত্র কামের সমস্ত পাপ, কলুষতা, অপরাধ চাপিয়ে দেয় নারীর ওপর। পিতৃতন্ত্রের চোখে নারী যৌনপ্রাণী, পুরুষ হচ্ছে মানুষ। প্যান্ডোরার উপাখ্যানের সাহায্যে নারীকে দণ্ডিত করার হয়েছে যৌনতার অপরাধে। নারী যেনো মানুষ জাতিকে পাপিষ্ট করেছে তার কামে, তাই পুরুষতন্ত্র তার শাস্তিও বিধান করেছে। নারী তার পাপের ফল ভোগ করছে জীবন দিয়ে। ‘প্যান্ডোরার সিন্দুক’ নামে যে-পৌরাণিক গল্পটি রয়েছে, তাতে সিন্দুকটি যোনির প্রতীক। পিতৃতন্ত্রের চোখে ওই কামনাজাগানো সিন্দুক থেকে জন্ম নিয়েছে জগতের সমস্ত দুঃখ।
বাইবেলের আদম-হাওয়ার পতনের উপাখ্যান প্যান্ডোরার উপাখ্যানেরই সংস্কৃত রূপ। এ-গল্পের অসীম প্রভাব রয়েছে ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমানের ওপর; অর্থাৎ সাম্প্রতিক সভ্যতার অধিকাংশ মানুষের ওপর। তারা বিশ্বাস করে নারীই সমস্ত পাপের মূল, সমস্ত দুঃখের উৎস। হাওয়া সম্ভবত ছিলো, প্যান্ডোরার মতোই, এক উর্বরতার দেবী; তবে পুরুষতন্ত্র তাকে উৎখাত করে তার মর্যাদার অবস্থান থেকে। এর কিছুটা পরিচয় বাইবেলে রয়ে গেছে। তাদের পতনের আগে, বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘আদম আপনি স্ত্রীর নাম হবা [জীবিত] রাখিলেন, কেননা তিনি জীবিত সকলের মাতা হইলেন’ [আদিপুস্তক : মানবজাতির পাপে পতন]। এ-উপাখ্যান প্রচলিত লৌকিক কাহিনীর রূপান্তর ব’লে হাওয়াকে সৃষ্টি করার দুটি বিরোধী কাহিনী বাইবেলে রয়ে গেছে। একটিতে নারীপুরুষকে একই সাথে সৃষ্টি করা হয়, আরেকটিতে নারীকে সৃষ্টি করা হয় পুরুষের অস্থি থেকে। আদম-হাওয়ার কাহিনী মানুষের সঙ্গম আবিষ্কারের কাহিনীও। এ-কাহিনীতে আরো নানা বিষয় রয়েছে, যেমন মানুষ কী ভাবে হারায় তার আদিম সারল্য, জ্ঞান কীভাবে আসে, বা আসে মৃত্যু। তবে এ-সবই আবর্তিত কামকে ঘিরে। বিধাতা আদমকে জানিয়েছিলো যে নিষিদ্ধ ফল খেলে তারা মারা যাবে, কিন্তু দেখা যায় বিধাতা সত্য কথা বলে নি, বরং শয়তানই বলেছিলো সত্য যে তারা মরবে না। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ফলে তারা মারা যায় নি, শুধু বুঝতে পেরেছে যে তারা নগ্ন; এবং সে-জন্যে লজ্জা বোধ করেছে। এতে যৌনতা সুস্পষ্ট। হিব্রু ভাষায় ’খাওয়া’ বলতে সঙ্গমও বোঝাতে পারে। বাইবেলে ‘জানা’ আর যৌনতা একই অর্থ বোঝায়; আর বাইবেলের সাপটি শিশ্নেরই প্রতীক। বাইবেলে মানুষের দুঃখকষ্ট ও স্বৰ্গ হারানোর জন্যে দায়ী করা হয়েছে কামকে। ওই নিষিদ্ধ কামের অপরাধে পুরুষের ভালো রকমেরই অংশ রয়েছে; কিন্তু ওই অপরাধ থেকে পুরুষকে মুক্তি দিয়ে সব অপরাধ চাপানো হয়েছে হাওয়া বা নারীর ওপর। বলা হয়েছে তারই জন্যে পতন ঘটেছে পুরুষের অর্থাৎ মানবজাতির।
প্রথম পুরুষটিও দোষ চাপিয়েছে নারীরই ওপর; বলেছে, ‘তুমি আমার সঙ্গিনী করিয়া যে স্ত্রী দিয়াছ, সে আমাকে ঐ বৃক্ষের ফল দিয়াছিল, তাই খাইয়াছি’ [আদিপুস্তক: মনিবজাতির পাপে পতন]। হাওয়া দণ্ডিত হয়েছে কামে আদমের অংশ গ্রহণের অপরাধে। তারা দুজনে শাস্তি পেয়েছে দু-রকম। আদম বা পুরুষকে যে-শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা শাস্তিই নয়। বিধাতা আদমকে বলেছে, ‘তোমার নিমিত্ত ভূমি অভিশপ্ত হইল; তুমি যাবজীবন ক্লেশে উহা ভোগ করবে’: অর্থাৎ পুরুষ পেয়েছে সভ্যতা সৃষ্টির ভার। হাওয়াকে যে-শাস্তি দেয়া হয়, তা রাজনীতিক। তার দণ্ড হচ্ছে : ‘আমি তোমার গৰ্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করিব; তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করিবে; এবং স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকিবে; ও সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করবে।’ নারীকে সাপের বা কামের সাথে চিরদ্বন্দ্বেও লিপ্ত ক’রে দেয়া হয় : ‘সদাপ্ৰভু সৰ্পকে কহিলেন, ‘…আমি তোমাতে ও নারীতে…পরস্পর শত্ৰুতা জন্মাইব; সে তোমার মস্তক চূর্ণ করিবে, এবং তুমি তাহার পাদমূল চূৰ্ণ করিবে’ [আদিপুস্তক : মানবজাতির পাপে পতন]। পুরুষতন্ত্র নারীকে ক’রে তোলে কাম ও পাপের আধার; এবং নারীকে পুরুষের রাজনীতিক অধীনতায় নিয়ে আসে তার কল্পিত স্বৰ্গেই। পিতৃতন্ত্রের চোখে নারী অশুভ; অশুভের পায়ে নিবেদিত। পিথাগোরাস বলেছেন, ‘রয়েছে এক শুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে। শৃঙ্খলা, আলোক, ও পুরুষ; এবং রয়েছে এক অশুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার, ও নারী’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১১২)]। পুরুষের প্রয়োজন নারী; তাই নারীকে সমাজে স্থান দিয়েছে। পুরুষ, কিন্তু তাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে বশ্যতা।
[আট] মনস্তাত্ত্বিক
পিতৃতন্ত্র শুধু নরনারীর বাইরের জগতটিকেই নিয়ন্ত্রণ করে নি, নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মনোজগতকেও। নারী ও পুরুষ মনের মধ্যে গ্ৰহণ করেছে অর্থাৎ অন্তরীকরণ করেছে পিতৃতন্ত্রের ভাবাদর্শ। নারীপুরুষের অবস্থান (মর্যাদা), মেজাজ, ও ভূমিকার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তাদের ওপর অত্যন্ত ব্যাপক। বিবাহরীতি, পুরুষের আর্থিক প্ৰভুত্ব নারীর মনকে মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তার ওপর রয়েছে নারীর যৌন অপরাধবোধ, যেনো নারীই সব যৌনতার মূলে। এর ফলে নারী ব্যক্তি না থেকে হযে ওঠে যৌনসামগ্ৰী। নারী বিবেচিত হয় আস্থাবর সম্পত্তি হিশেবে। নারীর কোনো যৌন স্বাধীনতা নেই। নারীর কুমারীত্ব বা সতীত্বের ওপর পিতৃতন্ত্র এতো জোর দেয় যে নারীর নিজের শরীরও তার নিজের থাকে না; তার শরীর পুরুষের জন্যে। নারীর ওপর এতো অভিভাবকত্ব করা হয় যে তাকে অনেকটা চিরশিশু ক’রে রাখা হয়। নারী তার জীবনধারণের জন্যে বা উন্নতির জন্যে নির্ভর করতে বাধ্য হয়। পুরুষের ওপর নারীর কোনো ক্ষমতা নেই, পুরুষের রয়েছে ক্ষমতা। পিতৃতন্ত্রে নারীকে দেয়া হয় তুচ্ছ মর্যাদা। এতো পীড়নের ফলে নারীর স্বভাবে এমন লক্ষণ দেখা দেয়, যা সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য। সমাজ তাদের দেখে অশ্রদ্ধার চোখে, তাই তারাও নিজেদের দেখে অশ্রদ্ধার চোখে। তারা নিজেদের কারো কৃতিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। ফিলিপ গোল্ডবার্গ ‘নারীরা কি নারীদের বিরুদ্ধে সংস্কারগ্রস্ত’ নামের একটি গবেষণায় দেখান যে নারীরা নারীদের সম্বন্ধে পোষে খুবই নিম্ন ধারণা। তিনি একই লেখার লেখক হিশেবে দেন দুটি নাম : জন ম্যাককে, ও জোয়ান ম্যাককে; এবং ছাত্রীদের ওই লেখা দুটির মূল্যায়ন করতে বলেন। ছাত্রীর জনের মৌলিকতা ও পাণ্ডিত্বের উচ্ছসিত প্ৰশংসা করে, আর জোয়ানকে নিন্দা করে তার মেধাহীনতার জন্যে [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৫৫)]। দুটি লেখাই ছিলো অবিকল এক, তবু নারীদের কাছেও পুরুষের লেখাটি হয়ে ওঠে অসাধারণ, নারীর লেখাটি তুচ্ছ।
পিতৃতন্ত্রে নারীরা নাগরিক অধিকারই পায় না, যেখানে পায় সেখানেও থাকে প্রান্তিক নাগরিক। সংখ্যায় তারা সংখ্যাগুরু, কিন্তু মর্যাদা পায় সংখ্যালঘুর। তাই তাদের মানসিকতাও হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানসিকতা। তারা নিজেদের ঘেন্না ও অবজ্ঞা করে, ও নিজের শ্রেণীকে অবজ্ঞা করে। কয়েক হাজার বছর ধরে শুনে আসছে তারা নিকৃষ্ট, দেখে আসছে তাদের নিকৃষ্ট অবস্থান; তাই তারাও মনে করে নিজেদের নিকৃষ্ট। তাদের যে-কোনো অপরাধকে বাড়িয়ে দেখে সমাজ; সমান অপরাধের জন্যে তারা পুরুষের থেকে অনেক কঠোর শাস্তি পায়। সংখ্যালঘুরা যেমন নিজের বা নিজ সম্প্রদায়ের কারো অপরাধকে বাড়িয়ে দেখে, অনাবশ্যক ক্ষমা চায়, নারীরা তেমনি। নারীদের অনেকেই পুরুষ হতে চায়; বেগম রোকেয়ার মধ্যে এটা বেশ প্রবল ছিলো। পুরুষ হতে চায়, কেননা নারী হিশেবে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই অনিশ্চয়তায় ভোগে। তারা মনে করে পুরুষ হ’লে তারা নিশ্চয়তা পাবে। মার্কিন গবেষকেরা দেখেছেন কৃষ্ণকায়েরা ও নারীরা মানসিকতায় একই রকম। তারা বুদ্ধিতে খাটো, তাদের স্বভাব আদিম ও শিশুর মতো আবেগপরায়ণ; তারা নিজেদের ভাগ্যে সন্তুষ্ট, ছালনাপরায়ণ, ও লুকিয়ে রাখে নিজেদের অনুভূতি। পুরুষ এসবই পছন্দ করে নারীর। শাণিত নারীর থেকে নির্বোধ নারীকে বেশি পছন্দ করে, আর নিবুদ্ধিতাকে রমণীয় ব’লে প্ৰশংসা করে। ইংরেজি উপন্যাসে নির্বোধ স্বর্ণকেশিনীর কাছে হেরে যায় তীক্ষ্ণ কৃষ্ণকেশিনী; বাঙলা উপন্যাসেও মাংসস্তুপের কাছে পরাজিত হয় ব্যক্তিত্ব। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতো নারীদেরও এক-আধজনকে অন্যদের থেকে উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। এটা নারীদের উপকারে আসে না, কেননা পুরুষতন্ত্রের স্বীকৃত নারীরা কাজ করে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে। এ-নারীরা গ্ৰহণ করে ‘নারীত্ব’ ও পুরুষের প্রাধান্য রক্ষার দায়িত্ব। পশ্চিমে এ-ভূমিকায় রাখা হয় সাধারণত গায়িকানায়িকাদের, যারা বিরাজ করে জনগণের যৌনসামগ্ৰীরূপে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভাগ্যবান দু-একজনকে সুযোগ দেয়া হয় তাদের প্রভুদের চিত্তবিনোদনের। নারীরা তাদের কাম দিয়ে পুরুষদের বিনোদন যোগায়, সুখী করে, এবং একেই মনে করে তারা গৌরবের কাজ। ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী’ ব’লে নজরুল নারীর শক্তির অসাধারণত্ব বোঝাতে চেয়েছিলেন; তিনি বুঝতে পারেন নি রাজাকে শাসন নারীর শক্তির অসাধারণত্ব নয়, শোচনীয়তা। নজরুল, বাহ্যিক সদিচ্ছাসত্ত্বেও, ছিলেন পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; এবং তিনিও পুরুষতন্ত্রের শিকাররূপেই দেখতে চেয়েছেন নারীকে। রানী রাজাকে যেটুকু শাসন করে, সেটুকু রক্ষিতার শাসন। এর বেশি নয়। পুরুষতন্ত্র খুবই আনন্দ বোধ করে ‘রাজারে শাসিছে রানী’তে; কিন্তু তার প্রবল আপত্তি নারীর শাসনে। পিতৃতন্ত্র রাজাকে বা স্বামীকে শাসন করা শিখিয়ে নারীকে ক’রে রেখেছে চিরন্তন রক্ষিতা। তাই নারীর মানসিকতাও হয়ে উঠেছে রক্ষিতার। পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীমাত্রই পুরুষতন্ত্রের রক্ষিতা, তারা পুরুষতন্ত্রকে গ্রহণযোগ্য করার সাধনা করে তাদের সমস্ত কাজে।
দেবী ও দানবী
পুরুষের কাছে নারী এক অনন্ত অস্বস্তি; নারী তার চোখে দুই বিপরীত মেরু- আলো ও অন্ধকার; সুখ ও ব্যাধি। পুরুষের চোখে নারী দেবী ও দানবী; প্রথমে দানবী, তারপর দেবী। নারী করালী দানবী পুরুষের কাছে, যে তাকে পাপিষ্ঠ ও স্বৰ্গচ্যুত করেছে; যে তাকে প্রলুব্ধ প্ররোচিত প্ৰতারিত ক’রে চলেছে। পুরুষ সারাক্ষণ ভয়ে থাকে যে ওই পাপীয়সী তার মতো দেবতাকে নামিয়ে দিতে পারে যে-কোনো রসাতলে। পুরুষ তাকে ভয় করে, তবে এড়িয়ে চলতে পারে না; কাম ও পার্থিব প্রয়োজনে সে নারীর সাথে জড়িয়ে আছে : তাকে আলিঙ্গনে বাঁধে, চুমো খায়, তার ঐন্দ্ৰজালিক মাংসকে নিয়তির মতো মানে, কিন্তু অবচেতন ও সচেতনভাবে নারীকে ভাবে দানবী। পুরুষের চোখে নারী দেবীও; তবে নারীর দেবীত্ব তাকে যতোটা সুখী করে, বরাভয় দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তাকে সন্ত্রস্ত করে নারীর দানবীত্ব। ওই অপ্রতিরোধ্য দানবীর কাছে পুরুষ বোধ করে অসহায়। নারী যখন দেবী তখন পুরুষ তাকে ভয় পায় না, কেননা দেবীকে পুরুষ দাসীও ক’রে তুলতে পারে; কিন্তু তার ভয় দানবীকে। দেবীও পুরুষের কাছে সম্ভোগের অসম্ভব সামগ্ৰী। ‘দেবী, অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে/অনেক অর্ঘ্য আনি;/আমি অভাগ্য এনেছি বহিয়া নয়নজলে/ব্যৰ্থ সাধনখানি’, বা ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’ বলে যে-পুরুষ, তার বাসনা হচ্ছে মন্দিরের বেদীতলে বা মালঞ্চের পুষ্পিত পরিবেশে দেবীৱ দেহখানি উপভোগ। পুরুষ কখনো নারী হ’তে চায় না, কিন্তু সব পুরুষই চায় পৃথিবীতে নারী থাকুক, নারীর জন্যে পুরুষ কৃতজ্ঞ প্রকৃতির কাছে। পুরুষের কাছে নারী এক সুখকর দুর্ঘটনা, যে-দুর্ঘটনা তাকে অমরত্বের আস্বাদ দিয়েছে; কিন্তু নারীকে নিয়ে তার মহাজাগতিক দুঃস্বপ্নের শেষ নেই। নারীকে ঘিরে পুরুষ সৃষ্টি করেছে নানা কিংবদন্তি বা পুরাণ, যাতে প্ৰকাশ পেয়েছে পুরুষের আশা ও ভয়। পুরুষের চোখে নারী মাংস, মাংসের অবর্ণনীয সুখ ও আতঙ্ক। পুরুষের কাছে নারী দেবী ও দানবী, খ্রিস্টানের কাছে সে পাপীয়সী হাওয়া ও পবিত্ৰ মেরিমাতা। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৭৫) বলেছেন, ‘সে হচ্ছে মূর্তি, পরিচারিকা, জীবনের উৎস, অন্ধকারের শক্তি, সে হচ্ছে সত্যের মৌল নিঃশব্দতা, সে কৃত্রিম সামগ্ৰী, গুজব, এবং মিথ্যা; সে শুশ্রুষা ও অভিচারিণী; সে পুরুষের শিকার, তার পতন, পুরুষ যা নয় এবং যা কিছু কামনা করে। নারী তার সব কিছুঃ সে পুরুষের নঞর্থকতা।‘ পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা নারীকে দেখেছে ভয়ের চোখে; আজো সে ভয় কাটে নি।
ছোটো বালিকা কোনো ভয় জাগায় না, কিন্তু যেই সে হয়ে ওঠে প্ৰজননপ্রস্তুত, নারী, সে হয় অশুচি। তার শরীর জুড়ে বিকশিত হয় পুরুষের আকর্ষণ ও আতঙ্ক। ওই শরীরের একটি বড়ো ঘটনার নাম ঋতুস্রাব। পুরুষতন্ত্র তার ঋতুস্রাবকে ঘিরে দিয়েছে একরাশ বিধিনিষেধ। অনেক সমাজ তাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেয় অন্যদের থেকে, তাকে ঘোষণা করে অশুচি ব’লে। ঋতুক্ষরণকে প্রতিটি ধর্ম ও আদিম সমাজ দেখেছে দানবিক ব্যাপার রূপে। পিতৃতন্ত্রের সূচনা থেকেই নারীর স্রাবকে অশুভ ধারারূপে দেখা হচ্ছে; এবং একে এতো বিধিনিষেধে ঘিরে দেয়া হয়েছে যে আজো পুরুষেরা এর নামে শিউরে ওঠে। পশ্চিমে এক সময় বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো যে ঋতুকালে নারীদের সংস্পর্শে শস্য নষ্ট হয়, বাগান ধ্বংস হয়, মৌমাছি মারা যায়; এ-সময়ে নারীর ছোঁয়ায় মদ হয় ভিনেগার, দুধ টক, এবং ঘটে আরো নানা অঘটন। উনিশ শতকের শেষভাগেও চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘এটা নিশ্চিত যে ঋতুমতী নারীর ছোয়ায় মাংস পচে।‘ এ-শতকের শুরুতেও ফ্রান্সে মদের কারখানায় ঢুকতে দেয়া হতো না ঋতুমতী নারীদের; বিশ্বাস ছিলো যে ওই অভিশপ্ত নারীদের, ঋতুস্রাবকে ইউরোপের অনেকাংশে ‘অভিশাপ’ই বলা হয়, প্রভাবে চিনি কালো হয়ে যায়। নারীর ক্ষরণ সম্পর্কে কুসংস্কারের মূলে রয়েছে অলৌকিক ভীতি। রক্ত পবিত্র, কিন্তু ঋতুকালে যে-রক্ত বেরিয়ে আসে তা অপবিত্র, কেননা এ-রক্তেই রয়েছে নারীর নারীত্ব। আদিম সমাজে রজঃস্রাবভীতি খুবই প্ৰবল; সেখানে ঋতুকালে নারীদের বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলা হয়, রাখা হয় পল্লীর প্রান্তে একলা কুটিরে। তাদের দুধ খেতে দেয়া হয় না, দুধের পাত্র ছুঁতে দেয়া হয় না, তারা স্বামীর কোনো কিছুই ছুঁতে পারে না। তারা মনে করে ঋতুমতী কোনো নারী যদি স্বামীর কোনো সামগ্ৰী স্পর্শ করে, তবে স্বামীটি অসুস্থ হয়ে পড়বে; আর সে যদি স্বামীর কোনো অস্ত্ৰ স্পর্শ করে তবে স্বামীটি নিহত হবে যুদ্ধে। কোনো কোনো সমাজে ঋতুকালে নারীদের চাঁদতারাসূর্যের দিকে তাকানোও নিষিদ্ধ।
বাইবেলে ও কোরানে ও সব ধর্মপুস্তকে ঋতুকে দেখা হয়েছে ভয়ের চোখে, এবং ঋতুমতী নারীদের নির্দেশ করা হয়েছে নিষিদ্ধ ও দূষিত প্রাণীরূপে। বাইবেলে বলা হয়েছে : ‘যে স্ত্রী রজঃস্বলা হয়, তাহার শরীরস্থ রক্ত ক্ষরিলে সাত দিবস তাহার অশৌচ থাকিবে, এবং যে কেহ তাহাকে স্পর্শ করে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত অশুচি থাকিবে’ এবং ‘অশৌচকালে যে পুরুষ তাহার সহিত শয়ন করে, ও তাহার রজঃ তাহার গাত্রে লাগে, সে সাত দিবস অশুচি থাকিবে’ [লেবীয় পুস্তক : ১৫]। কোরানে আছে : ‘লোকে তোমাকে রজঃক্ষরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলো, তা অশুচি। তাই রজঃক্ষরণকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে, আর যতোদিন না তারা পবিত্র হয়, তাদের কাছে যেও না’ [২:২২২]। হিন্দুধর্মের ঋষিরা ঋতুক্ষরণের নামে শিউরে উঠে প্ৰণয়ন করেছেন শ্লোকের পর শ্লোক ও অজস্র বিধি। তাঁরা বিধান দিয়েছেন যে ঋতুকালে নারী অস্পৃশ্য থাকবে, তাকে কেউ স্পর্শ করবে না। নারী এমনভাবে থাকবে যাতে ভোজনরত কোনো ব্ৰাহ্মণের চোখে সে না পড়ে। ক্ষরণের প্রথম দিনে নারীকে গণ্য করতে হবে চণ্ডালী, দ্বিতীয় দিনে ব্ৰহ্মঘাতিনী, তৃতীয় দিনে রাজকী; এবং তাকে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে দেয়া হবে না [দ্র নরেন্দ্রনাথ (১৯৭৫, ৮৬)]। মনু, অঙ্গিরা, পরাশর ও আরো অনেকে নারী দানবীর ক্ষরণ নিয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় ক’রে তৈরি করেছেন অনেক পবিত্র বিধি। মনু বলেছেন, ‘রজস্বলা নারীতে যে-পুরুষ সঙ্গত হয়, তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু, ও চক্ষু ক্ষয় পায়’ [মনুসংহিতা, ৪:৪১]। এর সবটাই বাজেকথা, তবে হাজার হাজার বছর ধরে এ-শ্লোকটি ভয় দেখিয়ে আসছে পুরুষদের। বরাহপুরাণের একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদই রয়েছে দানবীর ভয়ংকর রক্তপাত ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে। বিধান দেয়া হয়েছে রাজস্বলা নারীর সাথে কেউ কথা বলবে না, তার হাতের কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করবে না; তার সামনে মন্ত্র উচ্চারণ করা যাবে না; আর বামন বলেছেন ওই নারীর সাথে সঙ্গম মহাপাপ। ঋতুমতী নারী যদি কাউকে স্পর্শ করে, তবে তাকে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হবে। ছাত্রদেরও নিষেধ করা হয়েছে ঋতুমতী নারীর কাছাকাছি না আসার। কোনো ঋতুমতী নারীকে দেখা ছাত্রদের নিষেধ; আর সমাবর্তনের পর কমপক্ষে তিন দিন তারা কোনো রাজস্বলা নারীকে দেখতে পারবে না। এই যে রক্ত তা যে অশুচি, এমন নয়; আসলে পুরুষের চোখে নারী এক দানবী, নারীর প্ৰতিমাসের রক্তধারা নারীর আপনি অশুচিতার চিহ্ন।
নারীর দেবী ও দানবী রূপ, নারীর প্রতি পুরুষের ভীতি ও কামনা প্ৰকাশ পায় কুমারীত্ব সম্পর্কে পুরুষের আগ্রহ ও আতঙ্কে। কুমারী, অক্ষতযোনি, পুরুষ কামনা করে, ভয়ও পায়। কুমারী পুরুষের চোখে এক চরম রহস্য। পুরুষের কাছে কুমারী, কুমারীর দেহ, তার রন্ধের অদৃশ্য আবরণঝিল্লি একই সাথে ভীতিকর, ও পরম কামনার বস্তু। পুরুষ যখন মনে করে নারীর শক্তি তাকে পরাভূত করবে, সে হেরে যাবে ওই রহস্যের কাছে, তখন সে ভয় পায়; যখন পুরুষ ভাবে ওই শক্তিকে সে জয় করবে, আধিপত্য বিস্তার করবে ওই রহস্যের ওপর, তখন সে দাবি করে অক্ষত কুমারী। আদিম সমাজে যেখানে নারীশক্তি প্ৰবল, সেখানে পুরুষ আতঙ্কে থাকে; তাই সেখানে বিয়ের আগের রাত্রেই কনের কুমারীত্ব মোচন করে শক্তিমান কেউ, পুরোহিত বা সমাজপতি। মার্কো পলো জানিয়েছে যে তিব্বতি পুরুষেরা কেউ কুমারী নারী বিয়ে করতে রাজি নয়। কুমারীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করাকে মনে করা হয় এক অতীন্দ্রিয় ভীতির কাজ, যা সকলের পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। অনেক সমাজে মনে করা হয় যে যোনিতে লুকিয়ে রয়েছে সাপ, যা পর্দা ছেড়ার সাথেসাথে দংশন করবে পুরুষাঙ্গে; কোনো কোনো সমাজে মনে করা হয় যে রক্তপাতের ফলে হানি ঘটবে পুরুষের বীর্যের। ধাতু বা বীৰ্যকে সব সমাজেই অত্যন্ত দামি মনে করা হয়। পুরুষ এতো যে ভয় পায় তা নারীকে দানবী রূপে দেখারই ফল। অনেক সমাজে সতীচ্ছদ ছেড়ারই প্রশ্ন ওঠে না; সেখানে মেয়েরা কুমারী থাকে শুধু শিশুকালে। শৈশব থেকেই তারা সঙ্গমের অনুমতি পায়, সঙ্গম সেখানে বাল্যক্রীড়া। কোনো কোনো সমাজে মা, বড়ো বোন, ধাত্রী মেয়েদের সতীচ্ছদ ছিন্ন করে। কোনো কোনো সমাজে পুরুষেরা জোর ক’রে মেয়েদের গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক বা অন্য কোনো উপায়ে ছিন্ন করে কুমারীর আবরণ। কোনো কোনো সমাজে মেয়েদের তুলে দেয়া হয় অচেনা পুরুষদের হাতে, যারা মোচন করে তাদের কুমারীত্ব। ওই সমাজ বিশ্বাস করে অচেনা পুরুষদের এতে কোনো ক্ষতি হবে না, বা হ’লেও কোনো ক্ষতি নেই। কোনো কোনো সমাজে পুরোহিত বা সমাজপতি বা গ্ৰাম্য চিকিৎসক বিয়ের আগের রাতে মোচন করে কুমারীত্ব। মালাবার উপকূলে বিয়ের আগের রাতে কুমারীত্ব মোচনের দায়িত্ব পায় ব্ৰাহ্মণেরা; তারা এমনভাবে মোচন করে কুমারীর কুমারীত্ব যেনো একটি অসম্ভব কঠিন কাজ সম্পন্ন করছে। এ-কাজের জন্যে তারা মোটা পারিশ্রমিকও নিয়ে থাকে। সব সমাজেই পবিত্র কাজ অপবিত্রের করা নিষেধ: স্বামী পবিত্র নয়, শক্তিমান নয়; সমাজপতি বা পুরোহিত শক্তিমান বা পবিত্ৰ, তাই তাদের পক্ষেই ওই কাজ সম্ভব। সামোয়ায় রীতি হচ্ছে স্বামী তার স্ত্রীর সতীচ্ছদ স্বাভাবিক উপায়ে ছিন্ন করবে, তবে বীর্যপাত করতে পারবে না; কেননা তাতে যোনির রক্তে দূষিত হবে তার বীর্য। দানবীর নানা ভয়ে ভ’রে আছে পুরুষতন্ত্রের মন।
পুরুষ কুমারীকে ভয় পায়, তবে কামনাই করে বেশি। পুরুষ কুমারী কামনা করে, চায় কোমল কুমারী দেহলতা। কুমারীর তনু পুরুষের কাছে অনাবাদী জমি, ঘুমের দেশ, অনাঘ্রাত গোলাপ। ওই দেহে আছে গোপন ঝরনার জলের স্বাদ, ওই উদ্যানে পত্রপুটে ঢাকা অনাঘ্রাত দুটি পুজোর ফুল। পুরুষ তীব্র আকর্ষণ বোধ করে গোপন উদ্যান, মন্দির, ও নানা রকমের রুদ্ধ ও ছায়াসুনিবিড় এলাকার প্রতি: তার প্রতি পুরুষের আকর্ষণ, যার এখনো ঘুম ভঙে নি। পুরুষ রুদ্ধগৃহ খুলতে চায়, ঢুকতে চায় ওই গৃহে; পুরুষ তার ঘুম ভাঙাতে ও তাকে প্ৰাণ দিতে চায়; চায় তাকে অধিকার ও খনন করতে। পুরুষের রয়েছে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা। সতীচ্ছদ ছিন্ন ক’রে পুরুষ নারীকে পায় অন্তরঙ্গতমভাবে; লোকশ্রুত পদটি ছিড়ে পুরুষ নারীর দেহটিকে পরিণত করে অক্রিয় বস্তুতে ও তার ওপর ওড়ায় নিজের পতাকা, স্থাপন করে সাম্রাজ্য। পুরুষ অবশ্য নারীর কুমারীত্বের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে যতোদিন নারীর যৌবন থাকে, তারপর কুমারীত্ব তার কাছে হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক ভীতিকর। যে-নারীর শরীরে কোনো পুরুষ প্রবেশ করে নি, সে যখন আইবুড়ো হয় তখন পুরুষ তাকে মনে করে ডাইনি, অভিচারিণী। অনেকে বিশ্বাস করে আইবুড়ো অক্ষত মেয়েরা সহবাস করে শয়তানের সাথে। যেহেতু ওই নারী পুরুষের কাছে দেহ সমৰ্পণ করে নি, পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করে নি, তাই পুরুষের চোখে সে শয়তানী। পুরুষের কাছে পোষ-না-মানা, বিদ্রোহী, নারীমাত্রই দানবী বা ডাইনি; কেননা সে পুরুষের সূত্র ও অনুশাসন মেনে নেয় নি। পুরুষ বিশ্বাস করে এ-দানবীরা এতো অশুভ যে ঘুমের মধ্যেও তারা পুরুষের শরীর নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন স্বপদোষে। আমাদের দেশে এমন বিশ্বাস রয়েছে যে স্বপ্নে পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ফোনো অভিচারিণী নারী, তাই ঘটে নৈশস্থলন; এবং হানি ঘটে স্বাস্থ্যের। ইহুদিপুরাণের লিলিথ এমন এক দানবী। রুডউইন লিলিথ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লিলিথের করাল প্রভাব শুধু শিশুদের ওপরেই পড়ে না। সে আরো ভয়াবহ পুরুষের জন্যে, বিশেষ ক’রে তরুণদের জন্যে। লিলিথ পুরুষসম্মোহনকারিণী। লিলিথ হচ্ছে রূপসী ব্যভিচারিণী অবিবাহিতা বেশ্যার সেমেটীয় নাম, যে হাটেমাঠেঘাটে পুরুষদের সম্ভোগ করে’ [দ্র প্রাৎস (১৯৩৩, ২৮২);। ডাইনিদের বীভৎস ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে উপকথা রয়েছে সব জাতির ভাণ্ডারেই; এবং সব জাতির ডাইনিদেরই রয়েছে কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ডাইনিদের মূল বৈশিষ্ট্য তারা কামার্ত পুরুষখেকো; তারা সম্ভোগের মধ্য দিয়ে পুরুষদে্র পরিণত করে নিজেদের খাদ্যে। তারা সঙ্গম করে শয়তানের সাথে, শয়তান পানিপাত্ৰ ভ’রে পান করে তাদের ক্ষরিত ৱক্ত। এদিকে ম্যালিনোস্কির ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের বর্বরদের সাথে কোনো পার্থক্য নেই সভ্য ইউরোপীয় বা ভারতীয়দের। বর্বরদের কল্পনায় ডাইনিরা বেরোয় রাতে, নিজেদের রূপান্তরিত করে জোনাকি বা উড়ন্ত শেয়ালে, শব খায়, ও শয়তানের সাথে রমণ করে। ইউরোপে কয়েক শতক ধ’রে চলেছিলো ডাইনিশিকার; ওই হিংস্র শিকারীদের দুজন, জ্যাকব স্প্রেংগার ও হেনরি ক্র্যামার, একটি বই লিখেছিলেন ডাইনিদের হাতুড়ি নামে পনেরোশতকের শেষাংশে। তাঁরা লিখেছিলেন, ‘সব রকম ডাকিনীবিদ্যার মূলে রয়েছে কামক্ষুধা, নারীরা যাতে তৃপ্তিহীন। তিনটি জিনিশ রয়েছে যাদের ক্ষুধার শেষ নেই; না, আছে চতুর্থ একটি, যেটি কখনো বলে না, যথেষ্ট হয়েছে; সেটি হচ্ছে জরায়ুর মুখ। তাই নারীরা নিজেদের কামতৃপ্তির জন্যে এমনকি শয়তানের সাথেও সঙ্গমরত হয়’ [দ্র নেলসন (১৯৭৫, ৩৩৯)]। ডাইনি নাম দিয়ে ১৪০০ থেকে ১৭০০ অব্দের মধ্যে ইউরোপে পাঁচ লাখ নিরপরাধ নারীকে পুড়িয়ে মারে ঈশ্বরের পুরাহিতেরা। ওই নারীরা ডাইনি ছিলো না, তাদের অধিকাংশ নারী কেনো কোনো পুরুষের সাথেও সঙ্গমের সুযোগ পায় নি। তারা ছিলো কর্মজীবী নারী, যারা আর্থনীতিক কারণেই সমাজের প্রথাগত বিধি অমান্য করতে বাধ্য হয়েছিলো। তারা ছিলো অবিবাহিত; পুরুষ ও অর্থের অভাবে তারা বিয়ে করতে পারে নি, তারা নিয়েছিলো নানা পেশা জীবনধারণের জন্যে। অৰ্থাৎ তারা অমান্য করেছিলো সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি: তারা ছিলো বিদ্রোহী, তাই তারা পুরুষের চোখে হয়েছিলো ডাইনি; এবং আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আজো যে-নারী সামাজিক বিধি অমান্য করে, পুরুষকে পাত্তা দেয় না, যাপন করে স্বায়ত্তশাসিত জীবন, তাকে মনে করা হয় আধুনিক ডাইনি বা দানবী। ডাইনির ভয়ে আধুনিক সভ্যতার হৃৎপিণ্ডও কম্পমান।
নারীকে অভিচারিণী বা ডাইনিরূপে দেখা হচ্ছে আবহমান কাল ধ’রে, আজো দেখা হয় সেভাবেই। যেনো তার কাজ ইন্দ্ৰজাল ছড়িয়ে পুরুষকে মেষ বানানো। নারী যাদুকর। যাদুকর ভয়ানক মানুষ, সে কাজ করে দেবতা ও রীতির বিরুদ্ধে, নিজের স্বার্থে। নারী সমাজের সাথে জড়িয়ে গেছে, কিন্তু পুরুষের মনে ভয় রয়ে গেছে যে নারী তাকে যে-কোনো সময় নিজের যাদুতে মজাবে। পাশের বাসার মেয়েটিকেও মনে হয় অভিচারিণী, যে চোখের পলকে সুবোধ ছেলেটিকে নির্বোধ মেষে পরিণত করতে পারে। তার চোখে ইন্দ্রজাল, ঠোঁটে যাদু, আঙুলে রহস্য, শরীরের বাঁকে বাঁকে ফাঁদ। পশ্চিমি পুরাণে পাওয়া যায় অনেক অভিচারিণী। যেমন সাইরেন। নারী হচ্ছে সাইরেন, যার গানে মুগ্ধ নাবিকেরা জাহাজসহ আছড়ে পড়ে পাথরের ওপর; নারী হচ্ছে কির্কি, যে তার প্রেমিকদের রূপান্তরিত করে পশুতে। পুরুষ তার যাদুপাশে জড়িয়ে হারায় নিজেকে, নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে। নারী পুরুষকে পান করায় বিস্মৃতির পানীয়। ফ্রয়েড ‘সভ্যতা ও তার অতৃপ্তি’তে এ-কুসংস্কারকেই বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে দেখিয়েছেন নারী শুধু পুরুষ নয়, সভ্যতারই শত্রু। এ-দানবীর কাজ সভ্যতাকে বিচলিত করা। খ্রিস্টান ধর্মে যৌনতাকে ভয়ের চোখে দেখা হয়, কারণ তারা নারীকে দেখে দানবীরূপে। ওই ধর্মে বিচ্ছিন্ন ক’রে নেয়া হয়েছে দেহ থেকে আত্মাকে; এবং শরীরকে করে তোলা হয়ছে আত্মার শত্ৰু। ওই বিশ্বাসে শরীরের সাথে সমস্ত সম্পর্কই পাপ ও অশুভ। খ্রিস্টানের কাছে দেহ আর মাংস পাপ; তবে পুরুষের দেহ পাপ নয়, নারীর দেহই পাপ। খ্রিস্টানের চোখে নারীর শরীর প্রলোভনের সোনার কলস, তার দেহ শয়তান। নারীই পাপের পথে নিয়ে গেছে আদমকে; তাই খ্রিস্টান সাহিত্য নারীঘৃণায় ও তিরষ্কারে মুখর। তারতুলিয়ানের চোখে নারী ‘পয়ঃপ্ৰণালির ওপর নির্মিত প্রাসাদ’ ; অগাষ্টিন বলেছেন, ‘আমাদের জন্ম হয়েছে মলমূত্র থেকে’ [ দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২১৯-২২০)]। খ্রিস্টানের চোখে নারীর শরীর এতোই পাপীয়সী যে তারা ক্রাইস্টকে জন্ম দিয়েছে কুমারীর গর্ভ থেকে। ওই ধর্মের অনেক সন্তের মতে মেরি নারীদের মতো স্বাভাবিক রীতিতে জন্ম দেয় নি। ক্রাইস্টকে; অ্যামব্রোস, অগাস্টিনের মতে মেরির রুদ্ধ দেহ থেকেই জন্ম হয়েছিলো জেসাসের। খ্রিস্টানের কাছে নারীর দেহ কলঙ্ক, কাম হচ্ছে পাপ; তাই তারা দেহ ও কামের নিন্দায় মুখর থেকেছে, এবং উদ্ভাবন করেছে নিরন্তর নতুন নতুন শাস্তি। তারা পবিত্র মেরির দেহ থেকে নিঃশেষে বের ক’রে দিয়েছে অপবিত্ৰ কামকে তাকে পরিণত করেছে এক কামশূন্য বিদেহী নারীতে বা বিমূর্ত যন্ত্রে।
শুধু পুরোহিতেরা নন, বিজ্ঞানীরাও ঘেন্না করেছেন নারীর দেহের কথা ভাবতে। লিনাউস প্রকৃতিবিষয়ক সন্দর্ভে ঘেন্নায় নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করেন নি। আজো অনেকেই নারীর দেহ, এমনকি নারী সম্পর্কে আলোচনাকেই মনে করে অশ্লীল। ফরাশি বিজ্ঞানী দ্য লরেঁ ঘেন্নায় প্রশ্ন করেছেন, ‘কী ক’রে এই স্বর্গীয় প্রাণী, যার রয়েছে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি, আকর্ষণ বোধ করে নারীর গোপন অঙ্গের প্রতি, যা ভরা থাকে রসে, আর যা লজ্জাজনকভাবে অবস্থিত শরীরের নিম্নতম স্থলে?’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২০০)]। খ্রিস্টানেরা তাই দানবীকে রূপান্তরিত করেছে দেবীতে; তারা পাপী প্রলোভনকারিণী হাওয়াকে ধুয়েমুছে তৈরি করেছে পাপহর মেরিকে। নারীকে তারা ক’রে তুলেছে গৃহগির্জার থাম। এ-প্রক্রিয়ায় নারীর শরীর থেকে ছেঁকে ফেলে দেয়া হয়েছে কাম। একজন লিখেছেন, ‘পুরুষের মাঝে যৌনকামনা সহজাত ও স্বতস্ফুর্ত, নারীর মধ্যে গুপ্ত, যদিও একেবারে অনুপস্থিত নয়।‘ অ্যাকটন ছিলেন উনিশ শতকের এক বিখ্যাত বিলেতি চিকিৎসক, বই লিখেছিলেন জননেন্দ্ৰিয়ের ভূমিকা ও রোগ নামে। ওই বইতে তিনি নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করেন নি; তাঁর মনোভাব হচ্ছে নারীর ওই সব প্রত্যঙ্গ নেই, থাকলেও সেগুলোর কোনো ভূমিকা নেই! তিনি ভিক্টোরীয় তরুণ স্বামীদের অভয়ও দিয়েছেন যে নারীরা তাদের গিলে খাবে না, কেননা ‘প্রেম, গৃহ, সন্তানই নারীর সব। সঙ্গম ঘটে খুবই কম’ (দ্র বাস্ক (১৯৭৪, ৮-৯)]। যে-সঙ্গম পুরুষের দিবারাত্রির স্বপ্ন, তাকেও ভয় করে পুরুষ। ওই দানবীর অঙ্গটিকে তার মনে হয় ক্ষত : নিজের ধাতুক্ষরণকে মনে হয় মৃত্যু। সব সমাজেই বিশ্বাস করা হয় সঙ্গমে পুরুষের বীর্য ক্ষয় হয়, শক্তি নষ্ট হয়; ফরাশিরা পুরুষের পুলককে বলে ‘ছোটো মৃত্যু’। নারীকে পুরুষ মনে করে ডাইনি, রক্তপায়ী ভ্যাম্পায়ার, যে তাকে পান করে, খায়। ফ্রয়েড পুরুষের এ-ভয়কে বৈজ্ঞানিক রূপ দিয়েছিলেন যে নারী সঙ্গমের সময় পুরুষকে খোজা করার সুখ পায়, অধিকার করে নেয় সম্রাট শিশ্নটি। পুরুষ নারীকে ততোটুকু ভালোবাসে ও দেবী মনে করে যতোটুকু নারী তার অধিকারে; আর ভয় কয়ে ও দানবী মনে করে যতোটুকু নারী তার অধিকারের বাইরে।
নারী দানবী, তাই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। পুরুষের সমস্ত শাস্ত্র রটনা করেছে নারীকে বিশ্বাস করলে ঘটবে পুরুষের পতন; তার শৌর্য নষ্ট হবে, রাজ্য ধ্বংস হবে, সমস্ত কীর্তি ধুলোয় লুটোবে। নারীকে বিশ্বাস ক’রে পুরুষের শোচনীয় পতনের কাহিনীতে ভ’রে আছে সমস্ত পুরাণ ও সাহিত্য। হাদিসে আছে : ‘যদি বিবি হাওয়া না হইত তবে কখনো কোনো নারী স্বামীর ক্ষতি করিত না’, এবং ‘পুরুষের জন্য নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না’, এবং ‘তোমরা দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক হও এবং সতর্ক হও নারী জাতি সম্পর্কে। কেননা, বনি ইস্রাইলের প্রতি যে প্রথম বিপদ আসিয়াছিল তাহা নারীদের ভিতর দিয়াই আসিয়াছিল’, এবং ‘নারী হইল আওরত বা আবরণীয় জিনিস। যখন সে বাহির হয় শয়তান তাহাকে চোখ তুলিয়া দেখে’ [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ২৮১, ১৮৭, ১৮৮, ২০১); এবং ‘পুরুষ নারীর বাধ্য হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়’ [দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮৩)]। নারীর বশীভূত হ’লে বীরের কী দুর্দশা ঘটে, বাইবেলের প্রণেতারা তা লিখেছেন স্যামসন ও ডেলাইলার উপাখ্যানে। স্যামসন শাস্তি পায় নারীর বশীভূত হওয়ার অপরাধে। মিল্টনের স্যামসন অ্যাগোনিসটিজ-এ স্যামসন বিশ্বাসই করে সে পেয়েছে উচিত শাস্তি; কেননা সে করেছে তুচ্ছ নারীর বশীভূত হওয়ার মতো গৰ্হিত অপরাধ। নারীর মতো সামান্যার বশীভূত হওয়ার থেকে অনেক ভালো যুদ্ধে মরা, ঘৃণ্য শত্ৰুর দাস হওয়া। স্যামসনের বিলাপে বাজে নারীর প্রতি পুরুষের চিরন্তন ধিক্কার :
ঘূণ্য কাপুরুষতা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ক’রে
রেখেছিলো তার দাস; হে অসম্মান,
হে মর্যাদা, ধর্মের কলঙ্ক! ক্রীতদাস মন
পুরস্কৃত হয়েছে দাসের যোগ্য শাস্তিতে!
যে-রসাতলে এখন পড়েছি আমি,
এই ছিন্নবাস, এই ঘানিটানা, এও তুচ্ছ
আগের ঘূণ্য, অপৌরুষেয়, কলঙ্ককর, কুখ্যাত,
যথার্থ গোলামির কাছে। সেদিনের অন্ধদশা ছিলো অনেক নিকৃষ্ট,
যা দেখতে পায় নি আমার বশ্যতা ছিলো কতো শোচনীয়।
পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে নারী হচ্ছে অনন্ত কাম ক্ষুধা, যা পুরুষকে শুষে নিঃশেষ করে। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে কাম। যে-নারী নিচে অসার পড়ে থেকে পুরুষকে সম্ভোগ করতে দেয়, পুরুষ তাকে সতী ভাবে; আর যে-নারী সাড়া দেয়, পুরুষকে মথিত করে, পুরুষের কাছে সে দানবী। জাঁ জাক রুশোর কথা ধরা যাক। রোম্যানটিকতার পুরোধা এ-দার্শনিক ঘোষণা করেছিলেন, ‘মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।‘ তাঁর কাছে ‘মানুষ’ হচ্ছে ‘পুরুষ’। তিনি আসলে বলেছিলেন, ‘পুরুষ জন্ম নেয় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।‘ রুশোর বিশ্বাস ছিলো নারীরা বাঁচবে পুরুষের বিনোদের জন্যে; তবে পুরুষের অপেক্ষায় না থেকে কামেপ্রেমে নারীর উদ্যোগ নেয়ার প্রবল বিরোধী রুশো। যে-নারী উদ্যোগ নেয়, সে দানবী। রুশোর মতে, নারী থাকবে লাজুক লতা; সে নিজের দেহের সুখের কথা ভাববে না; যদি ভাবে তবে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা। অর্থাৎ পুরুষের কাম মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে, আর নারীর কাম হচ্ছে মানবজাতির বিনাশ। পুরুষ তার আজগর কামক্ষুধায় ছুটতে পারে নারী থেকে নারীতে; নিজের ক্ষুধা তৃপ্ত করার জন্যে জাগিয়ে তোলে অলৌকিক ভীতি, কিন্তু নারীর ক্ষুধা তার কাছে আপত্তিকর। নারী হচ্ছে পুরুষের কাম ক্ষুধার খাদ্য; পুরুষ এটা শুধু বিশ্বাসই করে না, নারী যাতে অবলীলায় খাদ্য হয়, পুরুষ তার বিধানও তৈরি করে। আরব অঞ্চলে নারীকে মনে করা হয় ‘ফিৎনা’, যে নিজের কামে ঘটাতে পারে সামাজিক বিশৃঙ্খলা; কিন্তু সেখানে নারীকে অবরুদ্ধ ক’রে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয় পুরুষের কামতৃপ্তির। একটি হাদিসে রয়েছে: ‘যখন কোনো রমণীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করে এবং সে অস্বীকাব করে এবং তার জন্য তার স্বামী ক্ষোভে রাত কাটায়–সেই রমণীকে প্রভাত পর্যন্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ দেয়’ [দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮১)]। নারী সম্পর্কে ডাইনিশিকারী স্প্রেংগার [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ৬৪)] লিখেছেন :
নারী হচ্ছে অমৃতভাষিণী গোপন শত্র। সে শিকারীদের ফাঁদের থেকে বিপজ্জনক ফাঁদ, সে শয়তানের ফাঁদ। পুরুষ যখন নারীদের দেখে বা তাদেব কথা শোনে, তখন পুরুষ ধরা পড়ে তাদেব কামজালে ; যেমন সন্ত বার্নার্ড বলেন : তাদের মুখ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার মতো, তাদের স্বর সৰ্পের শোঁ শোঁ ধ্বনির মতো; তাছাড়াও তারা দুষ্ট সম্মোহন ছড়ায় অসংখ্য পুরুষ ও প্রাণীর ওপর। তাদেব মন বিদ্বেষের রাষ্ট্র। তাদের হাত হচ্ছে বেড়ি; তারা যখন কারো গায়ে হাত রাখে, তখন তারা শয়তানের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত করে নিজেদের পরিকল্পনা।
ভারতীয় ত্রিকালদর্শীরা নারীর দানবীরূপ আঁকায় ও ছন্দোবদ্ধ ধিক্কার রচনায় পরিচয় দিয়েছেন লোকোত্তর প্রতিভার। ওই ঋষিরা লকলকে কামুক ও নারীবিদ্বেষী। নারী দেখলেই লক্ষ বছরেব ধ্যান আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে তাঁরা অসুস্থের মতো উত্তেজিত হন, প্রকাশ্যে বা কুয়াশা ছড়িয়ে ধর্ষণ-রমণ করেন, যোনি না পেলে যেখানে সেখানে বীর্যপাত ক’রে শান্তি পান; এবং রচনা করেন শ্লোকের পর শ্লোক নারীনিন্দা। তাঁদের শ্ৰেষ্ঠ ধ্যান হচ্ছে কামধ্যান; আর তাঁরা প্ৰায় সবাই ছিলেন অকালস্খলনগ্ৰস্ত, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের সামান্য উত্তেজনায় রতিস্খলনের মধ্যে। তাঁদের চোখে নারী কামদানবী। নারীনিন্দায় বৌদ্ধহিন্দু সবাই সমান। জাতক, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, মনুসংহিতা ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ভরে আছে নারীর দানবীরূপে ও নারীবিদ্বেষে; মুক্তকণ্ঠ ঋষিদের রচিত অশ্লীল উপাখ্যান ও শ্লোকে। জাতকের গল্পে ফিরে ফিরে আসে কামচণ্ডালী নারীরা, যারা কাম ছাড়া কোনো নীতি জানে না। জাতকের একটি গল্পে আছে নারীরা বুড়ী জরতী হয়ে গেলেও থেকে যায় কামদাসী দানবী। বোধিসত্ত্বের মায়ের বয়স একশো বিশ, যাকে বোধিসত্ত্ব নিজে সেবাযত্ন করে। ওই মা’ও কামার্তে হয়ে ওঠে এক যুবকের জন্যে এবং উদ্যত হয় নিজের পুত্রকে হত্যা করতে। আরেকটি গল্পে রাজা শত্ৰু দমনের জন্যে রাজধানী ছেড়ে দূরে যায়; এবং যাওয়ার পথেপথে এক-এক ক’রে বত্ৰিশজন দূত পাঠায় রানীর কুশল জানার জন্যে। রানী বত্ৰিশজনের সাথেই লিপ্ত হয় কামে। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাজা রানীর কুশল জানার জন্যে পাঠায় আবার বত্ৰিশজন দূত; রানী তাদের সাথেও কামে জড়িত হয়। এমনই দানবিক কাম ক্ষুধা নারীদের! নারীদের ক্ষুধার নানা উপাখ্যান রয়েছে পঞ্চতন্ত্র ও কথাসরিৎসাগর-এ। আর্য ঋষিদের চোখে নারী হচ্ছে সমস্ত অশুভ ও দোষের সমষ্টি। নারীকে দেখেছেন তাঁরা একটি বিশাল অতৃপ্ত যোনিরূপে; নারী হচ্ছে আপাদমস্তক যোনি, যে কাম ছাড়া আর কোনো সুখ বা নীতি জানে না। মনু [মনুসংহিতা, ৯:১৪; দ্র মুরারিমোহন (১৯৮৫)] বলেছেন :
নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ। সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিতেীব ভুঞ্জতে।
তারা রূপ বিচার করে না, বয়সও বিচার কবে না; সুরূপ বা কুরূপ যাই হোক, পুরুষ পেলেই তারা সম্ভোগের জন্যে অধীর হয়ে ওঠে।
পরের শ্লোকেই [৯:১৫) এ-মহর্ষি বলেছেন :
পুরুষ দেখামাত্রই তারা ভোগে মেতে ওঠে ব’লে তারা চঞ্চলচিত্ত ও স্নেহশূন্য; তাই সুরক্ষিত বাখ্যা হ’লেও তারা স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
মহাভারত-এ [অনুশাসনপর্ব : ৩৮] বলা হয়েছে নারী জন্মদুশ্চরিত্র : ‘নারীরা শুধু পরপুরুষের অভাব ও পরিজনের ভয়ে ভর্তার বশীভূত হয়ে থাকে।‘ তার কামক্ষুধার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় আর সব কিছু। মহাভারতের [অনুশাসনপৰ্ব : ১৯]। ঋষি বলেছেন :
স্ত্রীলোক স্বভাবতই রতিপ্রিয়। পুরুষসংসর্গ তাদের যেমন প্রীতিকর, অগ্নি বরুণ প্রভৃতি দেবতারাও তাদের কাছে ততো প্রীতিকর নয় ; সমস্ত স্ত্রীলোকোব মাঝে পতিব্ৰতা চোখে পড়ে মাত্র এক-আধটি। যখন তাদের কামপ্রবৃত্তি প্রবুদ্ধ হয়, তখন তারা পিতা, মাতা, ভ্রাতা, কর্তা, পুত্র ও দেবরেব কিছুমাত্র অপেক্ষা করে না। নিজেব অভিলাষ পূর্ণ করতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে।
বলা হয়েছে, ‘তারা অনায়াসে লজ্জা ছেড়ে পরপুরুষদের সাথে সংসর্গ করে। পুরুষ পরস্ত্রীসম্ভোগে অভিলাষী হয়ে তার কাছে গিয়ে অল্প চাটুবাক্য প্রয়োগ করলেই সে তখনি তার প্রতি অনুরক্ত হয়। [অনুশাসনপর্ব : ৩৮]। দেবীভাগবত-এ [ ৯:১৮] বলা হয়েছে :
স্ত্রীজাতি স্বভাবত নিরন্তর অভিলাষিণী-কামচারিণী, কামের আধার স্বরূপা ও মনোহারিণী হয়ে থাকে। তারা অন্তরের কামলালসা ছলক্রমে গোপন করে। নারী প্রকাশ্যে অতি লজ্জাশীলা কিন্তু গোপনে কান্তকে পেলে যেনো তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। রমণী কোপশীলা, কলহের অঙ্কুর ও মৈথুনাভাবে সর্বদা মানিনী, বহু সম্ভোগে ভীতা ও অল্পসম্ভোগে অত্যন্ত দুঃখিত হয়। স্ত্রীজাতি সুমিষ্টান্ন ও সুশীতল জলেব চেয়েও সুন্দর সুরসিক গুণবান ও মনোহর যুবপুরুষকে সর্বদা মনেমনে কামনা করে। তারা রতিদাতা পুরুষকে নিজের পুত্রের থেকেও বেশি স্নেহ করে এবং সম্ভোগপারদররশী পুরুষই তাদের প্ৰাণাধিক প্ৰিয়তম।
এসব শ্লোক থেকে ধারণা করতে পারি। এ-শ্লোককারেরা কী ভয়াবহ কামদানবীরূপে দেখতেন ও কতোটা অবিশ্বাস করতেন নারীকে। তাই ঋষিগুরুরা কোথাও গেলে উদ্বিগ্ন থাকতেন ভাৰ্যাদের রন্ধ সম্পর্কে, প্রহরী হিসেবে রেখে যেতেন শিষ্যদের; এবং শিষ্যদের সম্পর্কেও নিশ্চিতবোধ করতেন না। তাই বিধান দেন যে পঞ্চমহাপাতকের একটি হচ্ছে গুরুপত্নীতে উপগমন। ঋষি [দেবীভাগবত, ৯:১] আরো বলেছেন :
কামিনীগণ জলৌকার মতো সতত পুরুষের রক্ত পান ক’রে থাকে, মূর্খেরা তা বুঝতে পারে না; কেননা তারা নারীদের হাবভাবে মোহিত হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে কান্ত মনে করে, সে-কান্তা সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য, এবং কুটিল প্রেমালাপে মন ও ধন সবই হরণ করে। তাই নারীর মতো চোর আর কে আছে? রমণীরা কখনো সুখের নয়, তারা শুধু দুঃখেরই কারণ।
আরেকজন বলেছেন, ‘রমণীরা যে-পর্যন্ত কোনো নির্জন স্থান না পায় এবং কোনো পুরুষের সাথে বিশেষ আলাপ করতে না পারে, সে-পর্যন্ত স্ত্রীলোকের সতীত্ব থাকে‘ [শিবপুরাণ, ধর্মসংহিতা : ৪৪]। এ-ঋষিদের একজনের পুনর্জন্ম নেন বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায় নামে; তিনি সৃষ্টি করেন একটি দানবী–রোহিণী। উপপ্রেমিকাতুর রোহিণীর মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন বঙ্কিম [কৃষ্ণকান্তের উইল : ৭] এভাবে :
রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান–পটলচেরা চোখ।…ভাবিয়াছিল, নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন্ নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে? বাঘ গোরু মারে,–সকল গোরু খায় না। স্ত্রীলোক পুরুষকে জয় করে–কেবল জয়পতাকা উড়াইবার জন্য।
ঋষিরা পরিমাপও করেছেন দানবীর দুঃশীলতা; নির্দেশ করেছেন দুঃশীলতার ওজন। ঋষিদের পরিমাপে নারী [মহাভারত, অনুশাসনপর্ব : ৩৮] :
তুলাদণ্ডেব একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার, বিষ, সৰ্প, ও বহ্নি এবং অপরদিকে স্ত্রীজাতিকে সংস্থাপন করলে স্ত্রীজাতি কখনোই ভয়ানকত্বে ওগুলোব থেকে ন্যূন হবে না। বিধাতা যখন সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হয়ে মহাভূত সমুদয় ও স্ত্রী-পুরুষের সৃষ্টি করেন, সে-সময়ই স্ত্রীদের দোষের সৃষ্টি করেছেন।
শুধু একবার ওজন করেন নি, করেছেন বারবার, দেখেছেন পরিমাপে তাঁরা নির্ভুল : ‘ইহলোকে স্ত্রীলোকের থেকে পাপশীল পদাৰ্থ আর কিছু নেই। প্ৰজ্বলিত অগ্নি, ময়দানবের মায়া, ক্ষুরধার, বিষ, সৰ্প ও মৃত্যু এর সবগুলোর সাথে তাদের তুলনা করা যায়'[ওই : ৪০; দ্র রবীন্দ্রনাথ (১২৯৪), অশোক (১৯৮৩, ৯১-১০৩), অনন্যা (১৩৯৪, ৩৬-৩৭)]। পদ্মপুরাণ-এ বলা হয়েছে :
ঘূতকুম্ভসম নারী তৃপ্তাঙ্গারসমাঃ পুমান।
তস্মাদ্ঘৃতঞ্চ বহ্নিঞ্চ নৈকস্থানে চ ধারয়েৎ।।
যথৈব মত্ত মাতঙ্গ সৃণিমুদগর যোগতঃ।
স্ববশং কুরুতে যন্তা তথা স্ত্রীণাং প্ররক্ষকঃ।।
নারী ঘৃতকুম্ভসম, পুরুষ তপ্ত অঙ্গারাসমান;
তাই ঘৃত ও অগ্নিকে একস্থানে রাখা উচিত নয়।
মাহুত যেমন মুগুর দিয়ে মত্ত হস্তীকে বশ করে,
তেমনি বশ করতে হবে নারীকে।
ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ আছে, ‘দুনিবাৰ্যশ্চ সৰ্বেষাং স্ত্রীস্বভাবশাচ চাপলঃ’, অর্থাৎ “স্ত্রীস্বভাব এতো চঞ্চল যে কারো পক্ষে সহজে নিবারণ করা অসম্ভব।’ এ-পুরাণপ্ৰণেতা আরো বলেছেন, ‘নারী মোক্ষদ্বারের করাট, হরিভক্তির বিরোধী। সংসারবন্ধনস্তম্ভের রজ্জ্ব, যা ছিন্ন করা যায় না। নারী বৈরাগ্যনাশের বীজ, সর্বদা অনুরাগবর্ধনকারিণী, সাহসের ভিত্তি ও দোষের গৃহ। নারী অবিশ্বাসের ক্ষেত্র, মূর্তিমতী কপটতা; অহঙ্কারের আশ্রয়, নারীর মুখে মধু ও অন্তরে বিষ।‘ পঞ্চতন্ত্র-এ বিষ্ণুশৰ্মা হিতোপদেশ দিয়েছেন : ‘নারীর মুখে মধু, অন্তরে শুধুই বিষ; তাই এদের মুখ পান করবে। কিন্তু হৃদয় মুষ্টাঘাতে আহত করবে।‘ এমন দানবী কি ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারেন? এক ঋষি প্রশ্ন করেছেন : ‘বিষ ও অমৃতযুক্ত স্ত্রীরূপ যন্ত্র ধর্মনাশের জন্যে কার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে?’ আরেক ঋষি বিধান দিয়েছেন, ‘নাৰ্য শ্মশানঘটিকা ইব বর্জনীয়াঃ’ : ‘নারী শ্মশানের ঘটিকার মতো বর্জনীয়’ ( দ্র নারায়ণ (১৩৭৪, ৫৩-৫৪)]। নজরুল দোলন-চাঁপার ‘পূজারিণী’ কবিতায় চিৎকার করে বলেছেন, ‘নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো, / এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো। /ইহাদের অতিলোভী মন/একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।‘ প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের গলা স্পষ্ট শোনা যায় এ-বিদ্বেষ ও হাহাকারে।
কিন্তু নারীকে পুরুষ বর্জন করতে পারে নি, দানবীকে সে প্রয়োজনে, কামে ও আবেগে কখনো কখনো দেবী ক’রে তুলেছে। বন্দনা করেছে তার দেবীরূপের-মাতা, স্ত্রী ও দয়িতার। তবে দেবীরূপে নারী পুরুষের অধীন, সামান্য ও অসহায়; তাই দেবী অনেক স্বস্তিকর, পুরুষের প্রিয় পুতুল। পুরুষ যখন নারীকে দেবীরূপেও কল্পনা করে, তখন তার ওপরে থাকে পুরুষ ও পুরুষ দেবতারা; দেবীকে ক’রে তোলে তারা বাহ্যিক শোভাময়, এবং অন্তঃসারশূন্য। হিন্দু পুরাণে চণ্ডী বা দুৰ্গা মহাশক্তি, কিন্তু তার শক্তিও তার নিজের নয়; পুরুষ দেবতাদের কৃপায় সে শক্তিময়ী : ‘শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্ৰতেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জংঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্ৰহ্মার তেজে পদযুগল…। মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি…’ [দ্র হংসনারায়ণ (১৯৮০, ১৭৫)]। আদমের বক্র হাড় থেকে যেমন সৃষ্টি করা হয়েছে হাওয়াকে, তেমনি পুরুষ দেবতাদের শক্তির সংকলন হচ্ছে এ-দেবী, যার নিজস্ব অস্তিত্বই নেই।
পুরুষতন্ত্র বহু শতাব্দী ধ’রে নারীকে ভূমি আর ভূমিকে নারীরূপে দেখে আসছে; পৃথিবীকে মাতৃদেবীরূপে পুজোও করছে; কিন্তু তার শক্তিকে করছে অস্বীকার। এস্কিলুস, আরিস্ততল, হিপপোক্রেতিস ঘোষণা করেছেন অলিম্পাস থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সবখানে প্রধান পুরুষ; পুরুষই সৃষ্টিশীল, নারী নয়। নারী ভূমি, নারী উর্বর; তবে ওই উর্বরতা সৃষ্টিশীল নয়, তাকে সৃষ্টিশীল করে পুরুষের বীর্য। নারী মৃত্তিকা, পুরুষ বীজ; পুরুষ অগ্নি, নারী জল। মনু বলেছেন, ‘নারী জাতি ক্ষেত্রস্বরূপ এবং পুরুষ বীজস্বরূপ; ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগেই সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব হয়ে থাকে’ [৯:৩৩]; তিনি আরো বলেছেন, ঠিক সময়ে কৰ্ষিত ক্ষেত্রে যেমন বীজ বপন করা হয়, ক্ষেত্রে সে-বীজগুণসম্পন্ন অঙ্কুরই উদগত হয়ে থাকে’ [৯:৩৬]। কোরানে আছে : ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভারে ইচ্ছে যেতে পারো’ [২:২২৩]। পুরুষ নারীকে দরকারে দেবী করেছে, ধরণী করেছে; কিন্তু তাকে ক’রে রেখেছে অসার। প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করে তাকে পরিণত করেছে একটি অক্রিয় বীজধারণের পাত্রে। পিতৃতন্ত্র পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে বীজকেই দিয়েছে গুরুত্ব। হিন্দু পুরাণে দেখা যায় দেবতা ও ঋষিরা যেখানেসেখানে বীর্যপাত করছে, জন্ম দিচ্ছে অজস্র সন্তান; অর্থাৎ তারা নারীর জরায়ুকে প্রত্যাখ্যান ক’রে নারীকে তার একান্ত অধিকার থেকেও বহিষ্কার করেছে। পিতৃতন্ত্রের নারীর জরায়ুকে অস্বীকারের প্রায় রাজনীতিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এস্কিলুসের অরেসতেইয়া নাটকে। অ্যাপোলো পেশ করে জন্মদানের পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্য :
মা নয় শিশুর মাতা, যাকে তার বলা হয়।
সে সেবিকামাত্র, তার কাজ তার ভেতবে বপন করা
শিশুর প্রকৃত জন্মদাতা পুরুষের বীজ লালনপালন।
যদি দেবতার বরে বেঁচে থাকে শিশু,
সে তাকে পালন কবে, যেমন সখার জন্যে
কেউ দেখাশোনা কবে বেড়ে-ওঠা চারা…
মা ছাড়াও পিতা পারে জন্ম দিতে।
পুরুষের প্রাধান্য রাখার জন্যে পিতৃতন্ত্র সব পারে ; জন্মের স্বাভাবিক রীতিকেও উল্টে দিতে পারে। অ্যাপোলো এর উদাহরণও হাজির করেছে; নিয়ে এসেছে অ্যাথেনাকে, যে সম্পূর্ণ যুবতীরূপে জন্ম নিয়েছিলো পিতা জিউসের শির থেকে। সে এসেই ঘোষণা করে পিতৃতন্ত্রের জয় : ‘কোনো মাতা জন্ম দেয় নি আমাকে। তাই পিতার দাবি ও পুরুষাধিপত্যকে আমি শিরোধাৰ্য করি।‘ পুরুষতন্ত্রের একটি চমৎকার কৌশল হচ্ছে নারীর মুখে পুরুষের জয় ঘোষণা ও নারীনিন্দা করা। মহাভারত-এর নারীনিন্দার আধিকাংশ শ্লোক বলা হয়েছে নারীরই মুখে। পুরুষতন্ত্রে পুরুষই দেবতা; সে সব পারে, একলা নিজেই জন্ম দিতে পারে, দেবীকে পরিণত করতে পারে দাসীতে; মাকে শেখাতে পারে নীতিশাস্ত্র। বাঙলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো বিশ্বাস রয়েছে যে নারী ঘট মাত্র; পুরুষের বীজেই ওই ঘট ভরে ওঠে। পুরুষ যখন নারীকে দেবী ব’লে, ভূমি ব’লে, মা ব’লে, তখনো তার মহিমা অস্বীকার করে।
নারীর দেবীরূপের একটি হচ্ছে বধু, যে পরম কাম্য শিকার পুরুষের। নববধূকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে পুরুষ লাভ করে জীবন্র সমস্ত ধন। তার টাটকা শরীরের ছোঁয়ায় পুরুষের শরীরে ও মনে জাগে কবিতা, বাজে সঙ্গীতের সুর, সে ঢেকে যায় নিসর্গের বর্ণিল শোভায়। পুরুষের কাছে সে তখন কপোত ময়না কোকিল, গোলাপ পদ্ম রজনীগন্ধা, অমৃত, সন্ধ্যার মেঘমালা, হীরেচুনিপান্না, বসন্তের বাতাস, নীলিমা, সমুদ্র। কবিরা এ-দেবীর স্তব করেছেন উৎকৃষ্টতম শব্দের উৎকৃষ্টতম বিন্যাসে। বধু দেবী, কেননা সে পুরুষের রঙিন কামের রক্তিমতম পরিতৃপ্তি। কবি গেয়ে ওঠেন, ‘ওগো বধু সুন্দরী, তুমি মধুমঞ্জরী, পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন–/পর্ণের পাত্রে ফাল্গুনরাত্রে মুকুলিত মল্লিকামাল্যের বন্ধন।/এনেছি বসন্তের অঞ্জলি গন্ধের; পলাশের কুঙ্কুম চাঁদিনির চন্দন–/পারুলের হিল্লোল, শিরীষের হিন্দোল, মঞ্জল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কণ’ [রবীন্দ্রনাথ]; আর এর সুরে ও ছবিতে প্রবলভাবে বয়ে চলে পুরুষের কামের প্রবাহ। দেবীকে ঘিরে আবর্তিত হয় পুরুষের থরোথরো কামনা। কামই ঘিরে থাকে দেবীকে বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন, ‘যাও, মেয়ে জীবনের খাদ্য হও’; বা বিষ্ণু দে বলেন, ‘তুমি যেন এক পর্দায় ঢাকা বাড়ি, / আমি অঘ্রাণ-শিশিরে সিক্ত হাওয়া, /বিনিদ্র তাই দিনরাত ঘুরি ঘিরে’ ; বা ‘শলোমনের পরমগীত’-এর দয়িত বলে :
অয়ি মম প্ৰিয়ে! দেখ, তুমি সুন্দরী,
দেখ, তুমি সুন্দরী,
ঘোমটার মধ্যে তোমার নয়নযুগল কপোতের ন্যায়;
তোমার কেশপাশ এমন ছাগপালের ন্যায়,
যাহাবা গিলিয়দ-পৰ্ব্বতের পার্শ্বে শুইয়া থাকে।
তোমার দন্তশ্রেণী ছিন্নলোমা মেষীর পালবৎ,
যাহারা স্নান করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে,…
তোমার ওষ্ঠাধর সিন্দুরবর্ণ সূত্রের ন্যায়,
তোমার গণ্ডদেশ দাড়িম্বখণ্ডের ন্যায়।…
তোমার কুচযুগল দুই হরিণ-শাবকের,
হরিণীব দুই যমজ বৎসের ন্যায়…
তোমার প্রেম দ্রাক্ষারস হইতে কত উৎকৃষ্ট!
তোমার তৈলের সৌরভ সমস্ত সুগন্ধি দ্রব্য অপেক্ষা কত উৎকৃষ্ট।
কান্তে! তোমার ওষ্ঠাধর হইতে ফোটা ফোটা মধু ক্ষরে,
তোমার জিহ্বার তলে মধু ও দুগ্ধ আছে;
মম ভগিনি, মম কান্তা অর্গলবদ্ধ উপবন,
অৰ্গলবদ্ধ জলাকর, মুদ্রাঙ্কিত উৎস।…
তোমার গোলাকার উরুদ্বয় স্বর্ণহারস্বরূপ।
নিপুণ শিল্পীর হস্তনির্মিত স্বর্ণহারস্বরূপ।
তোমার দেহ এমন গোল বাটির ন্যায়,
যাহাতে মিশ্ৰিত দ্রাক্ষারসের অভাব নাই।
তোমার কটিদেশ এমন গোধূমরাশির ন্যায়,
যাহা শোশন-পুষ্পশ্রেণীতে শোভিত।….
তোমার কুচযুগ দ্রাক্ষাগুচ্ছম্বরূপ।
বধুর এ-অসামান্য রূপ শুধু যৌবনের, যখন সে প্রেমিক; যখন সে গাৰ্হস্থ্য স্ত্রী হয়ে ওঠে নি। স্ত্রী হয়ে ওঠার পরও কখনো কখনো তাকে দেবী ক’রে তোলে পুরুষ, সন্তানের জননী গৃহলক্ষ্মীরূপে; কিন্তু সে নিজে তখন দেবতা। দেবতাই প্ৰভু, গৃহের দেবী তার পরিচারিকামাত্র।
কোনো কোনো ধর্মে নারীকে তার রক্তমাংস থেকে উত্তীর্ণ ক’রে অতীন্দ্ৰিয় ক’রে তোলা হয়। যেমন খ্রিস্টধর্মে, বা সুফিদের সাধনায়, কিছুটা হিন্দুধর্মে। ইসলামে নারীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সমস্ত অতীন্দ্ৰিয়তা ও রহস্য থেকে, মুসলমানের কোনো দেবী নেই; মুসলমানের কাছে নারী সম্ভোগের সামগ্ৰী:–পৃথিবীতে এবং ইন্দ্ৰিয়ভারাতুর বেহেশতে। খ্রিস্টানরা নারীকে মনে করে পরিবার ও গৃহের আত্মা। প্রায় সমস্ত ভাষায়ই দেশ, নগর, নদী প্রভৃতি নারী; নানা বিমূর্ত ভাবনাও নারী। সাহিত্যে নারীই বারবার ব্যবহৃত হয়েছে রূপকরূপে; কারণ নারী হচ্ছে ভাব ও আত্মা। খ্রিস্টানের কাছে নারী স্বর্গের সৌন্দর্য, যে তাকে ঈশ্বরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, যেমন ‘ডিভাইন কমেডি’তে দান্তেকে পথ দেখায় বিয়াত্রিসে। অনেক তত্ত্বে নারী হচ্ছে সুষমা, যুক্তি, সত্য। বিহারীলাল, হিন্দুধর্মের প্রভাবেই, বিশ্বসৌন্দর্যের সারসত্তাকে দেখেছেন নারীরূপে, সারদারূপে, এবং তাকে গৃহে দেখতে পেয়েছেন স্ত্রীরূপে। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাও অনেক সময় নারী। নারী যখন ভাব, রূপক, প্রতীক, তখন সে আর মাংস নয়; সে তখন অলৌকিক সত্তা। নারী তখন, যেমন জীবনানন্দের কাছে, অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি অন্ধকারে জ্বলে যার পবিত্র শিখা। তখন সে কারো সম্পত্তি নয়, সম্ভোগসামগ্ৰী নয়, তখন সে আরাধ্য। তখন সে অতীন্দ্ৰিয়, বায়বীয়; তখন অশুভ রূপান্তরিত হয়। শুভ ও শুদ্ধতায়। তবে এ-নারী বাস্তব নারী নয়; তাকে নিয়ে বাস করে না পুরুষ; নারীর অতীন্দ্ৰিয় মূর্তি রচনা প্ৰকাশ করে পুরুষেরই প্রতিভা, তাতে নারীর অবস্থার কোনোই উন্নতি ঘটে না।
নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়
দ্য বোভোয়ার বলেছেন নারী মনুষ্যপ্ৰজাতির শিকার; পুরুষ তার শরীরকে অতিক্রম ক’রে গেছে, কিন্তু নারী পশুর মতো, শুধু জন্ম দেয়াই যার একান্ত ধর্ম, বন্দী হয়ে রয়েছে নিজের শরীরের শেকলে। নারী পরাভূত হয়েছে : মনুষ্যপ্ৰজাতির পরাজিত লিঙ্গের নাম নারী। নারী তার শরীরমনে বয়ে চলছে। ওই পরাজয়; বিজয়ী পুরুষকে অভিবাদন জানিয়ে, তার সামনে নত থেকে, শুরু ও শেষ হয় তার জীবন। নারী পরাজিত হয় পুরুষের কাছে, নারী তন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে। পিতৃ-বা পুরুষ-তন্ত্রের রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে। নারীর পরাজয়ের তত্ত্ব রচনা করেছেন অনেকে : চেরানিশেভঙ্কি [কী করণীয়?] মিল [নারী-অধীনতা], বেবেল [নারী ও সমাজতন্ত্ৰ], ভেবলেন [সুবিধাভোগী শ্রেণীর তত্ত্ব] প্রমুখ, তবে এঙ্গেলস লেখেন সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক রচনাটি, যার নাম ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (১৮৮৪)। এঙ্গেলস এটি লিখেছিলেন হেনরি মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ (১৮৭৭) ও বাখোফেনের ‘মাতৃ-অধিকার’ (১৮৬১) অবলম্বনে, কিন্তু তিনি এতে পেশ করেন পিতৃতন্ত্রের ইতিহাস ও অর্থনীতির এক সংহত বিবরণ; এবং একমাত্র তিনিই আক্রমণ করেন পিতৃতন্ত্রের বহুনন্দিত একটি সংস্থাকে, যাকে বলা হয় পরিবার। পিতৃতন্ত্রবাদীরা বিশ্বাস করেন পিতৃতন্ত্র ও পরিবারসংস্থা মানুষের সমাজসংস্থাগুলোর মধ্যে অনাদি; তাঁরা মনে করেন এগুলোর উদ্ভব ঘটেছিলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের জৈবিক শক্তি ও সহজাত প্রাধান্য ভিত্তি করে। যেনো এটিই বিধির স্বর্গীয় বিধান। তাঁরা মনে করেন দেহই নারীর নিয়তি; তার শারীরিক অশক্তি, ঋতুস্রাব, গর্ভ ও প্রসব তাকে বাধ্য করে পরাজিত লিঙ্গে পরিণত হ’তে।
নারীবাদীদেরও অনেকে দ্বিধাভরে মেনে নিয়েছেন একথা; যেমন দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ নারীর অশক্তির, মনুষ্যপ্ৰজাতির শিকার হওয়ার, দিয়েছেন বিশদ বিবরণ; কিন্তু কেইট মিলেট (১৯৬৯, ১০৯) এটা মেনে নেন নি। মিলেটের মতে সামাজিক রাজনীতিক সংস্থা দেহবল ভিত্তি ক’রে গ’ড়ে ওঠে না, গ’ড়ে ওঠে সমাজের মূল্যবোধ ও উৎপাদন পদ্ধতি ভিত্তি করে। পিতৃতন্ত্র একটি সংস্থা; মানুষের বিকাশের বিশেষ সময়ে এর উদ্ভব ঘটে, উদ্ভবের পেছনে রয়েছে বিশেষ পরিস্থিতি। তার উদ্ভবের প্রক্রিয়া আজ পুরোপুরি জানা না গেলেও সে-সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। অনেকেই মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ছিলো অন্য কোনো তন্ত্র। ম্যাথিয়াস ও ম্যাথিলডা ভ্যারটুং [আধিপত্যশীল লিঙ্গ, ১৯২৩] মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ছিলো মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্র, যেখানে নারীরাই ছিলো আধিপত্যশীল, যেমন পিতৃতন্ত্রে আধিপত্যশীল পুরুষেরা; আর বাখোফেন [মাতৃ-অধিকার, ১৮৬১], ম্যাকলেনন [আদিম বিবাহ, ১৮৭৫l, মর্গান [আদিম সমাজ, ১৮৭৭), ব্ৰিফল্ট [মাতারা, ১৯২৭) মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ঠিক মাতৃতন্ত্র না থাকলেও তার মতোই কিছু একটা ছিলো। সেখানে হয়তো সামাজিক আর ধর্মীয় এলাকায় প্রধান মূল্য পেতো মাতৃ-অধিকার, বা নারীনীতি, বা নারীর উর্বরতা। পিতৃতন্ত্রবাদীরা এটা মানতে রাজি নন; তাঁরা মনে করেন বর্তমান ও ঐতিহাসিক কালটি সম্পূর্ণরূপে পিতৃতন্ত্রের; শুধু তাই নয়, তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস প্রাগৈতিহাসিক কালটিও পিতৃতন্ত্রের, এবং বিপুল ভবিষ্যৎও থাকবে পুরুষতন্ত্রের অধিকারে। নারীবাদীরা অস্বীকার করেন দাবি; তাঁরা মনে করেন না যে পিতৃতন্ত্র অনাদি ও শাশ্বত; তাঁদের মতে পিতৃতন্ত্রের আগামী বিপুল ভবিষ্যৎ জুড়ে টিকে থাকার কোনো জৈবিক সামাজিক কারণ বা প্রয়োজন নেই। আজ যা আছে, তাকে সনাতন শাশ্বত ভাবা হাস্যকর।
পিতৃতন্ত্র মানুষের ইতিহাসের একটি পর্বমাত্র; তাই তার সমাপ্তি ঘটে শুরু হতে পারে নরনারীর সম্পর্কের আরেক, ও উন্নত, পর্ব। জন স্টুয়ার্ট মিল উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছিলেন নারী-অধীনতা (১৮৬৯) নামে একটি প্রভাবশালী বই। স্টুয়ার্ট মিল ধ’রে নিয়েছিলেন নারীজাতির অধীনতা ঘটেছে পুরুষের বলপ্রয়োগের বিশ্বজনীন নীতিতে, তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে নারীজাতির অধীনতা দূর হবে প্রগতি ও নৈতিকতার ক্রমাগ্রগতির ফলে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো মানুষের প্রগতি ও নৈতিকতার অগ্রগতি অবধারিত, কেননা মানুষ আর পেছনের দিকে যেতে পারে না। এঙ্গেলস মানুষের ওপর পোষণ করতে পারেন নি এতোটা আস্থা। মিলের মতো তিনি এমন আশাবাদ পুষতে পারেন নি যে মানবসমাজ প্রগতিশীল থেকে প্রগতিশীলতর হবেই, কেননা প্ৰগতিশীল আদিম সাম্যবাদের পর প্রতিক্রিয়াশীল দাসপ্রথার আবির্ভাব তিনি দেখেছেন। বিপ্লবী ছিলেন তিনি; তাই তার পক্ষে কোনো সংস্থার জৈবিক উদ্ভবতত্ত্বে বিশ্বাস করাও ছিলো অসম্ভব। তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সংস্থামাত্রেই মানুষের তৈরি। তাই বদলে দেয়া যেতে পারে যে-কোনো সংস্থাকে, এমনকি দরকার হ’লে তাকে হঠাৎ প্ৰচণ্ড বিপ্লবাত্মক প্রক্রিয়ায়ও উচ্ছেদ করা সম্ভব। তিনি দেখেন যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সম্পত্তির মধ্যে; সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা ও নারীর অধীনতার ভিত্তির ওপরই স্থাপিত পিতৃতন্ত্র। তাই পিতৃতন্ত্র ও পরিবার দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর; মানুষের একটি লিঙ্গ শোষণ করছে আরেকটি লিঙ্গকে–নারীশোষণের মহত্তম যন্ত্রটির নাম পিতৃতন্ত্র। তিনি অনুরক্ত ছিলেন বাখোফেনের মাতৃ-অধিকার গ্রন্থে প্রস্তাবিত তত্ত্বের প্রতি : মাতৃ-অধিকারে এঙ্গেলস দেখতে পান এক ধরনের আদিম সাম্যবাদ, যেখানে ছিলো না কোনো ব্যক্তিমালিকানা। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে একরাশ সামাজিক রোগ নিয়ে; দেখা দেয় সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার, নারী-অধীনতা ও দাসপ্রথা, সমাজ ভাগ হয়ে যায় নানা শ্রেণী ও বর্ণে, দেখা দেয় শাসক ও সম্পত্তিশীল শ্রেণী, শুরু হয়। সম্পত্তির অসম বণ্টন, এবং শেষে শোষণের নির্মম বিকট যন্ত্ররূপে দেখা দেয় রাষ্ট্র। এঙ্গেলস বাখোফেন ও মর্গানের সাথে নিজের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের সমন্বয় ক’রে রচনা করেন সমাজবিবর্তনের এক বিশ্বজনীন ইতিহাস, যাতে তিনি নির্দেশ করেন কীভাবে উদ্ভূত হয় পরিবার, বিভিন্ন সমাজসংস্থা; মানুষ কীভাবে সম্পদ উৎপাদনের জন্যে হাতিয়ার তৈরি করে, কৃষিকাজ শুরু করে, ব্যবসায়ী হয়, এবং শেষে হয় শিল্পপতি। পরিবারের ইতিহাসকে তিনি ভাগ করেন। কয়েকটি স্তরে; দেখান কীভাবে মাতৃতন্ত্র বা মাতৃ-অধিকারের স্তর থেকে নির্বিচার বা মুক্ত যৌনসম্পর্ক, সমষ্টি বিয়ে, জোড়বাধা বিয়ে, একরক্তেরসম্পর্কের বিয়ে, পুনালুয়া বিয়ে প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত হয় পিতৃতান্ত্রিক ও একপতিপত্নী বিয়ে (বা একপতিবহুপত্নী বিয়ে), এবং নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সম্ভোগসামগ্ৰী ও পরিচারিকা।
মানুষের ইতিহাসের প্রথমে আরণ্যপর্ব, তারপর বর্বরতার পর্ব, এবং তারপর ও এখন সভ্যতার পর্ব। আরণ্যপর্বে মানুষ ছিলো অরণ্যের সন্তান; মানুষ তখন প্রকৃতি থেকে আহরণ করেছে তার অবিলম্বে ব্যবহার্য সম্পদগুলো, যা তাকে বঁচিয়ে রেখেছে। হাতিযার বলতে কিছুই তার ছিলো না, বা ছিলো সে-সব যা তাকে সাহায্য করেছে প্রকৃতি থেকে ফলমূল আহরণে। এ-সময় নারীর অবস্থা কেমন ছিলো, তা নিশ্চিত জানার উপায় নেই। নারীকে নিশ্চয়ই তখন করতে হতো নানা কঠিন কাজ; স্থান থেকে স্থানান্তরে যাওয়ার সময় ভারবহনের ভারটা হয়তো পড়তো তখন নারীরই ওপর, কেননা পুরুষকে নিজের হাত দুটি মুক্ত রাখতে হতো পশুর আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে। অর্থাৎ নারী ভার বইতো, কিন্তু পুরুষ করতো আরো ভয়ঙ্কর কাজ। তবে ওই নারীরা আজকের বুর্জোয়া নারীদের মতো ভঙ্গুর ছিলো না। কিন্তু তারা বাঁধা ছিলো ঋতুস্ৰাব, গৰ্ভধারণ ও প্রসবের জৈব শেকলে, যা তাদের তখনো করে রেখেছিলো বিরূপ বিশ্বে অসহায়। তাই অন্ন ও আশ্রয়ের জন্যে তাদের নির্ভর করতেই হতো মুক্ত পুরুষের ওপর। নারী পুরুষের মতো সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করে নি, সে গর্ভবতী হয়েছে ও প্রসব করেছে। গৰ্ভ ও প্রসব কোনো কাজ নয়, তা জৈব ব্যাপার; তাই নারীকে আত্মসমৰ্পণ করতে হয়েছে নিজেরই জৈবনিয়তির কাছে। পুরুষ গেছে ভিন্ন পথে; সে তার জৈব ও পাশব স্বভাব পেরিয়ে হয়ে উঠেছে স্রষ্টা বা উদ্ভাবক। আদিম মানুষ মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে আরেক কারণে, তার পৌরুষ বা বীরত্বের জন্যে। সে বেছে নিয়েছে বিপজ্জনক কাজ: সে শিকার করেছে, ভয়ঙ্কর জন্তুদের সাথে লড়াই ক’রে বিপন্ন করেছে জীবন, এবং পরেছে জয়মাল্য। পুরুষ শোষক, স্বার্থপরায়ণ, পীড়ক, কিন্তু শক্তিমান; আর শক্তির কাছে গৌণ হয়ে যায় অন্য সব কিছু। নারী জীবন সৃষ্টি করে, এটা মানুষকে রেখে দেয় পশুরই স্তরে : পুরুষ জীবন বিপন্ন করে, এটা মানুষকে পশুর পর্যায় থেকে উত্তীৰ্ণ করে মানুষের পর্যায়ে। নারী টিকিয়ে রেখেছে মানুষ প্রজাতিকে, আর পুরুষ বদলে দিয়েছে পৃথিবীকে; নারীর নিয়তি, অন্তত এখন পর্যন্ত, হয়ে রয়েছে জীবনের পুনরাবৃত্তি করা; কিন্তু জীবনের পুনরাবৃত্তি করে কেউ পৃথিবীর প্রভু হতে পারে না। জৈবিক ও আর্থ কারণে পুরুষ হয়েছে পৃথিবী ও নারীর প্রভু। আরণ্যপর্বে নরনারীর যৌনসম্পর্কের রীতি কী ছিলো? এ-পর্বে ছিলো নির্বিচার বা মুক্ত যৌনসম্পর্ক, যে-কোনো নারী মিলিত হতো। যে-কোনো পুরুষের সাথে। এটা মেনে নিতে অনেকের লজ্জা লাগতে পারে; কিন্তু আরণ্য মানুষ আজকের ভণ্ডামো আয়ত্ত করে ওঠে নি। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ১৯১১) বলেছেন, ‘যদি কঠোর একপতিপত্নী বিধিই সর্বপ্রধান পুণ্য বলে মনে করা হয় তাহলে টোপওয়ার্মকেই শ্ৰেষ্ঠ মানতে হয়, কারণ তার পঞ্চাশ থেকে দু’শ খণ্ডে বিভক্ত শরীরের প্রত্যেকটি খণ্ডে একজোড়া পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গ আছে এবং সারা জীবন ধরে এই কৃমিকীট শরীরের প্ৰত্যেকটি খণ্ডে আত্মসঙ্গম করে কাটায়।‘ আরণ্য নরনারী টেপাওয়ার্ম ছিলো না; এবং ছিলো না তার উত্তরাধিকারীর মতো ভণ্ড।
মানুষের আরণ্যপর্বের পর আসে কৃষি বা বর্বরতার পর্ব। যাযাবর মানুষ স্থির হয় কোনো উর্বর অঞ্চলে, হয় কৃষক; এবং পশু হয় তার প্রধান সম্পদ, মানুষ হয় গোস্বামী। ভূমিকা বদলায় নারীরও। যাযাবর আরণ্য মানুষের ছিলো শুধু বর্তমান; কিন্তু কৃষিসমাজের মানুষের বর্তমান তো রয়েছেই, রয়েছে অতীত ও ভবিষ্যৎ। তার কাছে উর্বরতা দেখা দেয় একটি বড়ো বিস্ময়রূপে। কৃষক অনুভব করে নারী ও জমি একই প্রকৃতির, উভয়ই উর্বর; চাষ করলে উভয়ই সোনা ফলায়। কিন্তু সম্পূর্ণটা তখনো বুঝে উঠতে পারে নি। তারা, নারী ও জমিতে দেখেছে তারা ইন্দ্ৰজাল, যেনো কোনো অলৌকিক যাদুতে নারী হয় সন্তানবতী, জমি ফসলভারাবনত। এ-সময় সন্তান ও ফসলের দায়িত্বও ছিলো নারীর;–নারী শুধু সন্তান ধারণ করতো না, চাষের কাজও করতো। তাই তার মূল্য ছিলো, গৌরব ছিলো। এ-সময়ই দিকেদিকে দেখা দেয় উর্বরতার মহাদেবী: —মহামাতা, যে জীবন দেয়, জীবন হরণ করে, আবার পুনর্জীবন দেয়। ব্যাবিলোনিয়ায় তার নাম ইশতার, সেমেটীয় অঞ্চলে আসতারতে, গ্রিকদের সে রিঅ্যা, মিশরীয়দের আইসিস। এ-সময়ে নারীপুরুষের যৌনসম্পর্কের কয়েকটি রূপ দেখা দেয়, উন্মেষ ঘটে পরিবারের আদিরূপটির। পরিবারের আদি রূপটি হচ্ছে একরক্তসম্পর্কের পরিবার। একরক্ত পরিবারে বিয়ে হতো প্ৰজন্মক্রমে : পিতামহ ও পিতামহী পরস্পরের ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যারা একে-অন্যের ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যারা ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী। ক্রমে নিষিদ্ধ হয় একরক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বিয়ে, উদ্ভূত হয় এমন একধরনের পরিবার, মর্গান ও এঙ্গেলস যাকে বলেছেন ‘পুনালুয়া পরিবার’। পুনালুয়া পরিবারে আপনি বা সমান্তরবর্তী কজন বোন হতো তাদের সাধারণ স্বামীদের সাধারণ স্ত্রী, বাদ পড়তো তাদের ভাইয়েরা। এ-পরিবারে স্বামীরা পরস্পরের ভাই হতো না, তারা হতো একে-অন্যের ঘনিষ্ঠ সাথী বা পুনালুয়া। ঠিক একইভাবে একদল আপনি বা সমান্তরবর্তী ভাইয়েরা মিলিতভাবে বিয়ে করতো একদল নারীকে, এবং স্ত্রীরা হতো একে-অন্যের সাখী। এটা ছিলো সমষ্টি বিয়ে, যা থেকে উৎপত্তি হয়েছিলো গোত্রের।
সমষ্টি বিয়ের পরিবারে বাপের ঠিক ছিলো না, কিন্তু মা ছিলো সুনিশ্চিত। সমষ্টি মায়েররা পরিবারের সব সন্তানকেই নিজের সন্তান মনে করতো, তবে নিজের পেটের সন্তানদের চিনতো পৃথক করে। সমষ্টি বিয়েতে শুধু মায়ের দিক থেকেই সম্ভব ছিলো বংশপরম্পরা ঠিক করা; তাই তাতে স্বীকৃতি পেতো শুধু মাতৃধারা। সমষ্টি বিয়ের কালে বা তারও আগে কিছু সময়ের জন্যে দেখা দিয়েছিলো জোড়বাধা পরিবার, যাতে বহু স্ত্রীর মধ্যে একটি পুরুষের থাকতো একটি মুখ্য স্ত্রী। আবার ওই পুরুষটি হতো ওই নারীর বহু পতির মধ্যে মুখ্য পতি। মহাভারতে বিয়ের প্রচলন সম্পর্কে একটি কাহিনী রয়েছে। শ্বেতকেতু তার পিতা উদালক ও মায়ের সাথে বসে ছিলো; এমন সময় এক ব্ৰাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মাকে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এর কারণ জানতে চাইলে তার পিতা তাকে জানায় যে তার মায়ের ওপর তার একান্ত অধিকার নেই; যে-কেউ তার মাকে নিয়ে ভোগ করতে পারে। এ-উপাখ্যান নির্দেশ করে সম্ভবত জোড়বাধা পরিবার। এর আগে পুরুষের জন্যে নারীর অভাব ঘটতো না, কারণ তখনো রক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয় নি, তাই প্রচুর নারী পাওয়া যেতো বিয়ের জন্যে; কিন্তু এখন নারী দুষ্পপ্ৰাপ্য হয়ে ওঠে। নারীর অভাবে জোড়বাধা বিয়ের সাথেসাথে শুরু হয় নারীহরণ ও নারীকেনা। জোড়বাঁধা বিয়ে ছিলো অস্থায়ী ও দুর্বল; তাই এর ফলে আগের সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালি ভেঙে যায় নি। সমষ্টি বিয়ের সাম্যতন্ত্রী পরিবারে ছিলো নারীদের আধিপত্য; কেননা তখন জনককে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হতো না, তাই মা-ই ছিলো স্বীকৃত, পিতা তখনো স্বীকৃতি পায় নি। সমাজের সূচনাকালে নারীরা পুরুষের দাসী ছিলো না; আরণ্য ও বর্বর নারীরা ছিলো স্বাধীন ও সম্মানিত। সাম্যতন্ত্রী পরিবারে নারীরা বা বেশির ভাগ নারী হতো একই গোত্রের, পুরুষেবা বিভিন্ন গোত্রের; তাই আদিম যুগে ছিলো নারীর আধিপত্য। নারীরা তখন বিচ্ছিন্ন ছিলো না। শ্রম থেকে, শ্রমই তাদের সত্যিকার মর্যাদার আসনে বসাতো; তারা আধুনিক সুবিধাভোগী শ্রেণীর শ্রমবিচ্ছিন্ন নারীদের মতো আসার আরাম আর মর্যাদা ভোগ করতো না।
সমষ্টি বিয়েতে এক নারীর ছিলো বহু পতি, পরে তা একপতিতে সমাপ্তি পায়। পাতিব্ৰত্য এখন গুণ, কিন্তু একপতিতে সীমাবদ্ধ হওয়ার প্রথম দিকে পাতিব্ৰত্য হয়ে ওঠে নারীর অপরাধ; আর এ-অপরাধের জন্যে প্ৰায়শ্চিত্তও করতে হয় নারীদের। এটা নেয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আত্মদানের রূপ, নারীদের বিশেষ সময়ের জন্যে স্বামী ছাড়া অন্যদের দান করতে হয় দেহ। ব্যাবিলনের নারীদের বছরে একবার দেহদান করতে হতো মিলিট্টার মন্দিরে, মধ্যপ্রাচ্যের নানা উপজাতির মেয়েদের কয়েক বছর দেহদানের জন্যে পাঠানো হতো আনাইটিসের মন্দিরে। পরে প্রাঃশ্চিত্তমূলক দেহদানের সময় কমানো হয়। বাখোফেন বলেছেন : বৎসরে একবার করে আত্মদানের বদলে মাত্র একবার আত্মদান চালু হয়, বিবাহিতা স্ত্রীলোকের হেটায়ারিজমের (গণিকাবৃত্তি) জায়গায় দেখা দেয় কুমারীদের হেটায়ারিজম, বিবাহিত অবস্থায় তার আচরণের বদলে বিবাহের পূর্বে আচরণ, সকলের কাছে নির্বিচারে আত্মদানের বদলে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কাছে আত্মদান’ [দ্র এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২০৮)]। ভূমধ্যসাগর থেকে গঙ্গার কূল পর্যন্ত ধর্মের আবরণে, এবং কোনো কোনো জাতির মধ্যে ধর্মের আবরণ ছাড়াই চলে এ-প্রথা। পুরোনো দিনের থ্রেসিয়ান, কেল্টিক, ভারতের বহু আদিম অধিবাসী, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও আমেরিকার অনেক আদিবাসীদের মধ্যে মেয়েরা বিয়ের আগে ভোগ করতো প্রচুর যৌনস্বাধীনতা। কোনো কোনো জাতির মধ্যে বরের বন্ধু বা আত্মীয়রা বা বরযাত্রীরা বিয়ের রাতেই কনের দেহের ওপর খাটাতো নিজেদের সনাতন অধিকার, সবশেষে আসতো বরের পালা। পুরাকালে এর চল ছিলো বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে, ও আফ্রিকার অগিলাদের মধ্যে। কোনো কোনো জাতির মধ্যে কনের ওপর ‘প্রথম রাত্রির অধিকার’ উপভোগ করতো গোত্রপ্রধান, কাসিক, শামান, পুরোহিত, রাজপুত্র ইত্যাদি বরেণ্যরা। বাঙলায়ও একসময় ছিলো। এ-প্ৰথা, যার নাম গুরুপ্রসাদী; এতে গুরু বা পুরোহিত মোচন করতো বধুর কৌমাৰ্য। গুরুর প্রসাদগ্ৰহণ সম্পন্ন হওয়ার পর বরের ভাগ্যে জুটতো নববধুর দেহপ্রসাদ।
ক্রমে ক্রমে সম্পদ বাড়তে থাকে, আর সম্পদই শত্রু হয়ে দেখা দেয় নারীদের। পুরুষ যখন জমির মালিক হয়, সে তখন নারীর মালিকানাও দাবি করে। জমি আর নারী পুরুষের কাছে এক। আরণ্যপর্ব থেকে মানুষ যখন পৌঁছোয় কৃষিপর্বে তখন সম্পদশালী হয়ে ওঠে বিভিন্ন গোত্র। একসময় ওই সম্পদ অধিকারে চলে আসে গোত্রপতিদের; তারা হয়ে ওঠে সম্পদশালী। আগে, মাতৃ-অধিকার অনুযায়ী, গোত্রের কেউ মারা গেলে তার সম্পত্তি পেতো গোত্রভুক্তরা। সম্পদ যতো বাড়তে থাকে পরিবারে নারীদের থেকে গুরুত্ব বাড়তে থাকে পুরুষদের, এবং পুরুষেরা উদ্যোগ নেয় উত্তরাধিকারের সূত্র বদলানোর। পুরুষ মাতৃধারার প্রথা ভেঙে সৃষ্টি করে পিতৃধারার প্রথা। এটা এক বিপ্লব, কিন্তু এ-বিপ্লবে কোনো রক্তপাত ঘটে নি; নীরবেই সম্পন্ন হয়। পুরুষের অভ্যুত্থান। স্থির হয়। পুরুষের সন্তানসন্ততি হবে তার গোত্রভুক্ত, নারীর সন্তানেরা বাদ পড়বে গোত্র থেকে, অন্তর্ভুক্ত হবে পিতার গোত্রের। এভাবে উচ্ছেদ হয় মায়েদের দিক দিয়ে বংশপরম্পরার হিশেবে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার; তার স্থানে আসে পিতার দিক থেকে বংশপরম্পরার হিশেবে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ঠিক কখন এ-বিপ্লব ঘটেছিলো, অভ্যুত্থান ঘটেছিলো পুরুষের, এবং কীভাবে ঘটেছিলো, তা আজ বলার উপায় নেই, কিন্তু এটা সত্য যে মানুষ প্ৰজাতির মধ্যে পুংলিঙ্গের উত্থানে অধিকার হারিয়েছিলো স্ত্রীলিঙ্গ। মাতৃ-অধিকারের উচ্ছেদকে এঙ্গেলস বলেছেন ‘স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়’, যার ভার এখনো বইছে নারী। সত্যিই কি একসময় একটা আশ্চর্য সোনালি যুগ ছিলো নারীদের, যা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো পুরুষের অভ্যুত্থানে? বাখোফেন এতে বিশ্বাস করেন, তার অনুসরণে এতে বিশ্বাস করেন এঙ্গেলস; কিন্তু দ্য বোভোয়ার মনে করেন নারীদের ওই সোনালি যুগ একটি সুন্দর কিংবদন্তি। তার মতে সমাজ সব সময়ই পুরুষের, রাজনীতিক শক্তিও সব সময় ছিলো ও আছে পুরুষের মুঠোতে। তবে বাখোফেন নারীর সোনালি দিনের, পুরুষতন্ত্রের অভ্যুত্থানের যে কথা বলেছেন, তা তাঁর কল্পনা নয়; তিনি পুরুষের অভ্যুত্থানের কিছু চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন পুরাণে ও সাহিত্যে।
কখন ঘটে এ-অভুত্থান? সম্ভবত এটা ঘটে যখন জানা হয়ে যায় পিতৃত্বের রহস্য। আগে মনে করা হতো নারীদের গর্ভে দৈবপ্রক্রিয়ায় পুনরায় শিশু হয়ে জন্ম নেয় পূৰ্বপুরুষেরা; কিন্তু পিতৃত্বের রহস্য যখন জানা হয়, যখন পুরুষ বুঝতে পারে সন্তান জন্ম দেয়ায় রয়েছে তার ভূমিকা, তখন পুরুষ প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার ক’রে নিজের ভূমিকাকেই গুরুত্বপূর্ণ ব’লে ঘোষণা করে। পিতৃত্বের রহস্যটি যখন জানা হয়, তখনই ঘটে পুরুষতান্ত্রিক বিপ্লব। বাখোফেন এর পরিচয় দেখতে পেয়েছেন এস্কিলুসের অরেন্সতেইয়া ত্ৰিনাটকে। এ-ত্রিনাটকের তৃতীয়টির নাম অয়মেনিদেস [সুভাষিত অর্থ: দয়াবতী দেবীগণ, আসলে বোঝায় প্রতিহিংসার দেবীগণ], যাতে রূপায়িত হয়েছে জয়ী পিতৃতন্ত্র ও পরাজিত মাতৃতন্ত্রের শেষ রাজনীতিক সংঘর্ষ। ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে বিজয়ী সেনাপতি আগামেমনন, সাথে নিয়ে এসেছে অনেক নারীর মধ্যে ট্রয়ের রাজকন্যা কাসান্দ্ৰাকে, ধর্ষণেধর্ষণে যে পাগল হয়ে গেছে। ফেরার পর এ বিজয়ী বীরকে হত্যা করে তার স্ত্রী ক্লাইতেমনোন্ত্রা। হত্যার পেছনে রয়েছে দুটি কারণ; স্বামীর দশ বছরের অনুপস্থিতির সময় সে একটি দায়িত পেয়েছে, এবং সে তার কন্যা ইফিজিনিয়ার হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। ট্রয়যাত্রার আগে আগামেমনন কন্যা ইফিজিনিয়াকে একিলিসের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা বলে নিয়ে বলি দেয় দেবতার উদ্দেশে, যাতে দেবতার বরে অনুকূল বায়ুতে সে যেতে পারে ট্রয়ে। পরে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে অরেসতেস খুন করে মা ক্লাইতেমনোন্ত্রাকে। কিন্তু মাকে খুন ক’রে অরেসতেস রুষ্ট করে প্রতিহিংসার দেবীদেব, যারা তাকে তাড়িয়ে ফেরে শহর থেকে শহরে।
প্রতিহিংসার দেবী কারা? তারা আর কেউ নয়, তারা মাতৃতন্ত্র বা মাতৃ-অধিকারের পরাভূত শক্তিরাশি, যারা এখন পরিণত হয়েছে কলহপরায়ণ নারীতে। তারা যখন চিৎকার ক’রে অরেসতেসের শাস্তি চায়, তখন তাদের চিৎকারে শোনা যায় মাতৃ-অধিকারের শেষ দাবি। অরেসতেস তাদের জানায় তার কোনো দোষ নেই, অ্যাপোলোর নির্দেশেই সে মাতৃহত্যা করেছে। দৈববাণীর দেবতা এমন নির্দেশ দেবে, এটা তাদের বিশ্বাস হয় না; তাই তারা বিচারের জন্যে অ্যাথেনাকে মধ্যস্থ মানে অরেসতেস। জানতে চায় তারা কেনো স্বামীঘাতক ক্লাইতেমনোস্ত্ৰকে তাড়া করে নি? তারা উত্তর দেয় : ‘যে-পুরুষকে সে করেছে হত্যা তার সাথে ছিলো না তার রক্তের সম্পর্ক।’ এতে প্রকাশ পায় মাতৃ-অধিকারের ন্যায়। অরেসতেস প্রশ্ন করে : ‘কিন্তু আমি কি আমার মায়ের?’ এ-প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয় দেবীরা; কিন্তু অ্যাপোলো সত্যকে অস্বীকার ক’রে, পিতৃতান্ত্রিক দাপটে, জানায়, ‘মা ছাড়াও পিতা পারে জন্ম দিতে’। সে প্রমাণ হিশেবে দাঁড় করায় অ্যাথেনাকে, যার জন্ম হয়েছিলো পিতা জিউসের মাথা থেকে। অ্যাথেনা উঁচু গলায় ঘোষণা করে পুরুষতন্ত্রের জয়। প্রতিহিংসার দেবীরা ‘হে মাতা, হে অন্ধকার’ ব’লে কান্নায় ভেঙে পড়ে। হেরে যায় আগের উর্বরতার দেবীরা, সেখানে দেখা দেয় পুরুষ দেবতারা; মাতৃতন্ত্রকে উচ্ছেদ ক’রে প্রতিষ্ঠা পায় পিতৃতন্ত্র। পুরুষের জয় ঘোষিত হয় দিকেদিকে, এবং হাজার হাজার বছরে কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি। নারী হয়ে থাকে মানুষপ্রজাতির পরাভূত লিঙ্গ।
আগে নারী ছিলো গৃহের প্রধান; মাতৃ-অধিকার উচ্ছেদের পর পুরুষ দখল করে গৃহের কর্তৃত্ব। পুরুষ নারীকে করে নিজের দাসী, শৃঙ্খলিত, লালসার শিকার ও সন্তান (বিশেষ ক’রে পুত্র) উৎপাদনের যন্ত্র। দেখা দেয় পিতৃপ্রধান একপতিপত্নী পরিবার। আরো দুটি প্রথা ছিলো বিয়ের, এর একটি এখনো টিকে আছে মুসলমানদের মধ্যে। একটি বহুপত্নীত্ব ও অন্যটি বহুস্বামীত্ব। বহুপত্নীত্ব হচ্ছে সম্ভোগের চরম রূপ। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে ও তিব্বতে বহুস্বামীত্বও এক সময় ছিলো, হয়তো এখনো আছে। এখন চলছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, একপতিপত্নী প্রথা; কিন্তু একপতিপত্নী প্রথার সূচনা হয় কখন, এবং কাদের উদ্যোগে? বাখোফেন বলেছেন, তার কথিত ‘হেটায়ারিজম’ থেকে চালু হয়েছিলো একপতিপত্নীপ্ৰথা নারীদেরই চেষ্টায়। তাঁর মতকে এঙ্গেলস বলেছেন ‘সম্পূর্ণ নির্ভুল’। এ-বদলের কারণ ব্যাখ্যা ক’রে এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২১০) বলেছেন যে আর্থনীতিক বিকাশের ফলে আদিম সাম্যতন্ত্রী ব্যবস্থার ঘটে অবনতি, আগের যৌনসম্পর্কগুলো আরণ্যক চরিত্র হারিয়ে নারীদের কাছে মনে হতে থাকে হীন ও পীড়নমূলক, তাই ‘আগ্রহের সঙ্গে পরিত্রাণ হিসাবে তারা অবশ্য পাতিব্ৰত্যের অধিকার, একটি পুরুষের সঙ্গে অস্থায়ী বা স্থায়ী বিবাহ চেয়ে থাকবে।‘ এঙ্গেলস মনে করেন এ-অগ্রগতি পুরুষ চাইতে পারে না, কেননা পুরুষ আজও পর্যন্ত স্বপ্নেও কখনও আসল সমষ্টি-বিবাহের সুবিধা ছাড়তে চায় নি।‘ নারীরাই চেয়েছিলো পাতিব্ৰত্য, বহুযৌনসম্পর্ক নারীদের কাছে মনে হয়েছিলো পীড়াদায়ক, এবং তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে নারীরা চেয়েছিলো একপতির পবিত্ৰ শয্যায় সতীত্বের অধিকার? সমষ্টি বিয়ে পুরুষের জন্যে সুবিধাজনক, নারীদের জন্যে অসুবিধাজনক? মিলেট (১৯৬৯, ১১৬) এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তে দেখেছেন ‘অ্যাবসারডিটি’; কেননা এঙ্গেলস ধরে নিয়েছেন যে নারীরা কাম অপছন্দ করে। হাজার হাজার বছর ধরে পুর্বপশ্চিমের ঋষিরা রটিয়েছেন নারীরা কামচণ্ডালী, ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ (২৩:৩২) বলেছর ‘পুরুষের থেকে নারীদের কাম আটগুণ’, সন্তরা বলেছেন জরায়ুর ক্ষুধা আগুনের মতোই অশেষ ; আর এঙ্গেলস ধ’রে নিয়েছেন কাম নারীদের কাছে পীড়াদায়ক, অপ্ৰিয়। সঙ্গমকে তিনি হয়তো মনে করেছিলেন নারীর একধরনের রাজনীতিক পরাজয়, কেননা নারী যেনো তাতে আত্মসমৰ্পণ করে পুরুষের কাছে; এবং তার ভিক্টোরীয় মানসিকতাও কাজ করেছিলো এর পেছনে। ওই সময়ে এমন একটি ধারণা তৈরি, প্রচার ও জনপ্রিয় ক’রে তোলা হয়েছিলো যে নারী কামকে ঘেন্না করে, কাম নারীর প্রিয় নয়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভিক্টোরীয় সংস্কৃতি নারীকে কামবোধহীন ক’রে তুলেছিলো, শীতল নারীকেই তারা মনে করতো সতী; তাই সে-সময় নারীরা শীতল হয়ে উঠেছিলো; কিন্তু কাম নারীদের কাছে অপ্ৰিয় নয়। নারীদের কামপ্রবলতা সম্পর্কে প্রাচীন উপাখ্যানের শেষ নেই : মহাভারত-এ একটি উপাখ্যান রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে পুরুষদের থেকে নারীরাই সঙ্গম উপভোগ করে বেশি। রাজর্ষি ভঙ্গাসন ইন্দ্রের ক্ৰোধে নারীতে পরিণত হয়, এবং এক তাপসের ঔরষে নিজের গর্ভে একশো পুত্র জন্ম দেয়। পরে ইন্দ্র তাকে পুরুষত্ব ও নারীত্বের মধ্যে একটি বেছে নিতে বললে সে নারীই থাকতে চায়। কারণ হিশেষে সে বলে, ‘স্ত্রীপুরুষের সংযোগকালে স্ত্রীরই অধিক সুখ হয়।‘ ভঙ্গাসনের মতো নারীপুরুষ দু-রূপেই অভিজ্ঞতা অর্জন এখন অসম্ভব, কিন্তু মিলনের সময় নারীর আচরণ দেখে মনে হতে পারে কাম উদ্ভাবিতই হয়েছিলো নারীর জন্যে। কাম পুরুষের একটি প্রত্যঙ্গের, আর নারীর সমগ্র শরীর ও চৈতনার ব্যাপার। আধুনিক গবেষণা তাই প্রমাণ করেছে।
আধুনিক গবেষণা দেখিয়েছে সহজাত ও জৈবিকভাবে নারী পুরুষের থেকে অনেক বেশি উপভোগ করে কাম। পৌনপুনিকতায় ও পুলকানুভূতিতে নারী অনেক বেশি সমর্থ পুরুষের থেকে। মাস্টারস ও জনসন সাড়াজাগানো ‘মানুষের যৌন সাড়া’ (১৯৬৬) গ্রন্থে দেখিয়েছেন নারী খুব দ্রুত একের পর এক পুলক অনুভব করতে পারে, যা পুরুষ কখনো পারে না। নারীর পুলক সম্পর্কে ধারণাও বদলে গেছে একালে। আগে শুধু রন্ধটিকেই সুখের খনি মনে করা হতো; কিন্তু নারীর আসল সুখের বেদি ভগাঙ্কুর। মানুষের অন্য কামাঙ্গগুলোর আরো কাজ আছে, কিন্তু নারীরই শুধু রয়েছে একটি বিশেষ প্রত্যঙ্গ যার একমাত্র কাজ যৌনসুখ অনুভব। সেটি ভগাঙ্কুর। পুরুষের এমন কোনো প্রত্যঙ্গ নেই। পুরুষের যৌনশক্তি সীমিত, নারীর অমিত, তাতে শুধু বাধা দিতে পারে শারীরিক ক্লান্তি বা মানসিক অবস্থা। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীকে ও তার কামকে দমন ক’রে রেখেছে নানা বিধিনিষেধে; এবং পুরুষের কামকে ক’রে তুলেছে নিবৃত্তিহীন। পুরুষতন্ত্র পুরুষের কামশক্তির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করেছে বহুবিবাহ ও দ্বৈতমানের সুযোগ। এটা জৈব সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ। পুরুষতন্ত্র ভোগে স্ববিরোধিতায়ও : পুরুষতন্ত্র নারীকে কামসামগ্ৰীতে পরিণত করতে চায়, আবার চায় যে নারী হবে কামবিমুখ। মুসলমান দেশগুলোতে এটা প্ৰবল; ওই দেশের পুরুষেরা চায় স্বামীদের শয্যায় নারীরা হবে মেরেলিন মনরো, শয্যার বাইরে হবে সতীসাধ্বী বিবি। এঙ্গেলসের ধারণা ঠিক নয় যে নারীরাই চেয়েছিলো একপতির অধীনে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে, কেননা কাম তাদের কাছে পীড়াদায়ক। পুরুষই চেয়েছিলো, তাই এটা হয়েছে; যদি নারী চাইতো আর পুরুষ না চাইতো, তাহলে কখনো এটা ঘটতো না। পুরুষ নারীকে ক’রে তুলেছিলো তাদের শ্ৰেষ্ঠ সম্পত্তি, আর ওই সম্পত্তিতে ভাগ বসাক অন্য কেউ, এটা তারা চায় নি। তারা নিজেদের জন্যে রেখেছে বহুবিবাহ, বা বহুনারীসংসর্গের সুযোগ্য; আর নারীকে ক’রে রেখেছে একজনের একান্ত ভোগ্যবস্তু। নারী বহু কাল ধ’রে বাধ্য হয়ে যুগিয়ে আসছে পুরুষের কামতৃপ্তি এবং পশুর মতো প্রসব করে আসছে মনুষ্যশাবক।
বর্বরতার মধ্য স্তর থেকে শেষ স্তরে ওঠার সময় জোড়বাধা বিয়ে থেকে উদ্ভব ঘটে একপতিপত্নী বিয়ের। সভ্যতার সূচনার সময় একপতিপত্নী বিয়েই রীতি হয়ে ওঠে। এর ভিত্তি পুরুষাধিপত্য, লক্ষ্য সুনিশ্চিত পিতৃত্বে সন্তান উৎপাদন। তখন বাপই সমস্ত সম্পত্তির মালিক; আর বাপ এমন কাউকে সম্পত্তি দেবে না, যে তার ঔরষে জন্ম নেয় নি : বাপের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে সন্তান, বিশেষ করে পুত্র। এ-বিয়েতে স্বামীস্ত্রীর খেয়ালে বিয়ে ভাঙা সম্ভব নয়, তবে স্বামী তা পারে বেশ সহজে। এ-বিয়েতে দাম্পত্যজীবনে পুরুষের বিশ্বাসভঙ্গের অধিকারও থাকে খুবই বেশি; কিন্তু নারীর কোনো অধিকার থাকে না। এমন একপতিপত্নী পরিবারের কঠোর রূপ দেখা দেয় গ্রিকদের মধ্যে। সেখানে পুরোনো দেবীদের যে-প্রতিষ্ঠা, তা থেকে বোঝা যায় নারীরা তখন সম্মানিত ছিলো, কিন্তু বীরযুগে পতন ঘটে নারীদের অবস্থার। তখন দেখা যায় পুরুষেরা বিয়ের বাইরে যৌনসম্পর্ক রাখছে, কিন্তু নারীরা বাধ্য হচ্ছে কঠোর সতীত্ব বা পাতিব্ৰত্য পালন করতে। সভ্যতার যুগে নারী হয়ে ওঠে। পুরুষের বৈধ উত্তরাধিকারীর জননী, তার প্রধান গৃহকত্রী, দাসীদের প্রধান। স্বামীরা দাসীদের নিয়মিত সম্ভোগ করতো, বাইরে গণিকা উপভোগ করতো; কিন্তু স্ত্রীদের থাকতে হতো আপাদমস্তক সতী। তাই একপতিপত্নী বিয়ে নির্মমভাবে সত্য হয় শুধু নারীর জন্যে, পুরুষের জন্যে নয়। ডেমোসথেনেস বলেছেন, ‘চেতনার সুখের জন্যে আমাদের আছে গণিকা, ইন্দ্ৰিয়সুখের জন্যে রক্ষিতা, এবং পুত্রলাভের জন্যে স্ত্রী’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১১৯)]। পুরোনো ভারতে পুরুষ বিয়ে করতো বহু, তার ওপরে ছিলো বিচিত্র ধরনের বেশ্যা, যাদের শ্ৰেষ্ঠ ছিলো ‘গণিকা’। বাৎস্যায়ন লিখেছেন, ‘চৌষট্টিকলায় উৎকর্ষ লাভ ক’রে শীল, রূপ ও গুণান্বিতা বেশ্যা ‘গণিকা’ সংজ্ঞা লাভ করে এবং গুণগ্রাহীদের সমাজে স্থান লাভ করে। রাজা সর্বদা তাকে সম্মান করেন, গুণবানেরা তার স্তুতি করেন এবং সে সকলের প্রার্থনীয়া, অভিগম্য ও লক্ষীভূত হয়ে থাকে’ [কামসূত্র: দ্ৰ মহেশচন্দ্র (১৯৮০)]। কিন্তু স্ত্রীরা রাজা কেনো স্বামীদের কাছেও সম্মানিত ছিলো না।
একপতিপত্নী বিয়ে দেখা দেয় নি নারীপুরুষের সদ্ভাবের ফলে, বা বিয়ের একটি আদর্শ রূপ হিশেবে। এটি দেখা দিয়েছিলো নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যরূপে; এবং এখনো তাই আছে। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২২) বলেছেন, ‘ইতিহাসে শ্রেণীবিরোধ প্রথম যা দেখা দেয় সেটা মিলে যায় একপতিপাতী বিবাহে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বিরোধের বিকাশের সঙ্গে এবং প্রথম শ্রেণীপীড়ন মেলে পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীজাতির ওপর পীড়নের সঙ্গে।‘ একপতিপত্নী বিয়ে অগ্রগতি, কিন্তু পেছনে ফেরাও, কেননা এর ভিত্তি নারীর ওপর পুরুযের শোষণ। পবিত্র একপতিপত্নী বিয়ের সাথে দেখা দেয় দুটি অপবিত্র ব্যাপার, যা আগে ছিলো না; একটি গণিকাবৃত্তি, অন্যটি ব্যভিচার। গণিকাবৃত্তির শুরু হয়েছিলো প্ৰায়শ্চিত্তমূলক দেহদানে, যখন নারীরা প্রণয়দেবীর মন্দিরে অর্থের বিনিময়ে আত্মদান ক’রে প্রায়শ্চিত্ত করতো সতীত্বের। অর্থ জমতো মন্দিরের কোষে। আর্মেনিয়ার আনাইটিসের মন্দির ও করিন্থের আফ্রোদিতির মন্দিরের পরিচারিকারী ও ভারতের মন্দিরের দেবদাসীরা ছিলো প্ৰথম গণিকা। সম্পত্তির বৈষম্য শুরু হওয়ার পর ক্রীতদাসীরা যখন বাধ্য হয় প্রভুকে দেহদানে, তখন শুরু হয় স্বাধীন নারীদের পতিতাবৃত্তি। স্বামীরা পতিতা সম্ভোগ করতো, তাতে কোনো বাধা ছিলো না; কিন্তু স্ত্রীরা ছিলো অবহেলিত। স্ত্রীরা শুধু চোখ বুজে দেখে যাবে স্বামীদের লাম্পট্য, থাকবে সতীসাধ্বী, এটা আশা করা যায় না; তারাও যে হাত বাড়াবে নিষিদ্ধ গন্ধমের দিকে, এটাই স্বাভাবিক। তাই দেখা দেয় একটি নতুন প্রপঞ্চ, যার নাম স্ত্রীর উপপতি; শুরু হয় নারীর ব্যভিচার। একপতিপত্নী বিয়ের মধ্যে স্বামীর দিক থেকে থাকে গণিকাসম্ভোগ, আর স্ত্রীর দিক থেকে থাকে, এঙ্গেলসের মতে, ‘ঢালাও ব্যভিচার’। বাইবেলেব হিতোপদেশ বলেছে, ‘পরকীয়া স্ত্রীর ওষ্ঠ হইতে মধু ক্ষরে, তাহাব তালু তৈল অপেক্ষাও স্নিগ্ধ’; এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, ‘মৃত্যুর মতোই ব্যভিচারের কোন চিকিৎসা নেই।‘ এ-বিয়ের সুখ কেমন? এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, ‘একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকে বলা হয় দাম্পত্য সুখ।’ এ-বিয়ে পরিণত হয, এঙ্গেলসের মতে, স্থল বেশ্যাবৃত্তিতে, বিশেষ ক’রে স্ত্রীর বেলা। স্ত্রী আর পতিতা কি এক? এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৭) বলেছেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না, পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্ত্বে; এবং ফুরিয়ের [ দ্র এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৭)] বলেছেন, ‘ব্যাকরণে যেমন দুটি নেতিবাচক শব্দে একটি ইতিবাচক শব্দ হয়, তেমনই বিবাহের নীতিশাস্ত্রে দুটি বেশ্যাবৃত্তি মিলে পুণ্যধর্ম হয়ে ওঠে। সাম্যবাদী এঙ্গেলস বুর্জোয়াদের দাম্পত্যজীবনকে পতিতাবৃত্তি মনে করলেও প্রলেতারিয়েতদের সম্পর্কে তাঁর উঁচু ধারণা ছিলো; তিনি মনে করেছেন তাদের মধ্যে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক সুস্থ হ’তে পারে। কিন্তু এটা এক সাম্যবাদী ভ্ৰান্তি। প্রলেতারিয়েতদের স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক আরো অসুস্থ; তা একেবারেই শস্তা পতিতাবৃত্তি। পতিতার খদ্দের হিশেবে প্রলেতারিয়েতের থেকে বুর্জোয়া উৎকৃষ্ট।
উৎপাদন বা আর্থ ক্রিয়াকাণ্ডে যার অংশ নেই, দুরবস্থা তার কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। নারীর দুরবস্থার কারণ তাই নারী বহুকাল ধ’রে আর্থ ক্রিয়াকলাপ থেকে নিবাসিত হয়ে পরগাছায় পরিণত হয়েছে। নারী আর্থনীতিকভাবে শোষিত, তাই সব দিকেই শোষিত। আদিম সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালিতে নারীর ওপর অর্পিত ছিলো গৃহস্থালি, তা আজকের পরিবার সেবা ছিলো না, ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তি। কিন্তু পিতৃপ্রধান পরিবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গৃহস্থলির কাজের মূল্য কমে যায়; বৃত্তির বদলে তা হয়ে ওঠে সেবা, যার দরকার আছে কিন্তু মূল্য নেই। সামাজিক উৎপাদনের এলাকা থেকে বহিস্কৃত হয়ে স্ত্রী হয়ে ওঠে প্রথম ঘরোয়া ঝি। আধুনিক পরিবার দাঁড়িয়ে আছে নারীর প্রকাশ্য বা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ওপর; এঙ্গেলস বলেছেন, পরিবারের মধ্যে স্বামী হচ্ছে বুর্জোয়া, স্ত্রী প্রলেতারিয়েত। কারণ বিত্তবান শ্রেণীগুলোতে পুরুষ উপার্জন করে, নারী কোনো কিছু উপার্জন করে না; তাকে এমনভাবে নিষ্ক্রিয় ক’রে দেয়া হয়েছে যাতে সে হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক অপদার্থ। পানী শ্রেণীগুলোতে নারীদের ক’রে তোলা হয়েছে অপদার্থতার প্রতিমূর্তি; পুরুষের বিনোদ যোগানোর বেশি আর কিছু তারা করতে পারে না ; মানুষের হাতেপায়ে শেকল পরানো সহজ, কঠিন হচ্ছে শেকলমুক্ত করা; আর ওই শেকল যদি সুবিধাজনক হয়, তবে মানুষ মুক্তির চেয়ে শেকলকেই বেশি প্রিয় মনে করে। এটা ঘটেছে বুর্জোয়া নারীদের বেলা; তারা কারুকার্যখচিত শেকলকেই বরণ ক’রে নিয়েছে। ওই শেকল তাদের স্বাধীনতা ও সম্মান হরণ করেছে, কিন্তু নানা সুবিধা এনে দিয়েছে বলে শোকলে তারা নিজেদের আরো শক্ত করে বেঁধে রাখতে চায়। একপতিপত্নী বিয়েতে নারী সব স্বাধীনতা হারিয়েছে, দাসী হয়ে উঠেছে; তার সমষ্টি বিয়ের যৌন স্বাধীনতা হারিয়েছে, কিন্তু পুরুষ সমষ্টি বিয়ের সুবিধা হারায় নি। পুরুষদের জন্যে আজো রয়ে গেছে সমষ্টি বিয়ে। মুসলমানেরা বহু বিয়ে করতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সবাই বহু বিয়ে ক’রে থাকে; এবং পৃথিবী জুড়েই পুরুষেরা উপভোগ করে বিয়ের বাইরে জাকালো যৌনসম্পর্ক। নারীর পক্ষে যা মারাত্মক অপরাধ, পুরুষের বেলা তা অনেক সময় গৌরবের বা আনন্দের সাথে উপভোগ্য নিন্দার ব্যাপার। একই পুরুষের অধিকারে প্রচুর সম্পত্তি জড়ো হওয়ার ফলে, এবং তাঁর সন্তানসন্ততিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করার বাসনা থেকে উদ্ভূত হয় একপতিপত্নী বা একপতি-একাধিক পত্নী বিয়ে;- সম্পূর্ণ পুরুষের স্বার্থে। এজন্যে নারীর পক্ষে একপতিত্ব বাধ্যতামূলক, পুরুষের জন্যে নয়।
এঙ্গেলস পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে ও পরিবারের উদ্ভব ও প্রকৃতির যে-ব্যাখ্যা দেন, তা বিপ্লবাত্মক; কেননা তিনি দেখান যে এর কোনোটিই শাশ্বত নয়। যা বহুকাল ধ’রে চ’লে এসেছে, তাই যে চিরকাল চলবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে, পরিবার ও আর সমস্ত কিছু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত-বিবর্তিত হয়েছে, এখনো বিবর্তন চলছে; এমনকি এর আমূল পরিবর্তনও ঘটানো অসম্ভব নয়। তিনি দেখান যে পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে ও পরিবার গড়ে উঠেছে নারীকে পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত করে। নারীশোষণই পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি, যার সাথে যুক্ত আরো নানা ধরনের শোষণ। এ-সমস্ত শোষণের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র, যার কাজ বিচিত্র ধরনের শোষণ ও বৈষম্যকে বৈধ ক’রে তোলা। তাই সমস্ত মানবিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে। পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা, লৈঙ্গিক রাজনীতির ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থ সংগঠন। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২২) বলেছেন :
ইতিহাসে শ্রেণী-বিরোধ প্রথম যা দেখা দেয় সেটা মিলে যায় একপতিপত্নী বিবাহে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বিরোধের বিকাশের সঙ্গে এবং প্রথম শ্রেণী পীড়ন মেলে পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীজাতির ওপর পীড়নের সঙ্গে। একপতিপত্নী বিবাহ ইতিহাসের একটি বড় অগ্রসর পদক্ষেপ, কিন্তু সেই সঙ্গেই দাসপ্রথা ও ব্যক্তিগত সম্পদসহ তা এমন এক যুগের পত্তন করে যা আজও পর্যন্ত চলছে এবং যাতে প্রত্যেকটি অগ্ৰগতিই হচ্ছে সেই সঙ্গে একটা আপেক্ষিক পশ্চাদগতি, যেখানে জনসমষ্টির একাংশের সচ্ছলতা ও উন্নতি হয় অপর এক অংশের দুঃখ ও পীড়নেৰ মধ্য দিয়ে। একপতিপত্নী বিবাহ হচ্ছে সভ্য সমাজের কোষ-রূপ, এখানে আমরা সেই সব বৈরিতা ও বিরোধের প্রকৃতি লক্ষ্য কবতে পারি যেগুলি শেষোক্তের মধ্যে পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে।
বৈরিতা ও বিরোধের ভিত্তির ওপর যা দাঁড়িয়ে আছে, তা কি ধ’সে পড়বে না? এঙ্গেলস স্বপ্ন দেখেছেন এক শোষণহীন সমাজের; তাই যে-আর্থনীতিক শোষণের ওপর দাঁড়ানো একপতিপত্নী বিয়ে ও পরিবার, যদি সে-শোষণ চলে যায়, তবে কি থাকবে এ-বিয়ে ও পরিবার? এর চমকপ্ৰদ উত্তর দিয়েছেন এঙ্গেলস; বলেছেন, ‘এই প্রথা লোপ না পেয়ে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই।’ ওই সমাজে সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে আবার ফিরে আসবে নারী–এটাই তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত; এবং ওই সমাজে উৎপাদনের উপায়গুলো হবে সমাজের সম্পত্তি, সেখানে কেউ সুবিধাভোগী কেউ সর্বহারা হবে না। তাই নারী হবে স্বাধীন, সেখানে পতিতা থাকবে না কেউ, এবং একপতিপত্নী প্রথা সত্য হয়ে উঠবে পুরুষনারী উভয়ের জন্যে। পরিবারের রূপ থাকবে না এখনকার মতো, এখন পরিবার হচ্ছে সমাজের অর্থনীতির একক, এঙ্গেলসের সমাজে তা হবে না। সেখানে ‘ব্যক্তিগত গৃহস্থলি পরিণত হবে সামাজিক শিল্পে।‘ শিশুপালন ও শিক্ষা হবে সামাজিক ব্যাপার, বিয়ে বা বিয়ের বাইরে যেভাবেই জন্ম হোক শিশুর, পুরো সমাজ নেবে তার দায়িত্ব, সে হবে সমাজের সন্তান। একপতিপত্নী বিয়েকে শুদ্ধ পবিত্র স্বর্গীয় ক’রে তোলা এঙ্গেলসের লক্ষ্য নয়; তার লক্ষ্য নারীর ওপর পুরুষের শোষণ এবং সার্বিক শোষণ দূর করা। তা কিছুতেই বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সম্ভব নয়। আমাদের উগ্র পুরুষতান্ত্রিক, মধ্যযুগীয়, দরিদ্র, অশিক্ষিত সমাজে নারীশোষণ বন্ধ করা বিশেষভাবেই কঠিন; নারীর মুক্তি তো সুদূর ব্যাপার। এখানে একটি ভালো বিয়েকেই নারীর জীবনের পরম সাফল্য ব’লে গণ্য করা হয়; এর বেশি এখনো ভাবা হয় না ; বরং মুক্তিকে মনে করা হয় বিপজ্জনক ও ব্যর্থতা। পশ্চিমের নারীবাদীরা এঙ্গেলসকেও ছাড়িয়ে গেছেন; তাঁরা একপতিপত্নী বিয়ের পবিত্রতাকে বিশেষ মূল্যবান মনে করেন না, তারা নারীর সামাজিক-আর্থ-যৌন সব ধরনের মুক্তি চান। গত তিন দশকে পশ্চিমের নারীবাদীরা বদলে দিয়েছেন তাদের সমাজের বহু এলাকা; এবং যৌন এলাকায় যে-পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তাকে বিপ্লব বলা যায়। তবে পৃথিবী এখনো পুরুষের, নারী এখনো পরাজিত, বন্দী। নারীর মুক্তির জন্যে দরকার বড়ো ধরনের সামাজিক বিপ্লব; যতোদিন ওই বিপ্লব না ঘটে ততোদিন নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, থাকবে দাসী ও যৌনসামগ্ৰী।
পিতৃতন্ত্রের খড়গ : আইন বা বিধিবিধান
পিতৃতন্ত্র প্রণয়ন করেছে বিপুল পরিমাণ আইন বা বিধিবিধান, যার এক নৃশংস অংশ সুপরিকল্পিতভাবে বানানো হয়েছে নারীদের পীড়নের জন্যে। পিতৃতন্ত্রের আইনসংশ্রয়টি তার বলপ্রয়োগ সংস্থা, যার বিধিগুলো এক বহুমুখি হিংস্র খড়গ, যা নারীর জীবনের দিকে উদ্যত হয়ে আছে কয়েক হাজার বছর ধরে, এবং ওই খড়গের ধারাবাহিক বলি নারী। ওই বিধিগুলো তৈরি করেছে পুরুষ, তৈরির সময় নারীর কোনো বক্তব্য শোনে নি; নারী সম্পর্কে প্রথম থেকে শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরুষ, তার শাস্তির সব বিধি প্রণয়ন করেছে নারীবিরোধী পুরুষতন্ত্র। পুরুষ নিজে প্রণয়ণ করেছে ওই নিষ্ঠুর সংহিতাগুলো, নারীকে স্থান দিয়েছে দণ্ডিতের শ্রেণীতে; ওই বিধিগুলোকে প্রচার করেছে ঐশী ব’লে। পুরুষ তার পুরুষ বিধাতার হাতে লিখিয়ে নিয়েছে নিজের রচনা; বিধাতা হয়ে উঠেছে। পুরুষের প্রস্তুত বিধানের শ্রুতিলিপিকর। পুরুষ একই সাথে নারীর বিরুদ্ধে বাদী, বিধিরচয়িতা ও বিচারক: নারীর তাতে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারও নেই। পলা দ্য লা বার বলেছেন, ‘পুরুষেরাই প্রণয়ন করেছে সমস্ত আইন, তাই তারা পক্ষপাত দেখিয়েছে নিজেদের লিঙ্গের প্রতি, আর বিচারকেরা ওই সমস্ত বিধিবিধানকে উন্নীত করেছে নীতির স্তরে’ [দি দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২২)]। পুরুষ জানে তার তৈরি বিধি নারীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, নারী মেনে নেবে না ওই দণ্ডাদেশ; তাই পুরুষ সেগুলোকে ঘোষণা করেছে ঐশী, এবং পুরুষাধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের স্বর্গীয় শাশ্বত অধিকার ব’লে। পুরুষের লেখা বিধিবিধানে নারী চিরদণ্ডিত। পৃথিবীর নারীসমাজ এখন প্রধানত পাঁচ ধরনের আইনের অধীনে জীবনদণ্ড ভোগ করছে, যার মাঝে চারটিকে বলা যায় সনাতন, যেগুলোর উৎস ধর্ম ; হিন্দু আইন, ইংরেজি সাধারণ আইন [ইংলিশ কমন ল], রোমান আইন [রোমান ল], ইসলামি আইন [শরিয়া]; আর পঞ্চম ধরনের আইনগুলো প্রণীত হয়েছে এ-শতকে, যেগুলো চলছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে। পুরোনো সমস্ত আইন নারীকে পীড়নের জন্যেই তৈরি করা হয়েছিলো, ওগুলোর লক্ষ্য ছিলো নারীকে মানুষের স্তরে উঠতে না দেয়া; আর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিধিবিধান যদিও নারীকে দিয়েছে প্রচুর স্বাধীনতা ও অধিকার, তবু নারী সেখানেও মানুষেব স্বাধীনতা ও অধিকার পায় নি। পুরুষের তৈরি আইনে পুরুষের সুবিধার শেষ নেই, পুরুষের সুবিধার সাম্রাজ্যে সূৰ্য কখনো অস্ত যায় না; আর নারীর অসুবিধার অমারাত্ৰিও কখনো কাটে না। পিতৃতন্ত্রের বিধিবিধানের খড়গের নিচে বেঁচে আছে চিরদণ্ডিত নারী।
নারীর প্রতিদিনের জীবন শৃঙ্খলিত যে-আইনের শেকলে, তা হচ্ছে ব্যবহারিক বা অধিকার বিধিগুলো [সিভিল ল], বিশেষ ক’রে বিবাহ ও পারিবারিক বিধিগুলো। এর কিছু প্রথা হিশেবে চলে এসেছে, কিছু বিধিবদ্ধ হয়েছে; তবে এগুলো নারীর জীবনকে পরিণত করেছে নরকে। অধিকার আইনেই বিধিবদ্ধ হয়ে আছে নারী কখন কীভাবে বিয়ে বসতে বা করতে পারবে, কীভাবে বিয়ে ভাঙতে পারবে না বা পারবে, সন্তানের ওপর তার অধিকার কতোটা, সে কী ধরনের সম্পত্তির মালিক হ’তে পারে না বা পারে, ওই সম্পত্তির ওপর তার কতোটা অধিকার থাকবে, কী কী শর্তে সে ব্যবসাবাণিজ্যে জড়িত হতে পারে, বিধবা অবস্থায় সে হতে পারে কতোটা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, বিয়ে ভেঙে গেলে সে কতোটা ধন দাবি করতে পারে প্রভৃতি। এর সব এলাকায়ই পুরোনো আইন নারীর জন্যে ভয়াবহ, তা সাধারণত নারীর কোনো অধিকার স্বীকার করে না, যদিও এখন নানা সংস্কার করা হচ্ছে। অধিকার আইনগুলো কোনো সুসংবদ্ধ সংহত বিধি নয়, এগুলো বিচিত্র বিভীষিকাজাগানো বিধির সমষ্টি। এগুলোর ভেতরে রয়েছে। নানা স্ববিরোধিতা; হয়তো সংবিধানে উচ্চকণ্ঠে নারীকে দেয়া হয়েছে। পুরুষের সমান অধিকার, কিন্তু বিয়ের আইনে চুপচাপ বিধিবদ্ধ হয়েছে যে স্ত্রী স্বামীর দাসী, বা নারীকে দেয়া হয় নি ভোটাধিকার, এমনকি নিজের ইচ্ছেমতো বাইরে বেরোনোর অধিকার। নারীর আইনগত অধিকার এখনো অনেক কম পুরুষের তুলনায়। ওই পুরোনো আইনগুলো বিভিন্ন ব্যাপারে পোষণ করে বিভিন্ন বিরোধী বিশ্বাস, কিন্তু এক ব্যাপারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গভীর ঐক্য, সেটা নারীপীড়নে; নারীপীড়নে সব বিধিই সমান নির্মম। কয়েক হাজার বছর ধরে এ-বিধিপুঞ্জ নারীকে যেভাবে পীড়ন করেছে, ক্রীতদাসদেরও ততোখানি পীড়ন করা হয় নি। ওই আইনে কেড়ে নেয়া হয়েছে নারীর সব মানবিক ও সামাজিক অধিকার, এমনকি নিজের শরীরের ওপর তার নিজের অধিকার। পুরুষতন্ত্রের খড়গের নিচে নারী যাপন করেছে রক্তাক্ত জীবন, কিন্তু তাকে হাহাকার করার আইনগত অধিকারও দেয়া হয় নি।
পিতৃতন্ত্রগুলোর মধ্যে মানুষ ও নারীর বিরুদ্ধে সৰ্বগ্রাসী ষড়যন্ত্রে সবচেয়ে নিপুণ হিন্দু পিতৃতন্ত্র। অন্যরা যা করেছে বলপ্রয়োগে, হিন্দু পিতৃতন্ত্র করেছে যেনো মন্ত্রপ্রয়োগে; নিষ্ঠুরতম শোষণপীড়নকেও তারা ব্ৰহ্মার বিধান ব’লে গ্রহণযোগ্য ক’রে তুলেছে। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে সমাজের অধিকাংশ মানুষই বলি; এবং নারী ওই খড়গের নৃশংসতম বলি। যে-সমস্ত বিধি দিয়ে কয়েক হাজার বছর ধ’রে হিন্দুনারীর জীবন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই প্রথাগত; ওই সমাজে ঋষির পর ঋষি জন্ম নিয়েছে, ব্ৰহ্মার সাথে আলাপ ক’রে এসে তারা বিধান লিখেছে, এবং সবাই মিলে নারীকে ক’রে তুলেছে পুরুষের শিকার। হিন্দু বিধানগুলো নারীপীড়নের স্বর্গীয় অনুমতিপত্র। হিন্দু আইনের প্রধান উৎস বেদ; হিন্দুরা যেমন পুরুষের তৈরি সমস্ত কিছুকেই ব্ৰহ্মার মুখনিসৃত ব’লে প্রচার করেছে, তেমনি আইনকেও ক’রে তুলেছে ঐশ্বরিক, চিরন্তন, শাশ্বত, অবিনাশী। হিন্দু আইনের প্রথম ও প্রধান প্রণেতা মনু। মনু দাবি করেছেন যে ব্ৰহ্মা প্রথম আইন প্রণয়ন ক’রে তাকে শেখায়, এবং তিনি সে-আইন শেখান মরীচি ও অন্য ন-জন ঋষিকে [দ্র মনুসংহিতা, ১১:৫৮]। বেদ, শ্রুতি, ভাষ্য, প্রথার সমষ্টি হচ্ছে হিন্দু আইন। হিন্দু আইনে নারীর কোনো মূল্য নেই, নারী অস্থাবর সম্পত্তিমাত্র; নারী কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, পারে না সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে। পিতৃতন্ত্র নারীকে অস্তিত্বহীন করার জন্যে যে-ফাঁদটি পেতেছে, এবং যাতে ঢুকতে বাধ্য করেছে, তার নাম বিবাহ। মনু [৯:২২] বলেছেন, ‘নদী যেমন সমুদ্রমিলনে লবণায়ু হয়, নারীও তেমন; যেমন পুরুষের সাথে বিবাহিত হয় তেমন গুণযুক্ত হয়।’ নারী নির্গুণ, আর পুরুষ গুণের মহাসাগর, যেখানে অস্তিত্ব হারিয়ে নারী ধন্য হয়। বিয়ে হচ্ছে নারীর অস্তিত্বলোপ; এ-বিষয়ে হিন্দু ও খ্রিস্টান একমত। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে নারীকে বিয়ের ফাঁদে আটকে রাখার সুপরিকল্পিত বিধি তৈরি করা হয়েছে। মনু [২:৬৭] বিধান দিয়েছেন :
বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ। ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিক্রিয়া৷
বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন,
পতিসেবা হচ্ছে গুরুগৃহবাস, এবং গৃহকর্মই
প্রভাত ও সন্ধ্যায় হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।
হিন্দু নারীর অধিকার নেই কোনো কিছুতে; মন্ত্রে নেই, শিক্ষায় নেই, ধর্মে নেই। ব্ৰাহ্মণ বালকের জীবনে উপনয়ন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, উপনয়ন তার সামনে বিদ্যা ও ধর্মের পথ খুলে দেয়; কিন্তু নারীর উপনয়নের অধিকার নেই, তাই নারী বেদপাঠ করতে পারে না, পুজোয় উৎসর্গ করতে পারে না। [ দ্র দ্বারকানাথ (১৯১৩, ৯৬-৯৭)]। বিয়েই তার জীবনকারাগার। বঙ্কিম ‘দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইন’ [লোকরহস্য, ১৮৭৪] নামে একটি কৌতুককর রচনা লিখেছিলেন, কিন্তু নারীর চোখে দেখলে রচনাটিকে মনে হয় বেদনাদায়ক; পুরুষের জন্যে যা কৌতুক, নারীর জন্যে তা মৃত্যু। ‘পূৰ্ব্বজন্মকৃত পাপের জন্য পুরুষের প্রায়শ্চিত্তবিশেষকে বিবাহ বলে’ সংজ্ঞাটিকে একটু বদলে পুরুষের জায়গায় ‘নারীর’ বসালেই সংজ্ঞাটি হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর সত্য। বঙ্কিম বলেছেন, ‘অধীন যে সচল অস্থাবর সম্পত্তি, তাহাকে স্বামী বলা যায়’ : উনিশশতকের ঋষির সংজ্ঞা কৌতুক; কিন্তু সনাতন ঋষিাদের সংজ্ঞায় স্ত্রী স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তিই। তা লোকরহস্য নয়, কয়েক হাজার বছরের মর্মান্তিক সত্য। নারী অসম্পূর্ণ মানুষ, যার শক্তি নেই নিজেকে রক্ষার। হিন্দু ঋষিরা ও বাইবেলের সন্তরা এ-বিষয়ে একমত; নারীকে তারা বিন্যস্ত করেছেন শিশু ও উন্মাদের শ্রেণীতে। মনুর [৯:৩] বিধানে নারী চিরস্বাধিকারহীন অসহায় শিশু:
পিতা রক্ষতি কৌমারে ভৰ্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিবে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।
নারীকে কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী
ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা কববে,
নারী কখনোই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়।
হিন্দুবিধানে বিয়ে বাধ্যতামূলক নারীর জন্যে, যে-প্রক্রিয়ায় নারীকে পরিণত করা হয় দাসীতে। কোনো নারী যদি অবিবাহিত থাকতে চায়, তবে হিন্দু পিতৃতন্ত্র তার ওপর চরম প্রতিশোধ নেয়; নারী ম’রেও বিয়ের শেকল থেকে মুক্তি পায় না।
মহাভারত-এ সুভরূ, ঋষি কুণির কন্যা, চিরকুমারী থাকে; মৃত্যুশয্যায় সে জানতে পারে যে সারাজীবন ধৰ্মপালন করেও সে স্বর্গে যেতে পারবে না, কেননা বিয়ের দ্বারা তার দেহ পবিত্র হয় নি। তাই অসহায় মুমূর্ষ কুমারীটি এক ঋষিকে বিয়েতে রাজি করিয়ে একরাত্রি তার সাথে কাটিয়ে স্বর্গে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। একটি সূত্রে রয়েছে কুমারী নারী মারা গেলেও তার লাশকে বিয়ে দিতে হবে, তারপরই হবে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া [দ্ৰ আলতেকার (১৯৫৯, ৩৩)]। পুরুষ দ্বারা দূষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী পরিশুদ্ধ হয় না। বিয়ে দিতেই হবে, মানুষ না হ’লে বস্তুর সঙ্গে; যেমন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রতিভাবান বিদ্রোহী তরুণী সরলা যখন কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আলোড়ন তৈরি হয়ে যায়। স্বামী ছাড়া কী ক’রে থাকতে পারে একটি নারী, যতোই মেধাবী হোক? মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পুরুষতন্ত্রের মহিমা রক্ষার জন্যে মেয়েটিকে বিয়ে দিতে চান একটি খাপখোলা তলোয়ারের সাথে। তলোয়ারের সাথে পুরুষের বা পুরুষাঙ্গের মিল খুবই স্পষ্ট। হিন্দু বিয়ের অর্থ হচ্ছে নারীটির জন্যে জন্মজন্মান্তর ধ’রে একটি পুরুষ, এবং পুরুষটির জন্যে জন্মজন্মান্তর ধ’রে বহু নারী। হিন্দুপুরাণে বহুপতির কথা আছে, নারীদের কামোত্তেজনার মুহূর্তে যাকেতাকে আহ্বান করে গর্ভবতী হওয়ার কথাও আছে, কিন্তু হিন্দু বিয়ে হচ্ছে স্বামীর অধীনে নারীর কঠোর দাসীত্ব। স্বামীব প্ৰভুত্ব নিশ্চিত করার জন্যে ঋষিরা শ্লোকের পর শ্লোক লিখে স্বামীকে উত্তীর্ণ করেছেন ঈশ্বরের পর্যায়ে। স্বামী শব্দটিই বোঝায় ঈশ্বর। মনু [৫:১৫২] বলেছেন : ‘বিয়েতে যে বাগদান করা হয়, তাতেই নারীর ওপর পতির স্বামিত্ব জন্মে; সুতরাং স্বামীর সেবা করা নারীর কর্তব্য।’ এক শ্লোক পরেই তিনি বিধান দিয়েছেন :
পতি সদাচারহীন, পরদাররত বা গুণহীন হ’লেও সাধ্বী স্ত্রী পতিকে দেবতার মতো পুজো করবে [৫:১৫৪]
স্ত্রীদের স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া কোনো ব্ৰত বা উপবাস নেই। শুধু স্বামীসেবার সাহায্যেই নারী স্বৰ্গে যাবে [৫:১৫৫]।
স্বামীকে ক’রে তোলা হয়েছে গৃহের দেবতা, তবে গৃহে কোনো দেবী নেই, রয়েছে দাসী; দাসী স্ত্রীটি। স্বামীগৃহে নারীকে দাসী ক’রে রাখার বিধান দিয়েছেন মনু [৯:৩] সুচিন্তিত বাক্যে : ‘স্বামী ও স্বজনগণ স্ত্রীলোকদের দিবারাত্রির মধ্যে কখনো স্বাধীনভাবে থাকতে দেবেন না; কাজে ব্যস্ত রেখে সব সময় তাদের নিজেদের বশে রাখবেন।‘ হিন্দুবিধানে স্বামী কখনো মারা যায় না, স্বৰ্গলোকে যায়; তাই তার স্বৰ্গযাত্রার পরও নারী আর কোনো পুরুষের কথা ভাবতে পারবে না। মনু বলেছেন : ‘পতির মৃত্যু হ’লে স্ত্রী পবিত্র পুষ্পফলমূল দিয়ে অল্পাহারে দেহ ক্ষয় করবে, তবু পরপুরুষের নাম করবে না।’ [৫:১৫৭]; এবং যদি পরপুরুষের নাম নেয়, তাহলে রয়েছে শাস্তি : ‘পরপুরুষ উপভোগের ফলে নারী ইহকালে নিন্দিত হয়, পরকালে শৃগালযোনিতে জন্ম নেয় ও নানা পাপরোগে আক্রান্ত হয়’ [৫:১৬৪]। নারীটি তো আর পরপুরুষের নাম নেবে না, কিন্তু পুরুষটি কী করবে? মনু [৫:১৬৮] নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজ বিধান দিয়েছেন : ‘ভাৰ্যার মৃত্যু হ’লে দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ ক’রে পুরুষ আবার বিয়ে ও অগ্ন্যাধ্যান করবে।‘ পুরুষ কখনো কামবিরহিত থাকবে না, থাকবে নারী।
হিন্দুবিধানে নারীর মূল্য নারী হিশেবে নেই, স্ত্রী হিশেবেও নেই। তবে নারী দরকারী, কেননা সে সম্ভোগের বস্তু—‘রতিরুত্তমা’; এবং দরকারী কেননা এ-জন্তুটি উত্তরাধিকারী প্রসব করে। মনু [৯:২৬] বলেছেন : ‘সন্তান উৎপাদনের জন্যে স্ত্রীরা বহুকল্যাণভাগিণী, গৃহের দীপ্তি ও পূজনীয়া।’ স্ত্রীর সমস্ত কৃতিত্ব হচ্ছে প্রজনন। তাদের কাজ পিতার উত্তরাধিকারী, এবং পুত নরক থেকে ত্রাণকারী, পুত্র জন্ম দেয়া; কন্যা জন্ম দেয়া অপরাধ। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে : ‘পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়াই নারীর প্রধান কর্তব্য’; মৈত্রায়নী সংহিতায় বলা হয়েছে: ‘নারীর প্রকৃষ্ট কর্তব্য হচ্ছে পুত্র উৎপাদন করা’ [দ্র সুকুমারী (১৯৮৯)]। কন্যা শুধু হিন্দুসমাজেই নয়, সব সমাজেই অবাঞ্ছিত; তবে হিন্দু পিতৃতন্ত্র কন্যাকে ভয় পেয়েছে ও অসহায় ক’রে রেখেছে সবচেয়ে বেশি। অথর্ববেদ-এ পুত্ৰলাভের ও কন্যানিরোধের মন্ত্র রয়েছে। কন্যানিরোধ না ক’রে কোনো উপায় ছিলো না; হিন্দু পিতৃতন্ত্র তার বিধিবিধানে নারীর জীবনকে এমন নারকীয় ক’রে তুলেছিলো যে কন্যা কামনাই ছিলো নিষ্ঠুরতা। মেয়েকে লেখাপড়া শেখানো যাবে না, বিয়ে দিতে হবে শৈশবে [তিরিশ বছরের পুরুষ বারো বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে; চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছর বয়সের কন্যাকে বিয়ে করবে, নইলে ধর্ম নষ্ট হয়: [মনুসংহিতা, ৯:৪], কিন্তু আন্তবর্ণ বিয়ে নিষিদ্ধ ব’লে বর পাওয়া যাবে না, সে কোনো কিছুর উত্তরাধিকারী হবে না, স্বামীর মৃত্যু হ’লে তাকে আর বিয়ে দেয়া যাবে না, তাকে তুলে দিতে হবে স্বামীর চিতায়, হিন্দু পিতৃতন্ত্রে এ হচ্ছে নারীর সম্পূর্ণ জীবনী।
হিন্দু পিতৃতন্ত্রে তিন প্রধান পিতা, স্বামী, ও প্রভু; তাদের বর্তমানে কেউ সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। মনু [৮:৪১৬] বলেছেন : ‘ভাৰ্যা, পুত্র, ও দাস শাস্ত্রানুসারে অধম, তাই তারা যে-ধন উপার্জন করবে, তাতে তাদের অধিকার থাকবে না; তারা যার, ওই ধন হবে তার।’ স্ত্রী, পুত্র, দাস হচ্ছে স্বামী, পিতা, প্রভুর সম্পত্তি; তাই তারা সম্পত্তির মালিক হ’তে পারে না মালিকের জীবনকালে; এবং স্ত্রী ও দাস মালিক হ’তে পারে না কখনোই। পুত্ৰই যখন পিতার বর্তমানে নিজেরই অর্জিত ধনের মালিক হ’তে পারে না, তখন কন্যার ধনে অধিকারের কথাই ওঠ না ব’লে শ্লোকে মনু কন্যার উল্লেখও করেন নি। কন্যা উল্লেখযোগ্যও নয়। সে কোনো ধন উপার্জন করতে পারতো না; তবে পিতা তাকে স্বামীর কাছে বিক্রি ক’রে ধন অর্জন করতে পারতো। কন্যা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য নয়, যদি পিতার কোনো পুত্র থাকে। আদিকালে কোনো ভাই না থাকলে বোন উত্তরাধিকারী হতে পারতো। পিতার সম্পত্তির। তবে ভাইহীন নারীটি পিতার সম্পত্তি পেয়ে যে সুখের সাগরে ভাসতো, তা নয়; ওই ধন অভিশাপ হিশেবে দেখা দিতো তার জীবনে, কেননা অধিকাংশ সময় ভাইহীন নারীর বিয়েই হতো না। অপুত্ৰক পিতা পুত্রের শোকে কন্যাটিকেই ঘোষণা করে যেতো পুত্র হিশেবে; এবং নিজের বংশ রক্ষার জন্যে এমন ব্যবস্থা ক’রে যেতো যে ওই মেয়েটির প্রথম পুত্ৰ চ’লে আসবে মাতামহের বাড়ি, রক্ষা করবে তাঁর বংশ। পুত্র ও স্বৰ্গ হারানোর ভয়ে পুরুষেরা অমন মেয়েকে বিয়ে করতেই রাজি হতো না। তবে পুত্র থাকুক বা না থাকুক। মনু, বশিষ্ঠ, গৌতম কন্যার উত্তরাধিকার একেবারেই স্বীকার করেন নি। যাজ্ঞবল্ক, বৃহস্পতি, নারদ কন্যার কিছুটা উত্তরাধিকার স্বীকার করেছেন। ভাই থাকলে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকারের কথাই ওঠে না, খ্রিপূ ৩০০ অব্দ থেকে হিন্দু আইনে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার কোনো অধিকার নেই। পিতার বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নারী যায় স্বামীগৃহে; এবং সেখানে সে পরিণত হয় আরেকজনের সম্পত্তিতে। স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি, তাই স্ত্রীর কোনো সম্পত্তির অধিকার নেই, সে কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। মৈত্রায়নী সংহিতায় বিধান দেয়া হয়েছে : ‘সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার থাকবে না’; বলা হয়েছে : ‘স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর কোনো অধিকার থাকবে না ; হিন্দু স্ত্রীর শোচনীয় পরিণতি হচ্ছে বিধবা, যার জীবনেরই অধিকার ছিলো না, তাই তার সম্পত্তিতে অধিকারের কথা ভাবাও হাস্যকর। খ্রি:পূ: ৩০০ অব্দ থেকে কন্যা ও বিধবা পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত। বেদ আর অধিকাংশ ধর্মসূত্র বিধবার উত্তরাধিকার অস্বীকার করেছে। বৌধায়ন বিধবার উত্তরাধিকার অস্বীকার করেছে; আপস্তম্ব সাত স্তরের উত্তরাধিকারী বের করেছেন, এমনকি রাজাকে এবং ছাত্রকে উত্তরাধিকারী করেছেন, কিন্তু বিধবাকে করেন নি [দ্র আলতেকার (১৯৫৯, ২৫০-২৭০)]। বিধবার উত্তরাধিকার হচ্ছে সহমরণ, স্বামীর চিতার আগুনে ছাই হওয়া, বা দুৰ্গত কলঙ্কিত জীবন।
বিধবা হিন্দু পিতৃতন্ত্রের দুঃস্বপ্ন, তার খড়গের শোচনীয়তম বলি। ঋষিরা বিধবার জীবনকে অস্বীকার করেছে, আর যখন সে বেঁচে থেকেছে তখন তাকে চূড়ান্ত অপমান করেছে। বিধবাকে সতী নাম দিয়ে দাহ করার ব্যবস্থা করেছে হিন্দুবিধি। জেসাসের জন্মের অনেক আগে থেকেই একটি-দুটি ক’রে হিন্দু বিধবা সহমরণে ও অনুমরণে গেছে, বা যেতে বাধ্য হয়েছে। ৭০০ খ্রিস্টাব্দে থেকে সতীদাহ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আঙ্গরা বলেছেন, বিধবার ধর্ম হচ্ছে সহমরণ; হারীত বলেছেন, সহমরণ বরণ ক’রে স্ত্রী স্বামীকে চরম পাপ থেকে উদ্ধার করতে পারে। সতীদাহবাদীদের পবিত্র যুক্তি রামমোহন রায় ‘সহমরণ বিষয় প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ’-এ (১৮১৮, ৩-৪) দিয়েছেন প্রবর্তকের মুখে :
স্বামী মরিলে পর যে স্ত্রী এ পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতী যে বশিষ্ঠের পত্নী তাঁহার সমান হইয়া স্বৰ্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোক গমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বৰ্গে বাস করে।….যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন করে সে মাতৃকুল পিতৃকুল এবং স্বামিকুল এই তিন কুলকে পবিত্র করে।…পতি যদি ব্ৰহ্মহত্যা করেন কিম্বা কৃতঘ্ন হয়েন কিম্বা মিত্রহত্যা করেন তথাপি ঐ পতিকে সৰ্ব্বপাপ হইতে মুক্ত করে ইহা অঙ্গিরা মুনি কহিয়াছেন।
সব বিধবা স্বামীর চিতায় ওঠে নি; কিন্তু এক সময় দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিলো সতীদাহের চিতা। এটা প্রথম ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। উত্তর ভারতে ও কাশ্মীরে, প্রধানত রাজপরিবারে। রানীরা, এমনকি উপপত্নীরা, দলেদলে রাজাদের চিতায় উঠে সতী হ’তে থাকে। উত্তর ভারতের রাজপুতদের মধ্যে সতীদাহের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো বর্ণাঢ্য মড়করূপে। মারওয়ারের রাজা অজিত সিংহের চিতায় (১৭২৪) উঠেছিলো ৬৪টি সতী, পানিতে ডুবে বুন্দির রাজা বুধ সিং মারা গেলে তার চিতায় ওঠে ৮৪টি, ১৬২০ অব্দে এক রাজপুত রাজা মারা গেলে তার চিতায় উঠেছিলো ৭০০ সতী। হুমায়ুন ও আকবর সতীদাহ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। বাঙলায়ও সতীদাহ ছিলো হিন্দুসমাজের স্বর্গীয় ও পার্থিব সুখের ব্যাপার। ১৮১৫-১৮২৮ সালের মধ্যে বাঙলায় ৩৭৮+৪৪২+৭০৭+৮৩৯+৬৫০+৫৯৮+৬৫৪+৫৮৩+৫৭৫+ ৫৭২+৬৩৯+৫১৮+৫১৭+৪৬৩=৮১৩৫ জন নারী সতী হয়। এ-সময়ে এতো সতী আর কোথাও হয় নি; বোম্বাই, মাদ্রাজ, এমনকি রক্ষণশীল বেনারসেও হয় নি। হিন্দুবিধি বিধবাকে সম্পত্তির অধিকার দেয় নি, আর নিয়তির পরিহাস হচ্ছে বাঙলায় একটি বিধিই বিধবাকে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে তাকে ঠেলে দেয় চিতার আগুনে। দায়ভাগ আইনে বাঙলায় নিঃসন্তান বিধবারাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো; তাই স্বজনেরা সম্পত্তির লোভে বিধবাদের ঠেলে দিতো স্বামীর চিতায়। সতীদাহের চিতার আগুনের রূপে কিন্তু মুগ্ধ ছিলেন কবিরা; কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’; এবং চল্লিশোত্তর বয়সে চিতার আগুনের শোভায় ভরে উঠেছিলো তার মন : ‘দাম্পত্যলীলার অবসানদিনে সংসারের কার্যক্ষেত্ৰ হইতে বিদায় লইয়া তেমনি সহজে বধূবেশে সীমান্তে মঙ্গলসিন্দূর পরিয়া পতির চিতায় আরোহণ করিয়াছ। মৃত্যুকে তুমি সুন্দর করিয়াছ, শুভ করিয়াছ, পবিত্র করিয়াছ; চিতাকে তুমি বিবাহশয্যার ন্যায় আনন্দময় কল্যাণময় করিয়াছ’ [বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ, ‘মা ভৈঃ’, ১৩০৯]। পিতৃতন্ত্রের খড়গের ক্ৰোধ থেকে নারীদের বাঁচানোর প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় উনিশ শতকে, যার সূচনাকারী রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩]। নারীদের মর্মান্তিক পরিণতি ছিলো বিধবা, তাই বিধবাকে বঁচিয়েই রামমোহন শুরু করেন নারীবাঁচানোর আন্দোলন। ১৮২৯ সালে বেন্টিংক সতীদাহ নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেন। সতীদাহ নিবারণে বেন্টিংক যে-ভূমিকা নেন, তার জন্যে হিন্দুবিধবার কৃতজ্ঞতা বেন্টিংকের বিশেষভাবেই প্ৰাপ্য।
রামমোহন ও বেন্টিংক হিন্দু বিধবাকে প্ৰাণ দিয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর [১৮২০–১৮৯১] দেয়ার চেষ্টা করেন জীবন। সব বিধবা সহমরণে যেতো না, তবে যারা বেঁচে থাকতো তারা বাঁচতো চরম লাঞ্ছনা, অপমান, কলঙ্কের মধ্যে। বিদ্যাসাগর বিধবাদের বিয়ে দেয়ার আন্দোলন শুরু করেন; অশ্লীল রক্ষণশীলেরা প্রথমে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে, পরে মেতে ওঠে বিধবার যোনির ক্ষতাক্ষত বিচারে; তবে ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়। বিদ্যাসাগর কিছু বিধবাকে বিয়েও দেন; তবু আজো হিন্দুসমাজ বিধবার বিয়ে মেনে নেয় নি। বিধবার বিয়ের কথা ভাবতে এখনো হিন্দুসমাজের রক্ত জমে বরফ হয়ে যায়; এমনকি নারীরাও বিধবা বিয়ের কথা শুনলে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম করে। সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কেননা প্রকাশ্য নৃশংসতা বন্ধ করা সহজ; বিধবার এখনো বিয়ে হয় না, কেননা গোপন নৃশংসতা বন্ধ করা কঠিন। বিধবাকে বোঝার মতো সংবেদনশীলতা বা মনুষ্যত্ব হিন্দুসমাজ আজো আয়ত্ত করে নি। অধিকাংশ হিন্দু বিধবার জীবনে দুৰ্গতির শেষ নেই; শ্বশুর বা পিতার পরিবারে তারা যাপন করে লাঞ্ছিত জীবন। তাদের যে-ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে পুরুষতন্ত্র, তা পতিতার; যেনো হিন্দু বিধবা কাম ক্ষুধার্তা নারী, যার দিবসরজনী কাটে নিরন্তর কামযন্ত্রণায়, পুরুষ পেলেই যে লিপ্ত হয় রতিক্রিয়ায়। বালবিধবাদের শারীরিক জ্বালার কথা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু তারা পুরুষখেকো ডাইনি নয়, পুরুষেরাই বিধবাখের দানব। কোনো পাড়ায় একটি তরুণী বিধবা থাকলে ওই এলাকার সব পুরুষের কাম তাকে ঘিরে জ্বলতে থাকে; এক সময় তা পোড়ায় বিধবাটিকে। বিদ্যাসাগর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’-এ (১৮৫৫) লিখেছিলেন :
বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা যাহাদের কন্যা, ভগিণী, পুত্ৰবধু প্রভৃতি অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কত শত বিধবারা, ব্ৰহ্মচৰ্যনিবাহে অসমর্থ হইয়া, ব্যভিচারদোষে দূষিত ও ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকুল, পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যভিচারদোষ ও ভ্রূণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিনিকুলের কলঙ্ক নিরাকরণ হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্ৰথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যয়ন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক।
বিদ্যাসাগর বিধবার বৈধব্যযন্ত্রণার, এবং তিনটি পাপের কথা বলেছেন : ব্ৰহ্মচৰ্যনির্বাহে অসামৰ্থ ব্যভিচারদোষ, ও ভ্ৰাণহত্যাপাপ। যন্ত্রণাটি সত্যিই বিধবার, কিন্তু পাপ তিনটি বিধবার নয়, নারীলোলুপ পুরুষের। পুরুষেরাই বিধবাদের পরিণত করে সহজ শিকারে। বিধবা মানেই সম্ভাব্য কলঙ্ক, এমন ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো সমাজে; সে যে একদিন কুলত্যাগিনী হবে, এ-বিষয়ে সমাজ ছিলো নিশ্চিত। প্রতিটি বিধবাকে বইতে হয় এমন কলঙ্কের বোঝা, যার জন্যে সে দায়ী নয়। বিধবা সম্পর্কে সমাজের এ-হীন ধারণার প্রতিবাদ করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নারীর মূল্য’-এ (১৯২৪)। বিদ্যাসাগরের বক্তব্য কিছুটা তরল ক’রে প্রচার করা হয়েছিলো যে বিধবাদের বিয়ে দেয়া হয় না ব’লে কুলত্যাগিনীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শরৎচন্দ্র প্রশ্ন করেছেন, ‘কথাটা প্রচার করিবার সময, বিশ্বাস বদ্ধমূল করিয়া লইবার সময়, একবারও সে মনে করিয়াছে কি, কি গভীর কলঙ্কের ছাপ সে নারীত্বের উপর বিনা দোষে ঢালিয়া দিতেছে?” বিধবারা কেনো কুলত্যাগ করে? শরৎচন্দ্ৰ দেখিয়েছেন কামজ্বলায় নয়, বাস্তব দুৰ্গতি সহ্য করতে না পেরেই তারা কুলত্যাগ করে :
ভদ্ৰ-ঘরেক বিধবার অবস্থা ঠিক নীচজাতীয়া সধবার অনুরূপ। তাহাকেও স্বাধীনভাবে কায়িক পরিশ্রম করিয়া জীবিকা অর্জন করিতে দেওয়া হয় না, কারণ তাহাতে পিতৃকুলের বা শ্বশুরকুলের মর্যাদা হানি হয়, অথচ বাড়ির মধ্যে ভদ্ৰ-বিধবার অবস্থা কাহারো অবিদিত নাই। শতকরা সত্তরজন হতভাগিনী অন্ন-বস্ত্রের অভাবে এবং আত্মীয়-স্বজনের অনাদর, উপেক্ষা, উৎপীড়নেই গৃহত্যাগ করে, কামের পীড়নে করে না।
ভারতের স্বাধীনতার পর হিন্দুতন্ত্রের খড়গ কিছুটা কোমল হয়েছে। ১৯৫৫ সালে গৃহীত হয় হিন্দুবিবাহ অ্যাক্ট, যাতে দুটি মৌলিক পরিবর্তন সম্পন্ন করা হয়। এতে পুরুষের একবিবাহ, নারীর তো চিরকালই ছিলো, বিধিবদ্ধ করা হয়, এবং বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত হয়। সম্পত্তিতে এখন কিছুটা অধিকার এসেছে হিন্দুনারীর : ১৯৫৬র ‘হিন্দু উত্তরাধিকার অ্যাক্ট’ ও ১৯৫৯এর ‘বিবাহিত নারীর সম্পত্তি (পরিবর্ধিত) অ্যাক্ট’ নারীকে কিছুটা অধিকার দিয়েছে সম্পত্তির [দ্র আলমেনাস-লিপোস্কি (১৯৭৫, ৪৫-৫২)]। তবু আজো হিন্দু নারী পুরোনো বিধিবিধানের শিকার, এখনো স্বামীর পায়ের নিচে তার স্বৰ্গ হিন্দুবিধি পৃথিবীর একটি বিশেষ খণ্ডে সীমাবদ্ধ; কিন্তু যে-দুটি আইনের জগতে সূর্য কখনো ডোবে না, সে-দুটি হচ্ছে ইংরেজি সাধারণ আইন, ও রোমান আইন, পরে যার নাম হয় ‘কোড নেপোলিয়ন’ বা ‘নেপোলিয়নি বিধি’। দুটি বিধিই নারীর জন্যে নৃশংস; দুটিরই প্রণেতা নারীবিদ্বেষীরা, যারা নারীকে দেখছে প্রচণ্ড ঘৃণার চোখে, এবং আইনের নামে বিধিবদ্ধ করেছে বিনাবিচারে চরম দণ্ড। এ-দুটি বিধির পেছনে হিংস্র পিতৃতান্ত্রিকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইবেল; প্রাণভরে শাস্তি দিয়েছে নারীকে। খ্রিস্টান সন্তরা নারীবিদ্বেষে হিন্দু ঋষিদেরও ছাড়িয়ে গেছেন; তাদের চোখে একটি নারী, মেরি, ছাড়া আর সব নারীই পাপিষ্ঠা; তাই তারা নারীদের জন্যে যে-সব বিধি রচনা করেছেন সেগুলো পাপিষ্ঠাদের জন্যে রচিত বিধি। ইহুদি ও খ্রিস্টান সন্তদের কাছে নারী হচ্ছে ‘শয়তানের খেলার মাঠ’, ‘বিষ্ঠার ছালা’; লুথার বলেছেন, নারী কখনো নিজের প্রভু নয়। ঈশ্বর তার দেহ তৈরি করেছে। পুরুষের জন্যে, সন্তান ধারণ ও লালনের জন্যে; নারীকে সন্তান বিয়োতে বিয়োতে মরতে দাও, এজন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে।’[দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৭৬, ৮০)]|
ইংরেজি সাধারণ আইন ও রোমান আইনে প্রকাশ পেয়েছে পিতৃতন্ত্রের এ-মনোভাবই; এ-দু-আইনেই নারী পুরুষের সম্পূর্ণ অধীন। নারীকে পুরুষের বাধ্যতামূলক ক্রীতদাসী করার একটি নিপুণ কৌশলের নাম হচ্ছে বিবাহ, যার কবলে পড়ে নারী হারায় তার অস্তিত্ব ও অধিকার। ইংরেজি সাধারণ আইনে স্ত্রীকে স্বামীর রক্ষণাবেক্ষণে থাকতে হ’লে পালন করতে হয় কতকগুলো শর্ত [কোভেরচার], যেগুলোর কাজ হচ্ছে নারীকে অস্তিত্বহীন করা। এ-শর্তের উৎস বাইবেলের একটি অনুশাসন : ‘মনুষ্য আপন পিতামাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, এবং তাহারা একাঙ্গ হইবে’ [আদিপুস্তক, ২.২৪] ; শুনতে সুখকর শোনালেও আইনে এর তাৎপর্য হচ্ছে স্ত্রীর ‘ব্যবহারিক মৃত্যু’। আইনের ভাষায় এ-অনুশাসন বোঝায় স্বামী-স্ত্রী এক ব্যক্তি; অর্থাৎ স্ত্রীর কোনো ভিন্ন সত্তা নেই। ধর্মের এক কথায় স্বামীর শরীরে বিলীন হয়ে গেছে স্ত্রীর সমগ্র অস্তিত্ব। বিচারক ব্ল্যাকস্টোন এর আইনগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন : ‘আইনে, বিয়ের ফলে, স্বামী ও স্ত্রী অভিন্ন ব্যক্তি : অর্থাৎ বিবাহিত অবস্থায় নারীর সত্তা বা আইনগত অস্তিত্ব বাতিল, বা অন্তত নারীর অস্তিত্ব স্বামীর অস্তিত্ত্বে গৃহীত ও সংহত’ [ দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৬৮)]; রিস বলেছেন, ‘আইনে নারী তার বিবাহিত পুরুষের সম্পত্তি; সে তার অস্থাবর মাল’; এলিজা কুক লিখেছেন, ‘স্বামী স্ত্রীর, স্ত্রীর সম্পত্তির, ও স্ত্রীর সন্তানের নিরঙ্কুশ প্রভু’ [দ্র বাস্ক (১৯৭৪, ১৭)]। হিন্দুবিধানেও স্ত্রীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় স্বামীর অস্তিত্বের মহাসমুদ্রে [মনুসংহিতা, ৯:২২]৷ স্বামী-স্ত্রীর একদেহে বিলীন হওয়া কাম ও কাব্যিকভাবে চমৎকার, কিন্তু আইনের দিকে ভয়াবহ। এতে স্বামীর শরীর বা অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না, বিলুপ্ত হয় নারীর শরীর ও অস্তিত্ব; এ-বিলুপ্তির মূল্য দিতে হয় নারীকে তার মাত্র একটি সামান্য জীবন দিয়ে। স্বামী হয় প্রভু, স্ত্রী ভূমিদাসী। বিয়ের অনুষ্ঠানেই বধুটিকে দীক্ষা দেয়া হয় সন্ত পলের অনুশাসনে : ঈশ্বরের প্রতি সে যেমন অনুগত থাকবে তেমনই অনুগত থাকবে স্বামীর প্রতি।
ইংরেজি সাধারণ আইনে স্ত্রীকে ফেলা হয় শিশু, নির্বোধ ও বদ্ধপাগলের দিলে, যে অক্ষম নিজের দায়িত্ব নিতে; যার নেই কোনো বিবেচনাশক্তি। অস্তিত্বলোপের অর্থ খুবই ভীতিকর; এতে স্বামীকে দেয়া হয় স্ত্রীর শরীরের সম্পূর্ণ মালিকানা, স্বামী ওই সম্পত্তি ভোগ করতে পারে যথেচ্ছভাবে। বেকন এ-মালিকানার মানে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ‘স্বামী পিটোতে পারে স্ত্রীকে, তবে খুব ভয়ঙ্কর বা নিষ্ঠুরভাবে নয়; দরকার মনে করলে স্বামী স্ত্রীকে আটকে রাখতে পারে, তবে সে স্ত্রীকে কারারুদ্ধ করে রাখতে পারে না।’ [দ্র বাঙ্ক (১৯৭৪, ১৭)]। অস্তিত্বলীনের মানে হচ্ছে স্বামী বা কারো বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার কোনো অধিকার তার নেই; সে কারো সাথে কোনো চুক্তি সম্পাদনের অধিকারী নয়; ঋণ আদায়ের জন্যে সে মামলা করতে পারে না; কারো বিরুদ্ধে সে পারে না মানহানির অভিযোগ আনতে, এবং তার বিরুদ্ধেও পারে না কেউ। অর্থাৎ বিয়েতে বাতিল হয়ে যায় তার নাগরিক অধিকার, আইনের চোখে সে নিরস্তিত্ব। তার হাতপা বাধা: তার অস্তিত্ব নেই, গৃহ নেই, সহায় নেই, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নেই। সে নিজেই তো নেই : বিয়ে হচ্ছে নারীর অস্তিত্বহীনতা–কিছুদিনও আগেও ইংরেজি সাধারণ আইনে বিয়ে ছিলো এতোই মধুর ও মর্মান্তিক। বিয়েতে নারীর অস্তিত্বলীনের ব্যাপারটি মোটেই আধ্যাত্মিক নয়, সম্পূৰ্ণ বৈষয়িক; ওই আইনে বিয়ের পর নারীর নিজের অধিকারে কিছুই থাকে না। সে নিজের মালিক নয়, সে নিজের আঁকাবাঁকা দেহখানির মালিক নয়, সে মালিক নয় কিছুরই। যে কোনো কিছুর মালিক হতে পারে না, তার আবার কিসের অস্তিত্বস্বাতন্ত্র্য? একই কারণে হিন্দুবিধানেও বারবার বলা হয়েছে ‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যামর্হত’ [মনুসংহিতা, ৯:৩]।
স্বামী-স্ত্রীর একাঙ্গ হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে বিয়ের পর স্ত্রীর সমস্ত সম্পত্তির, এমনকি তার নিজের, মালিক হয় স্বামী। এর বিনিময়ে স্বামী তার রক্ষণাবেক্ষণ করে, তার ভরণপোষণ করে। বিয়ের সময় নারীর যা-কিছু স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি থাকে, তা হয়ে ওঠে স্বামীর সম্পত্তি, আর স্ত্রী হয়। স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি! এমনকি বিয়ের পরও সে যা কিছুর মালিক হয়, তাও তার থাকে না, অবলীলায় হয়ে ওঠে। স্বামীর। স্বামীর এ-অধিকার শুধু বিবাহিত কালের নয়, ১৮৫৭র আগে বিবাহবিচ্ছেদের পরও স্বামী ভোগ করতো স্ত্রীর ওপর এ-অধিকার। ১৮৩৭-এর আগে সন্তানের ওপরও নারীর ছিলো না অধিকার, সব অধিকার ছিলো স্বামীর। আইন, পিতৃতান্ত্রিক রীতিতে, মাকে স্বীকারই করতো না; স্বীকার করতে শুধু পিতাকে। পিতার জীবনকালে মায়ের কোনো অধিকার ছিলো না; তার প্রাপ্য ছিলো। শুধু ‘সম্মান’, আর তখন একেই মনে করা হুতো নারীর গৌরব। পিতা সন্তানদের শাস্তি দিতে পারতো, মায়ের কাছে থেকে কেড়ে নিতে পারতো, নিজের রক্ষিতার কাছে রাখতে পারতো; এবং মাকে নিষিদ্ধ করে দিতে পারতো। কুমারী অবস্থায় তার বেশ কিছু অধিকার ছিলো, কিন্তু একাঙ্গ হওয়ার পর সে হারায় সব কিছু। ইংরেজি আইন ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিধি; তাই এ-আইন ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা পৃথিবীতে। এ-আইন কোনো কোনো দেশে নারীকে প্রথাগত নিষ্ঠুরতর আইনের কবল থেকে কিছুটা উদ্ধার করে, যেমন ভারতে; আবার কোনো কোনো দেশে এ-আইন নারীর বহুদিনের অধিকার হরণ করে, যেমন ব্ৰহ্মদেশে। ব্ৰহ্মদেশে স্বামীস্ত্রীকে পরস্পরের প্রতি পালন করতে হতো ‘পাঁচটি আনুগত্য’, কিন্তু এ-আইন স্বামীর আনুগত্য লোপ ক’রে স্ত্রীকে করে স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি ও দাসী।
রোমান আইনে ইংরেজি সাধারণ আইনের থেকে পিতৃতান্ত্রিক হিংস্ৰতা আরো প্রচণ্ড। ইংরেজি আইনে অবিবাহিত নারীদের কিছু অধিকার আছে, কিন্তু রোমান আইনে কোনো অধিকার নেই অবিবাহিতাদেরও। তাদের চিরকাল বাস করতে হয়, কোনো রোমান মনুর বিধানেই যেনো, কোনো পুরুষ অভিভাবকের অধীনে। রোমান আইন কোনো অবস্থায়ই নারীকে স্বাধীনতার যোগ্য মনে করে না। নেপোলিয়ন রোমান আইনকে মান-ও বিধি-বদ্ধ করে গ্রহণ করে তার সাম্রাজ্যের আইনরূপে। এর নতুন নাম হয় নেপোলিয়নি বিধি [কোড নেপোলিয়ন]। একনায়কের বিধিবদ্ধ আইনে চরমভাবে প্ৰকাশ পায় একনায়কের স্বৈরাচার। নেপোলিয়নের কাছে নারী এমন একটি রাজ্য, যাকে শুধু জয় করলেই চলবে না, তাকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত পর্যুদস্ত পদদলিত করতে হবে। তার বিধি নারীকে তাই করে; এ-বিধিতে নারী হয়ে ওঠে সবচেয়ে লণ্ডভণ্ড রাজ্য। নারী সম্পর্কে তার ধারণা খ্রিস্টান সন্তদেরই মতো। এ-একনায়ক বলেছে, ‘প্রকৃতি চেয়েছে যে নারী হবে আমাদের দাসী। তারা আমাদের সম্পত্তি, আমরা তাদের সম্পত্তি নই। ফলবান গাছের মালিক যেমন মালি, আমরাও তেমনি তাদের মালিক। নারীর সমানাধিকার দাবি নিছক পাগলামো! নারী সন্তান উৎপাদনের কল ছাড়া আর কিছু নয়’ [দ্র নিউল্যান্ড (১৯৭৯, ১৩)]। এ-বিধি পশ্চিম ইউরোপে ও ফরাশি উপনিবেশে চাপিয়ে দেয়া হয়, এবং হঠাৎ অনেক দেশে নারী নিজেকে দেখতে পায় গৃহদাসীরূপে। এ-আইনেও নারী শিশু আর নির্বোধদের শ্রেণীভুক্ত; তাই তারা কোনো চুক্তি করতে পারে না, স্বামীর স্বাক্ষর ছাড়া স্বাধীনভাবে আইনসম্মত লেনদেন করতে পারে না, বাকিতে কিছু কিনতে পারে না, ব্যাংকে একটি হিশেবেও খুলতে পারে না। এ-আইনে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির এবং জীবনের পরিচালক। স্ত্রী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় বা চাকুরি করতে চায, তাহলেও স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। এ-আইনে স্বামীর প্রতি আনুগত্য শুধু সামাজিক বা ধর্ময়ি নয়, তা আইনগত।
এখন উগ্রতম পিতৃতন্ত্র মুসলমান পিতৃতন্ত্র, এর বিকাশ ঘটেছে কম। ইসলাম কনিষ্ঠ ধর্ম, এটি যে-অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে সে-অঞ্চলের দুটি পুরোনো ধর্মের উত্তরাধিকার বহন করে অনেকখানি; এ-ধর্ম নারীকে দিয়েছে কিছু অধিকার, যা আগের পিতৃতন্ত্রগুলো দেয় নি। তবে মুসলমান দেশগুলোতেই নারী এখন সবচেযে শৃঙ্খলিত, কেননা অন্যান্য পিতৃতন্ত্রগুলোর বিবর্তন ঘটেছ, আর এটি বিবর্তন রোধ ক’রে চলছে। এখন অনেক দেশে এর অবলম্বনকারীদের সহনশীলতাও এতো কম যে এর সম্পর্কে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ কিছু লেখাও বিপজ্জনক। প্রচারের ফলে মুসলমানদের মধ্যে জন্মেছে এমন এক বদ্ধমূল ধারণা যে ইসলামপূর্ব আরবে নারীদের অবস্থা ছিলো শোচনীয়; ইসলাম উদ্ধার করে তাদের। প্রতিটি ব্যবস্থা পূর্ববতী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়; তবে তা ঐতিহাসিকভাবে সাধারণত সত্য হয় না। আরব নারীদের নানা ইতিহাস লেখা হয়েছে; সবগুলোতেই স্বীকার করা হয় যে ইসলামপূর্ব আরবে অনেক বেশি ছিলো নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার। তারা অবরোধে থাকতো না, অংশ নিতো সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে: এমনকি তাদের প্রাধান্য ছিলো সমাজে। শিশুকন্যা হত্যার জন্যে আরবরা খুব নিন্দিত ইতিহাসে, কিন্তু তারা সব শিশুকন্যা হত্যা করতো না, করলে জাতিটিই লুপ্ত হয়ে যেতো। শিশুকন্যা হত্যা একান্ত আরবি রীতি ছিলো না, পৃথিবীর নানাদেশে, যেমন ভারতেও, ছিলো। এ-ধর্ম শিশুকন্যাদের বঁচিয়েছে, তবে নারীদের মুক্ত সমাজ থেকে স্থানান্তরিত করেছে অবরোধে [দ্ৰ সোহা আবদেল কাদের (১৯৮৪, ১৪০)]।
কোরান-এ আছে :
হে নবীপত্নীগণ,… তোমাবা নিজেব গৃহে থাকবে; প্রাচীন যুগের মতো নিজেদেব প্রদর্শন ক’রে বেড়িও না [আহজাব : ৩২.৩৩]।
বোখারিতে [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ১৯৬)] আছে :
বিবি আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন : নারীগণ এখন যে ধরনের চালচলন এখতেয়ার করিয়াছে তাহা যদি রছুলুল্লাহ (ছঃ) দেখিতেন, তবে নিশ্চয় তাহাদিগকে মসজিদে যাইতে বাধা দিতেন।
এ থেকে বোঝা যায় ইসলামের আগে ও প্রথম পর্যায়ে নারীদের যে-অধিকার ও স্বাধীনতা ছিলো, তা পরে হরণ করা হয়। ফাতনা এ সাবাহ [ফাতিমা মেরনিস্সির ছদ্মনাম] নামক এক নারী ও মুসলমান ঐতিহাসিক মুসলমানের অবচেতনায় নারী (১৯৮৪) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইসলামে নারী হচ্ছে বিকলাঙ্গ প্ৰাণী’; তিনি আরো লিখেছেন, ‘যতোবারই আমি সেই ক্লান্তিকর ভণিতাটি শুনি যে সপ্তম শতাব্দী থেকে ইসলাম নারীকে দিয়েছে উচ্চ স্থান, ততোবারই আমি বিবমিষা বোধ করি’ [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৭৫)]। নারীকে ইসলাম কতোটা অধিকার দিয়েছে বা দিতে পারে, তা বোঝার জন্যে নারী সম্পর্কে ইসলামি ধারণার সাথে কিছুটা পরিচয় থাকা দরকার।
ইসলামি শাস্ত্ৰে নারী ও কাম সম্পর্কে ধারণার পরিচয় দিয়েছেন ফাতিমা মেরনিস্সি তাঁর ‘বোরখা পেরিয়ে’ (১৯৭৫) গ্রন্থে। তিনি দেখিয়েছেন, ইসলামে কামকে দেখা হয় এক আদিম শক্তিরূপে, যা শুভও নয় অশুভও নয়। তার শুভাশুভ নির্ভর করে ব্যবহারের ওপর। ইসলামে মনে করা হয় যে নারীপুরুষের মধ্যে নারীর কামই প্রচণ্ড, তাই তা দারুণ সামাজিক উদ্বেগের ব্যাপার। নারীর ওই কামকে যদি বশে রাখা না হয়, তবে তা সৃষ্টি করবে ফিৎনা বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা, যা নষ্ট করে দেবে সমাজকে। ইসলাম মনে করে নারীর পক্ষে নিজের কামকে বশে রাখা সম্ভব নয়, কেননা নারীর সে-চারিত্রিক শক্তি নেই; কিন্তু পুরুষের আছে, কেননা পুরুষ শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকভাবে নারীর থেকে উৎকৃষ্ট। তাই স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ পেয়েছে নারীর ওপর প্রভুত্বের ও নারীকে রক্ষার অধিকার। নারীকে যে বোরখায় মুড়ে বা অবরোধে আটকে রাখা হয়, তা সমাজকে নারীর অনিবার কামের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্যে [দ্র আমল রাসসম (১৯৮৪, ১২৯)]। পুরুষ সম্পর্কে উচ্চ ও নারী সম্পর্কে নিম্ন ধারণা ইসলাম পেয়েছে ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্য থেকে; এবং তাকে বদ্ধমূল ক’রে তুলেছে। পুরুষকে যে-চারিত্রিক শক্তির অধিকারী ব’লে মনে করা হয়, তা আসলে পুরুষের নেই; আর নারীর মধ্যে চারিত্রিক শক্তির যে-অভাব রয়েছে ব’লে মনে করা হয়, তাও ভুল। কামের বেলা তা অত্যন্ত স্পষ্ট : নারীর কামসংযমের পাশে পুরুষ কামইতর প্রাণী। ইসলামে নারী সম্পর্কে রয়েছে যে-অবিশ্বাস, তা বিশেষভাবেই আরববিশ্বাস; আরবরা সম্ভোগ্যপরায়ণ, তারা নারী থেকে নারীতে ছোটে, কিন্তু কলঙ্ক দেয় নারীদের। আরব্য রজনীর উপাখ্যানগুলোতে রয়েছে এর বিশ্বস্ত পরিচয় ; উপাখ্যানগুলোতে পুরুষেরা সম্ভোগে অক্লান্ত, কিন্তু অসতী অবিশ্বাসিনীর অপবাদ বইতে হয়েছে নারীদের। আরব্য রজনীর কবি পুরুষদের শিখিয়েছেন [দ্র ক্ষিতীশ (১৯৮২, ১০)] :
ওগো বন্ধু, বিশ্বাস করো না তাকে।
মুচকি হেসে উপেক্ষা কবো তার ভালোবাসার প্ৰতিজ্ঞা
দয়িতের জন্যে ছলাকলা,
আর প্রতারণা– কিছুই অসাধ্য নয় তার।
একান্ত নিবিষ্ট মনে যখন সে পশমের কারুকার্যে রত,
তখনো আচ্ছন্ন থাকে পরকীয়া প্রেমে
মনে রেখো সেই কথা– ইউসুফের,
কান পেতে শোনো সেই আদমের মর্মভেদী করুণ ক্ৰন্দন–
আজও শোনা যায়.
সব ধর্মেই নারী অশুভ, দূষিত, কামদানবী। নারীর কাজ নিষ্পাপ স্বর্গীয় পুরুষদের পাপবিদ্ধ করা; এবং সব ধর্মেই নারী অসম্পূর্ণ মানুষ। নারী কামকৃপ, তবে সব ধর্মই নির্দেশ দিয়েছে যে নারী নিজে কাম উপভোগ করবে না, রেখে দেবে পুরুষের জন্যে; সে নিজের রন্ধটিকে একটি অক্ষত টাটকা সতীচ্ছদে মুড়ে তুলে দেবে পুরুষের হাতে। পুরুষ সেটি ইচ্ছেমতো ভোগ করবে, নিজের জমি যেভাবে ইচ্ছে চাষবে। ইসলাম নারী সম্পর্কে এ-ধারণাই পোষণ করে। ইসলামে একজন নারী, সে যতোই অসাধারণ হোক, একজন পুরুষের, সে যতোই তুচ্ছ অপদাৰ্থ পাশবিক হোক, অর্ধেক। গাজালি বলেছেন, ‘হাওয়া নিষিদ্ধ ফল খেয়েছে ব’লে আল্লা তাকে আঠারো রকমের শাস্তি দিয়েছে।’ এর মাঝে রয়েছে ঋতুস্রাব, গর্ভ নিজের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্নতা, অচেনা পুরুষের সাথে বিয়ে ও তার বাড়িতে বন্দীজীবন কাটানো প্রভৃতি, এবং নারীকে দেয়া হয়েছে মেধার ১০০০ উপাদানের মধ্যে মাত্র একটি, আর পুরুষকে, সে যতোই দুশ্চরিত্র হোক, দেয়া হয়েছে বাকি ৯৯৯টি [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৬৯-৭০)]। ইসলামে পুরুষ নারীর থেকে তুলনাহীনভাবে শ্রেষ্ঠ, এবং নারী হচ্ছে কামসামগ্ৰী– পৃথিবী থেকে বেহেশত পৰ্যন্ত।
কোরান-এ আছে :
পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লা তাদের এককে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এজন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ ব্যয় করে।…স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন করো এবং তাদের প্রহার করো [সুরা নিসা : ৩৪]।
হাদিসে রয়েছে। [মিশকাত, দ্র। রফিক (১৯৭৯, ১৮১)] :
যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা কবতে।
পুরুষ ও নারী ইসলামে ব্যক্তি হিশেবে প্ৰভু ও দাসী। পুরুষের প্রতিনিধিরূপে প্রতিটি পরিবারে কাজ করে স্বামী, নারীর প্রতিনিধিরূপে স্ত্রী। নারী দাসী, তবে সম্ভোগের বস্তুও। সব রকম সম্ভোগের চূড়ান্তরূপ হচ্ছে নারীসম্ভোগ; এবং এ-ধর্মেও নারীকে নির্দেশ করা হয়েছে কামসামগ্ৰীৱৰূপে: পুরুষের কামকে পৃথিবী থেকে স্বর্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আর নারীর কামকে ক’রে দেয়া হয়েছে নিষিদ্ধ।
কোরান-এ আছে :
তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র, তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে প্রবেশ কবতে পারো [সুরা বাকারা : ২২৩] ;
হাদিসে আছে [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ১৮৭-২০০১); রফিক (১৯৭৯, ১৮১-১৮৩)] :
পুরুষের পক্ষে নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না।
সতর্ক হও নারী জাতি সম্পর্কে। কেননা বনি ইসাইলের প্রতি যে প্রথম বিপদ আসিয়াছিল তাহা নারীদের ভিতর দিয়াই আসিয়াছিল।
অকল্যাণ রহিয়াছে তিন জিনিসে নারী, বাসস্থান ও পশুতে।
নারী শয়তানের রূপে আসে আর শয়তানের রূপে যায়।
নারী হইল আওরত বা আবরণীয় জিনিস। যখন সে বাহির হয় শয়তান তাহাকে চোখ তুলিয়া দেখে। যখন কোনো রমণীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করে এবং সে অস্বীকার করে এবং তার জন্য তার স্বামী ক্ষোভে রাত কাটায়–সেই রমণীকে প্রভাত পৰ্যন্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ দেয়।
স্ত্রীগণকে সদুপদেশ দাও, কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তারা সৃষ্ট। পাজরের হাড়ের মধ্যে ওপরের হাড় সবচেয়ে বাঁকা–যদি ওকে সোজা করতে যাও তবে ও ভেঙে যাবে, যদি ছেড়ে দাও তবে আরো বাঁকা
হবে।
পুরুষ নারীর বাধ্য হলে ধ্বংসপ্ৰাপ্ত হয়।
এর সারকথা হচ্ছে নারী অবাধ্য, অশুভ, ও কামুক। তবে নারী তার কাম চরিতার্থ করতে পারবে না, পুরুষ নারীতে চরিতাৰ্থ করবে কাম। ইসলামে কামসামগ্ৰী নারীর চরম রূপ হূর বা স্বর্গের উর্বশী। পুরুষের কামকল্পনা চূড়ান্ত রূপ ধরেছে হূর-এ। বেহেশত সম্পূর্ণরূপে পুরুষের প্রমোদপল্লী; অধিকাংশ নারী জুলবে দোজখে [হাদিসে আছে : ‘দোজখ পরিদর্শনকালে আমি দোজখের দ্বারে দাঁড়ালাম এবং জানতে পারলাম যে দোজখীদের মধ্যে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ’ : হাদিস, দ্র বোখারী শরীফ, ২১৬], আর যাদের দেহ হচ্ছে পুরুষের আদিম কামকল্পনার প্রতিমূর্তি।
কোরান-এ আছে :
ওদের সঙ্গিনী দেবো আয়তলোচনা হূর [সুরা দুখান : ৫৪]।
সাবধানীদের জন্যে রয়েছে সাফল্য উদ্যান, দ্রাক্ষা, সমবয়স্কা উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী এবং পূর্ণ পানপত্র [সুরা নাবা : ৩১-৩8]।
সে সবের মাঝে রয়েছে বহু আনতনয়না যাদের এর আগে কোনো মানুষ বা জিন স্পর্শ করে নি। [সুরা রাহমান : ৫৬]।
আমি তাদের মিলন ঘটাবো আয়তলোচনা হূরের সঙ্গে [সুরা তূর : ২০]।
হাদিসে আছে [দ্র রফিক (১৯৭৯, ৩০১)] :
হরিণনয়না স্বৰ্গসুন্দরীগণ তাদের পত্নী হবে। তারা সবাই (৩৩/৩৪ বছরের পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত) সমবয়স্ক হবে।
যদি বেহেশতের কোনো নারী পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতো। তবে তার দেহভবা মৃগনাভির সৌরভো পৃথিবী ভরপুর হয়ে যেতো এবং তার সৌন্দর্যে সূর্য ও চন্দ্ৰ মলিন হতো।
গাজ্জালি নিজের সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ভারাতুর কল্পনা প্রয়োগ ক’রে দিয়েছেন এ-নারীদের রূপের ইন্দ্ৰিয়উত্তেজক, আধুনিক দৃষ্টিতে হাস্যকর, বর্ণনা [দ্র রফিক (১৯৭৯, ৩০২)] :
সেখানে অন্সরাসদৃশ পুণ্যময়ী নারীরা রয়েছে, আল্লাহ তাদের আলোকের দ্বাবা সৃষ্টি করেছেন, তারা যেন মরকত ও প্রবালের মতো। আনতনয়না সে-নারীরা তাদের স্বামী ব্যতীত আর কোরো প্ৰতি দৃষ্টিপাত করে না, জ্বিন ও মানবদের মধ্যে কেউই তাদের ইতিপূর্বে স্পর্শ কবে নি, তাদের স্বামীরা যখনই তাদের সাথে মিলিত হবে তখনই তাদেব কুমারী দেখতে পাবে ; তাদের শলায় থাকবে নানা রঙেব সত্তরটা ক’রে হার, কিন্তু সেগুলো তাদে্র শরীরে একটা কেশের মতোও ভারী মনে হবে না। যেমন কাচের গোলাসের লাল শরাব বাইরে থেকে দেখা যায় তেমনি তাদের অস্থি, মাংস, চর্ম, কণ্ঠনালীর মধ্য দিয়ে তাদের সর্বাঙ্গ দেখা যাবে। তাদের মাথায় চুল মুক্তা ও পদ্মরাগমণি দ্বা্রা সুশোভিত থাকবে।
বেহেশত পুরুষের বিলাসস্থল, সেখানে পার্থিব নারী বা স্ত্রীদের স্থান নেই। পৃথিবীতে তারা চুক্তিবদ্ধ দাসী, স্বর্গে অনুপস্থিত বা উপেক্ষিত। ইসলামি আইনে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এ-দৃষ্টিকোণ থেকেই।
শরিয়া আইনের উৎস কোরান ও সুন্নাহ, এ-আইনও ঐশী। তবে এতে প্রাকইসলাম আরবের নানা রীতির মধ্য থেকে বিশেষ কিছু রীতিকে বেছে নিয়ে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে ইসলামি রীতি বা আইনরূপে। প্রাকইসলাম আরবের সে-সমস্ত রীতিই গৃহীত হয়েছে ইসলামে, যা খর্ব করে নারীর অধিকার; যা আগের স্বাধীন নারীকে পরিণত করে পুরুষের দাসীতে। ইসলামি আইন বিবর্তনশীল নয়, তাই দেশেদেশে মুসলমান নারীর মৌলিক অধিকার চোদ্দো শো বছর আগে যা ছিলো, এখনো তাই আছে; তবে নানা দেশে নারীকে দেয়া হয়েছে এমন কিছু অধিকার, যা ইসলামসম্মত নয়। বাঙলাদেশি ও সৌদি নারীর মূল অধিকার একই, যদিও বাঙলাদেশি নারী সৌদি নারীর থেকে কিছুটা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে, ধর্মের বিধি অনুসারে যা তার প্রাপ্য নয়। এ-আইন নারীকে দিয়েছে কিছুটা সম্পত্তির অধিকার, যা অন্য কোনো সনাতন আইন দেয় নি; তবে এ-আইনে দুটি নারী একটি পুরুষের সমান, আর স্বামী হচ্ছে নারীর প্রভু। অনেক মুসলমান দেশে এখন সংবিধানে বলা হয় নারীপুরুষের অধিকার সমান, কিন্তু বিশেষ আইনে এসে দেখা যায় ওই সাম্য সংবিধানের সৌন্দৰ্য বাড়িয়েছে, কিন্তু নারীকে রাখা হয়েছে পুরুষের অধীনে। যেমন, কাতারের সংবিধানে (১৯৭০ : বিধি ৯) বলা হয়েছে ; ‘জাতি, লিঙ্গ বা ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক ভোগ করবে সমানাধিকার’; তবে কাতারে, ও আরো নানা মুসলমান রাষ্ট্রে, নারীর ভোটাধিকারই নেই। মরক্কোর সংবিধানে এক জায়গায় নারীদের আইনগত, রাজনীতিক, ও আর্থনীতিক সমানাধিকার দেয়া হয়েছে, কিন্তু একটু পরেই আরেক বিধিতে নারীকে ক’রে তোলা হয়েছে স্বামীর আইনসঙ্গত দাসী। এ-বিধিতে বলা হয়েছে : স্ত্রী বাধ্য ও বিশ্বস্ত থাকবে স্বামীর কাছে, স্বামীর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনদের সম্মান করবে, এবং স্ত্রী যদি নিজের বাপমাকেও দেখতে যেতে চায়, তখনো স্বামীর অনুমতি নিতে হবে [দ্র নিউল্যান্ড (১৯৭৯, ২৪)]। ইসলামি আইনে স্বামীর বাধ্য থাকা স্ত্রীর আইসঙ্গত দায়িত্ব। এ-আইন স্ত্রীকে কিছুটা আর্থ অধিকার দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছে বহু ব্যক্তিগত অসুবিধার শেকলে।
পিতৃতান্ত্রিক আইনে বিয়ে হচ্ছে নারীবলি, শরিয়ায়ও তাই। ইসলামে বিয়ে ঐশী ধর্মানুষ্ঠান নয়, বিয়ে একটি রাসকসহীন কর্কশ চুক্তি [দ্র এম হিদায়াতুল্লাহ (১৯০৬, ২৮২)]। এ-চুক্তি দুটি সমমানুষের মধ্যে নয়, অসম মানুষের মধ্যে; তাই ইসলামে বিয়ে এক অসম চুক্তি, যাতে পুরুষটি ভোগ করে চুক্তির সুবিধা আর নারীটি ভোগ করে পীড়ন। এ-আইনে স্ত্রী হয়ে ওঠে। চুক্তিবদ্ধ দাসী; সে নিজেকে চুক্তি ক’রে সমর্পণ করে একটি পুরুষের খেয়ালখুশির কাছে। বিয়ের চুক্তিকে এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৮) তুলনা করেছিলেন মালিক ও শ্রমিকের অসম চুক্তির সাথে। তিনি দেখান যে মালিক ও শ্রমিক যখন চুক্তি করে, তখন কাগজেকলমে মনে হয় যেনো তারা স্বেচ্ছামূলক চুক্তি করেছে; আইন এ-নিয়েই খুশি থাকে। মালিক পক্ষ যে বেশি শক্তিশালী, তার চাপ যে মারাত্মক, আইন মাথা ঘামায় না তা নিয়ে; যতোক্ষণ চুক্তি বলবৎ থাকে ততোক্ষণ মনে করা হয় যে তারা ভোগ করছে সমান অধিকার। বিয়ের চুক্তিও এমনি; আইন এটুকুতেই সন্তুষ্ট যে দু-পক্ষই সম্মতি জানিয়েছে। বাস্তব জীবনে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে আইনের উদ্বেগ নেই। ইসলামি আইনে বিয়ের চুক্তি মালিক-শ্রমিকের চুক্তির থেকেও ভয়াবহ ও শোষণমূলক, কেননা এখানে চুক্তি ক’রেই একজনকে দেয়া হয় অশেষ অধিকার এবং আরেকজনের প্রায় সমস্ত অধিকার বাতিল হয় কিছু সুযোগসুবিধার বিনিময়ে। ইসলামি আইনে স্ত্রী হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ দাসী, যে স্বামীকে দেবে যৌনতৃপ্তি ও বৈধ সন্তান, কিন্তু স্বামী যখন ইচ্ছে মনের খেয়ালে শুধু তিনবার ‘তালাক’ বলে ছেড়ে দিতে পারবে তাকে। চুক্তির কথা বলা হলেও ইসলামি বিয়েতে পুরুষ ও নারীটি চুক্তিতে আসে না, চুক্তিতে আসে পুরুষ ও নারীর অভিভাবক। বিয়েতে নারীর সম্মতির কথাও বলা হয়, কিন্তু তা সম্মতির অভিনয়। ইসলামি বিয়ের চুক্তির ব্যাখ্যা আনোয়ার আহমদ কাদারির বই থেকে, কিম্ভূত বাঙলায়, অনুবাদ করেছেন এক ভাষ্যকার। তাঁর অনুবাদ : ‘ইহা এমন এক চুক্তি যাহার দ্বারা একজন পুরুষ কর্তৃক একজন নারীকে সম্ভোগের অধিকার দ্বারা দখল করা বুঝায়’ [দ্র মোঃ মজিবর (১৯৮৯, ৫৩)]। ইসলামি বিবাহ চুক্তির নৃশংসতা স্পষ্ট ধরা পড়েছে উৎকট বাঙলায় অনুদিত ভাষ্যটিতে। বিয়েতে একটি পুরুষ ‘দখল করে’ একটি নারীকে; দখল করে ‘সম্ভোগের অধিকার দ্বারা’! ‘সম্ভোগ’ ও ‘দখল’ দুটিই নৃশংস প্রভুর কাজ। এ-চুক্তির অনন্ত সুফল উপভোগ করে পুরুষ, নারী হয় শিকার। ‘ক্রীতদাসীও এমনভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেকে সমর্পণ করে না প্রভুর কাছে যেভাবে করে মুসলমান স্ত্রী। ইসলামে বিয়ে যেহেতু চুক্তি, তাই তা চিরস্থায়ী নয়; যে-কোনো সময় স্বামী তা বাতিল করতে পারে। তবে এতেও পুরুষ সুখ পায় নি, তারা নিয়েছে একেবারে অস্থায়ী চুক্তির সুবিধাও, যা দেখা যায় শিয়া সম্প্রদায়ের ‘মুতা’ বিয়েতে। মুতা বিয়ে হচ্ছে এক বিশেষ সময়ের জন্যে, একদিনের বা একরাতের জন্যেও হ’তে পারে, বিয়ে বা যৌনচুক্তি। এ-বিয়ের চুক্তিতে নারী হয়ে ওঠে শুধুই উপভোগ্য মাংস।
ইসলাম নারীকে কিছু আর্থ সুবিধা দেয়, যা অন্য কোনো ধর্ম দেয় না। বিয়ের চুক্তির ফলে স্ত্রী স্বামীর কাছে থেকে পায় দেনমোহর ; কিছু টাকা বা সম্পত্তির লিখিত প্রতিশ্রুতি। ওই দেনমোহর শুধু কাবিনে লেখা থাকে, স্ত্রী তা সাধারণত পায় না, এমনকি বিচ্ছেদ হ’লেও দেনমোহর সাধারণত আদায় করতে পারে না। দেনমোহর পরিমাণে হয় খুবই কম ; হানাফি আইনে কমপক্ষে ১০ দিরহাম, মালিকি আইনে কমপক্ষে ৩ দিরহাম, আর হাদিস অনুসারে কমপক্ষে ১টি লোহার আংটি! বিয়ে স্ত্রীকে খোরপোষের অধিকার দেয়; স্ত্রীটির ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর। ভরণপোষণের অধিকারের জন্যে স্ত্রীকে থাকতে হবে স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত, মেনে চলতে হবে স্বামীর নির্দেশ। স্বামী যেখানে থাকবে বা যেখানে থাকার জন্যে স্ত্রীকে নির্দেশ দেবে, সেখানেই থাকতে হবে স্ত্রীকে; স্ত্রী তা অমান্য করলে ভরণপোষণের অধিকারী হবে না। ইসলামে কন্যা পিতার সম্পত্তির ও স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে; কিন্তু তাদের অংশ খুবই কম। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার উত্তরাধিকার রয়েছে। পিতা যদি শুধুই একটি কন্যা রেখে মারা যায়, তবে সে পায় পিতার সম্পত্তির ১/২; আর ভাই থাকলে বোনের অংশ ভাইয়ের অংশের ১/২। স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির কতোটা পায়? সামান্য। স্বামী কিন্তু পায় স্ত্রীর সম্পত্তির একটি বড়ো অংশ। স্ত্রী কোনো সন্তান না রেখে মারা গেলে স্বামী তার সম্পত্তির ১/২ পায়, কিন্তু স্বামী কোনো সন্তান না রেখে মারা গেলে স্ত্রী পায় স্বামীর সম্পত্তির ১/২; আর সন্তান রেখে গেলে পায় স্বামীর সম্পত্তির ১/৮। তাই কন্যা বা স্ত্রী অর্থাৎ নারী আর্থিকভাবেও প্রতারিত, যদিও অর্থের প্রয়োজন তারই বেশি।
শরিয়া নারীকে কিছু আর্থ ও সম্পত্তির অধিকার দিয়ে কেড়ে নিয়েছে তার অন্যান্য অধিকার। মুসলমান পুরুষ বিয়ে করতে পারে ঐশীগ্রন্থে বিশ্বাসী যে-কোনো ধর্মের নারী; অগ্নি বা মূর্তিপূজারিণীও বিয়ে করতে পারে, কিন্তু মুসলমান নারী অমুসলমান বিয়ে করার অধিকারী নয়। তবে শরিয়া আইনে নারীর প্রধান সংকট হচ্ছে স্বামীর বহুবিবাহের ও স্বেচ্ছাচারী তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার। তালাক মুসলমান নারীর জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর শব্দ, ওই বজ্র যে-কোনো সময় নীলাকাশ থেকে তার মাথায় এসে ফাটতে পারে। মুসলমান পুরুষ চারটি বৈধ বিয়ে করতে পারে, পঞ্চম একটিও করতে পারে। পঞ্চম বিয়ে করলে বিয়েটি বাতিল হয় না, শুধু তার দরকার পড়ে আগের একটি স্ত্রীকে এক-দুই-তিন ক’রে তালাক দেয়া। মুসলমান পুরুষের জন্যে তার চারটি স্ত্রী সম্ভোগই শুধু বৈধ নয়, সে তার ক্রীতদাসীদের সাথেও সঙ্গম করার অধিকারী। মোহাম্মদ ইবনে সাদ এল তবকত এল কোবরা-য় (১৯৭০) ক্রীতদাসী সম্ভোগের একটি আকর্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করেছেন [দ্র নওঅল (১৯৮০, ১৯৭)]।
কোরান-এ আছে :
বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদের তোমাদের ভালো লাগে, দুই তিন, অথবা চার, আর যদি আশংকা করো যে সুবিচার করতে পারবে ন তবে একজনকে, অথবা তোমাদের অধিকাবভুক্ত দাসীকে [সুরা নিসা : ৩]।
হাদিসে আছে [দ্ৰ নুর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ২৪৬)] :
হজরত জাবের (রাঃ) বলেন : এক ব্যক্তি রজুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু অলাইহে ওয়া ছাল্লাম-এর নিকট আসিয়া বলিল : হুজুর, আমার একটি দাসী আছে; সে আমাদের খেদমত কবে। আমি তাহাকে উপভোগ করি অথচ তাহার গর্ভধারণ করাকে আমি পছন্দ করি না। হুজুর বলিলেন : ইচ্ছা থাকিলে ‘আজল’ করিতে পার।
হজরত আবু ছায়ীদ খুদরী (রাঃ) বলেন : আমরা রাজুলুল্লাহর (ছঃ) সাথে বনি মুস্তালিক যুদ্ধে বাহির হইলাম এবং তথায় আমরা বহু যুদ্ধবন্দী লাভ করিলাম। এ সময় আমাদের নারী সঙ্গমেব আকাঙ্খা জাগিল এবং নারীবিহীন থাকা আমাদের পক্ষে কষ্টকর হইয়া পড়িল কিন্তু আমরা (যুদ্ধবন্দিনীদের সাথে) ‘আজল’ করাকেই পছন্দ করিলাম;…আমরা তাঁহাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন : না করিলেও তোমাদের কোনো ক্ষতি হইবে না।
শরিয়া আইনে প্রতিটি নারীর ভাগে পড়ে একচতুর্থাংশ স্বামী, যদিও এ-ধর্মের বিশ্বাস হচ্ছে যে নারীর কাম অত্যন্ত প্ৰবল। মিলেট (১৯৬৯, ১১৯) হিশেবে ক’রে দেখিয়েছেন এক স্বামীর চারটি স্ত্রী থাকলে স্বামী ও প্রতিটি স্ত্রীর সঙ্গমসুযোগের অনুপাত হয় ১:১৬, প্রতিটি নারী যেখানে পায় তার স্বামীর যৌনপ্রতিভার সিকিভাগ, সেখানে স্বামীটি ভোগ করে চারটি স্ত্রীর প্রবল কাম। তবু আরবি চেতনায় নারী হচ্ছে ফিৎনা, যার কাম এলোমেলো ক’রে দিতে পারে সমাজ। বলা হয় চারটি বিয়ে সে-পুরুষই করার অধিকারী, যে সমান আচরণ করতে পারবে স্ত্রীদের সাথে। সমান আচরণ নারীকে সম্মানিত করে না, শুধু জানিয়ে দেয় তারা পুরুষের সম্ভোগের সামগ্ৰী। ওই সাম্য চুক্তিবদ্ধ দাসীদের বা শয্যাসঙ্গিনীদের মধ্যে মৌখিক বা চুক্তির সাম্য; কিন্তু কামে আর আবেগে সাম্য কখনোই সম্ভব নয়।
শরিয়ায় বিয়ে হচ্ছে পুরুষাধিপত্যের চুক্তি; পুরুষ ওই চুক্তি রদ করতে পারে স্বেচ্ছাচারিতার সাথে। ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক গেলাশ থেকে জল ঢালার থেকেও সহজ–স্বামীর জন্যে; আর স্ত্রীর জন্যে ফাঁসির রজ্জু খোলার মতোই কঠিন। অধিকাংশ মুসলমান রাষ্ট্রেই নারী জীবন কাটায় তালাকের খড়গের নিচে, যে-কোনো সময় ওই খড়গ নেমে আসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে তালাক সাধারণ ঘটনা, সেখানে সম্পদশালীরা নিয়মিতভাবে তরুণী স্ত্রী গ্ৰহণ ক’রে বেহেশতের কিছুটা স্বাদ পেতে চায় ব’লে ব্যবহৃতাদের বাতিল না করলে চলে না। মুসলমানের এক সাথে চারটি স্ত্রী রাখার অধিকার রয়েছে, তবে তাতেও তার ক্ষুধা মিটতে নাও পারে; এবং সাধারণত মেটে না। ইসলামে স্বামীর পক্ষে তালাক দেয়া এতো সহজ ও সুবিধাজনক যে ওই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তার পক্ষে একই সাথে অসংখ্য স্ত্রী রাখা সম্ভব; এবং আরব অঞ্চলে ধনীরা এ-সুবিধা নিয়ে থাকে। আরব অঞ্চলে ‘ইদ্দা’ নামক একটি বিধান রয়েছে। ওই বিধান অনুসারে স্বামী তিন মাসের জন্যে স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে; এবং তারপর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। এ-সময়ে স্বামীটি আরেকটি বিয়ে করতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে স্বামীটি ঘরে চারটি স্ত্রী রাখতে পারে, এবং আরো চারটি রাখতে পারে ‘ইদ্দা’ তালাকে বেঁধে। অর্থাৎ এ-সময়ে তার থাকে চারটি সক্রিয় স্ত্রী, আর চারটি ছুটিভোগরত স্ত্রী। এভাবে সে চারটিকে ঘরে ও চারটিকে তালাক-ছুটিতে রেখে সম্ভোগ করতে পারে অসংখ্য নারী। এ হচ্ছে ইসলামে নারীর মর্যাদা [দ্র নওঅল (১৯৮০, ২০৬)]। মুসলমান স্বামী কোনো কারণ না দেখিয়েই যে-কোনো সময় শুধু তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণ ক’রে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে পারে; তবে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। স্ত্রীর তালাক দেয়ার সহজাত স্বাধীন অধিকার নেই। তবে স্ত্রীও স্বামীকে তালাক দিতে পারে, যদি বিয়ের কর্কশ। কবিনে স্বামী তাকে সে-অধিকার দিয়ে থাকে! তালাক দেয়ার প্রভু হচ্ছে পুরুষ, সে কোনো কারণ না দেখিয়ে একের পর এক স্ত্রী তালাক দিতে পারে; আর নারীকে ওই অধিকার পেতে হয় প্রভুরই কাছে থেকে। স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিলে দেনমোহরটুকুও সে পায় না, আর স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে স্ত্রী শুধু দেনমোহর ছাড়া স্বামীর সম্পত্তির একরাত্তিও পায় না, দেনমোহর আদায় করাই হয়ে ওঠে কঠিন কাজ। বাঙলাদেশে বহুবিবাহ ও তালাকরীতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (১৯৬১) গৃহীত হওয়ার পর। তবে এ-আইনও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে নি, শুধু সামান্য নিয়ন্ত্রণের, এবং তালাকে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা হ্রাসের চেষ্টা করেছে। নারী এখনো হয়ে আছে শরিয়ার শিকার।
নারীর শত্রুমিত্ৰ: রুশো, রাসকিন, রবীন্দ্রনাথ, এবং জন স্টুয়ার্ট মিল
পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা; তৈরি করেছে ধর্ম, দর্শন, আইন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা; এবং পৃথিবী ভ’রে জন্ম দিয়েছে তার প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ প্রতিভাদের। ওই প্রতিভারা মনীষী, মানুষপ্ৰজাতির গৌরব; অমর তাঁরা। তাঁদের স্তবে মুখর মানুষ; পুরুষেরা মুখর, পুরুষের কাছে শুনে শিখে নারীরাও মুখর। পুরুষ নারীদের এমনভাবে ছাঁচে ফেলে নিজেদের উপযুক্ত ক’রে নিয়েছে যে নারীরা স্তব করে নিজেদের শত্ৰুদেরও। পুরুষ প্রতিভারা বিকাশ ঘটিয়েছেন সভ্যতার, মানুষপ্ৰজাতির অনন্ত সম্ভাবনার প্রতিমূর্তি তারা; তাদের ছাড়া মানুষের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস অন্ধকার। মহাকালের আলোকশিখা তারা; বাল্মীকি, ব্যাস, হোমার, সফোক্লিস, প্লাতো, আরিস্তাতল, দান্তে, শেক্সপিয়র, কনফুসিয়াস, রুশো, রবীন্দ্রনাথের মতো অজস্র শিখায় উজ্জ্বল সৌরলোক। ওই শিখার পুরুষের শিখা, ওই প্রতিভার পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি, ওই মনীষীরা সবাই পুরুষতন্ত্রের পুরোহিত। তারা, প্রায়-সবাই, মানুষ বলতে বুঝেছেন নিজেদের লিঙ্গকে অর্থাৎ পুরুষকে; নারীকে মনে করেছেন। শুধুই নারী, মানুষ নয় বা বিকলাঙ্গ মানুষ। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে জন্মেছেন যতো মহাপুরুষ, তারা সবাই মগজ চূৰ্ণবিচূর্ণ ক’রে ভেবেছেন পুরুষের বিকাশ, প্রতিষ্ঠা ও মহিমার কথা, নারীকে করেছেন উপেক্ষা; আর যখন নারীর কথা ভেবেছেন, তখন তাৰে- দেখেছেন অবিকশিত মানুষরূপে, যার কোনো স্বায়ত্ত্বশাসিত অস্তিত্ব নেই। তাঁদের কাছে নারী হচ্ছে পুরুষের পাদটীকা। তাঁরা রচনা করে গেছেন বহু বাণী, ওই বাণী পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছে এবং পেছনের দিকে টেনে ধরেছে; তাদের উদঘাটিত অনেক সত্য আলো দিয়েছে, আবার তাদের অজস্র মিথ্যা অন্ধকার ক’রে রেখেছে মানুষের চারপাশ। ওই অন্ধকার কেটে নতুন আলো সৃষ্টি করতে লাগছে দীর্ঘ সময়, ওই অন্ধকার রখনো কাটে নি। নারী সম্পর্কে তারা ছড়িয়েছেন অন্ধকার, রচনা করেছেন অভিনব অনন্ত কুসংস্কার; আর পুরুষতন্ত্র তাদের অন্ধকার ও কুসংস্কারে ঢেকে রেখেছে নারীকে। প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রের মনীষীদের নারীবিষয়ক সমস্ত সিদ্ধান্ত ভুল ও প্রতিক্রিয়াশীল, এবং নারীদের জন্যে অশেষ ক্ষতিকর। নারীদের সম্পর্কে পুরুষরা বইয়ের পর বই লেখে, বিধানের পর বিধান দেয়। ভার্জিনিয়া উলফ (১৯২৯, ৪০-৪১) নারীদের সম্বোধন ক’রে বলেছেন :
‘আপনাদের কি ধারণা আছে প্ৰত্যেক বছর নারীদের নিয়ে কতো বই লেখা হয়? আপনাদের কোনো ধারণা আছে তার কতোগুলো পুরুষের লেখা? আপনারা কি অবগত যে আপনারা, সম্ভবত, মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্ৰাণী?… নারী আকর্ষণ ক’রে সাধারণ প্রাবন্ধিকদের, লঘু ঔপন্যাসিকদের, এমএ ডিগ্রিপ্রাপ্ত তরুণদের; এবং সে-সব পুরুষদের যাদের কোনো ডিগ্রি নেই; যাদের একমাত্ৰ যোগ্যতা হচ্ছে তারা নারী নয়।‘
পুরুষতন্ত্রের প্রতিভাদের চোখে পুরুষ সূর্য ওই পুরুষ-সৌরলোকে নারী তুচ্ছ অবজ্ঞেয় গ্রহের মতো, যে জীবন পেয়েছে পুরুষসূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ার জন্যে। তারা কখনো মুখর হয়েছেন নারীনিন্দায়, নারীর মুখে মেখে দিয়েছেন সবচেয়ে কালো কলঙ্ক, এমন কোনো অপবিশেষণ নেই যাতে তারা নারীকে তিরষ্কার করেন নি। তারা তৈরি করেছেন নারীকে বেঁধে রাখার শক্ত শেকল; আর যারা একটু নারী ও আবেগকাতর, নৃশংস হ’তে যারা কুষ্ঠা বোধ করেছেন, তাঁরা নারীকে পরিণত করেছেন। পোষা আদুরে বেড়ালে। তাঁদের কাছে নারী বিশেষ উপযোগী প্ৰাণী, যাকে সম্ভোগ করা যায়, যে সন্তান জন্ম দিয়ে টিকিয়ে রাখে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে; এ ছাড়া নারীর আর কোনো উপযোগিতা নেই তাদের কাছে। নারী যে মানুষ, পুরুষের মতোই মানুষ বা পুরুষ তারই মতো মানুষ, পুরুষের মতোই যে নারী সম্ভাবনাময়, এটা মনে হয় নি তাদের : নারীকে তাঁরা ক’রে রাখতে চেয়েছেন। পুরুষের দাসী, ভোগ্যপণ্য, তৃষ্ণার শান্তি। এ-লক্ষ্য থেকে তারা যা-কিছু লিখেছেন, সে-সবকে বলা হয় দর্শন, কাব্য, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা! ওই প্ৰতিভারা সবাই নারীর শত্ৰু, কেউ হিংস্রভাবে, মনোরমভাবে কেউ কেউ নারীর দিকে পাথর ছুঁড়েছেন, কেউ আলিঙ্গন করতে গিয়ে পিশে মেরেছেন নারীকে। নারীর শক্রতে ভ’রে আছে সময় ও সভ্যতা; নারীর মিত্র বেশি নেই, উনিশ শতকের আগে মিত্ররা দেখা দেন নি। পুরুষতন্ত্রের প্রতিভারা নারীদের বিরুদ্ধে ও বশে রাখার জন্যে লিখেছেন হাজারহাজার পৃষ্ঠা, খণ্ডখণ্ড রচনাবলি, পেয়েছেন অমরতা; তারা নারী সম্পর্কে সৃষ্টি করেছেন সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত ধারণা, যদিও ওগুলোকে পরম সত্য বলে পুজো করা হয়েছে শতকের পর শতক। এখনো করা হয়। তাদের সবার মত বিচার করা অসম্ভব ও নিরর্থক; খুব পুরোনো মনীষীদেব মতও বিচার করার দরকার নেই। আধুনিক সময়ের পুরুষতন্ত্রের প্রতিভাদের কয়েকজনের মত বিচার করলেই আধুনিক পিতৃতন্ত্রের নারীদর্শনের রূপটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। আমি বেছে নিচ্ছি চারজনকে : রুশো। [১৭১২-১৭৭৮], রাসকিন (১৮১৯-১৯০০), রবীন্দ্ৰনাথ (১৮৬১–১৯৪১), যারা পড়েন নারীদের শক্রগোত্রে; এবং মিলকে (১৮০৬—১৮৭৩), যিনি নারীদের মহান মিত্ৰ।
এ-চারজনকে অকারণে নিচ্ছি না, নিচ্ছি বিশেষ কারণে। মানবমুক্তি ও সাম্যের রোম্যানটিক দার্শনিক জ্যাঁ-জাক রুশোর প্রভাব পড়েছে পৃথিবী জুড়ে, তার চোখেই তথাকথিত আলোকপ্ৰাপ্তরা নারীর মুখ দেখছে দু-শো বছর ধরে। রুশো সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে অধিকাংশের:- যেহেতু তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি, তাই অনেকেরই ধারণা যে তিনি চেয়েছিলেন নারীরাও মুক্তি, কেননা নারী মানুষেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিস্ময়কর ও শোকাবহ সত্য হচ্ছে যে মানুষের সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক চেয়েছিলেন পুরুষের সাম্যমুক্তি। নারীকে তিনি প্ৰবল উৎসাহে ধার্মিকের মতো বলি দিয়েছিলেন পুরুষের যুপকাঠে। নারীর বেলায় রুশো পাড় প্রতিক্রিয়াশীল, নারীর তিনি অদ্বিতীয় শত্ৰু। জন রাসকিন ছিলেন ভিক্টোরীয় কপট নৈতিকতার এক বড়ো প্ৰবক্তা; নারীকে ‘রানী’ বলে ডেকেডেকে বেঁধে রাখার কৌশল বের করেছিলেন তিনি। তার প্রতিক্রিয়াশীল নারীবিষয়ক বক্তব্য নারীমুক্তির বাধারূপে কাজ করেছিলো পশ্চিমে; এবং তার প্রভাব পড়েছিলো। উনিশ শতকের শেষভাগের শিক্ষিত বাঙালির ওপরও। তারা নারীকে দেখেছিলেন কপট রাসকিনের চোখে। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আধুনিক বাঙালির ওপর অশেষ। রোম্যানটিক এ-মহাকবিকেও মনে করা হয় মানুষের মুক্তির মহাপুরুষ ব’লে, কিন্তু তিনিও পুরুষেরই মহাপুরুষ। তিনিও নারীকে সম্পূর্ণ মানুষরূপে গণ্য করেন নি; নারীকে তিনি ধারাবাহিকভাবে বিসর্জন দিয়েছেন নারী নামক এক ভুল ধারণার পায়ে। রবীন্দ্রনাথ রুশো ও রাসকিনের মিশ্রণ, আবার তাতে লাগিয়েছেন ভারতীয় ভেজাল; এবং হয়ে উঠেছেন নারীর মুক্তির এক বড়ো প্রতিপক্ষ। পশ্চিমে প্রথম নারীদের পক্ষে যে-পুরুষ যুদ্ধে নেমেছিলেন, পুরুষতন্ত্রের সমস্ত কপটতা ও মিথ্যাচার উদঘাটন ক’রে নারীমুক্তির পথটিকে প্রশস্ত করেছিলেন, তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল। স্টুয়ার্ট মিলের পথ ধ’রেই দেড় দশক পরে এসেছিলেন এঙ্গেলস, যিনি সম্পূর্ণ প্রগতিশীল, এবং যাঁর পিতৃতন্ত্রের ভাষ্যের পরিচয় আমি আগেই দিয়েছি। এ-চারজনের পরিচয়েই ধরা পড়ে নারীর সাথে আধুনিক পিতৃতন্ত্রের শত্রুমিত্রতার রূপটি।
জাঁ-জাক রুশো (নারীর শত্রুমিত্ৰ)
মার্ক্স-পূর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো, যাঁর রচনা অন্তত একটি বিপ্লব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলো। সাম্যবাদী মার্ক্সের রচনায় যেমন শ্রেণীসংগ্রাম, রোম্যানটিক রুশোর রচনায় তেমনি প্রকৃতি; এবং প্রকৃতি নামক মিথ্যার শেকলে রুশো বন্দী করেছেন নারীকে। রুশো বিভিন্ন রচনায় বিচার করেছেন নারীর প্রকৃতি বা স্বভাব, শিক্ষা, ও সামাজিক-রাজনীতিক ক্ষেত্রে নারীর স্থান। নারী সম্পর্কে তাঁর আবেগতাড়িত মত পশ্চিমকে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়েছিলো, পশ্চিমের দেশেদেশে তাঁর মতকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো উগ্রভাবে, কেননা পশ্চিম রুশোর মধ্যে পেয়েছিলো এক নতুন বিধানকর্তাকে। রুশো, ফরাশি বিপ্লবের দার্শনিক, বিরোধী ছিলেন সমস্ত শৃঙ্খলের, ভাঙতে চেয়েছিলেন সমস্ত শেকল ও মূর্তি; কিন্তু নারীর জন্যে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেকগুলো শক্ত শেকল, এবং অবিনশ্বর করে রাখতে চেয়েছিলেন পিতৃতন্ত্রেব তৈরি নারীমূর্তিটি। তাঁর বিখ্যাততম উক্তি : ‘মানুষ জন্মে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’–সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য শুধু পুরুষ-মানুষের ক্ষেত্রে। ‘মানুষ’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘পুরুষ’, নারী রুশোর কাছে মানুষ ছিলো না। নারী পরাধীনভাবে জন্ম নিলেও তাঁর কোনো আপত্তি থাকতো না, খুবই সুখী বোধ করতেন। তিনি, কেননা তাহলে নারীকে সুচারুরূপে পুরুষাধীন করার জন্যে এতোগুলো বই তাকে লিখতে হতো না। নারী সম্পর্কে রুশোর দর্শনের সম্পূর্ণটাই ভ্ৰান্ত, যার সারকথা হচ্ছে: ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, এবং তাকে চিরকাল পুরুষাধীন রাখতে হবে’ বা ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, তবে কোনো নারী যদি স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়, তবে পুরুষের কাজ হচ্ছে তাকে পুরুষাধীন করা।’ মানুষ ও রুশোর জন্যে বিশেষ মর্মান্তিক যে সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক রচনা করেছিলেন নারীকে বন্দী করার দর্শন, যা বাতিল ক’রে দেয় তাঁর মূল দার্শনিক প্রতিপাদ্যকে। রুশো ছিলেন পিতৃতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত। পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নারীপুরুষের যে-বিভেদ ও চালিয়েছে যে-পীড়ন, রুশো তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। নারী ও পুরুষের জন্যে তিনি নির্দেশ করেন। সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ও বিপরীত স্থান ও ভূমিকা। তবে তিনি নারীপুরুষের ভিন্ন স্থান ও ভূমিকাকে দাবি করেছেন ধ্রুব সত্যরূপে; তাঁর মতে, নারীপুরুষের প্রথাগত স্থান ও ভূমিকা কোনো প্রথা বা সামাজিক ব্যাপার নয়, তা প্রাকৃতিক। তবে তাঁর কাছে পুরুষের জন্যে যা প্রাকৃতিক নারীর জন্যে তা প্রাকৃতিক নয়, নারীপুরুষ রুশোর দর্শনে দুই প্রকৃতির অন্তর্গত। তাই প্রকৃতির এ-দার্শনিক সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন কী প্রাকৃতিক নারীর জন্যে, আর কী প্রাকৃতিক পুরুষের জন্যে। নারীর প্রকৃতি রুশো নির্দেশ করেন নারীর ভূমিকা বা উপযোগিতা অনুসারে, অর্থাৎ নারীর যৌন ও সন্তান জন্ম দানের উদ্দেশ্য দিয়ে; আর পুরুষের প্রকৃতি নির্দেশ করেন পুরুষের চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতার অশেষ সম্ভাবনা দিয়ে। রুশোর নারী জৈবিক, পুরুষ অজৈবিক; নারী মাংস, পুরুষ দেবদূত। রুশোর নারী শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত; আর পুরুষ সৃষ্টিশীল ও মননশীল। এসব ধারণা রুশো পেয়েছেন প্রথা থেকে; এবং প্রথা থেকে পেয়েছেন নারী সম্পর্কে আরো অনেক অশীল ধারণা। পশ্চিমের পিতৃতন্ত্র যেমন নারীকে মনে করে সমস্ত অশুভর উৎস, রুশোর চোখেও নারী পৃথিবীর সমস্ত অশুভর প্রধান উৎস। নারী সম্পর্কে রুশোর সমগ্র দর্শনই ভ্ৰান্ত; তিনি তার চারপাশে যা দেখেছেন, তাকেই ধ্রুবসত্য ব’লে গণ্য করে চর্চা করেছেন দর্শনের।
রুশোর দর্শনে নারী হচ্ছে পুরুষের কামসামগ্ৰী, এবং তার স্থান পুরুষের অধীনে। নারী পুরুষের কামের তৃপ্তি যোগাবে, কিন্তু নিজে থাকবে কামবাসনাহীন। রুশোর মতে পুরুষের কাম অত্যন্ত মূল্যবান; নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের মূল্যবান কামকে চূড়ান্তরূপে পরিতৃপ্ত করা। রুশোর দর্শন হচ্ছে পুরুষ তার প্রবল কামবেগ ও প্রমোদের জন্যে চায় যে নাস্ত্রী হবে পরম কামবেদনময়ী ও চরম কামোত্তেজক; এবং একই সাথে পুরুষ আরো চায় যে নারী নিয়ন্ত্রণে রাখবে পুরুষের অনন্ত কামাবেগকে; তাই নারী হবে অযৌন ও শীতল সতী; নারীকে, একই সাথে ও শরীরে, হতে হবে তীব্ৰ কামজাগানো অগ্নিগিরি ও তুষারের মতো পরিশুদ্ধ; অতিকামময়ী ও নিষ্কাম। নারীর কাছে রুশো চান যে নারী একই সাথে পরিপূর্ণ থাকবে লােজনম সতীত্বে ও চিত্ৰতারকার প্রচণ্ড যৌনাবেদনে; নারী হবে মর্মরের মতো শুদ্ধ, আবার তীব্রতম সুরার মতো কামোদীপক, সবার জন্যে নয় শুধু স্বামীর জন্যে। একই শরীরে একই সাথে নারী হবে শুদ্ধতমা কুমারী ও বিলোল বেশ্যা। রুশো নিজে ছিলেন কামার্ত লম্পট, অনেক অবৈধ সস্তানের দায়িত্বহীন জনক, যিনি অনুরাগিণীদের গর্ভবতী ক’রে ফেলে যেতে দ্বিধা করেন নি, কিন্তু তিনিই আবার দর্শনচর্চার সময় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন সঠিক পিতৃত্বের ব্যাপারে। বারবার তিনি বলেছেন যে স্বামীদের নিশ্চিত হতে হবে তাদের স্ত্রীদের সতীত্বে, যাতে তাদের সন্তানেরা আসলেই হয় তাদের নিজেদের সন্তান। সাবধান থাকতে হবে যাতে তাদের পুকুরে মাছ না ধরে অন্য কেউ। রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে প্রস্তাব করেছেন ভিন্ন নৈতিকতা। নারীদের সতী রাখার জন্যে আবদ্ধ ক’রে রাখতে চেয়েছেন বাড়িতে, যাতে নারীরা অন্য পুরুষের সংসর্গে এসে হারিয়ে না ফেলে তাদের সতীত্বের হীরের টুকরোটি। রুশোর কাছে সতীই শ্রেষ্ঠ নারী; সতীত্ব ছাড়া নারীর আর কোনো গুণ থাকতে পারে না। সাম্য ও মুক্তির এ-দার্শনিক নারীপুরুষকে এক মানদণ্ডে বিচার করেন নি, এটা বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। রুশো বিখ্যাত মূর্তিভগ্নকারীরূপে, কিন্তু নারীর ব্যাপারে তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের চূড়ামণি।
রুশো নারীর বিরুদ্ধে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত চক্রান্তকে, নারীর অধীন অবস্থা ও পীড়নকে, শুধু প্রথা হিশেবেই মানেন নি, একেই তিনি মনে করেছেন সত্য বা ধ্রুব। রুশো অবশ্য পিতৃতন্ত্র, পরিবার ও রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রক্রিয়া ঠিকমতো বোঝেন নি; রোম্যানটিক হিশেবে তিনি যা কল্পনা করেছেন, যা তাঁর আবেগকে তৃপ্ত করেছে, তাকেই তিনি ধ্রুব বা প্রাকৃতিক বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা একান্তভাবেই প্রাকৃতিক। তিনি বিশ্বাস করেন পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও আইনে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তা মানুষের সৃষ্টি নয়; তা শাশ্বত, প্রাকৃতিক, এবং যুক্তিসঙ্গত। রুশো মনে করেন প্রকৃতিই নারীপুরুষকে ভিন্ন ক’রে সৃষ্টি করেছে, পুরুষকে দিয়েছে যুক্তি ও শক্তি, নারীকে দিয়েছে রূপ; পুরুষ যে কামে সাহসী আর নারী লাজনাম, তা স্থির ক’রে দিয়েছে প্রকৃতিই। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শব্দ দুটি পুরোনো কাল থেকেই বারবার ব্যবস্তৃত হয়েছে নারীর অধীন অবস্থাকে শোভন ও গ্রহণযোগ্য, এবং নারীকে বশীভূত করার জন্যে। রুশো, রোম্যানটিকতার পুরোধা, পুরোধা ছিলেন প্রকৃতিতত্ত্বের। নারী অক্রিয়, অধীন, সতী, যুক্তিরহিত, স্পর্শকাতর, লাজুক, ছলনাময়ী, ও আরো বহু কিছু; একথা পুরুষতন্ত্র রটাচ্ছে অনেক শতাব্দী ধ’রে; আর রুশো এগুলোকে ক’রে তোলেন তাঁর দার্শনিকতার ভিত্তি। নারীর এ-বৈশিষ্ট্যগুলো যে বিশেষ সামাজিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি, তা না মেনে বা না বুঝে রুশো। ধ’রে নিয়েছেন যে প্রকৃতিই নারীকে নির্ভুলভাবে সাজিয়ে দিয়েছে এসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে। রুশো প্রকৃতিকে ব্যবহার করে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছেন নারীর পুরুষাধীন শেকলপারা অবস্থা। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় ‘প্রকৃতি, প্রকৃতি, এবং প্রকৃতি’, এবং ‘প্রকৃতি কখনো মিথ্যা বলে না’র মতো ধ্রুবপদ। যা কিছু রুশো যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি বা চান নি, তাতেই সহায়তা নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি নামক অবৈজ্ঞানিকতার। প্রকৃতি রুশোর ও রোম্যানটিকদের একটি বড়ো কুসংস্কার; ওই কুসংস্কারের মন্দিরে রুশো বলি দিয়েছেন নারীদের। নারী সম্পর্কে রুশোর ধারণা দু-শো বছর আগেই বাতিল করে দিয়েছিলেন নারীবাদের প্রথম পুরোহিত, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, তাঁর ‘এ ভিনডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান’ (১৭৯২, পঞ্চম পরিচ্ছেদ) গ্রন্থে।
নারীর প্রকৃতি, ভূমিকা, অবস্থা, শিক্ষা প্রভৃতি নির্দেশ ও ব্যাখ্যা করার জন্যে রুশো লিখেছেন একটি উপন্যাস : জুলি বা ল্য নোভেল এলোইজ (১৭৬১) ও একটি উপন্যাসসন্দর্ভ এমিল বা শিক্ষা (১৭৬২) , এবং নানা সন্দর্ভ। রুশো সভ্যতাবিরোধী, কেননা সভ্যতা নষ্ট করে মানুষকে। এমিল-এর (খণ্ড ১, ৫) শুরুতেই রুশো বলেছেন, ‘বিধাতা সব কিছু সৃষ্টি করে শুভরূপে; মানুষ তাতে হাত দেয়। আর সে-সব হয়ে ওঠে অশুভ।’ তার কাছে শুভ হচ্ছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক থাকা; রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন মানুষ, ক্রীতদাস, এমনকি কুকুর, আর ঘোড়ার মুক্তির জন্যে, শুধু নারীকে ছাড়া। তিনি নারীর অধীন অবস্থাকে স্থায়ী করার জন্যে এসব রচনা জুড়ে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতিকে। তিনি নারীকে ক’রে তুলতে চেয়েছেন প্রাকৃতিক নারী, আর পুরুষকে প্রাকৃতিক পুরুষ; কিন্তু পুরুষকে প্রাকৃতিক করার জন্যে যে-রীতি অবলম্বন করেছেন নারীকে প্রাকৃতিক করার জন্যে অবলম্বন করেছেন তার বিপরীত রীতি। নারীকে প্রাকৃতিক করার নামে তিনি করেছেন পুরুষের দাসী। তাঁর এমিল উপন্যাসসন্দর্ভের নায়ক এমিল, আর নায়িকা সোফি, যাদের তিনি দূষিত পৃথিবীর ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে ক’রে তুলতে চেয়েছের প্রাকৃতিক নরনারী। কিন্তু তাদের তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিপরীত শিক্ষা। এ-উপন্যাসে মানুষরূপে বিকশিত করা হয়েছে এমিলকে, যে হবে স্বামী; আর নারীরূপে তৈরি করা হয়েছে সোফিকে, যে হবে প্রাকৃতিক পুরুষের অধীনস্থ প্রাকৃতিক স্ত্রী। এমিলকে শেখানো হয়েছে যে ‘পিতৃতান্ত্রিক পল্পীজীবনই মানুষের আসল জীবন, যা সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ আর সবচেয়ে প্রাকৃতিক’; আর সোফিকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে : ‘যখন এমিল তোমার স্বামী হবে, তখন সে হবে তোমার প্রভু; প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে যে তুমি অনুগত থাকবে তার’ [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৪)]। রুশোর কাছে নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক ও ধ্রুব (এমিল, ৫:৩২৪) :
‘নারীপুরুষের আপেক্ষিক দায়িত্ব এক নয়, ও এক হতে পারে না। যখন নারী তার ওপর পুরুষের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় অসাম্য সম্পর্কে অভিযোগ করে, তখন নারী ভুল কবে; এ-অসাম্য কোনো মানবিক প্ৰথা নয়, অন্তত এটা কোনো কুসংস্কারের ক্রিয়া নয়, বরং যুক্তিরই ক্রিয়া : যে-লিঙ্গের ওপর প্রকৃতি ভার দিয়েছে সন্তান ধারণের, সে-লিঙ্গ অবশ্যই সে-জন্যে জবাবদিহি করবে। অন্য লিঙ্গের কাছে।‘
স্ত্রীকে হ’তে হবে নিখুঁত সতী, কেননা সে স্বামীর সন্তান ধারণ করে গর্ভে; তবে, রুশোর মতে, স্বামীকে সৎ হওয়ার বিশেষ দরকার নেই। পুরুষকে একশো ভাগ নিশ্চিত হতে হবে তার নারীর গর্ভে জন্মেছে যে-সন্তান, যে হবে তার উত্তরাধিকারী, সে আর কারো নয়, তার। রুশো কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা সহ্য করেন না। এ-কারণে রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে স্থির করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতা ও নৈতিক শিক্ষা।
রুশো তাঁর প্রাকৃতিক নারী শনাক্ত করার জন্যে জোর দিয়েছেন লিঙ্গ বা কামের ওপর। এমিল-এ (৫,৩২১) সোফির শিক্ষা সম্পর্কে রুশো বলেছেন, ‘তার লিঙ্গ ছাড়া, নারী হচ্ছে পুরুষ; তার আছে একই প্রত্যঙ্গ, একই প্রয়োজন, একই গুণ’; এবং একটু পরেই রুশো বলেছেন, ‘তবে যেখানে কাম বা লিঙ্গ জড়িত, সেখানে পুরুষ ও নারী ভিন্ন; তারা পরস্পরের পরিপূরক।’ রুশোর কাছে নারী হচ্ছে নিজের লিঙ্গনিয়ন্ত্রিত; এবং তাঁর মতে, ‘একটি খাটি নারী ও একটি খাটি পুরুষের মধ্যে মুখে যতোখানি মিল রয়েছে মনেও তার চেয়ে একটুকুও বেশি মিল নেই।’ (এমিল ৫:৩২২)। রুশো প্রথম দিকে, অসাম্য সম্পর্কে প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫), মনে করেছেন যে সঙ্গম একটি সহজাত দরকারি ক্রিয়া, যাতে নারীপুরুষ অংশ নেয় স্বাধীনভাবে; কিন্তু পরে কাম উপভোগ রাখেন তিনি পুরুষের জন্যে, নারীকে দেন পুরুষের কাম পরিতৃপ্ত করার দায়িত্ব। পুরুষ হয়ে ওঠে আক্রমণকারী, নারী আক্রান্ত। তবে নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের কাম জাগিয়ে তোলা, তাকে আক্রমণকারী ক’রে তোলা; তাই নারীকে হতে হবে পুরুষের কাছে আবেদনময়ী; নারীকে হ’তে হবে লাজনম্র সতী, কিন্তু তার থাকতে হবে সুখকর ছেনালিপনা। কারণ পুরুষ সতী চায়, আবার নারীর ছলাকলা না থাকলে পুরুষ উদ্দীপ্ত হয় না। রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন, কিন্তু আসলে তিনি প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে প্রাকৃতিক ব’লে মনে করেছেন তাঁর সময়ের ফরাশিদের কামাচরণকে। নারীকে সতী হতে হবে, তবে তা নারীর নিজের জন্যে নয়; পুরুষের কাম জাগানোর জন্যে, কেননা নারীর ‘সতীত্ব প্রজ্জ্বলিত করে পুরুষদের’। রুশোর মতে নারীকে তৃপ্ত করা পুরুষের কাজ নয়, তবে ‘নারীকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে পুরুষের প্রমোদের জন্যে’ (এমিল, ৫:৩২২)। রুশো প্রকৃতিকে পরিণত করেছেন ছেনাল পতিতায়। নারী পুরুষের কাম জাগাবে, পুরুষের কামকে পরমভাবে পরিতৃপ্ত করবে, আবার নারীকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অতিকামে পুরুষ ধ্বংস হয়ে না যায়। কেননা তাতে- ‘ধ্বংস হয়ে যাবে উভয়েই, আর মানবজাতি লুপ্ত হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা’ (এমিল, ৫:৩২২)। নারীকে দিয়েছেন রুশো দুটি বিপরীত দায়িত্ব : নারী হবে উর্বশী ও সীতা; নারী প্রলুব্ধ করবে পুরুষকে, আবার নিবৃত্ত করবে তাকে; নারী হবে কামোদীপক, রূপসী, সংরাগপূর্ণ, আবার হবে সুচারু সতী–এক দেহে মেরি ও মেরেলিন মনরো।
রুশোর মতে পুরুষের জীবনে তার লিঙ্গের প্রভাব কম, আর নারীর সম্পূর্ণ জীবনই তার লিঙ্গের পরিণতি; অর্থাৎ পুরুষ হচ্ছে মানুষ, কিন্তু নারী সব সময়ই নারী। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২৪): ‘পুরুষ কখনো কখনো পুরুষ, নারী সব সময়ই নারী, অন্তত তার যৌবনকাল ভ’রেই নারী; তার সব কিছুই মনে করিয়ে দেয় তার লিঙ্গকে।’ তার মতে সন্তানধারণই হচ্ছে নারীর ‘প্রকৃত কর্তব্য’। তাই নারীকে শিক্ষা দিতে হবে। এমনভাবে, যাতে ‘নারী পরিতৃপ্ত করতে পারে পুরুষকে ও অধীনে থাকতে পারে পুরুষের’; কেননা ‘প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের।‘ রুশো প্রকৃতির কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন প্রতারণারূপে; তাঁর নারদর্শনে প্রাকৃতিক কিছু নেই. এর সবটাই পিতৃতান্ত্রিক। রুশো পিতৃতন্ত্রকেই মনে করেছিলেন প্রকৃতি, যদিও তা একটি সুপরিকল্পিত শোষণমূলক ব্যবস্থা। রুশোর অনেক আগে প্লাতো নারীপুরুষকে দিতে চেয়েছিলেন একই শিক্ষা; রুশো তার প্রতিবাদ করেছেন। নায়িকা জুলিকে দিয়ে রুশো বলিয়েছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৮)]; ‘আক্রমণ ও প্রতিরোধ, পুরুষের সাহস আর নারীর লাজনম্রতা, তোমাদের দার্শনিকেরা যেমন ভাবেন তেমন প্রথা নয়, এগুলো প্রাকৃতিক ব্যাপার। এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় সহজেই, এবং এগুলো থেকে বের করা যায় আর সমস্ত নৈতিক ভিন্নতা।’ তাই রুশো এমিল-এর নায়ক এমিলের জন্যে উদ্ভাবন করেছেন এক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা, আর নায়িকা সোফির জন্যে আরেক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা। সোফিকে তৈরি করেছেন তিনি পুরুষের কামসামগ্ৰী, পতির অনুগত সতী স্ত্রী ও সন্তানবৎসল মাতারূপে। এমিলকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে স্বাধীন পুরুষরূপে বিকশিত হওয়ার, সোফিকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে এমিলের নারী হওয়ার : এ হচ্ছে রুশোর প্রকৃতির নির্দেশ। রুশো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁর ‘প্রাকৃতিক নারী’র অবস্থান নির্দেশ করেছেন। পুরুষের পদতলে (এমিল, ৫:৩২৮) :
‘নারীপুরুষ সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরের জন্যে, তবে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা সমান নয় : পুরুষ নারীর ওপব নির্ভরশীল তার কামনার জন্যে; নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল তার কামনা ও প্রয়োজন দুয়েরই জন্যে; পুরুষ নারী ছাড়া চমৎকার চলতে পারে। কিন্তু নারী পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। পুরুষের সাহায্য, সদিচ্ছা, শ্রদ্ধা ছাড়া নারী তার জীবনের লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারে না; তারা আমাদের অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল, তা নির্ভর করে আমাদের কাছে তাদের যোগ্যতা, তাদের রূপ আর সতীত্ব কতোটা মূল্যবান বলে মনে হয়, তার ওপর। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে নারীরা, তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের জন্যে, পুরুষের বিচারবিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।‘
রুশো শোষণমূলক পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে প্রাকৃতিক মনে ক’রে নারীর জন্যে এমন দর্শন ও ব্যবস্থা রচনা করেছিলেন, যা মানুষ সম্পর্কে তাঁর দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। রুশো ঘেন্না করতেন তাঁর সময়ের পুরুষদের, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের সহজাত অনন্ত শক্তিতে; মনে করতেন প্রতিবেশ ও শিক্ষার দোষেই বিকাশ ঘটতে পারছে না তাদের শক্তির। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীও রয়েছে পুরুষের নষ্টের মূলে; নারী কাম দিয়ে নষ্ট করছে পুরুষদের। নারীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়েই পুরুষ ব্যর্থ হচ্ছে মহান সব অর্জনে, হারাচ্ছে জ্যোতির্ময় পৌরুষ ও প্রতিভা!
রুশো নারীর বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা তৈরি করেছেন এমিল-এ (৫:৩৩২-৩৪৫), এবং দাবি করেছেন নারীর ওই সব বৈশিষ্ট্য সহজাত। লজ্জা, নমতা, সাজসজ্জা ও অলঙ্কারপ্রিয়তা, অন্যদের খুশি করার স্বভাব, বিনয়, চতুরতা রুশোর মতে নারীর সহজাত; এমনকি অন্যায় সহ্য করারও নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। রুশো মনে করেন দাসীত্ব নারীর জন্যে প্রাকৃতিক; এবং এসব থাকলেই নারী হয়ে ওঠে খাঁটি নারী! রুশোর মতে, নারীকে যেহেতু পুরুষের অনুগত থাকতে হবে, এমনকি অবিচার সহ্য ক’রে বাঁচতে হবে, তাই নারীর থাকা দরকার সহজাত মাধুর্য। নারীর যে রয়েছে মেধা, রুশো তা স্বীকারই করেন না। তিনি বলেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১২৯)], ‘নারী সাধারণত কোনো শিল্পকলা পছন্দ করে না, সেগুলোর কিছু জানে না, এবং তাদের কোনো প্রতিভা নেই। যে-সমস্ত তুচ্ছ কাজে লাগে ত্বরিৎ বোধ, রুচি, শোভা, কখনো কখনো লাগে সামান্য দর্শন ও যুক্তি, সেগুলো তারা পারে। কিন্তু তাদের নেই প্ৰতিভার অলৌকিক শিখা’। রুশোর নারীর কোনো মেধা নেই, সে কামসামগ্ৰী; নারী হবে স্ত্রী ও মা, তাই তার থাকতে হবে মেধা ছাড়া সমস্ত মেয়েলি গুণ। নারীর মেধাহীনতা সম্পর্কে রুশোর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য পুরোপুরি উদ্ধৃত ক’রে, একবার ‘কী ছাইপাশ’ ব’লে, রুশোকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্ (১৭৯২, ১২৪, ও পঞ্চম পরিচ্ছেদ)। নারীর মেধাশূন্যতা সম্পর্কে রুশোর সারকথা (এমিল, ৫: ৩৪৯-৩৫০) :
‘বিমূর্ত ও প্রকল্পনিক সত্য অনুসন্ধান, বিজ্ঞানের নীতি ও সূত্র উদঘাটন, যা কিছুতে দরকার পড়ে চিন্তার সাধারণীকরণ, তা নারীর আয়ত্তের বাইরে; তাদের বিদ্যা হবে ব্যবহারিক, তাদের কাজ হচ্ছে পুরুষের আবিষ্কৃত সুত্র প্রয়োগ করা, এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সে-সব পর্যবেক্ষণ করা, যা ভিত্তি ক’রে পুরুষ রচনা করবে সাধারণ সূত্র। নারীর সমস্ত ভাবনা চলবে পুরুষকে ঘিরে, এবং তারা আয়ত্ত করার করার চেষ্টা করবে সে-সব সুখকর সাফল্য, যা সুন্দর; কেননা প্ৰতিভার কাজ তাদের আয়ত্তের বাইরে। তাদের নেই বিজ্ঞানে সফল হওয়ার মতো যথেষ্ট যথাযথতা বা মনোযোগশক্তি, আর পদার্থবিদ্যায় সফল হতে পাবে তারাই, যারা সক্রিয়তম, চবম অনুসন্ধিৎসু, যারা অনুধাবন করতে পারে বিচিত্র ধরনের বস্তু, এটা তাদের এলাকা, যাদের রয়েছে। তীব্ৰতম শক্তি, যারা ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য সত্তা ও প্রকৃতির নিয়মের সম্পর্ক বিচাবের জন্যে চরমভাবে প্রয়োগ করে তাদের শক্তি। নারী প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল,এবং নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না।… নারীর আছে বোধশক্তি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী পর্যবেক্ষণ করে, পুরুষ প্রয়োগ করে যুক্তি।’
রুশোর মতে, ‘চিন্তার ব্যাপারটি নারীদের অচেনা নয়, তবে তাদের উচিত যুক্তির ওপরে শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া’; তাই রুশোর কাছে নারীর মানসিক শক্তির কোনো মূল্য নেই। রুশোর বিধান হচ্ছে নারীকে শরীর-মনে হ’তে হবে তাই, পুরুষ তাকে যা হওয়াতে চায় : নারী হবে পুরুষের সহচরী বা সহকারী বা রক্ষিতা। গবেষণাগারে পুরুষ হবে বৈজ্ঞানিক, আর নারী, বড়োজোর, হবে তার গবেষণা সহকারী।
নারী স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীর কোনো দরকার ছিলো না, পুরুষ আছে বলেই নারী দরকার। বাইবেলের বিধাতা ও রুশোর মধ্যে রয়েছে সুন্দর মিল; বিধাতা স্বর্গে একটি পুরুষ সৃষ্টির পর তার সহচরী বা পত্নীরূপে সৃষ্টি করে একটি নারী। রুশোও এমিলকে সৃষ্টি করার পর, বইয়ের চারখণ্ড জুড়ে তাকে বিকশিত ক’রে, পঞ্চম খণ্ডে এসে এমিলের জন্যে সৃষ্টি করেন একটি নারী, যার নাম সোফি। এমিল-এর পঞ্চম খণ্ডের নাম ‘সোফি, বা নারী’। এ-খণ্ডের (৫:৩২১) শুরুতেই বিধাতার স্বরে রুশো বলেন, ‘পুরুষের একলা থাকা ভালো নয়। এমিল এখন পুরুষ, এবং তাকে আমাদের দিতে হবে তার প্রতিশ্রুত পত্নী [হেল্প্মিট : সহচরী]। সে-পত্নী হচ্ছে সোফি।’ রুশো নারীকে দেখেছেন। পুরুষের পত্নী বা সহকারী-সহচরীরূপে, নারীকে হতে হবে এই অন্য কিছু হওয়া নারীর জন্যে অশুভ। রুশো তাঁর জুলি বা ল্য নভেল এলোইজ-এর নায়িকা জুলিকে করেছেন নিজের কণ্ঠস্বর; ওই নারী তার প্রেমিককে উচ্চকণ্ঠে জানায় যে নারীপুরুষের সমশিক্ষা সম্বন্ধে প্লাতো যা বলে গেছেন, তা ভুল; কারণ প্রকৃতির উদ্দেশ্য” ও ‘স্রষ্টার অভিলাষ’ থেকে স্পষ্ট যে নারীপুরুষ একধরনের নয় [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৩২)]। প্রকৃতি আর স্রষ্টা নারীর নিয়তিই করেছে মাতৃত্ব, সন্তানলালন ও ঘরকন্ন; পুরুষের জন্যে রেখেছে বাইরের জগতের সাফল্য; তাই ‘এক লিঙ্গের আরেক লিঙ্গকে অনুকরণ করা চরম নির্বুদ্ধিতা’। রুশোর কোনো উৎসাহ ছিলো না নারীর শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে; তিনি চেয়েছেন নারীকে পুরুষের অধীনে পুরুষের পরিপূরক ক’রে গড়ে তুলতে। বালিকাদের মধ্যে তিনি মাঝেমাঝে পরিচয় পেয়েছেন বুদ্ধির, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে বালিকাদের ওই বুদ্ধিটুকু বিধাতা দিয়েছেন তাদের সতীত্বের দামি রত্নটিকে রক্ষা করার জন্যে। জুলি বলেছে, নারীর রয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সম্পদ, যার নাম সতীত্ব, আর তাদের বুদ্ধি দরকার শুধু ওই সম্পদটিকে রক্ষার জন্যে। রুশোর কাছে নারীপুরুষ, নৈতিক ও মননগতভাবে, পরস্পরের পরিপূরক; একা তারা অসম্পূর্ণ, কিন্তু একত্রে তারা গড়ে তোলে এক সম্পূর্ণ সুষম সত্তা। নারীর আছে সামান্য স্ত্রীবুদ্ধি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী শুধু দেখে, পুরুষ রচনা করে আভ্যন্তর সূত্র। রুশোর মতে, নারীপুরুষ পরস্পরের পরিপূরক না হ’লে বিয়ে ব্যাপারটি হবে বিপদসঙ্কুল, এবং বিপদগ্ৰস্ত হবে সামাজিক স্থায়িত্ব। পরিপূরক শব্দটি বেশ প্রতারক; নারী ও পুরুষ ঠিক তেমন পরিপূরক পরস্পরের যেমন পরিপূরক প্ৰভু ও দাস, ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্ৰ।
রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে দু-রকম শিক্ষার প্রস্তাব করেছেন। পুরুষকে দিয়েছেন তিনি এমন শিক্ষা, যাতে সে হয়ে ওঠে নাগরিক বা স্বাধীন-প্ৰাকৃতিক মানুষ, আর নারীকে দিয়েছেন এমন শিক্ষা, যাতে নারী স্বাধীন বা প্রাকৃতিক হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে পুরুষের অনুগত স্ত্রী। তাকে শেখাতে হবে লােজনম্রতা, গৃহপালন, আর প্রথার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ বেড়ে ওঠে মুক্ত মানুষরূপে, নারী বেড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিতভাবে, তার জীবনের উদেশ্য অনুসারে। তাই এমিল বেড়ে উঠেছে তার মাতারূপে। রুশো নারীর জন্যে প্রস্তাব করেছেন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত উপযোগিতামূলক শিক্ষা, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয় (এমিল : ৫ ) :
‘নারীর সমস্ত শিক্ষা হবে পুরুষের আপেক্ষিক। তাদের খুশি করা, তাদের কাছে উপকারী হওয়া, তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হওয়া, শিশুকালে তাদের লালন করা, বয়স্ককালে তাদের যত্ন করা, তাদের পরামর্শ ও সান্ত্বনা দেয়া, তাদের জীবনকে মধুর ও সুন্দর করা হচ্ছে নারীর সব সময়ের দায়িত্ব, এবং শিশুকালেই তাদের এসব শেখাতে হবে। এ-নীতি আমরা যতোটা অমান্য করবো, ততোটা বিচ্যুত হবো। আমাদেব লক্ষ্য থেকে, এবং এছাড়া আর যে-শিক্ষাই নারীদের দেয়া হোক-না-কেনো, তা তাদের বা আমাদের জন্যে সুখের হবে না।’
তাই নারীকে কোনো মননগত শিক্ষা দেয়া যাবে না, তাদের দিতে হবে নারীশিক্ষা। নারী মেনে চলবে স্বামীর অধীনতা, লালন করবে সন্তানদের। সতী নারী থাকবে কোথায়? রুশোর উত্তর হচ্ছে, নারী জীবন কাটাবে অবরোধের মধ্যে। রুশোর মতে, ‘সম্পূর্ণ অবরোধ ও গৃহিণীপনার মধ্যে জীবন কাটানোই নারীর জন্যে প্রকৃতি ও যুক্তির বিধান’। পেরিক্লেসের আদর্শে তিনি আস্থা পোষণ করেন যে সেই উৎকৃষ্ট নারী, যার সম্পর্কে কেউ কখনো কোনো কথা বলে না। রুশো শিক্ষা দিয়ে নারীকে অভ্যস্ত ক’রে তুলতে চেয়েছেন অধীনতার মধ্যে বাস করতে। এ-উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেছেন মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়াশীল বিধান (এমিল, ৫:৩৩৩) :
‘নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে একরকম বশমানা ভাব, যা নারীর দরকার সারা জীবনভর, কেননা সে সারা জীবন থাকবে পুরুষের অধীনে, বা পুরুষের বিচারবিবেচনার অধীনে, এবং সে কখনো পুরুষের মতের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না নিজের মত। নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার ভদ্রতা; নারী তৈরি হয়েছে পুরুষ নামক এমন এক ক্রুটিপূর্ণ, এমন এক দুশ্চরিত্র ও ভ্ৰান্তিপূর্ণ প্রাণীর কাছে অনুগত থাকার জন্যে যে নারীকে শিশুকালেই শিখতে হবে অন্যায়ের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে এবং বিনাপ্রতিবাদে স্বামীর সমস্ত অন্যায় সহ্য করতে।‘
অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মন্ত্রণামূলক দর্শন রচনা করেছেন যে-দার্শনিক, তিনি নারীর জন্যে বিধান তৈরি করেছেন। পুরুষের অধীনে থাকার, অন্যায়ে অভ্যস্ত হওয়ার। তবে রুশো বিপদে পড়েছেন তার নারী নিয়ে। নারীকে তিনি একই দেহে করতে চেয়েছেন কামোদ্দীপক যৌনসামগ্ৰী ও পরম সতী; কিন্তু দেখেছেন এমন নারী তাঁর প্রাকৃতিক পুরুষের প্রাত্যহিক সাথী হ’তে পারে না। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ ও আবেদনময়ী সতীর নিয়তি হচ্ছে অধিকাংশ সময় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা!
রুশোর প্রাকৃতিক নারী প্রাকৃতিক নয়, বানানো; রুশোর নারী পুরুষতন্ত্রের কলে উৎপাদিত সবচেয়ে আকর্ষণীয় সামগ্ৰী। রুশো প্ৰবক্তা সাম্যমুক্তির; তবে তাঁর দর্শনে সাম্যমুক্তির মতো মানবিক ব্যাপারগুলো পুরুষের জন্যে, নারীর জন্যে নয়। মানুষের অসাম্যে ক্ষুব্ধ রুশো উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন এমন সামাজিক-রাজনীতিক পদ্ধতি, যাতে দূর হবে মানুষের অসাম্য। রুশো অবশ্য বৈজ্ঞানিকের বস্তুনিষ্ঠ চোখে, মার্ক্সের মতো, অসাম্যকে দেখেন নি, দেখেছেন ব্যক্তিগত মন্ময় দৃষ্টিতে; অসাম্য সম্পর্কে তাঁর ঘৃণা জন্মেছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। রুশো অসামাবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) দেখিয়েছেন কীভাবে আদিম স্বাধীন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণের ফলে সমাজে উৎপত্তি ঘটে অসাম্যের। রুশো বলেছেন [ দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪২)] :
‘অগণন মানুষ বলি হবে মুষ্টিমেয়র কাছে, আর সাধারণের সুবিধা বলি হবে ব্যক্তিগত সুবিধার কাছে। সুবিচার ও অধীনতার মতো আপাতসুন্দর শব্দগুলো সবসময় কাজ করবে সন্ত্রাসের উপকরণ ওঅবিচারের অন্ত্ররূপে; এভাবে উচ্চশ্রেণীগুলো, যারা নিজেদের পাবি করে অন্যদের জন্যে উপকারী ব’লে, আসলে অন্যদের শুষে সেবা করছে নিজেদের।‘
রুশোর মতে বেশি শক্তি বা সম্পদ কাউকে বৈধ অধিকার দিতে পারে না। তাঁর বিশ্বাস প্রকৃতি একজনকে দেয় নি অন্যের ওপর প্রভুত্বের অধিকার, এবং কেউই বলপ্রয়োগে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। রাজনীতিক আধিপত্যের সমস্যাটির বৈধ সমাধান হতে পারে শুধু সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে, যাতে মানুষের অভিলাষ হয়ে ওঠে। সার্বভৌম। এমন চুক্তি ছাড়া রাজনীতিক ব্যবস্থা হয় ‘উদ্ভট, স্বৈরাচারী’। রুশো পুরুষের জন্যে চান সার্বভৌম অভিলাষ, কিন্তু নারীকে রাখেন পুরুষের উদ্ভট স্বৈরাচারের অধীনে।
রুশো বিশ্বাস করেন সব পুরুষের অসীম সম্ভাবনায়; তিনি মনে করেন সুযোগ পেলে ভূমিদাসও ভূষিত হতে পারে জমিদারের সমস্ত গুণে। রুশোর কাছে ক্রীতদাসত্ব সম্পূর্ণ অবৈধ; কেননা ক্রীতদাসত্ব মনুষ্যত্বের অবমাননা; এতে একটি মানুষ নিজের জীবন, স্বাধীনতা, অধিকার সমর্পণ করে আরেকটি মানুষের কাছে। প্রকৃতি মানুষের এমন স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার বিরোধী। কিন্তু সাম্যমুক্তির এ-প্রচণ্ড প্রবক্তা নারীর ক্ষেত্রে ভুলে যান সাম্যমুক্তির কথা; তিনি সাম্যমুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান নারীকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে। তিনি নারীর ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ করেন অসাম্য ও অধীনতা। রুশোর মতে, নারী অধীনে থাকবে পুরুষের, আর পুরুষকে বশে রাখার জন্যে ব্যবহার করে যাবে তার রূপ, বুদ্ধি, বোধি; এর সাহায্যেই নারী ক্ষতিপূরণ করে নেবে নিজের অসাম্য ও অধীনতার। রুশোর কাছে পুরুষ শক্তিমান আর নারী পুরুষের অধীন, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য; নারী জীবনযাপন করবে। এ-সত্য মেনে নিয়ে রুশোর চিন্তায় নারীর রাজনীতিক অধিকারের কথাই ওঠে নি; নারীর ভোটাধিকারের কথা তিনি ভাবেন নি। ‘জেনেভার মধুর ও সতী নারীদের’ তিনি বলেছেন যে তাদের নিয়তি হচ্ছে পুরুষদের শাসন করা, অর্থাৎ তারা প্রভাব বিস্তার করবে স্বামীদের মাধ্যমে। রুশোর রাজ্যে পুরুষ রাজা শাসন করবে, আর রাজাকে নিজের ‘সতীত্বের শক্তি’তে শাসন করবে নারী! নারী সতী আর অনুগত হয়ে পুরুষের ওপর বিস্তার করবে। ‘আনুগত্যমূলক আধিপত্য’! এই হচ্ছে নারীর রাজনীতিক অধিকার। শুধু রাষ্ট্রে নয়, রুশোর বিধানে পরিবারের মধ্যেও নারীর কোনো কর্তৃত্ব নেই, স্বামীই পরিবারের প্রভু। রুশোর কাছে পরিবার একটি প্রাকৃতিক সংস্থা, তার প্রাকৃতিক প্ৰভু স্বামী। রুশো বলেছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪৬), ‘প্রকৃতির বিধান হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের’; আর ‘জীবন ধারণ করবে তার স্বামীর নিরঙ্কুশ আইনের অধীনে।’ পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে ছলেবলে খুশি রেখে অর্জন করবে সামান্য ক্ষমতা। রুশো যে-পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা মোটেই প্রাকৃতিক নয়; তা একটি সুশৃঙ্খল, সম্পদভিত্তিক, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। রুশোর মতে, পরিবারে কর্তৃত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েবই থাকতে পারে না, কেননা পরিবারে থাকা দরকার একজন প্রধান, যে নোবে সমস্ত সিদ্ধান্ত। সাধারণ অভিলাষের এ-প্রবক্তা পরিবারের মতো একটি সংস্থায়ও সাধারণ অভিলাষের মূল্য দেন নি। রুশো নারীকে পুরুষের অধীনে রাখতে চেয়েছেন নারীর গর্ভধারণের জন্যেও, কারণ তখন নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; রুশোর মতে, ‘নারীকে কর্তৃত্ব না দেয়ার এ-ই যথেষ্ট কারণ।’ আরেকটি কারণেও পুরুষের অধীনে রেখেছেন তিনি নারীকে, তা হচ্ছে নিশ্চিত পিতৃত্বের পরিচয়; পুরুষকে ঠিকমতো বুঝে নিতে হবে তার নারীর গর্ভে যারা জন্মাচ্ছে তারা তার কিনা? নারীপুরুষের সাম্য স্বীকার না করার পেছেনে ছিলো রুশোর একটি গোপন ভীতি। রুশোর ভয় হচ্ছে যদি পুরুষের অধীনে না রাখা হয় নারীকে, তাহলে নারী পুরুষের ওপর স্থাপন করবে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। রুশোর বিশ্বাস ছিলো যে নারীকে প্রকৃতি দিয়েছে এমন কামক্ষমতা, যা দিয়ে নারী বশীভূত পরাভূত ক’রে রাখতে পারে পুরুষকে; নারী পুরুষকে ক’রে তুলতে পারে অসহায়। অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারী নিয়ন্ত্রক। রুশো নারীভীতি পেয়েছেন ঐতিহ্য থেকে; নারীকে দেখেছেন তিনি কামদানবী অশুভ শক্তিরূপে। একটি কবিতায় নারীকে সম্বোধন ক’রে রুশো লিখেছিলেন, ‘সম্মোহিনী ও ভয়ঙ্করী, যাকে আমি পুজো আর ঘৃণা করি,… পুরুষকে যে পরিণত করে ক্রীতদাসে।’
রুশোর দর্শনে সাম্যের মতোই মূল্যবান মুক্তি বা স্বাধীনতা; তবে সাম্য যেমন পুরুষের ব্যাপার, মুক্তিও পুরুষেরই ব্যাপার, নারীর নয়। নারীর মুক্তি খুঁজেছেন রুশো পুরুষের পায়ে; মুক্তি নারীর জন্যে নয়, নারীকে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করেছেন পুরুষের অধীনে। রাজনীতিক অর্থনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) রুশো [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৫৪)] বলেছেন, ‘শুধু স্বাধীন মানুষের মধ্যেই মনুষ্যত্ব স্পষ্ট; স্বাধীনতা মানুষের গুণাবলির মধ্যে মহত্তম’; এবং ‘স্বাধীনতা অস্বীকার করা মনুষ্যত্ব অস্বীকার করা, মনুষ্যত্বের অধিকার, এমনকি তার দায়িত্ব, বর্জন করা। এমন অস্বীকার অসামঞ্জস মানুষের প্রকৃতির সাথে, এবং তার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে তার নৈতিকতা হরণ করা।’ তবে রুশো হরণ করেছেন নারীর স্বাধীনতা ও নৈতিকতা দু-ই, কেননা রুশোর চোখে নারী মানুষ নয়, মেয়েমানুষ। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২২), ‘দু-লিঙ্গের মিলনে প্রত্যেকে কাজ করে একই উদ্দেশ্যে, তবে ভিন্ন উপায়ে। তারা ‘ভিন্ন উপায়ে’ কাজ করে, কেননা তারা ভিন্ন; একজন প্ৰভু, আরেকজন তার দাসী। ‘ভিন্নতা’ ধারণাটিও প্রতারক, নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন বলার অর্থ হচ্ছে নারী ‘নিকৃষ্ট’। রুশোর কাছে পুরুষ হচ্ছে শক্তিমান ও সক্রিয়, নারী দুর্বল ও অক্ৰিয়। তাই নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, কেননা পুরুষ শক্তিমান; রুশোর কাছে শক্তিমানের অধীনে থাকাই প্রকৃতির বিধান। কিন্তু ফরাশি বিপ্লবেও নারী পালন করেছিলো অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা, যদিও ওই বিপ্লবের দার্শনিক বলেছেন নারী দুর্বল ও অক্রিয়! নারী রুশোর দর্শনের জন্যে শোচনীয় এলাকা, এ-এলাকায়ই রুশো এমনভাবে পদস্থলিত হয়েছেন যে তার অজ্ঞাতে তার দর্শনের মূল বক্তব্য বাতিল হয়ে গেছে। রুশো নারীর স্বাধীনতা পুরোপুরি অস্বীকার ক’রে নারীকে করেছেন। পুরুষের ক্রীতদাসী, যার কাজ পুরুষের বিনোদ যোগানো ও সেবা করা। রুশোর নারী প্রাকৃতিক নয়, স্বাধীন নয়, তা পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে বানানো পুরুষভোগ্য সামগ্ৰী। রুশো নারী সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সামান্যও অভিনব নয়; পিতৃতন্ত্রের সমস্ত পুরোনো গ্রন্থে এসব বিধিবিধান অনেক আগেই প্রণীত হয়েছিলো; রুশো শুধু সেগুলোকে রোম্যানটিক রীতিতে প্ৰকাশ ক’রে আঠারো-উনিশ শতকের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ক’যে তুলেছিলেন, এবং নারীকে বেঁধেছিলেন নতুন শক্ত শোকলে।
জন রাসকিন (নারীর শত্রুমিত্ৰ)
পুরুষাধিপত্যের প্রতিক্রিয়াশীল রোম্যানটিক রূপটি পাওয়া যায় রুশোর রচনায়; চাটুকারিতাপূর্ণ ভিক্টোরীয় ভণ্ডামোর রূপটি পাওয়া যায় জন রাসকিনের ‘সিসেম অ্যান্ড লিলিজ’ (১৮৬৫) গ্রন্থের ‘লিলিজ : অফ কুইন্স গার্ডেনস্’ (১৮৬৪) নামের বক্তৃতাপ্রবন্ধে। রাসকিনের বক্তব্যে মৌলিক কিছুই নেই, তিনি নারী সম্পর্কে সব কিছু পেয়েছেন প্রথা, সাহিত্য, ও চারপাশ থেকে; তবে তিনি নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় পর্বের কপট, প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকাশ করেছিলেন খুবই বীরত্বের সাথে। ভিক্টোরীয়রা তার কাছে যা শুনতে চেয়েছিলো, তিনি তাদের তা শুনিয়েছিলেন উদ্দীপনার সাথে, এবং অর্জন করেছিলেন অশেষ জনপ্রিয়তা। সব জনপ্রিয় বস্তুই এক সময় হাস্যকর হয়ে ওঠে, রাসকিনের বক্তৃতাটিও তাই; কিন্তু দুঃখ লাগে রাসকিনের আবর্জনা প্রভাব বিস্তার করেছিলো বিপুলভাবে; তিনি প্রভাবিত করেছিলেন এমনকি উনিশশতকের শেষাংশের শিক্ষিত বাঙালিদেরও, যাঁরা রাসকিনের পরামর্শে নিজেদের নারীদের ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘ভদ্রমহিলা’ বা ‘লেডি’। রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’-এর প্রকাশের চার বছর পর বেরিয়েছিলো জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ (১৮৬৯); কিন্তু ওই সত্যনিষ্ঠ বইয়ের ভাগ্যে জুটেছিলো তিরষ্কার। মিলেট (১৯৬৯, ৮৯) বলেছেন, ‘মিলে পাওয়া যায় লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতা, আর রাসকিনে পাওয়া যায় রোমান্স ও রূপকথা।’ রাসকিন বাস্তবতার থেকে বাগিতায়, সত্যের থেকে রূপকথায় বেশি আগ্রহী; তোষামোদে তিনি নির্লজ্জ, পুরুষাধিপত্যে একনিষ্ঠ। নারীদের ডেকেছেন তিনি ‘লিলি’ বা ‘পদ্ম’। ব’লে, ‘রানী’ ব’লে, কিন্তু বন্দী করতে চেয়েছেন গৃহকূপে। ‘পদ্ম’ বা ‘রানী’ ডাকে রয়েছে বেশখানিকটা কাম; ‘পদ্ম’ স্মরণ করিয়ে দেয় অক্ষত শুভ্র সতীত্বের ব্যাপারটিকে, ‘রানী’ও আশ্লেষজাগানো ডাক। রাসকিনকে অনেকখানি নষ্ট করেছে সাহিত্য : তিনি দান্তে, শেক্সপিয়র, ও রোম্যানটিক কবিতার নারীদের ভেবেছেন বাস্তব, কিন্তু ওই নারীরা যে বাস্তব নারী থেকে সুদূরে, তা বোঝেন নি। রোম্যানটিক কবিতা নারীকে দেবী ক’রে শেষ পর্যন্ত পরিণত করে পুরুষের সেবিকায়, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে; এখানে দুটি কবিতা উল্লেখযোগ্য, কেননা কবিতা দুটি রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের মনে বদ্ধমূল করেছিলো নারীর বিশেষ রূপ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি কবিতার নাম ‘শি ওয়াজ এ ফ্যান্টম অফ ডেলাইট’। কবি বলছেন : যখন সে প্রথম আমার চোখে পড়লো, সে ছিলো আনন্দের মায়ামূর্তি। আবেগের তীব্র মুহূর্তে সে দেবী; কিন্তু আবেগ কেটে গেলে কবি দেখতে পান : সে দেবী, কিন্তু নারীও বটে! তাই আনন্দের মায়ামূর্তি হয়ে ওঠে পুরুষের গৃহিণী, যার কাজ সংসার দেখাশোনা, মানসসুন্দরী শুরু করে মাছ কোটা। কভেন্ট্রি প্যাটমোরের ‘দি অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ বা ‘গৃহলক্ষ্মী’ কবিতায় বিয়ে ও নারীত্ব সম্পর্কে ভিক্টোরীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ভালোভাবে। রাসকিনের বক্তৃতায় প্রকাশ পায় ওই ‘দেবী, কিন্তু নারীও বটে’ এবং ‘গৃহলক্ষ্মী’র ধারণা।
রাসকিন ১৮৬৪ অব্দে ম্যানচেস্টার শহরের টাউন হলো মধ্যবিত্ত নরনারীদের সামনে দিয়েছিলেন বক্তৃতাটি। বক্তৃতাটিতে পাওয়া যায় এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি পরিপূর্ণ মধ্যযুগীয় শিভালরি ও প্রতিক্রিয়াশীলতায়; যার চোখে নারীমাত্ৰই নাবালিকা। চাটুবাক্যে শুরু করেছেন তিনি বক্তৃতাটি; শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বসিয়েছেন ‘বিপথগামী ও অশিক্ষিতদের রাজার আসনে, এবং নারীদের বসিয়েছেন ‘রানী’র অসার সিংহাসনে। পরোক্ষভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি সে-সময়ের নারীবাদীদের, যারা বলছিলেন নারীর অধিকারের কথা; কেননা রাসকিন নারীর অধিকারে বিশ্বাস করেন না। সে-সময় জনপ্রিয় ছিলো স্যাপারেট স্ক্যোরিস বা পৃথক এলাকা, অর্থাৎ ঘরে-বাইরে তত্ত্ব, যা তখন সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো নারীদের পোষমানানোর জন্যে। রাজকবি টেনিসন ‘প্রিন্সেস’ (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে বলেছিলেন : ‘নারী অসম্পূর্ণ পুরুষ নয়/ তবে ভিন্ন… অভিন্নরূপে এক নয়, তবে বিভিন্নরূপে এক’, ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা/ অর্ধেক, আর খাঁটি বিয়েতে কেউ/ সমান বা অসমান নয়, প্রতিটি পূরণ করে/ অন্যটির ক্রটি।’ টেনিসনের এ-কাব্যিক ভিন্নতার মধ্যে অভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এমন এক শোভন কৌশল, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষণকে সুখকর ক’রে তোলা। রাসকিন ঘরেবাইরে ও পরিপূরক তত্ত্ব নানাভাবে পেশ করে নারীকে তার অধিকারের কথা ভুলিয়ে চেয়েছেন। পুরুষের সেবিকা ক’রে রাখতে। নারীদের ‘রানী’ ব’লে কপট সম্বোধনের পর রাসকিনের কাজ হচ্ছে ওই রানীরা কোথায় থাকবে, কী করবে, কী শিখবে তার বিধান রচনা। তিনি নতুন কিছু বলেন নি, পুরুষতন্ত্র যা ব’লে এসেছে কয়েক হাজার বছর ধরে, আর তাঁর একশো বছর আগে রুশো, এবং রোম্যানটিক কবিরা যা বলেছেন, তিনি তাই বলেছেন ভিক্টোরীয় নাইটের ভঙ্গিতে।
নারীরা রাসকিনের চোখে রানী, কী ক্ষমতা ওই রানীদের, এবং কীভাবে প্রয়োগ করবে তারা তাদের রানীসুলভ ক্ষমতা? কিন্তু রাসকিন ক্ষমতার কথা বলতে গিয়েই দ’মে গেছেন, তার মনে পড়ে গেছে নারীরা রানী, তবে আসলে তো তারা নারী! তাই আগে ঠিক করতে হবে কী হবে তাদের ক্ষমতা নারী হিশেবে? রাসকিন (১৮৬৫, ৬১) এখন দেখা দেন মুখোশ খুলে; বলেন, ‘নারীদের রানীসুলভ ক্ষমতা কী হবে তা স্থির করতে পারি না, যদি না আমরা একমত হই তাদের সাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে।’ বিপত্তি ঘটে এখানেই, কেননা রাসকিনের বিধানে নারীদের সাধারণ ক্ষমতা খুবই তুচ্ছ, নারীর ক্ষমতা হচ্ছে নারীর ভূমিকা পালন করা। নারী পুরুষের সমান হবে না, নারী হবে পুরুষের সহায়ক। উনিশ শতকে পুরুষতন্ত্রীরা বের করেছিলেন পৃথক এলাকার ধারণা, রাসকিন তা নিজের ক’রে নিয়েছিলেন, এবং একেই ঘোষণা করেছিলেন প্রাকৃতিক ব’লে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পুরুষ ও শোষকতন্ত্রের বড়ো প্রতারণা; রুশো প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে, রাসকিনও প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে। উনিশশতকে প্রকৃতি শুধু আবেগাতুর শব্দ ছিলো না, শোষকতন্ত্র এ-শব্দটিতে পেয়েছিলো সমস্ত সমস্যার সমাধান। তারা যা কিছু বুঝতে পারতো না, বা যা কিছু নিজেদের সুবিধার জন্যে তারা বিধিবদ্ধ করতে চাইতো, তাকেই বলতো তারা ‘প্রাকৃতিক’ : শ্রেণী, স্বৈরাচার, শোষণ সব কিছুই প্রাকৃতিক! রাসকিন যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট বলা শোভন ছিলো না, তাই তাদের সুভাষণ বের করতে হয়েছিলো। টেনিসনের প্রন্সেস-এ মেলে নারীপুরুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্ব :
For Woman is not underdevelopt man
But diverse:..
Not like to like, but like in difference…
either sex alone
Is half itself, and in true marriage lies
Nor equal, nor unequal each fulfills
Defect in each
নারী নয় অবিকশিত পুরুষমানুষ
তবে ভিন্ন…
একজন নয় অপরজনের মতো, কিন্তু ভিন্নতার মধ্যে একরূপ…
দু-লিঙ্গের মধ্যে একটি একলা
শুধুই অর্ধেক, আর প্রকৃত বিবাহে
কেউ সমান বা অসমান নয়; প্রত্যেকে পূরণ করে
অপরের ত্রুটি
ভিক্টোরীয় রাজকবির মতে নারী অবিকশিত মানুষ বা পুরুষ নয়, ভিন্ন ধরনের মানুষ; শুনতে এটা ভালো শোনালেও কবি আর ভিক্টোরীয়রা নারীকে অসম্পূর্ণ মানুষই মনে করতো। এ-কবিতার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্বের প্রতিধ্বনি ক’রে রাসকিন (১৮৬৫, ৭২) বলেন :
‘আমরা নির্বোধি, ক্ষমাহীনভাবে নির্বোধ, যখন আমরা এক লিঙ্গের ওপর আরেক লিঙ্গের শ্ৰেষ্ঠতার কথা বলি, যেন তাদের তুলনা করা সম্ভব অভিন্ন বিষয়ে। একটির যা আছে অন্যটির তা নেই; একটি পূর্ণতা দেয় অন্যটিকে, এবং পূর্ণতা পায় অন্যটি দিয়ে : তারা কোনো কিছুতেই একরকম নয়, উভয়ের সুখ ও উৎকর্ষ নির্ভর করে অন্যের যা আছে তা চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে, যা শুধু দিতে পারে অন্যটি।‘
রাসকিনের এ-নাইটপনা হচ্ছে নারীপুরুষের সামাজিক ও মেজাজগত পার্থক্যকে জৈবিক যুক্তির সাহায়ে বৈধ করার কূটকৌশল। তিনি উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্টতে না গিয়ে গেছেন টেনিসনি ভিন্নতায় ও পরিপূরকতায়, শয্যা থেকে সাম্রাজ্য পর্যন্ত যার সুফল পাবে পুরুষ আর দুর্ভোগ পোহাবে নারী। পুরুষ : নারী ভিন্ন ও পরিপূরক, যেমন ভিন্ন ও পরিপূরক ব্ৰাহ্মণ; শূদ্ৰ, শোষক : শোষিত, যারা সৃষ্টি করে সামাজিক বৈচিত্র্যের সঙ্গীত! নারীপুরুষের কোনো মৌল পার্থক্য নেই; যোনিলিঙ্গস্তন প্রভৃতি পার্থক্যের নেই কোনো সামাজিক-রাজনীতিক মূল্য, কিন্তু রাসকিনেরা এসবের জন্যেই পুরুষকে প্ৰভু আর নারীকে দাসী ক’রে রাখার কৌশল বের করেছেন চিরকাল।
রাসকিন নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব ও পরিপূরকত্ব প্রস্তাব ক’রেই ধ’রে নিয়েছেন যে তা প্রমাণ হয়ে গেছে; এবং সাথেসাথেই তিনি আঁকা শুরু করেছেন নারীপুরুষের ভিন্ন ও পরিপূরক জগতের মানচিত্র। তিনি পুরুষকে দিয়েছেন মুক্ত পৃথিবী, নারীকে ঢুকিয়েছেন বদ্ধ ঘরে; সৃষ্টি করেছেন ঘরে-বাইরের ভিন্ন ও বিপরীত পরিপূরক বিশ্ব। রাসকিনের রাজারা পুরুষ, তাই তারা দায়িত্ব পেয়েছে সমস্ত মানবিক কাজের, আরা রাসকিনের রানীরা নারী, তাই তারা পেয়েছে গৃহপরিচারিকার দায়িত্ব : এই হচ্ছে রাজারানীর পরিপূরকতা! নারীপরুষের ভিন্নতা সম্পর্কে আবহমান পুরুষতন্ত্র যা বলেছে, রুশো যা বলেছেন, যা বলেছে ভিক্টোরীয়রা, তাই বলেছেন রাসকিন (১৮৬৫, ৭২-৭৩) :
‘তাদের চাবিত্রিক ভিন্নতা সংক্ষেপে এগুলো। পুরুষের শক্তি সক্রিয়, প্রগতিশীল, প্রতিরোধাত্মক। সে প্রধানত কর্তা, স্রষ্টা, আবিষ্কারক, রক্ষক। তার মেধা প্ৰকল্পনার ও আবিষ্কারের; তার শক্তি অভিযাত্রার, যুদ্ধের, বিজয়ের, যেখানে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত, যেখানে বিজয় দরকার। কিন্তু নারীর শক্তি শৃঙ্খলার, যুদ্ধের নয়; আব্ব তার মেধা আবিষ্কার বা সৃষ্টির নয়, তা মধুর শৃঙ্খলার, বিন্যাসের, এবং সিদ্ধান্তের। তার কাজ প্রশংসার : সে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না, কিন্তু কার শিরে মুকুট পরানো হবে সে তার রায় দেয; তার কাজ ও স্থান দিয়ে সে সব রকম বিপদ ও প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত। পুরুষ, মুক্ত পৃথিবীতে বিভিন্ন কর্কশ। কাজে, মুখোমুখি হয় বিপদ ও বিচারেব্য;–তাই পুরুষেবই জন্যে রয়েছে ব্যর্থতা, অপরাধ, অনিবাৰ্য ভুল: মাঝেমাঝেই সে আহত বা পরাভূত হবে, বিপথে যাবে, এবং সব সময় কঠিনতর হবে। কিন্তু সে নারীকে রক্ষা করে এসব থেকে; তার গৃহের মধ্যে, যা শাসন করে নারী, যদি নারী নিজে না চায়, তবে নারীকে ঢুকতে হবে না কোনো বিপদ, প্রলোড়ন, ভুল বা অপরাধের মধ্যে। এ হচ্ছে গৃহের আসল প্রকৃতি–এটা শান্তির এলাকা।‘
রাসকিনের বুলির সারকথা : পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সেবিকা। গৃহে থাকা, সংসার শাসন করা, পুরুষের সেবা করাই রাসকিনের মতে ‘নারীর প্রকৃত স্থান ও শক্তি’। নারীকে হ’তে হবে গৃহের উপযুক্ত, ওই বদ্ধকূপে থেকেই সে সফল ক’রে তুলবে তার জীবন। নারী হবে। আপাদমস্তকআত্মা এমন নারী যে সে যেখানেই রাখবে তার পা দুখানি, তাই হয়ে উঠবে গৃহ। তাঁর, ও তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদী গোত্রের, কাছে এই প্রাকৃতিক। রাসকিনের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে প্ৰথাই প্রাকৃতিক; যা চলে এসেছে, তা যতোই নিষ্ঠুর অমানবিক অস্বাভাবিক হোক-না-কেনো, তাদের কাছে তাই প্রাকৃতিক শাশ্বত। নারীকে তার জীবন সফল করার জন্যে আয়ত্ত করতে হবে নানা রমনীয় গুণ। রাসকিন (১৮৬৫,৭৩-৭৪) তাঁর রানীদের ভূষিত দেখতে চেয়েছে আত্মবিনাশী গুণে :
‘সে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে ভালো; সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে জ্ঞানী-জ্ঞানী, আত্মবিকাশের জন্যে নয়, বরং আত্মোৎসর্গের জন্যে : জ্ঞানী, এজন্যে নয় যে সে নিজেবে প্রতিষ্ঠা করবে স্বামীর ওপরে, ববং এজন্যে যাতে সে ব্যর্থ না হয় স্বামীর পাশে থাকতে।‘
রাসকিন পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন নারীদের অস্তিত্ব, কেননা নারীর কিছুই নারীর নিজের জন্যে নয়। নারীকে ভালো হতে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে; জ্ঞানীও হতে হবে সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে; কিন্তু সে আত্মবিকাশ ঘটাতে পারবে না, সে নিজেকে তৈরি করবে। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের পায়ে আত্মোৎসর্গের জন্যে। এ হচ্ছে একধরনের সতীদাহ। রাসকিন নারীদের পরিণত করেছেন শোচনীয় প্রাণীতে, অথচ ভিক্টোরীয় কপটতায় তাদের ডেকেছেন ‘রানী’ বলে।
পুরুষতন্ত্র শুধু পীড়ন ক’রে নারীদের নারী ক’রে তোলে নি, তাদের দীক্ষিত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাক্ত মন্ত্রে, যার নাম নারীমন্ত্র। নারীমন্ত্রে দীক্ষণ দেয়ার জন্যে পুরুষতন্ত্র উদ্ভাবন করেছে বিশেষ ধরনের নারীশিক্ষা, যা প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষাই নয়। রুশোর এমিল-এর বিকল্প নাম শিক্ষা, কিন্তু ওই শিক্ষা নারীদের জন্যে অশিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। রাসকিনও ওই শিক্ষায় শিক্ষিত অর্থাৎ অশিক্ষায় অশিক্ষিত করতে চেয়েছেন নারীদের। রাসকিন নারীদের জন্যে রেখেছেন স্বামী ও সংসার, তাই তাদের দিতে চেয়েছেন সে-শিক্ষা যাতে নারীরা সম্পূর্ণরূপে খাপ খায় স্বামী ও সংসারের অন্ধকূপে। রাসকিন বলেছেন, ‘আমি নারীদের স্থান ও শক্তি দেখিয়েছি’; তারপর প্রশ্ন করেছেন নারীদের শিক্ষা সম্পর্কে, ‘এর সাথে খাপ খাবে কী ধরনের শিক্ষা’ নারীদের জন্যে তিনি বিধিবদ্ধ করেছেন খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা, যার লক্ষ্য নারীদের পুরুষাধীনতায় অভ্যস্ত করে তোলা। রাসকিন (১৮৬৫,৭৬) বলেন, ‘প্রথমে নারীর দেহখানিকে ছাচে ফেলে ঢালাই করতে হবে’; তারপর ওই নমনীয় ভঙ্গুর দেহখানির ভেতর যে-মনটি থাকবে, সেটিকে বদলে দিতে হবে ও ভ’রে তুলতে হবে।’ আত্মোৎসর্গ্র শিক্ষায়। রাসকিনের মতে নারীর জ্ঞান যেমন আত্মবিকাশের জন্যে নয়, তেমনি শিক্ষাও আত্মবিকাশের জন্যে নয়;–নারীর শিক্ষা পুরুষের সেবা করার জন্যে, পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার জন্যে। এ-শিক্ষায় নারী বড়েজোর হয়ে উঠবে সখি, সচিব ও প্রিয়শিষ্যা, যা তাকে ক’রে তুলবে পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়, কিন্তু সে কখনো স্বাধীন ব্যক্তি হয়ে উঠবে না।
রাসকিন (১৮৬৫, ৭৬-৭৯) নারীকে দিতে চেয়েছেন পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার শিক্ষা। নারীকে দিতে হবে সে-সব জ্ঞান, যা নারীকে সাহায্য করবে। ‘পুরুষের কাজ বুঝতে, এমনকি সহায়তা করতে’। অর্থাৎ পুরুষ হবে ঔপন্যাসিক, আর তাঁর স্ত্রী হবে পাণ্ডুলিপি।প্রস্তুতকারক ও গ্রুফসংশোধক, পুরুষ বিশ্ববিখ্যাত হবে। আর নারী স্বামীর খ্যাতিতে ধন্য বোধ করবে! এ-প্রসঙ্গে টলষ্টয় ও তার স্ত্রী সোফিয়া স্মরণীয়। টলষ্টয় পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষের স্থান পেয়েছেন, আর নিন্দিত হয়ে আছেন সোফিয়া, যদিও ওই নারী সহচরীরূপে তাঁর সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছেন টলষ্টয়ের বিখ্যাত নিষ্ঠুর পায়ে। টলস্টয় দুশ্চরিত্র ছিলেন, নিজের অবৈধ পুত্রদের লাগিয়েছিলেন ভূমিদাসের কাজে, পরিচারিকদের গর্ভবতী করেছেন, আর শেষ জীবনে যখন ধর্ম ও নিষ্কামতা প্রচার করছিলেন তখনও জড়িত ছিলেন চেরট্কভের সাথে সমকামে; এবং নিয়মিতভাবে গৰ্ভবতী ক’রে চলছিলেন সোফিয়াকে, আর সোফিয়া ক’রে চলছিলেন স্বামীর সহকারীর কাজ। টলষ্টয় তাকে তেরোবার গর্ভবতী করেন, ওই নারী নটি জীবিত সন্তান লালনপালন করেন, জমিদারি দেখাশোনা করেন, প্ৰকাশ করেন স্বামীর রচনাবলি, এবং বারবার অনুলিপি প্রস্তুত করেন স্বামীর পাণ্ডুলিপির। টলষ্টয়ের অপাঠ্য হস্তাক্ষরে লেখা যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করেন তিনি সাতবার, রাত জেগেজেগে বিবর্ধক কাচ দিয়ে দেখে, এবং নষ্ট করেন নিজের জীবন [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ১৬৩-১৬৪)]। রাসকিন এভাবেই নষ্ট করতে চান নারীকে। রাসকিন বলেন, নারীকে ‘জ্ঞান দেয়া যাবে না জ্ঞান হিশেবে, নারীদের জ্ঞান দিতে হবে এমনভাবে যাতে নারী শুধু ‘অনুভব ও বিচার করতে পারে’। নারীর মাথাটি নষ্ট করে দিয়ে তার বুকের ভেতরে সৃষ্টি করতে হবে স্যাঁতসেঁতে ভাবালুতা। নারীর জ্ঞান ‘নারীর গর্ব বা বিশুদ্ধির জন্যে নয়’; তা শুধু তাকে দয়াবতী ক’রে তোলার জন্যে। রাসকিনের বিধান হচ্ছে নারীকে বিজ্ঞান শেখানোর দরকার নেই, তাকে শুধু বিজ্ঞানের দু-একটি খবর জানানো যেতে পারে। নারীকে জ্ঞানের অভিধানে পরিণত করার দরকার নেই; তবে তাকে ক’রে তুলতে হবে ভাবালুতার ঝরনাধারা। নারীকে ধর্মতত্ত্বও শেখানো যাবে না, এটা বিশেষভাবেই বারণ করেছেন রাসকিন, কেননা এটা এক ভয়ঙ্কর বিজ্ঞান’, যেখানে পদষ্মলন ঘটেছে শ্রেষ্ঠ পুরুষদেরও। নারীরা ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, তবে তাদের ভীরে তুলতে হবে ধর্মভাবে, যাতে তারা হয়ে ওঠে বিনীত ও করুণাময়ী।
স্ববিরোধিতা করে এক সময় রাসকিন বলেন, ‘এটা (ধর্মতত্ত্ব) বাদে, ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, পাঠে ও বিষয়ে, হবে প্ৰায় একই; তবে তাদের শিক্ষার লক্ষ্য হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন’। ‘প্রায় একই’ অবশ্য অভিন্নতা বোঝায় না, বোঝায় সম্পূর্ণ ভিন্নতা; আর লক্ষ্য তো ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন’। রাসকিন চান পুরুষের জন্যে শিক্ষা, আর নারীর জন্যে অশিক্ষা :
নারীর শিক্ষা হবে স্বামীমুখি। স্বামী যা কিছু জানে স্ত্রীকে জানতে হবে সে-সব, তবে ভিন্নভাবে; ওই জ্ঞানে স্বামীর ‘অধিকার হবে মৌলিক ও অগ্রসর’; আর স্ত্রীর অধিকার হবে ‘সাধারণ, যাতে তা প্রাত্যহিক জীবনে উপকারে আসে’। রাসকিনের বিধান হচ্ছে ‘পুরুষ তার জানা ভাষা বা জ্ঞান আয়ত্ত করবে ব্যাপকভাবে, আর নারী ওই ভাষা বা জ্ঞান জানবে ততোটুকু, যতোটুকু হ’লে সে তার স্বামীর আনন্দের সঙ্গে তাল দিতে পারে’। সারকথা হচ্ছে নারীকে কোনো যথার্থ শিক্ষাই দেয়া হবে না, তাদের দিতে হবে নারী হয়ে ওঠার, স্বামীর সহচরী হয়ে ওঠার সবক। তারা হয়ে উঠবে উন্নত জাতের দাসী ও শয্যাসঙ্গিনী। রাসকিনের নারীশিক্ষা হচ্ছে পুরুষের সাথে খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করেন নারী-অধীনতায়; তার শিক্ষাও নারীকে পুরুষের অধীন করার মন্ত্র। নারীশিক্ষা পুরুষতন্ত্রের একটি বড়ো ভীতির ব্যাপার, কেননা শিক্ষা নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের সাথে, তাকে বুঝিয়ে দেয় তার পতনের শোচনীয়তা ও সম্ভাবনাকে।
ভিক্টোরীয় যুগে নানা চক্রান্ত হয়েছে নারীর শিক্ষা নিয়ে, যে-চক্রান্তের একটি আদর্শ রূপ পাওয়া যায় টেনিসনের ‘প্রিন্সেস’-এ (১৮৪৭, ১৮৫৩), যার দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত ছিলেন রাসকিন। প্রিন্সেস একটি শিক্ষাবিতর্কমূলক কাব্য। ভিক্টোরীয় যুগে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিলো; এমনকি এর প্রভাব পড়েছিলো রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার ওপরও, যার ফলে একটি বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসিত রাজকন্যা হয়ে ওঠে পুরুষের শোচনীয় সহচরী। প্রিন্সেস-এ বিবাহবিরোধী রাজকন্যা আইডা নারীশিক্ষার জন্যে স্থাপন করে একটি নারী-বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে ছাত্রীর ছদ্মবেশে ভর্তি হয় আইডার অনুরাগী মৃগীরোগগ্ৰস্ত এক রাজপুত্র ও তার বন্ধু। রাজপুত্র যখন ধরা পড়তে যাচ্ছিলো, তখন একদিন সে জলমগ্ন আইডাকে উদ্ধার ক’রে প্রাণে বাঁচায়, এবং প্ৰেম নিবেদন করে। আইডা তা প্রত্যাখ্যান করে। এক সময় যুদ্ধ বাধে আইডা ও রাজপুত্রের দলের মধ্যে, যুদ্ধে আহত হয় রাজপুত্র। আইডা আহত রাজপুত্রের সেবা ক’রে নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে; বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সেখানে সে স্থাপন করে হাসপাতাল। বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে ও শিক্ষানুরাগী বিবাহবিরোধী রাজকন্যাকে নার্সে পরিণত করে পুরুষতন্ত্র প্ৰতিশোধ গ্রহণ করে নারীবাদ ও নারীশিক্ষার ওপর।
প্রিন্সেস-এ প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে নারীবাদের ওপর; দেখিয়ে দেয়া হয়েছে যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ, নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা। নারীর শিক্ষা হচ্ছে বাজে কথা, আর নারীপুরুষ কখনো সমান হ’তে পারে না। প্রিন্সেস-এর নায়ক আইডাকে বিয়ে করতে চায়, তবে সে এমন কাউকে বিয়ে করতে পারে না যে তার সমকক্ষ। নারীর সমকক্ষতা দাবি দ্রোহিতা, তাই তাকে পেতে হবে উপযুক্ত শাস্তি। দ্রোহী নারীকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে যাতে সে হয়ে ওঠে অনুগত স্বামীপরায়ণ দাসীস্বভাব স্ত্রী। নারী যদি সমান হয়ে ওঠে। পুরুষের, তাহলে কি বিয়ে টিকতে পারে, সুখের হতে পারে সংসার’ ভিক্টোরীয়রা বিশ্বাস করতো সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে; আর রমণীর শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে পুরুষের নিচে থাকা। শিক্ষা হচ্ছে সে-শক্তি যাতে নারী সমান হয়ে উঠতে পারে পুরুষের, তাই নারীকে সরিয়ে নিতে হবে শিক্ষার দরোজা থেকে। নারীকে থাকতে হবে ঘরে, তাই প্রিন্সেস-এ গানেগানে প্রচার চালানো হয়েছে ঘর আর চুলোর সপক্ষে; হিটলার যেমন প্রচার চালিয়েছে কিন্ডের, কুচে উন্ট কিরচে’র [শিশু, রান্নাঘর ও গির্জা] পক্ষে। তাদের কাছে প্ৰেম/বিবাহ ও শিক্ষা ছিলো পরস্পরবিরোধী; একটি করা যাবে, একসাথে দুটি করা যাবে না। এ-কাব্যে পুরুষাধিপত্যবাদী ভিক্টোরীয় মনোভাব প্ৰকাশ পেয়েছে প্রচণ্ডভাবে [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ’৭৮-৭৯)];
মাঠেন্য জন্যে পুরুষ আর চুলোর জন্যে নারী;
তলোয়ারের জন্যে পুরুষ সূচের জন্যে নারী;
পুরুষেব আছে মগজ, নারীর আছে হৃদয়;
পুরুষ দেবে আদেশ, আর পালন করবে নারী;
…
পুরুষ শিকারী; নারীরা শিকার।
মৃগয়ার চকচকে ঝলমলে মৃগ,
আমরা শিকার করি তাদের চামড়ার সৌন্দর্যের জন্যে;
এজন্যেই তারা ভালোবাসে আমাদের
এবং আমরা অশ্ব ছুটিয়ে তাদের ভূপাতিত করি।
হিংস্র পুরুষাধিপত্যের কোমল চতুর রূপ হচ্ছে নারীপুরুষের পরিপূরক পার্থক্যের তত্ত্ব। নারীপুরুষের সাংস্কৃতিক আপাতপার্থক্যকে ভিক্টোরীয় রীতিতে জৈবিক ক’রে তুলেছেন টেনিসন ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা অর্ধেক’ বলে। তাঁর মতে নারীপুরুষ দুজনে মিলে গ’ড়ে তোলে ‘বিশুদ্ধ সঙ্গীত’; তবে এ-দ্বৈত সঙ্গীতে পুরুষই প্রধান সুর। টেনিসন বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে, জ্ঞানার্থী তরুণীকে নার্সে পরিণত ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে সৃষ্টি করেছেন ভিক্টোরীয় বিবাহের বিশুদ্ধ সঙ্গীত; রাসকিন করেছেন একই কাজ। নারীকে শিক্ষার নামে দিয়েছেন অশিক্ষা, নবীর পুরুষাধীনতাকে ক’রে তুলেছেন মহিমানিত।
রাসকিনের রানীদের রাজ্য গৃহ, সংসারই তাদের রাজদরবার; তবে শিভালরিতে তিনি অদ্বিতীয়, তাই তিনি রাষ্ট্রের সাথে তার রানীদের/নারীদের কী সম্পর্ক হবে, তাও দেখাতে ভোলেন নি। তিনি বলেছেন (১৮৬৫, ৮৭), ‘আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে পুরুষের দায়িত্ব বাইরে, আর নারীর দায়িত্ব ঘরে। তবে আসলে তা নয়।’ তাঁর মতে নারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব রয়েছে সংসারের প্রতি, তবে বাইরের প্রতিও রয়েছে তার দায়িত্ব। নারীর বাইরের জগত, রাসকিনের মতে, তার সংসারেরই সম্প্রসারণ। পুরুষের নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ‘ভরণপোষণ, উন্নতি ও নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা, আর নারীর কাজ হচ্ছে সংসারকে সাজানোগোছানো, আরামপ্রদ ও মনোরম করা’। রাসকিন রাষ্ট্রের প্রতি নারীপুরুষের যে-দায়িত্ব নির্দেশ করেছেন, তাতে পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সহায়ক অলঙ্কার। পুরুষের দায়িত্ব ‘রাষ্ট্রকে সচল রাখা, তাব উন্নতি করা, তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা’; আর নারীর দায়িত্ব হচ্ছে ‘রাষ্ট্রকে সাজিয়েগুছিয়ে, আরামপ্রদ ও সুন্দর ক’রে রাখা’। এরপর রাসকিন পুরুষকে ‘ভদ্রলোক’-এর বদলে ভূষিত করেন লর্ড উপাধিতে, নারীকে ‘ভদ্রমহিলা’র বদলে ‘লেডি’তে। তবে তিনি ‘লর্ড’ ও ‘লেডি’ শব্দের যে-অর্থ নির্দেশ করেন, তাতে নারীর সব মহিমা লুটিয়ে পড়ে। ‘লেডি’ শব্দের অর্থ ‘রুটিদানকারিণী’, অৰ্থাৎ যে ভিক্ষা দেয়; আর ‘লর্ড’ শব্দের অর্থ ‘আইনরক্ষণকারী’ বা ‘প্ৰভু। সমস্ত ক্ষমতা থাকছে পুরুষের হাতে, নারী শুধু পালন করবে দান বা ভিক্ষা দেয়ার কাজ। কিন্তু নারী দান করবে কার ধন? সে নিজেই তো সর্বহারা, ভিখিরি; পুরুষের ধন ছাড়া দেয়ার মতো কোনো ধন তার নেই। তাহলে কি তার কাজ প্রভুর ধন থেকে মাঝেমাঝে কিছু ভিক্ষে দিয়ে প্রভুর শোষণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা? রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’ হচ্ছে পুরুষাধিপত্যের ভিক্টোরীয় মন্ত্র ও চক্রান্ত, যার থেকে এখনো উদ্ধার পায় নি মধ্যবিত্ত নারীরা। নিম্নবিত্ত নারীদের কথা তিনি ভাবেনই নি, তার চোখে তারা রানী নয়, নারীও নয়, সম্ভবত মানুষও নয়।
জন স্টুয়ার্ট মিল (নারীর শত্রুমিত্ৰ)
রুশো-রাসকিন পুরুষতন্ত্রের মহাপুরোহিত; নারীর জন্যে তাঁরা বিধিবদ্ধ করেছেন বিনোদযোগানো দাসীর ভূমিকা। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁদের বিপরীত; পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম নারীকে দেখেছেন মানুষরূপে, এবং নারীর জন্যে খুলে দিতে চেয়েছেন মানবিক সমস্ত এলাকা। ১৮৬৯-এ বেরোয় মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ [নারী-অধীনতা। মিল ছিলেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তির অধিকারের দার্শনিক; তিনিই প্রথম পুরুষ, যিনি একটি সম্পূর্ণ বই লেখেন নারীর অধিকারের সমর্থনে। তাঁর আগে কোনো পুরুষ নারীর দুর্দশার কথা ভাবে নি বা দুৰ্দশা থেকে উদ্ধার করতে চায় নি নারীদের, তা নয়; তাঁর আগে বাঙলায়ই আমরা পেয়েছি দুজন মানবিক নারীবাদী : রামমোহন ও বিদ্যাসাগরকে; তবে মিলই প্রথম বিস্তৃতভাবে দেখান পুরুষতন্ত্রের নারীশোষণের রূপটি। মিল রুশো বা রাসকিনের মতো ভাবালুতগ্রস্ত নন, তার মধ্যে নেই রুশোর স্ববিরোধিতা; মিল তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে, মাঝেমাঝে ক্ষোভ মিশিয়ে, পেশ করেছেন নিজের বক্তব্য। মিল দেখান নারীর জীবনের শোচনীয় বাস্তবতা, পুরুষের অধীনে নারীর দুরবস্থা। তাঁর দেড় দশক পরে এঙ্গেলস ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’তে (১৮৮৪) উদঘাটন করেন শোষণের বিশ্বজনীন সূত্র। মিলের লেখায় পাওয়া যায় ভিক্টোরীয় পর্বের লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতার দিকটি; ভিক্টোরীয় পুরুষ ও মহাপুরুষদের মতো নারী সম্পর্কে তিনি পরীর গল্প বলেন নি, বলেছেন নির্মম সত্য। মিলের নারী-অধীনতা প্রথাবিরোধী রচনা, তাতে প্রথার সমস্ত শেকড় তুলে ফেলা হয়েছে অকাট্য যুক্তির সাহায্যে। মানুষের অগ্ৰগতি ও স্বাধীনতার বড়ো বাধা হচ্ছে প্রথা, সুবিধাভোগীরা ওই প্রথাকেই ঐশ্বরিক, শাশ্বত, প্রাকৃতিক বলে প্রচার করে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের স্বার্থ। নারী প্রথার প্রধান শিকার। যিনি প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন, প্রথাবাদীরা তাঁর নিন্দা রটায়; নিন্দা রটানো হয়েছিলো মিলের বিরুদ্ধেও। মিল বইটি লিখেছিলেন ১৮৬১তে; বইটি লেখায় তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন স্ত্রী হ্যারিয়েট টেইলর, এবং সহায়তা করেছিলেন সৎকন্যা হেলেন টেইলর। হ্যারিয়েট নারীবাদী আন্দোলনকারী ছিলেন, মিল তাঁকে বিয়ে করার সময় খ্রিস্টান স্বামীর সমস্ত আইনসঙ্গত অধিকার লিখিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেননা তা স্বামীস্ত্রীর সাম্যের বিরোধী। তাই মিলের নারী-অধীনতা পারিবারিক আবেগ থেকেই জন্মেছিলো, যদিও বইটিতে আবেগের কোনো চিহ্ন নেই। মিলের ‘নারী-অধীনতা’য় উপস্থাপিত হয়েছে কালকালান্তর ধ’রে নারীর শোচনীয় অবস্থার বাস্তবতা; তিনি আক্রমণ করেছেন নারীর আইনগত দাসীত্বকে, শিক্ষার নামে অশিক্ষাকে, ভিক্টোরীয় যুগের স্ত্রীসুলভ অধীনতাকে। তাঁর বক্তব্য বিপ্লবাত্মক, যখন নারীর জন্যে দাসীর দর্শন রচনা করাই ছিলো মহাপুরুষত্ব, তখন তিনি দাবি করেছিলেন নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে বিশুদ্ধ সাম্য। মিলের মূল প্রতিপাদ্য (১৮৬৯, ১) :
‘যে-নীতি নিয়ন্ত্রণ করে দু-লিঙ্গের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক সম্পর্ক–এক লিঙ্গের কাছে আরেক লিঙ্গের আইনগত অধীনতা–তা সম্পূর্ণ ভুল; এবং এখন মানুষের অগ্রগতির এক প্রধান বাধা; এর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিশুদ্ধ সাম্যের নীতি, এতে একপক্ষের থাকবে না বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা, অন্যপক্ষেরও থাকবে না কোনো অসুবিধা।‘
পুরুষতন্ত্রের কাছে তখন এমন বক্তব্য ছিলো পুরুষতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি জানতেন তাঁর বক্তব্য কলহ বাধাবে, এবং তা বেধেছিলো প্ৰচণ্ডভাবে। তাঁর বক্তব্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্র; এবং মিলকে দিয়েছিলো উন্মাদ আর অনৈতিকের অপবাদ।
পুরুষতন্ত্রের কোনো যুক্তি ছিলো না, কিন্তু ছিলো প্ৰথা, আর গোঁড়ামি। মিল জানতেন, যাঁরা আক্রমণ করেন কোনো বিশ্বজনীন বিশ্বাস বা প্রথাকে, তাদের ভাগ্যে জোটে দুঃসহ দুৰ্দশা, কখনো সুপরিকল্পিত অবহেলা। মিলের নারী-অধীনতা প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তির আক্রমণ; এতে নেই ভাবাবেগ বা মিথ্যার দোহাই, যদিও যে-সময় তিনি লিখছিলেন তখন প্রথাবদ্ধ গোড়াদের শক্তির প্রকাশ ঘটতো প্রথাগত ভাবাবেগের মধ্য দিয়ে, যেমন আজো ঘটে। মিল (১৮৬৯, ৫) বলেছেন, ‘আমি কলহ করতে চাই না তাদের সাথে, যাদের বিশ্বাস নেই যুক্তিতে, কিন্তু অতিবিশ্বাস রয়েছে প্রথায় ও সাধারণ আবেগে।’ নারী পুরুষের অধীনে, এ-সম্পর্কে মিল (১৮৬৯, ৮) বলেছেন, যারা মনে করে নারীদের থাকতে হবে পুরুষদেরই অধীনে, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে বিশেষ এক তত্ত্ব। ওই তত্ত্বটি তারা গোঁড়ামির সাথে পোষণ করে আসছে, তাই ওই তত্ত্বের বিরোধী আর কিছু কখনো পরীক্ষা ক’রে দেখতে দেয়া হয় নি। নারীপুরুষের অসাম্য, মিলের মতে, বিশেষ বিচারবিবেচনার ফল নয়; এর উদ্ভব ঘটেছে পুরুষের শারীরিক শক্তির ফলে। পুরুষ শক্তিবশত নারীকে নিজের অধীন করেছে। পরে আইন বিধিবদ্ধ করেছে তাই। মিল দেখিয়েছেন শক্তিপ্রয়োগের ফলেই সূচনা ঘটেছে সব রকম আধিপত্য ও অধীনতার, তারপর আধিপত্য ও অধীনতাকেই পরিণত করা হয়েছে বিধানে। নারীর অধীনতাকে মিল তুলনা করেছেন দাসত্বপ্রথার সাথে। মিল দেখিয়েছেন দাসত্ব শুরুতে ছিলো প্ৰভু ও দাসের মধ্যে শক্তির ব্যাপার; কিন্তু পরে তা বিধানে পরিণত করা হয়। প্রভুরা একত্র হয়ে দাসত্বকে পরিণত করে বিধানে। মিলের মতে প্ৰাচীন কালে অধিকাং নরনারীই ছিলো দাস; পরে মুক্তি লাভ করে পুরুষ দাসেরা, আর নারীকে বিন্যস্ত করা হয় একটু কোমল ধরনের অধীনতার ভেতবে। বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তার মূলে রয়েছে শক্তিমানের আইন। মিল মনে করেন শক্তিমানের আইন এখন পরিত্যক্ত হ’লেও তা রয়ে গেছে নানা এলাকায়, যেমন নারীর বেলা। শক্তিমানের বিধি অনুসারে নারী পরিণত হয়েছে গৃহদাসীতে।
পুরুষতন্ত্র প্রচার করে যে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। কোনো কিছুকে প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে তা মানুষের তৈরি নয়, তা কোনো শাশ্বত বিধানের ফল। তাই তা প্রশ্নের ওপরে, তা অসংশোধনীয়। কিন্তু মানুষের জীবনে কোনো কিছুই শাশ্বত নয়; বিধাতা, ধর্ম, রাজা, প্ৰজা, ধনী, দরিদ্র সবই মানুষের তৈরি। সুবিধাভোগীরা চিরকালই দোহাই দেয় ঈশ্বরের, প্রকৃতির, স্বভাবের; কেননা তাতে রক্ষা পায় তাদের স্বার্থ। মিল (১৮৬৯, ২১) প্রশ্ন করেছেন, ‘এমন কি কোনো আধিপত্য রয়েছে, যা প্রাকৃতিক মনে হয় নি প্ৰভুদের কাছে?’ তিনি দেখিয়েছেন এক সময় মানবসমাজকে ভাগ করা হতো দুটি ভাগে : ছোটো ভাগটিতে পড়তো প্রভুরা আর বড়ো ভাগটিতে দাসেরা, এবং তাকেই মনে করা হতো প্রাকৃতিক; এমনকি শ্রেষ্ঠ পুরুষেরাও তাই মনে করতো। জ্ঞানী আরিস্তলের কাছেও প্ৰভু ও দাসের বিভাগকে মনে হয়েছিলো প্রাকৃতিক। তিনি মনে করতেন মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে দুটি ভাগ : একটি স্বাধীন প্রকৃতির, যেমন গ্রিকরা; আরেকটি দাসপ্রকৃতির, যেমন থ্রেসীয় ও এশীয়রা। মার্কিন দাসমালিকেরাও প্রাকৃতিক বলে মনে করতো শাদার প্রভুত্ব ও কালোর দাসত্বকে। রাজতন্ত্রবাদীরা সব সময়ই মনে করেছে যে রাজতন্ত্রই প্রাকৃতিক। এসবের মূলকথা হচ্ছে যারা জোর ক’রে ক্ষমতা দখল করেছে, যারা প্ৰভু হয়ে উঠেছে, তাদের কাছে প্ৰভুত্ব মানেই প্রাকৃতিক। চিরকাল বিজয়ীরা মনে করেছে যে প্রকৃতির নির্দেশ হচ্ছে বিজিতরা অধীনে থাকবে বিজয়ীদের। মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুরা নিজেদের প্রভুত্বকে মনে করতো প্রাকৃতিক; নিম্নশ্রেণীর মানষেরা তাদের সমান হবে এমন ভাবনাকে তারা মনে করতো সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক বা অর্থাভাবিক। তা-ই মানুষের কাছে অস্বাভাবিক/ অপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়, যা অপ্রথাগত; যা প্রথায় পরিণত হয়েছে, তা যতোই অস্বাভাবিক উৎকট পাশবিক হোক-না-কেনো, তা-ই মানুষের কাছে স্বাভাবিক। মিল (১৮৬৯, ২২-২৩) তথাকথিত প্রাকৃতিককে নির্দেশ করেছেন প্ৰথা বলে :
‘এটা এতো সত্য যে অস্বাভাবিক বলতে সাধারণত বোঝানো হয় শুধু অপ্ৰথাগতকে, আর যা কিছু প্রথাগত তাকেই মনে করা হয় প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক। নারীর পুরুষাধীনতা যেহেতু বিশ্বজনীন প্রথা, তাই এর থেকে সামান্য স’রে যাওয়াকে মনে হয় অস্বাভাবিক।‘
অপ্ৰথাগত ব’লে অস্বাভাবিক মনে হওয়ার নানা উদাহরণ দিয়েছেন মিল। বিলেতের শাসক একজন নারী, এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয় পৃথিবীর নানাদেশের মানুষের কাছে; রানীর শাসন তাদের কাছে অবিশ্বাস্যরূপে অস্বাভাবিক। ইংরেজের কাছে এটা অস্বাভাবিক নয়, কেননা এতে তারা অভ্যস্ত; কিন্তু নারীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বা সংসদ সদস্য হওয়া তাদের কাছে অস্বাভাবিক। চিরকালই সুবিধাবাদী শোষকেরা নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখার জন্যে দোহাই দেয় প্রকৃতির। নারীকে বশে রাখার জন্যে তারা দোহাই দিয়েছে প্রকৃতির। মিল ‘প্রাকৃতিক’ ধারণাকেই বাতিল ক’রে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা এবং তাদের সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক অবস্থাকে প্রাকৃতিক বলে দাবি করা একধরনের রাজনীতি। মিলের কাছে কোনো কিছুই প্রাকৃতিক নয়। পুরুষতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর দাসীত্ব প্রাকৃতিক; মিল দেখিয়েছেন এটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম।
পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে থাকে যে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ভিন্ন অন্যান্য আধিপত্য থেকে, কেননা এটা শক্তির আধিপত্য নয়; নারী এ-আধিপত্য মেনে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে স্বেচ্ছায়। এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই নারীর, নারী স্বীকৃতি দিয়েছে এ-আধিপত্যকে। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে; এখনকার নারীপুরুষের অবস্থা দেখে মনে হতে পারে যে পুরুষাধিপত্য নারীর কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে প্রকৃত সত্যটি যে নারী পুরুষাধীনতা মেনে নেয় নি। মিল বলেছেন, বহু নারী পুরুষাধিপত্যকে স্বীকার করে না; অনেকে লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে তাদের মনোভাব, এবং এখন নারীরা এর বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ জানাচ্ছে প্রকাশ্যে। নারীরা ভোটাধিকার চায়, চায় পুরুষের সাথে সমান শিক্ষা ও পেশা। মিলের সময় পর্যন্ত নারীবাদীরা স্পষ্টভাবে বলে নি যে তারা পুরুষাধিপত্য মানে না, তারা সম্পূর্ণ মুক্তি চায়; কিন্তু মিল তাদের আন্দোলনে দেখেছেন পূর্ণ মুক্তির অভিলাষ। মিল বলেছেন, কোনো পরাধীন শ্রেণীই একবারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে না। যারা বহুদিন প্রচলিত কোনো শক্তির অধীনে থাকে, তারা শুরুতেই ওই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় না, প্রতিবাদ জানায় শুধু তার পীড়নের বিরুদ্ধে। অসংখ্য নারী প্রতিবাদ জানায় তাদের স্বামীদের পীড়নের বিরুদ্ধে। মিল বলেছেন, নারীরা একযোগে নানা কারণে পুরুষের ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে না। তারা অন্য সমস্ত অধীন-শ্রেণী থেকে ভিন্ন; তাদের প্রভুরা তাদের কাছে শুধু শ্ৰম চায় না, প্রভুরা তাদের কাছে শ্রমের থেকে কিছুটা বেশি চায়। পুরুষ শুধু নারীদের আনুগত্য চায় না, পুরুষ চায় নারীদের আবেগানুভূতি। শুধু বর্বর ছাড়া কোনো পুরুষই নারীকে একটি বাধ্য ক্রীতদাসী হিশেবে পেতে চায় না, চায় একটি স্বেচ্ছাদাসী; পুরুষ তার নারীর কাছে শুধু দাসী চায় না, চায় প্রিয়দাসী। তাই পুরুষ সব রকমের চেষ্টা চালায় নারীর মনকে দাসীতে পরিণত করার। অন্য ধরনের দাসদের প্রভুরা ভয় জাগিয়ে আনুগত্য আদায় করে দাসদের কাছ থেকে, আর নারীর প্রভুরা যেহেতু শুধু আনুগত্যে সুখী নয়, যেহেতু তারা নারীর কাছে চায় আবেগানুভূতি, তাই তারা নারীকে দেয় এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। পীড়ন ক’রে নয়, শিক্ষা দিয়ে পুরুষ নারীকে ক’রে তোলে প্রিয় ক্রীতদাসী। পুরুষতন্ত্রের উদ্ভাবিত নারীশিক্ষা হচ্ছে নারীকে পুরুষের দাসী করার শিক্ষা। শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তাদের প্রকৃতি পুরুষের বিপরীত; নারীরা নিয়ন্ত্রণ করবে না, তারা আত্মসমৰ্পণ করবে। অন্যের নিয়ন্ত্রণের কাছে; সব ধরনের নীতিশাস্ত্র শেখায় যে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণই তাদের কর্তব্য; আর সব ধরনের ভাবালুতা তাদের শেখায় যে নারীর প্রকৃতি হচ্ছে অন্যের জন্যে বেঁচে থাকা, নিজেদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা। বঞ্চিত হওয়াই নারীত্ব! নিজের স্বার্থে নিজের অধীনে রাখার জন্যে পুরুষ নারীকে এমন শিক্ষা দিয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যাতে নারী হয়ে উঠেছে বিনম, বশ্যতাপরায়ণ, এবং নিজের অভিলাষ ছেড়ে দিয়েছে সে পুরুষের হাতে।
পুরুষতন্ত্রের মতে বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অবস্থা, পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা, ঘটেছে নারীপুরুষের স্বভাব বা প্রকৃতি অনুসারে। মিল একে বাতিল ক’রে দিয়েছেন, কেননা তাঁর মতে নারীপুরুষের স্বভাব বিজ্ঞানসন্মতভাবে জানার মতো উপায় তখনো উদ্ধাবিত হয় নি। তাই তাদের স্বভাব বলে যা নির্দেশ করা হয়, তা বানানো জিনিশ। মিল (১৮৬৯,৩৮) বলেছেন :
‘একথা বলা যাবে না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি অনুসারেই তাদের বর্তমান ভূমিকা ও অবস্থান নির্ণীত হয়েছে, এবং এ-ই। তাদের জন্যে উপযুক্ত। সাধারণ বুদ্ধি ও মানবমনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমি একথা স্বীকার করি না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি কেউ জানে বা জানতে পারে, বিশেষ ক’রে যখন তাদের দেখা হয় তাদের বর্তমান পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসারে।… এখন যাকে নারীপ্রকৃতি বলা হয়, তা সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম জিনিশ–একদিকে তা পীড়নের, আরেক দিকে তা অস্বাভাবিক প্ররোচনার ফল। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আর কোনো অধীন-শ্রেণীর চরিত্র তাদের প্রভুদের সাথে সম্পর্কের ফলে এতো অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত হয় নি।‘
পুরুষ শিক্ষা দিয়ে বদলে, বিকৃত ক’রে দিয়েছে নারীর স্বভাবকে; নারীকে ক’রে তুলেছে বশ্যতাপরায়ণ, ভীরু, ভাবালুতগ্রস্ত, এবং এর ফলে নারীকে আর যোগ্য মনে হয়। না কোনো মানবিক কাজের। নারীপুরুষের স্বাভাবিক পার্থক্য কোথায়? পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে যে তারা তা জেনে গেছে সম্পূর্ণরূপে; কিন্তু মিলের মতে সমাজের বর্তমান অবস্থায় তা জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব। মিল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্বভাবের ওপর প্রতিবেশের প্রভাবের দিকে। নারীপুরুষের নৈতিক ও মননগত পার্থক্য যতো ব্যাপকই মনে হোক-না-কেনো এখন, মিল তাকে কিছুতেই স্বাভানিক পার্থক্য বলে মেনে নিতে রাজি নন। কেননা শিক্ষা ও প্রতিবেশের প্রভাবে নারী তার প্রকৃত স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে, গ্রহণ করেছে কৃত্রিম স্বভাব। মিলের মতে, পুরুষ নারীকে যা মনে করে নারী তা নয়। পুরুষ নারী সম্পর্কে যা বলে তা ঠিক নয়, নারীর কথা বলতে পারে শুধু নারী।
পুরুষ সাধারণত ধারণা করে যে নারীর ভূমিকা হচ্ছে স্ত্রী ও মাতার। মিল একে শুধু ধারণা ব’লেই মনে করেন, ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন না, কেননা সমাজের বর্তমান অবস্থায় জানার কোনো উপায় নেই নারী নিজেকে দেখতে পছন্দ করে কোন ভূমিকায়। এমনও হতে পারে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাকে ঘেন্না করে তারা; তবে নারীদের যেহেতু স্বাধীনভাবে কোনো ভূমিকা বা পেশা বেছে নিতে দেয়া হয় নি, তাদের ওপর যেহেতু চাপিয়ে দেয়া হয়েছে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা, তাই তারা বাধ্য হয়ে তা পালন করে; কিন্তু একে তাদের স্বাভাবিক ভূমিকা মনে করার কোনো কারণ নেই। মিলের মতে দাসদের যেমন বাধ্য করা হতো বিশেষবিশেষ কাজ করতে, কারণ ওই কাজ সমাজের জন্যে দরকার, তেমনি নারীদের বাধ্য করা হয় বিয়েতে ও সন্তান লালনে, কেননা সমাজের তা দরকার। পুরুষ নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে। শুধু বিয়ের গলিটি, তাই ওই কানাগলিতে নারীকে ঢুকতেই হয়। মিলের মতে বিয়ে হচ্ছে নারীর সমাজনির্ধারিত নিয়তি। মিল দেখিয়েছেন এক সময় খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বামী ছিলো স্ত্রীর জীবনমৃত্যুর অধিপতি। মিল (১৮৬৯, ৫৫) বলেছেন :
‘এখন স্ত্রী হচ্ছে তার স্বামীর দাসখত দেয়া দাসী : আইনের চোখে তারা ক্রীতদাসদের থেকে একটুও কম দাস নয়। বেদীতে সে স্বামীর প্রতি জীবনব্যাপী আনুগত্যের শপথ নেয়।… স্ত্রী নিজের জন্যে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে পারে না, স্বামীর জন্যে পারে; তার সম্পত্তি অবলীলায় স্বামীর সম্পত্তি হযে ওঠে। বিলেতের সাধারণ আইনে স্ত্রীর অবস্থা অনেক দেশের ক্রীতদাসের অবস্থার থেকেও খারাপ।‘
মিল অবশ্য দেখিয়েছেন যে আইনের চেয়ে মানুষ, এমনকি পুরুষও অনেক ভালো; যদি তা না হতো তবে পৃথিবীটা বেশ একটা নরক হয়ে উঠতো। আইন পুরুষকে যতোটা নিষ্ঠুরতার অধিকার দিয়েছে পুরুষ ততোটা নিষ্ঠুর নয়, বা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব ততোটা নিষ্ঠুর হওয়া। তবে আইনে নারী পুরুষের দাসীই।
নারী পুরুষের ওপর নানা প্রভাব খাটাতে পারে, মেষ বানিয়ে রাখতে পারে পুরুষকে; কিন্তু নারীর ওই শক্তির কোনো কোনো মূল্য নেই। মিলের মতে নারীর এ-শক্তি কিছুতেই নারীর স্বাধীনতাহীনতার ক্ষতি পূরণ করতে পারে না। নারীর এ-শক্তি নারীকে অবৈধ অধিকার দিতে পারে, কিন্তু তাকে তার বৈধ অধিকার দাবি করার অধিকার দেয় না। মিল (১৮৬৯,৭০) বলেছেন, সুলতানের প্রিয় ক্রীতদাসীর অধীনেও থাকে অনেক দাসদাসী, তাদের ওপর সে উৎপীড়নও চালিয়ে থাকে; কিন্তু তাতে সে স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠে না, সে থাকে ক্রীতদাসীই। যা কাম্য তা হচ্ছে সে নিজেও দাসী হবে না, আর তার অধীনেও থাকবে না দাসদাসী। কোনোকোনো নারী থাকে অশেষ সুখ ও শক্তির মধ্যে, তবে তা দাসীর সুখ ও শক্তি; সে ওই সুখশক্তি পায় প্রভুকে সেবার ও প্রমোদ দেয়ার বিনিময়ে। মিল ভিক্টোরীয় সমাজের একটি ভণ্ডামোরও সমালোচনা করেছেন। ভিক্টোরীয়রা বারবার বলতো যে নারী পুরুষের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, আর একথা বেশি বলতো তারা, যারা নারীদের আসলেই মনে করতো দাসী। এটা কি এক পরিহাস নয় যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে? ভিক্টোরীয়রা নারীদের উৎকৃষ্টতায় বিশ্বাস করতো না, তবে তাদের বশে রাখার জন্যে করতো। এ-তোষামোদটুকু। মিল প্রশ্ন করেছেন, নারীরা উৎকৃষ্ট কিসে, এবং দেখিয়েছেন নারীরা পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট শুধু আত্মোৎসর্গপরায়ণতায়! কেননা পৃথিবী জুড়েই শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তারা জন্ম নেয় আত্মোৎসর্গের জন্যে; তারা নিজেদের যতো বঞ্চিত কববে ততোই উন্নতি ঘটবে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার! নারী বেঁচে থাকে নিজেকে বঞ্চনা করে, কেননা আত্মবঞ্চনাই পুরুষতন্ত্রের মতে নারীত্ব। মিল মনে করেন নারীপুরুষ যদি সমানাধিকার পায়, তবে লোপ পাবে নারীর এ-আত্মঘাতী প্রবণতা। ভিক্টোরীয়রা বড়াই করতো নৈতিকতায়, মিল তাদের নৈতিকতার ভেতরে লুকোনো অনৈতিকতার রূপটিও তুলে ধবেছেন। মিল মনে করেন সাম্যই নৈতিকতা, আর সে-সমাজই নৈতিক যেখানে রয়েছে সাম্য। এতোদিন ধরে যে-সমাজ চলে এসেছে, সেটা বলতান্ত্রিক সমাজ; সেখানে সমান হওয়ার অর্থই হচ্ছে শত্রু হওয়া। ওই সমাজ ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শেকল বা মইয়ের মতো, সেখানে কেউ ওপরে কেউ নিচে; তাতে কেউ আধিপত্য করে কেউ থাকে অধীনে। তাই প্ৰচলিত নৈতিকতা হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার নৈতিকতা। মিল মনে করেন আধিপত্য ও অধীনতা হচ্ছে সমাজের বিকার; সমাজের স্বাভাবিক রূপ হচ্ছে পারস্পরিক সাম্য। তিনি মনে করেন মনুষ্যত্ব নিহিত পরস্পরের সাথে সমভাবে বসবাসের মধ্যে। তিনি দেখিয়েছেন বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবার হচ্ছে স্বৈরাচারের রাজ্য; তবে তিনি মনে করেন ঠিক মতো গড়ে উঠলে পরিবার হবে স্বাধীনতার রাজ্য। মিল আক্রমণ করেছেন পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে, যেখানে পুরুষ প্ৰভু নারী তার অধীন। মিল দাবি করেছেন নারীপুরুষের আইনগত সমানাধিকার, পরিবারে কেউ প্ৰভু বা দাসদাসী হবে না; স্বামীস্ত্রী হবে সমান।
পুরুষতন্ত্র নারীপুরুষের বিশ্বকে দুটি পরিচ্ছন্ন ভাগে ভাগ করে; নারীর জন্যে বরাদ্দ করে ঘর, পুরুষের জন্যে বাইর। ভিক্টোরীয়রা ছিলো ঘরে বাইরে তত্ত্বের একনিষ্ঠ উপাসক। পুরুষ নারীকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে, তাকে মা-স্ত্রী-কন্যার ভূমিকা দিয়ে কেড়ে নেয তার সমস্ত মানবিক অধিকার। মানবিক প্রায় সব পেশাই তারা নিষিদ্ধ করে নারীর জন্যে। নারী যে ওই সব পেশার অযোগ্য, তা নয়; তবে পুরুষ জোর ক’রেই নারীকে ঘোষণা করে ওইসব পেশার অযোগ্য বলে। পুরুষের সমান হয়ে ওঠার জন্যে নারীর ফিরে পাওযা দরকার সমস্ত মানবিক পেশা। নারীপুরুষের সাম্যের জন্যে মিল নারীর জন্যে চেয়েছেন সে-সব ভূমিকা ও পেশা, যা এতোদিন ধরে রয়েছে পুরুষের অধিকারে। তিনি দেখিয়েছেন নারীকে সব পেশা ও ভূমিকা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, যাতে নারী পরিবারের মধ্যে সহজে মেনে নেয় পুরুষের আধিপত্য। তাঁর মতে অধিকাং পুরুষ সমান কারো সাথে বসবাসের কথা ভাবতেই পারে না। তাই পুরুষ নারীকে দূরে রেখেছে সমস্ত আকর্ষণীয় পেশা থেকে, যা নারীকে ক’রে তুলবে পুরুষের সমান। পুরুষ অবশ্য যুক্তি দেয় যে নারী ওই সব কাজের উপযুক্ত নয়, নারীর নেই ওই সব কাজের প্ৰতিভা বা যোগ্যতা। মিল ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে নারী সম্পর্কে এ-ধারণা সত্য নয়; সত্য হচ্ছে নারী সব কাজই যোগ্যতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে। তবে নারীকে অনেক কাজ করতেই দেয়া হয় নি, তাই তারা যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পায় নি। তাদের যে-কাজ করতেই দেয়া হয় নি, সে-কাজে তাদের অযোগ্যতা প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও বলা হয় তারা সে-কাজের উপযুক্ত নয়। মিল বলেছেন, এখনো কোনো নারী হোমার, আরিস্তাতল বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো দেখা দেয় নি; তাই ব’লে মনে করা যায় না যে কোনো কালে ওই মাপের কোনো নারী দেখা দেবে না। তবে নারীরা এলিজাবেথ বা জোয়ান অফ আর্ক হয়েছে। মিল দেখিয়েছেন এখনকার আইনের এক বিস্ময়কর বিধান হচ্ছে যে-কাজে নারীরা দক্ষতা দেখিয়েছে, সে-কাজ থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে নারীদের। এমন কোনো আইন নেই, যাতে নারীদের শেক্সপিয়র বা মোৎসার্ট হওয়া নিষেধ, তবে নারীরা রাজ্যশাসনে দক্ষতা দেখালেও তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা লাভ নিষিদ্ধ। এলিজাবেথ বা ভিক্টোরিয়া ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে, নইলে তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা পাওয়ার কোনো পথ ছিলো না। পুরুষতান্ত্র নারীর বিরুদ্ধে তোলে যে-সব অভিযোগ, মিল সেগুলোর উত্তর দিয়েছেন এক-এক করে, এবং দেখিয়েছেন সব অভিযোগই বানানো; সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। নারীর মেধা কম নয়, শক্তিও কম নয়; নারী কোনো কিছুতেই নিকৃষ্ট নয় পুরুষের থেকে; নারী পুরুষের সমান। তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার পরিপূর্ণ সাম্য। স্টুয়ার্ট মিল নারীপুরুষের সাম্য চেয়েছেন শুধু নারীর কল্যাণের জন্যে নয়, চেয়েছেন মানবজাতি ও সভ্যতার কল্যাণের জন্যে। মিলের বইটিকে সে-সময়ের নারীবাদীরা নিজেদের পবিত্র বই হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন; এবং তাঁর বিভিন্ন যুক্তি গত একশতকের বেশি সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে বই থেকে বইয়ে। নারীর মুক্তিতে মিল ও নারী-অধীনতার ভূমিকা অশেষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নারীর শত্রুমিত্ৰ)
রবীন্দ্রনাথ, রুশো-রাসকিনের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ওই দুজন, ও আরো অনেককে, দিয়ে। রোম্যানটিক ছিলেন তিনি, এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্ৰেম, কবিতা, সমাজ, সংসার, রাজনীতি, জীবন, এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোম্যানটিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে-সবের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য। রুশো ও রাসকিনের নারীবিষয়ক লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন তিনি, বোঝা যায়; নারী সম্পর্কে তাঁর অনেক উক্তিই রুশো-রাসকিনের প্রতিধ্বনি। মিলের সাথেও পরিচিত ছিলেন, যদিও মিলের সাথে তাঁর মিল ছিলো না; তাঁর মিল ছিলো টেনিসনের সাথে, এবং ‘প্রিন্সেস’-এর নারীবিষয়ক ধারণা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদায়। তার নারীধারণা রোম্যানটিক; বাস্তব নারী তিনি দেখেছেন, তবে অনেক বেশি দেখেছেন স্বপ্নের নারী। রোম্যানটিকের চোখে নারীমাত্রই তরুণী, রূপসী, মানসসুন্দরী, দেবী; আর তারা নিজেরা দেবতা। তারা অবাস্তব নারীর উপাসক, তারা জন্মজন্মান্তর ধ’রে স্তব ক’রে যেতে পারে লোকোত্তর নারীর; তবে বাস্তবে নারী তাদের কাছে গৃহিণী, সুন্দর করে যাকে বলা হতো ‘গৃহলক্ষ্মী’। রোম্যানটিকেরা অহমিকায় ছাড়িযে যায় বিধাতাকেও, তারা মানসসুন্দরীর স্তব করলেও নিজেদের দেখে নারীর স্রষ্টারূপে। রবীন্দ্রনাথও তাই দেখেছেন। রবীন্দ্ৰনাথ অপরূপ রূপসী নারীর স্তবগান করেছেন, কিন্তু নারীর বাস্তব অস্তিত্বও অনেক সময় স্বীকার করেন নি। রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখতে পছন্দ করতেন। স্বপ্নে ও ঘরে, নারী স্বপ্নে থাকবে নইলে থাকবে ঘরে; বাস্তবের অন্য কোথাও থাকবে না। দুই বোন (১৩৩৯) উপন্যাসের শুরুতে তিনি মন্তব্য কবেছেন, ‘মেয়েরা দুই জাতের, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্ৰধানত মা, আর-এক জাত প্রিয়া।‘ কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এটা তার শোনার দরকার ছিলো না, এটা তাঁর নিজেরই কথা; একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি একথা প্রমাণ করার জন্যেই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন না নারীমুক্তিতে, যদিও তার কোনো কোনো পংক্তি নারীবাদের ইশতেহারের মতো শোনায়; তিনি বিশ্বাসী ছিলেন পুরুষতন্ত্রে ও পুরুষাধিপতো। ভিক্টোরীয় ঘরেবাইরে তত্ত্বে তাঁর আস্থা ছিলো দৃঢ়, এ-নামে একটি উপন্যাস লিখে তিনি তা দেখিয়েছেন; এবং নারীপ্রকৃতি ব’লে পুরুষতন্ত্র যে-উপকথা তৈরি করেছিলো, তিনি ছিলেন তাতে অন্ধ বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথের নারীধারণা রুশো-রাসকিন-টেনিসনের নারীধারণারই বাঙালি রূপ; তাদের মতই তিনি ভিন্ন ভাষায় কিছুটা ভারতীয় ভাবাবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন না নারীর, ছিলেন নারীর প্রতিপক্ষের এক বড়ো সেনাপতি । তিনি চেয়েছিলেন নারীরা কবিতা পড়বে, আর হবে তাঁর মতো কবির একান্ত অনুরাগিনী ।
নারী সম্পর্কে তিনি লিখেছেন প্রচুর; কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্ৰবন্ধ, ভাষণ, ভ্ৰমণকাহিনীতে বারবার তিনি কথা বলেছেন নারী সম্পর্কে–বাঙালি, ভারতি, বিদেশি, এবং সনাতনী, শাশ্বতী, চিরন্তনী, কল্যাণী সম্পর্কে। তাঁর কথা ধাধায় ভরা, অনেক সময় কথা বলার জন্যেই কথা বলা! ঘুরিয়েপেঁচিয়ে সুন্দর কথা অনেক বলেছেন, যা প্রথম মনে হয় চমৎকার; কিন্তু একটু ভাবলেই ধরা পড়ে যে নারীকে তিনি মনে করেন অসম্পূর্ণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের চোখে পুরুষের বিকাশ ঘটেছে, বিবর্তন ঘটেছে সব কিছুর; শুধু বিকাশবিবর্তন ঘটে নি নারীর; এবং তিনি চান নারীর কোনো বিকাশ না ঘটুক, নারী থেকে যাক আদিমতম বা চিরন্তনী। পুরুষ মহাজগত পেরিয়ে চলে যাক, কিন্তু নারী থাকুক ঘরের কোণে কল্যাণী হয়ে। পুরোনো ভারতের ঋষিদের মতো আধুনিক ভারতের এ-ঋষি কুৎসা রটান নি নারীর নামে, বরং প্রতিবাদ করেছেন ওই সব আশীল কুৎসার; তবে পুরোনো ঋষিরা নারীদের যেখানে ও যে-ভূমিকায় দেখতে পছন্দ করতো, তিনিও পছন্দ করতেন তাই। বাস্তব নারী তাঁর চোখে গৃহিণী, আর অবাস্তব নারী মানসসুন্দরী, এমনকি জীবনদেবতা। পুরোনো ঋষিদের মানসসুন্দরীর মোহ ছিলো না, তবে রোম্যানটিক রবীন্দ্রনাথের সে-মোহ ছিলো প্ৰবল; ওই মোহটুকু বাদ দিলে নারী হচ্ছে গৃহিণী : জায়া ও জননী। নারী যে খাচায় বন্দী, এটা তাঁর চোখে পড়েছে; তবে তিনি খাঁচার রূপেই মুগ্ধ হয়েছেন, মনে করেছেন নারী আছে ‘যেন সোনার খাঁচায়’। নারী যে শেকলে বন্দী, তাও তার চোখে পড়েছে; তবে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন শেকলের রূপেই, মনে করেছেন শেকলটি সোনার। নারী যখন বন্দী, রবীন্দ্রনাথের চোখে নারী তখন ‘কল্যাণী’! রবীন্দ্রনাথের নারীধারণার বিবর্তন পরে আলোচনা করবো; শুরুতে তাঁর দুটি কবিতা পড়ে নিতে চাই, কেননা ওই কবিতা দুটিতে প্ৰকাশ পেয়েছে তাঁর নারীধারণার সম্পূর্ণ রূপ : নারীর বাস্তবতা ও অবাস্তবতা। সোনার তরী (১৩০০) কাব্যে আছে একটি কবিতা, যার নাম ‘সোনার বাঁধন’ (১২৯৯) :
বন্দী হয়ে আছো তুমি সুমধুর স্নেহে
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণ ক্ৰন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কন দুটি বহিতে্যুছ দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়নানন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজ
বহ্নিবাণ বীজসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্ৰেম-করুণার মাঝে
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখানি।
ভিক্টোরীয় ইংরেজ, বা উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাঙালি ভদ্রলোক গৃহিণীকে যেভাবে আদর্শায়িত ক’রে সুখ পেতো, এতে রূপায়িত হয়েছে সে-ছবিটিই। এর সাথে বাস্তবের মিল নেই। ভদ্রলোক বাঙালির চোখে যা ‘গৃহলক্ষ্মী’, ভিক্টোরীয়দের চোখে তা ‘অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’, দুটিই সুভাষণ। কবিতাটি বাস্তবভাবে পড়লে বোঝা যায় যে একটি স্বাধীন দেবীকে বন্দী করা হয়েছে বা বেঁধে ফেলা হয়েছে, বাঁধনটি অবশ্য সোনার। বন্দী ওই দেবীর কোনো দুঃখ আছে কিনা, তাতে কবির উৎসাহ নেই; তাকে যে বন্দী করা গেছে, এটাই বেশ স্বস্তিকর। এতে স্তব করা হচ্ছে শেকলটিরই। নারী বন্দী, বন্দীত্বই তার সুখ। পুরুষ স্বাধীন বীর, সব সময় সংগ্ৰাম ক’রে চলছে; পুরুষ এতোই বীর যে সে বন্ধনহীন দেবীকেও বেঁধে ফেলেছে। এখন দেবীর কাজ শুধু ‘শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন’। যদি ওই শুভকর্ম ও নিশিদিন সেবার একটি তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে দেবী আর দেবী থাকে না, হয়ে ওঠে গৃহপরিচারিকা। ওই দেবী ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে যায়, বাসন মাজে, স্বামীর খাবার তৈরি করে, শাশুড়ীর তিরষ্কার শোনে, স্বামীর জামার বোতাম শেলাই করে, বছরে বছরে নোংরা আঁতুড়ঘরে বাচ্চা বিয়োয়, বিয়োতে গিয়ে মারা যায় অনেকেই, আর যারা বেঁচে থাকে তাদের আর যা-ই থাক, রূপ নামের কিছু থাকে না, যা টানতে পারে কোনো রোম্যানটিক কবিকে বা মাংসাশী স্বামীকে। তখন পুরুষ পুরোনো দেবীকে ছেড়ে নতুন দেবী খোঁজে। রবীন্দ্রনাথ যখন গৃহিণীর দিকে তাকিয়েছেন, তখন তাকিয়েছেন রোম্যানটিকের চোখে, তাকে আদর্শায়িত করেছেন, যদিও তিনি নিজের ঘরেও আমন কোনো দেবী দেখেন নি। তবে তিনি চান বাস্তবে নারী হবে গৃহিণী। রোম্যানটিকের চোখে নারীর আরেক রূপ মানসী, তিন বছর পরে লেখা ‘মানসী’ (১৩০২) কবিতায় যার পরিচয় পাওয়া যায় :
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দৰ্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না–
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্ৰাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা–
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।।
এ-কবিতায় পুরুষ নারীর দ্বিতীয় বিধাতা, যে অনেক শক্তিশালী প্রথম বিধাতার থেকে। প্রথমটি নারীকে সৃষ্টি করেছে, আর দ্বিতীয়টি সৃষ্টির নামে বন্দী করেছে নারীকে। কবিতাটিতে পুরুষ সক্রিয় : পুরুষ স্রষ্টা, স্থপতি, ভাস্কর, কবি, শিল্পী; নারী নিষ্ক্রিয় : নারী পুরুষের তৈরি মূর্তি; আর সম্ভোগসামগ্ৰী। কবিতাটিতে নারীর বাস্তব অস্তিত্বকেই অনেকটা অস্বীকার করা হয়েছে; নারী ‘অর্ধেক মানবী’, বা অর্ধেক বাস্তব; তার ‘অর্ধেক কল্পনা’ বা অর্ধেক অবাস্তব। এটি নারীর রোম্যানটিক স্টেরিওটাইপ। পুরুষের চোখে যদি নারী অর্ধেক কল্পনা হয়, তবে নারীর চোখেও পুরুষ অর্ধেক কল্পনা হওয়ার কথা; এবং পুরুষও তথাকথিত একলা বিধাতার সৃষ্টি নয়, নারীরও সৃষ্টি। তবে এ-কবিতায় বলা হয়েছে যে-নারীর কথা, সে সম্পূর্ণ কল্পনা; যার বাস পুরুষের ক্ষণায়ু উন্মাদনার মধ্যে। ওই মানসী যদি কবি বা পুরুষের স্ত্রী হয়, তবে দেখা যাবে মানসসুন্দরী মাছ কুটিছে রান্নাঘরে, বোতাম শেলাই করছে, আর অস্বাস্থ্যকর আঁতুড়ঘরে প্রসব ক’রে চলেছে বাচ্চাকাচ্চা! কবিতা হিশেবে চমৎকার এটি, তবে এটিতে প্রবলভাবে প্ৰকাশ পেয়েছে পুরুষতন্ত্র ও পুরুষাধিপত্যের অহমিকা। পুরুষ নারীকে সৃষ্টি করার নামে যে বন্দী করেছে, তাকে লজ্জা-সজা-আবরণ দিয়ে যে ঘরের মাঝে আটকে ফেলেছে, এটা চোখে পড়ে নি পড়ে নি রোম্যানটিকের।
রবীন্দ্ৰনাথ নারী সম্পর্কে গদ্যে প্রথম কথা বলেন বিলেতে গিয়ে [১৮৭৮-১৮৮০] ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’-এ (১৮৮১)। একটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্ত সমাজে গিয়ে সতেরো-আঠারো বছরের এক নারীসঙ্গকাতর রোম্যানটিক তরুণ উচ্ছসিত হয়ে পড়েন তরুণীদের দেখে, তাদের সংস্পর্শে এসে, তাদের সাথে হাতে হাত ধ’রে গালে গাল লাগিয়ে নেচে। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র ছেয়ে আছে নারী আর নাচের বিবরণে। তাঁর বিবরণে পাওয়া যায় উচ্চবিত্ত বিলেতি সমাজের যে-নারীদের, তারা ‘রাসকিনের মেয়ে’ বা ‘রানীর বাগানের পদ্ম’, যারা আপাদমস্তক অপদাৰ্থ : তারা নাচ, গান, ফ্লার্ট করা ছাড়া আর কিছু জানে না। বিলেতে গিয়েই তিনি তাদের সাথে মিশে যেতে পারেন নি, তাদের দেখেছেন দূর থেকে, এবং খুঁত খুঁজেছেন তাদের; তবে তাদের কাছাকাছি আসার পর উচ্ছসিত হয়েছেন। তাদের অন্তঃসারশূন্যতা তাঁর চোখে পড়েছে বিলেতে যাওয়ার সাথে সাথেই; ‘মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে…মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে থাকে, তুমি নাচে গিয়েছিলে কি না, কনসার্ট কেমন লাগল, থিয়েটারে একজন নূতন অ্যাকটর এসেছে, কাল অমুকু জায়গায় ব্যাণ্ড হবে ইত্যাদি (রবীন্দ্র-রচনাবলী:১, ৫৪২)। এ-বৰ্ণনায় রয়েছে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের জন্যে গৌরবজনক নারীবিদ্বেষ, যখন নারীবিদ্বেষই ছিলো অনেকটা বুদ্ধিজীবিতার লক্ষণ। সতেরো-আঠারো বছরের তুলনায় একটু বেশি পাকাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তবে তিনি ধ’রে নিয়েছিলেন যে নারীমাত্রই লঘু, যারা বেশভূষা, নাচ, অ্যাকটর প্রভৃতির ওপরে উঠতে পারে না। ভিক্টোরীয় সমাজ যে নারীদের তৈরি করেছে ওভাবেই, সেটা তার চোখে পড়ে নি। ওই নারীদের প্রাত্যহিক জীবন কর্মহীন প্রমোদের : ‘এ দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজায়, গান গায়, আগুনের ধারে আগুন পোহায়, সোফায় ঠেসান দিয়ে নভেল পড়ে, ভিজিটরদের সঙ্গে আলাপচারি করে ও আবশ্যক বা অনাবশ্যক মতে যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে’ (রর : ১, ৫৪২)। রবীন্দ্ৰনাথ ‘এ দেশের মেয়ে’ যাদের বলেছেন, তারা উচ্চবিত্ত অপদাৰ্থ নারী, সাধারণ নারীদের সাথে তাদের কোনো মিল নেই। এ-অকর্মী নারীদের তিনি সমালোচনা করেছেন, এমনকি যে-মেয়েরা বিয়ে না করে কিছু একটা করছে, তাদের কাজেরও বিদ্রুপ করেছেন : ‘এ দেশের চির-আইবুড়ো মেয়েরা কাজের লোক। টেমপারেন্স মীটিং, ওয়ার্কি মেনস সোসাইটি প্রভৃতি যতপ্রকার অনুষ্ঠানের কোলাহল আছে, সমুদয়ের মধ্যে তাদের কণ্ঠ আছে’ (রর : ১. ৫৪২)। ওই উচ্চবিত্ত নারীরা ওই সব ছাড়া আর কী করতে পারে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য বিপদে পড়তেন; এবং ওই সব ছাড়া তারা অন্য কিছু করলেও তিনি হয়তো তাদের সমালোচনা করতেন। তিনি ক্রমশ ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন পিয়ানোবাজানো মেয়েদের সাথে, দেখেছেন ‘এক-একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে’ , সুখ পেয়েছেন ‘শত রমণীর রূপের আলোকে গ্যাসের আলো ম্রিয়মাণ’ (রর : ১, ৫৪৪-৫৪৫) দেখে। তখনি তার মনে পড়েছে ‘আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পাই নে’ (রর : ১, ৫৫৫)। নারীদের সাথে মুক্তভাবে মিশতে পাওয়াটা তার নিজের জন্যে, নারীর জন্যে নয়; নারীর সাথে মুক্তভাবে মিশতে পাওয়ার বেশি স্বাধীনতা তিনি নারীর জন্যে চান না।
ভিক্টোরীয় সমাজে মেয়েদের জীবনের লক্ষ্য যে বিয়ে, সেখানে পুরুষই যে সর্বময়, ওই সমাজের সাথে বাঙালি সমাজের পার্থক্য যে গুণের নয় মাত্রার তা চোখে পড়েছে। তাঁর (রর : ১, ৫৭০) :
‘আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্যে প্রস্তুত করে, যথেষ্ট লেখাপড়া শেখায় না, কেননা মেয়েদের আপিসে যেতে হবে না; এখানেও তেমনি মাগ্গি দরে বিকোবার জন্যে মেয়েদের পালিশ করতে থাকে, বিয়ের জন্যে যতটুকু লেখাপড়া দরকার ততটুকু যথেষ্ট। একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা ফরাশি ভাষা বিকৃত উচ্চারণ, একটু বোনা ও সেলাই করা জানলে একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত রঙচঙে পুতুল গড়ে তোলা যায়। এ-বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের ও এ-দেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত মাত্র।…আমাদের দিশি মেয়েদের পিয়ানো ও অন্যান্য টুকিটাকি শেখাবার দরকার করে না, বিলিতি মেয়েদেরও অল্পসল্প লেখাপড়া শিখতে হয়, কিন্তু দুই-ই দোকানে বিক্রি হবার জন্যে তৈরি। এখানেও পুরুষেরাই হৰ্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের অনুগতা; স্ত্রীকে আদেশ করা, স্ত্রীর মনে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমত চালিয়ে বেড়ানো স্বামীরা ঈশ্বর নির্দিষ্ট অধিকার মনে করেন।‘
তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য সমাজ ও নারী দু-ই, তবে মেয়েদের ওপরই আক্রমণটা একটু বেশি; তিনি মনে করেছেন যেনো মেয়েরা নিজেরাই পুতুল হওয়ার জন্যে পাগল। অন্য ধরনের নারীও তিনি দেখেছেন ওই সমাজে; ফ্যাশনী মেয়ে ছাড়া বিলেতে আরো অনেকরকম মেয়ে আছে, নইলে সংসার চলত না। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মেয়েদের অনেকটা মেহনত করতে হয়, বাবুয়ানা করলে চলে না।…এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গিন্নিরা সাদাসিদে। যদিও তারা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি, তবু তারা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার’ (রর : ১, ৫৭০-৫৭১)। তিনি কিছুটা শ্ৰদ্ধাশীল সে-নারীদের প্রতি, যারা ফ্যাশনমত্ত নয়, যারা কমী, মধ্যবিত্ত, যারা আছে ব’লে ‘সংসার চলে’। তবে ওই ফ্যাশনমত্তরাই কিছুদিনের জন্যে তাঁকে ক’রে তুলেছিলো সীমিত নারীস্বাধীনতাবাদী, কেননা ওই স্বাধীনতাটুকু ছাড়া মেয়েদের নাচের আসরে পাওয়া অসম্ভব। মেয়েরা অবাধে নাচের আসরে আসতে না পারলে মেয়েদের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মতো তরুণেরা, যারা গালে গাল ঘষে নাচতে চায়। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে তিনি নারীস্বাধীনতার অর্থাৎ নারীপুরুষের মেলামেশার পক্ষে কিছু মত প্রকাশ করেছিলেন, বাঙালি নারীকে ঘরে আটকে রাখার অপরাধে অভিযুক্ত করেছিলেন পুরুষদের। বলেছিলেন, ‘একজন বুদ্ধি ও হৃদয়বিশিষ্ট মানুষকে জন্তুর মতো, এমন কি তার চেয়ে অধম, একটা জড়পদার্থের মতো সম্পূর্ণরূপে নিজের প্রয়োজনের জিনিষ করে তোলা… এ-সকল যদি পাপ না হয় তবে নরহত্যা করাও পাপ নয়’ [য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র থেকে বর্জিত, উদ্ধৃত অনন্যা (১৩৯৪, ২০)]। এমন কয়েকটি স্ত্রীস্বাধীনতাবাদী অংশ বইটি থেকে বর্জনের সাথে সাথে রবীন্দ্ৰনাথ বর্জন করেছিলেন স্ত্রীস্বাধীনতার ধারণাটিও। রবীন্দ্ৰনাথের ওই স্ত্রীস্বাধীনতায় বিশ্বাস ছিলো বিলেতি তরুণীদের সাথে মেশার ফলে তরুণ রক্তমাংসের ভেতর থেকে বেরোনো অস্থায়ী উচ্ছাস, যা মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে নি। বাঙালি নারীকে অন্তঃপুর থেকে মুক্তি দেয়া সম্পর্কে যে-কয়েক পংক্তি লিখেছিলেন তিনি আঠারো-উনিশ বছর বয়সে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তা বই থেকে মুছে ফেলে তারুণ্যের অশিষ্ট উচ্ছ্বাসের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি দ্বিধা করেন নি।
এর পর দু-বছরের মধ্যেই রবীন্দ্ৰনাথ নিজে হন স্বামী (৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩), এবং এক দশক কাটার আগেই হয়ে ওঠেন নারীমুক্তিবিরোধী, সম্ভবত তখন তার তরুণীদের সাথে মেলামেশার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে। পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে তিনি আয়ত্ত করে ফেলেন নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় ও ভারতীয় দর্শন : প্ৰবক্তা হয়ে ওঠেন ‘ঘরেবাইরেতত্ত্বের’, ‘প্রকৃতিতত্ত্বের’, ‘নারীপুরুষের অসাম্যতত্ত্বের’, ‘পরিপূরকতত্ত্বের’ এবং আপন ক’রে নেন পুরুষতন্ত্রের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা। এর পরিচয় প্রথম ধরা পড়ে ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (১২৯৬, রব : ১২, ৪৫০-৪৫৫) নামের পত্রপ্রবন্ধে। মহারাষ্ট্র নারীবাদী রমাবাই নারীমুক্তি সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন পুনায় (জ্যৈষ্ঠ ১২৯৬), তবে শেষ করতে পারেন নি বক্তৃতাটি; পুরুষাধিপত্যবাদীদের প্রচণ্ড উৎপাতে তিনি স্থগিত করতে বাধ্য হন তাঁর বক্তৃতা। আটাশ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনো উৎপাত করেন নি, তবে ওই বক্তৃতা সম্পর্কে তিনি যে-মত দিয়েছেন তাতে তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদিতা প্ৰকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে। তিনি রুশো-রাসকিন, ভিক্টোরীয় ও সমগ্র পুরুষতন্ত্রের মতো বিশ্বাস করেন যে নারীপুরুষ সমকক্ষ নয়, নারী প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট। একজন চমৎকার ভিক্টোরীয় হিশেবে তিনি নারীদের মধ্যে দেখেছেন শুধু রূপ আর আবেগ, দেখেছেন নারীদের শক্তিহীনতা, প্রতিভাহীনতা, আর এ-সবই তাঁর মতে প্রাকৃতিক। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা সকল বিষয়েই যদি পুরুষের সমকক্ষ, তাহলে পুরুষের প্রতি বিধাতার নিতান্ত অন্যায় অবিচার বলতে হয়।’ তার চোখে নারীপুরুষের অসাম্যই ন্যায়সঙ্গত, আর সাম্য অন্যায়; প্রকৃতি বা বিধাতা এমন অন্যায় করতে পারে না। ভিক্টোরীয়দের মতো তিনি নারীপুরুষকে প্রাকৃতিকভাবেই দুটি বিপরীত ও পরিপূরক জাতির সদস্য ব’লে মনে করেন :
‘আমরা যেমন বলে শ্ৰেষ্ঠ, মেয়েবা তেমনই রূপে শ্রেষ্ঠ; অন্তঃকরণের বিষয়ে আমরা যেমন বুদ্ধিতে শ্ৰেষ্ঠ, মেয়েরা তেমনই হৃদয়ে শ্ৰেষ্ঠ; তাই স্ত্রী পুরুষ দুই জাতি পরস্পর পরস্পরকে অবলম্বন করতে পারছে। স্ত্রীলোকের বুদ্ধি পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অল্প বলে…স্ত্রীশিক্ষা অত্যাবশ্যক এটা প্রমাণ করবার সময় স্ত্রীলোকোব বুদ্ধি পুরুষের ঠিক সমান এ কথা গায়েব জোরে তোলাবার কোনো দরকার নেই।‘
রুশো-রাসকিন-টেনিসন ও সমগ্র পুরুষতন্ত্র এখানে কথা বলছে রবীন্দ্রনাথের মুখে। তাঁর কিছু বিশ্বাস বেশ ভয়ঙ্কর, যেমন বিশ্বাস করেন তিনি প্রাকৃতিক ও সামাজিক অসাম্যে। তিনি বিশ্বাস করেন পরস্পরকে অবলম্বন করতে হ’লে সমান হ’লে চলে না, হতে হয় অসম; এটা শুধু পারিবারিকভাবেই ভয়ঙ্কর তত্ত্ব নয়, সামাজিকভাবেও ভয়ঙ্কর। পুরুষের বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠতা সম্পর্কে তিনি এতো নিশ্চিত যে সে-সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি রুষ্ট হন। তিনি বিশ্বাস করেন একটি বানানো উপকথায় যে নারী বুদ্ধিতে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট: এবং ঘোষণা করেন ‘মেয়েরা কখনোই পুরুষদের সঙ্গে (কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে) বুদ্ধিতে সমকক্ষ হবে না।’ পুরুষাধিপত্যবাদীরা বারবার যুক্তি দেয় নারীর প্রতিভা নেই, পৃথিবীতে কোনো বড়ো নারীপ্রতিভা জন্মে নি, মিল যা খণ্ডন করেছেন নারী-অধীনতায় (১৮৬৯); কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯-এ পেশ করেছেন পুরুষাধিপত্যবাদীদের পুরোনো যুক্তি আর উদাহরণ :
‘মেয়েব এতদিন যেরকম শিক্ষা পেয়েছে তাই যথেষ্ট ছিল …শ্ৰীজাতির মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কবির আবির্ভাব এখনো হয় নি। মনে ক’রে দেখো, বহুদিন থেকে যত বেশি মেয়ে সংগীতবিদ্যা শিখছে এত পুরুষ শেখে নি। য়ুরোপে অনেক মেয়েই সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পিয়ানো ঠং ঠাং এবং ডোরেমিফা চেঁচিয়ে মরছে, কিন্তু তাদের মধ্যে ক’টা, Mozart কিংবা Beethoven জন্মাল।‘
পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছেন ব’লেই তিনি বলতে পেরেছেন মেয়ের যে-শিক্ষা পেয়েছে, তাই যথেষ্ট। মেয়েদের যে-শিক্ষা দেয়া হয়েছে এতোদিন, তা কোনো শিক্ষাই নয়; তা পুরোপুরি অশিক্ষা। ওই অশিক্ষার মধ্যে থেকে যে কারো পক্ষে ভিঞ্চি, দান্তে বা বিটোফেন হওয়া সম্ভব নয়, তা রবীন্দ্রনাথ, একজন প্রবল পুরুষাধিপত্যবাদী, মানেন নি; এও তাঁর মনে পড়ে নি যে পৃথিবীতে মোৎসার্ট-বিটোফেন দুটির বেশি জন্মে নি—পুরুষমাত্ৰই একেকটি সম্ভাব্য মোৎসার্ট বা নিউটন বা রবীন্দ্রনাথ নয়; এবং রুশোর মতো বলেছেন, ‘প্ৰতিভা একটা শক্তি (ঋভণবথহ), তাতে অনেক বল আবশ্যক, তাতে শরীর ক্ষয় করে। তাই মেয়েদের একরকম গ্ৰহণশক্তি ধারণাশক্তি আছে, কিন্তু সৃজনশক্তির বল নেই’, বা ‘মেয়েদের একরকম চটপটে বুদ্ধি আছে, কিন্তু সাধারণত পুরুষদের মতো বলিষ্ঠ বুদ্ধি নেই।’ উগ্র পুরুষাধিপত্যবাদী রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছেন, ‘মেয়েরা হাজার পড়াশুনো করুক, এই কার্যক্ষেত্রে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে নাবতে পারবে না।’ মেয়েদের পড়াশুনোয় তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই, বা তিনি মনে করেন মেয়েদের পড়াশুনো বিশেষ কাজে লাগে না; তবে তার আপত্তি ‘কার্যক্ষেত্ৰ’ দখলে। পুরুষ যে-সমস্ত পেশা দখল ক’রে রেখেছে, সেগুলোতে নারী ঢুকুক তা তিনি চান না; নারী যদি নিষেধ না শুনে সেখানে ঢুকে পড়ে তাহলে তিনি চান তার ব্যর্থতা।
নারীপুরুষের অসাম্যকে শাশ্বত করার জন্যে এর পর তিনি সাহায্য নিয়েছেন। রুশো-রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের প্রকৃতিতত্ত্বে। সুবিধা ও আধিপত্যবাদীরা, এবং পুরুষতন্ত্র প্রকৃতিকে চিরকাল ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথও নারীদের ঘরে আটকে রাখার জন্যে দোহাই দিয়েছেন প্রকৃতির, যদিও প্রকৃতি নয় সমাজের চক্রান্তেই নারীরা বন্দী হয়ে আছে ঘরে। প্রকৃতির কণ্ঠস্বর শুনে তিনি তা বাঙলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন এভাবে :
‘যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাহিরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সে-রকম অভিপ্ৰায় না হত তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাত। যদি বল, পুরুষদের অত্যাচারে মেয়েদের এই দুর্বল অবস্থা হয়েছে, সে কোনো কাজেরই কথা নয়।‘
প্রকৃতির স্বর শোনা প্রথাবাদীদের স্বভাব, কেননা তাতে যুক্তি ও সত্যের বদলে উপস্থিত করা যায় অলৌকিক শক্তিকে, এবং সব কিছু চাপিয়ে দেয়া যায় শোষিতদের ওপর। প্রকৃতি স্থির ক’রে দিয়েছে যে মানুষ স্বামীস্ত্রী হবে, সংসার করবে, সমাজ বানাবে, রাষ্ট্র তৈরি করবে, একদল শোষণ করবে। আরেকদল শোষিত হবে, এটা খুবই হাস্যকর ও সুবিধাবাদী বিশ্বাস; রবীন্দ্রনাথ প্রথা-ও সুবিধা-বাদীদের মতো দোহাই দিয়েছেন প্রকৃতিরই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন নারীদের থাকতে হবে ঘরে, আর জীবনধারণের জন্যে নির্ভর করতে হবে পুরুষের ওপর : ‘যখন শারীরিক দুর্বলতা এবং অলঙঘনীয় অবস্থাভেদে মেয়েদের সেই গৃহের মধ্যে থাকতেই হবে তখন কাজে- কাজেই প্রাণধারণের জন্যে পুরুষদের প্রতি তাদের নির্ভর করতেই হবে।’ মেয়েরা যে ঘরের ভেতরে থাকে, এটাও এক উপকথা। সুবিধাভোগী শ্রেণীর নারীরাই ঘরে বন্দী থাকে, পুরুষকে সেবা ও দেহ দিয়ে ব্যবস্থা করে নিজেদের জীবিকার; কিন্তু অধিকাংশ নারী কাজ করে ঘরে ও বাইরে, যদিও তাদের বাইরের কাজ স্বীকৃতি পায় না, আর মূল্য পায় না ঘরের কাজ। রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত উচ্চবর্ণের নারীদের সম্পর্কেই, এবং প্রকৃতির দোহাই দিযে তাদেরই আটকে রাখতে চান ঘরে। নিম্নশ্রেণীর নারীরা নরকে যাক, সেটা তাঁর ভাবনার ব্যাপার নয়। নারীর দুরবস্থা যে পুরুষতন্ত্রেরই চক্রান্তের ফল, একথার প্রতিবাদ করেছেন তিনি সমস্ত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে।
রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির আন্দোলনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে তাকে বলেছেন ‘কোলাহল’, এবং নারী-অধীনতাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন এমন কথা, যা শুধু নারীমুক্তির বিরুদ্ধেই যায় না, যায় মানুষের সব রকমের মুক্তির বিরুদ্ধেই :
‘আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল উঠেছে, সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়। পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত; তাতে এই হত যে, চরিত্রের ওপর অধীনতার কুফল ফলতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমন-কি অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদন করত। প্ৰভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তা হলে ভূত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না।‘
এর অর্থ হচ্ছে অধীনতা মেনে নেয়াই মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্ব; অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ বা বিদ্রোহ অন্যায়। এ-ধরনের বিশ্বাস অত্যন্ত ভয়ঙ্কর; এমন প্রতিক্রিয়াশীলতার উদ্দেশ্য সব রকমের শোষণকে তরল আধ্যাত্মিকতা দিয়ে গ্রহণযোগ্য ক’রে তোলা। নারী আন্দোলন তাঁর কাছে অমঙ্গলজনক, তা হ’তে পারে; কিন্তু তা মঙ্গলজনক নারীদের ও অধিকাংশ মানুষের জন্যে, যারা বিশ্বাস করে সাম্যে। নারী-আন্দোলন অসংগত হবে কেনো? তার বিশ্বাস পরাধীন থাকাই সঙ্গত; এ-ধরনের বিশ্বাসের সীমা বাড়িয়ে দিলে দাঁড়ায় যে রাজনীতিক স্বাধীনতা চাওয়াও অসঙ্গত, যা সব সময়ই বলে সাম্রাজ্যবাদীরা। ‘পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত’ বলে যে-সত্যে তিনি বিশ্বাস করেন, তাও সত্য নয়। মেয়েরা পুরুষাধীনতাকে ধর্ম মনে করতো না, পুরুষেরাই ওটাকে ধর্ম বলে চাপিয়ে দিয়েছিলো নারীদের ওপর, যেমন বৰ্ণভেদকেও ধর্ম বলে চাপিয়ে দিয়েছে শক্তিমানেরা। প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে খুব বিশ্ৰী যুক্তি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ : তাঁর মতে অধীনতা মেনে নিলে চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদিত হয়! এর অর্থ হচ্ছে খাঁটি দাসের চরিত্রই মহত্ত্বসম্পন্ন, বিদ্রোহী দাসেরা মহত্ত্বহীন। ভৃত্যের চরিত্রের মহত্ত্ব রক্ষার উপায় হচ্ছে জন্মজন্মান্তর ধ’রে ভূত্য থাকা! রবীন্দ্রনাথ, যাকে মনে করা হয় নিজের সময়ের থেকে অনেক অগ্রসর, পিছিয়ে ছিলেন নিজের সময়ের থেকে হাজার বছর।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস কিছু মানুষ জন্মে প্ৰভু হয়ে, আর কিছু মানুষ জন্মে দাস হয়ে; তাই তিনি মনে করেন, ‘কতকগুলি অবশ্যম্ভাবী অধীনতা মানুষকে সহ্য করতেই হয়।’ নারীর পুরুষাধীনতা, তার মতে, অবশ্যম্ভাবী, নারীকে তা সহ্য করতেই হবে; শুধু তা-ই নয়, পুরুষাধীনতাই নারীর জন্যে ধর্ম। পুরুষতন্ত্রের অবিচল অনুসারী। রবীন্দ্রনাথ স্বামীকে দেখেন নারীর দেবতারূপে, যাকে ভক্তি করা নারীর জন্যে ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের চোখে পরিবার, সামাজিক সংস্থা নয়, দেবমন্দির, যার অধিষ্ঠিত দেবতার নাম স্বামী; স্ত্রী তার, জন্মজন্মান্তরের, ভক্ত :
‘পতিভক্তি বাস্তবিকই স্ত্রীলোকের পক্ষে ধর্ম। আজকাল একরকম নিষ্ফল ঔদ্ধত্য ও অগভীর ভ্ৰান্ত শিক্ষার ফলে সেটা চলে গিয়ে সংসারের সামঞ্জস্য নষ্ট করে দিচ্ছে এবং স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই আন্তরিক অসুখ জন্মিয়ে দিচ্ছে। কর্তব্যের অনুরোধে যে-স্ত্রী স্বামীর প্রতি একান্ত নির্ভর করে সে তো স্বামীর অধীন নয়, সে কর্তব্যের অধীন।‘
ধর্ম যে বড়ো প্রতারণা ও পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা, তা মনে জাগার কথা নয় প্রথা ও পুরুষাধিপত্যবাদী রবীন্দ্রনাথের; তিনি বরং দাসত্বকেই মহিমান্বিত করেছেন ধর্মরূপে। স্বামীস্ত্রী মিলে গ’ড়ে তোলে একটি সামাজিক সংস্থা-পরিবার, তাতে ভক্তির কথা ওঠে না; তবে পুরুষ নারীকে দাসী ক’রেই স্বস্তি পায় নি, নিজেকে দেবতার স্তরে উঠিয়ে স্ত্রীর আনুগত্যকে ক’রে তুলেছে ঐশ্বরিক। শুধু আনুগত্যে নিশ্চিন্ত বোধ করেন না রবীন্দ্রনাথ, তিনি চান নিশ্চিত ভক্তি, কেননা ভক্তি হচ্ছে আত্মসমর্পণের বা সত্তাবিলোপের চূড়ান্তরূপ। ‘পতিভক্তি’র মতো একটি মধ্যযুগীয় ধারণা ও শব্দ যে তিনি ব্যবহার করেছেন, তা আমাদের খুব বিস্মিত করে। স্বামীর অধীনতাকে তিনি বিধিবদ্ধ করতে চেয়েছেন আধ্যাত্মিক ও ইহজাগতিক দু-রকম যুক্তি দিয়েই : স্বামীর অধীনে থাকা নারীর জন্যে একদিকে আধ্যাত্মিক ধর্ম, আরেক দিকে ইহজাগতিক কর্তব্য! দু-ধরনের শিকলেই নারীকে বেঁধেছেন তিনি। মনে রাখা দরকার যে এ-রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধ নন, ঐর বয়স উনত্রিশ! সংসারের সামঞ্জস্য নষ্ট হওয়ার জন্যে তিনি দোষী করেছেন। আজকালকার ‘একরকম নিম্বফল ঔদ্ধত্য ও অগভীর ভ্রান্ত শিক্ষা’কে। রবীন্দ্ৰনাথ যাকে ‘নিস্ফল ঔদ্ধত্য’ বলেছেন, তা ঔদ্ধত্য নয়, অধিকার দাবি, এবং গত একশো বছরে প্রমাণিত হয়েছে যে তা নিস্ফল নয়, বেশ সফল। তিনি যাকে ‘অগভীর ভ্রান্ত শিক্ষা’ বলেছেন, তাও অগভীর নয়, ভ্রান্ত তো নয়ই, তা-ই প্রকৃত শিক্ষা; আর রবীন্দ্রনাথ নারীর জন্যে যে-শিক্ষার কথা ভেবেছেন, তার গভীরতা- অগভীরতার কথাই ওঠে না, কেননা তা আসলে কোনো শিক্ষাই নয়।
স্বামীকে যিনি মনে করেন নারীর দেবতা, তিনি যে অবধারিতভাবে হবেন নারীমুক্তির বিরোধী, এটা আগে থেকেই ধ’রে নিতে পারি; আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাই। তিনি নারীমুক্তির বিরোধী হয়ে ওঠেন বিলেত থেকে ফেরার পরপরই; তাই তিনি মেনে নিতে পারেন নি নারীমুক্তি-আন্দোলনকারীদের। নারীদের আধুনিক শিক্ষা দেয়ারও তিনি ছিলেন বিরুদ্ধে। রবীন্দ্ৰনাথ জীবনে নানা ধরনের প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করেছেন, তারা সবাই যে তাঁর সত্যিকার প্রতিপক্ষ ছিলো, এমন নয়; অনেক সময় তিনি নিজেই ছিলেন প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষের সাথে রবীন্দ্রনাথের লড়াইয়ের রীতি হচ্ছে তিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন, তারপর উপহাস আর ব্যঙ্গ করেন। যদিও নারীমুক্তি-আন্দোলনকারীরা তার সাথে কোনো লড়াইয়ে লিপ্ত হন নি, তবুও তিনিই এগিয়ে গিয়ে লড়াইয়ে নামেন তাদের সাথে; এবং উপচে পড়ে তাঁর উগ্র পুরুষতান্ত্রিক ঘেন্না :
‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগতই নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষেব আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতা প্রাপ্ত হচ্ছে; অথচ সে-বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই।‘
তাঁর অবজ্ঞা আর ঘেন্না দেখে মনে হয় তিনি কোনো আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন শেষ খড়কুটো। তাঁর সংবেদনশীলতার অভাবও শোচনীয়; নারীমুক্তির দাবি তাঁর কাছে উপহাসের ব্যাপার- ‘নাকী সুরে’ বিলাপ। মনে হচ্ছে আদি-মধ্য-আধুনিক সমস্ত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি ঠেকাবেন নারীমুক্তি। তিনি ধ’রে নিয়েছেন নারীদের মুক্তি কখনো ঘটবে না, বা নারীদের মুক্তি ঘটা অনুচিত ও ক্ষতিকর। তিনি যাকে বলেছেন ‘স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন’, তা প্ৰভু ও এক বা একাধিক দাসীর বন্ধন, যাতে বাঁধা নারী। তিনি ওই বন্ধনের হীনতাপ্ৰাপ্তির ভয়ে উদ্বিগ্ন, যদিও সত্য হচ্ছে আন্তরিকভাবে ওই বন্ধন কখনোই উন্নত ছিলো না। নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে ভুলও বুঝেছেন রবীন্দ্রনাথ; তিনি মনে করেছেন নারীমুক্তির অর্থ হচ্ছে নারীরা বিয়ে করবে না। এমন একটা ভয় অবশ্য ছিলো ভিক্টোরীয়দের মনে; তারা মনে করতো নারী যদি মুক্তি পায়, পুরুষের পেশা অধিকার করে, সমান হয়ে ওঠে পুরুষের, তবে তারা বিয়ে করতেই অস্বীকার করবে। এটাও নারী সম্পর্কে পুরুষের ভুল ধারণার ফল : পুরুষ নিজের কামকেই প্রধান ক’রে দেখে দমিয়ে রেখেছে নারীর কাম, মনে করেছে কাম নারীর জন্যে খুবই গৌণ ব্যাপার, ওটা না হ’লেও চলে নারীর। তাই নারী যদি স্বায়ত্তশাসিত হয়, তবে নারীর বিয়ের কোনো দরকার পড়বে না; তখন পুরুষ তার মহৎ কামের অগ্নিতে জ্বলবে একলা। নারী মুক্তি চেয়েছে পুরুষের অধীনতা থেকে, বিয়ে থেকে নয়; তবে বিয়ে যে করতেই হবে, মাংসকে সুখী করার জন্যে বিয়েই যে বিকল্পহীন উপায়, তাও নয়। বিয়ে একটি প্রথা।
তিনি ভিক্টোরীয়দের মতো প্রকৃতির দোহাই দেন বারবার, ঘোষণা করেন প্রকৃতির বিধান বা নারীর নিয়তি হচ্ছে পুরুষাধীনতা :
‘নানা দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, সংসারের কল্যাণ অব্যাহত রেখে স্ত্রীলোক কখনো পুরুষের আশ্রয় ত্যাগ করতে পারে না। প্রকৃতি এই স্ত্রীলোকের অধীনতা কেবল তাদের ধর্মবুদ্ধির উপরে রেখে দিয়েছেন তা নয়, নানা উপায়ে এমনই আটঘটি বেঁধে দিয়েছেন যে, সহজে তার থেকে নিস্কৃতি নেই। অবশ্য পৃথিবীতে এমন অনেক মেয়ে আছে পুরুষের আশ্রয় যাদের আবশ্যক করে না, কিন্তু তাদের জন্যে সমস্ত মেয়ে-সাধাবণের ক্ষতি করা যায় না।‘
নারীকে পুরুষের অধীনে থাকতে হবে ‘সংসারের কল্যাণ অব্যাহত’ রাখার জন্যে, ও নারীর বিবেকের আদেশে; তবে নির্বোধ নারী সংসার কল্যাণেব কথা প্রাজ্ঞ পুরুষের মতো অতোটা ভাবতে নাও পারে, আর বিবেক বা ‘ধর্মবুদ্ধি’ নাও থাকতে পারে তার; তাই রাবীন্দ্রিক প্রকৃতি আগে থেকেই নিয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থা;–পুরুষের অধীনে রাখার জন্যে প্রাকৃতিক শেকলে বেঁধে নারীকে পাঠিয়েছে পুরুষের কারাগারে! প্রকৃতি পুরুষের ধর্মবুদ্ধির ওপর আস্থাশীল, তাই আটঘটি বেঁধে পুরুষকে পাঠায় নি; কিন্তু প্রকৃতি নারীকে বিশ্বাস করে না, প্রকৃতির আস্থা নেই নারীর ধর্মবুদ্ধিতে, তাই নারীকে করেছে দুর্বল, তাকে দিয়েছে প্রতি মাসের বিশ্ৰী ব্যাপার, দিয়েছে নিজের ভেতরে মানুষ জন্মানোর শাস্তি! তাই উদ্ধার নেই নারীর, তাকে মেনে নিতেই হবে পুরুষের অধীনতা! নারীকে থাকতে হবে পুরুষের আশ্রয়ে; রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর জন্যে এটাই লাভজনক, মুক্তি নারীর জন্যে ক্ষতিকর। প্ৰগতিবিরোধী হিন্দু ও ভিক্টোরীয় মানসিকতার মিশ্ররূপ মূর্ত দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। তিনি অবশ্য বলেছেন যে তার মতের সাথে স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতার কোনো বিরোধ নেই; তবে বিরোধ রয়েছে প্ৰচণ্ড, কেননা তিনি ‘স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতা’ বলতে যা বোঝেন, তা শিক্ষাও নয়, স্বাধীনতাও নয়।
রবীন্দ্ৰনাথ আটাশ-উনত্রিশ বছর বয়সে হয়ে ওঠেন চমৎকারভাবে প্ৰগতিবিরোধী। উনত্রিশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিলেতে যান তিনি, তবে তার প্রথম ও দ্বিতীয় বিলেত যাত্রার মধ্যে রয়েছে দু-মেরুর বৈপরীত্য : প্ৰথমবার তিনি গিয়েছিলেন ইউরোপের কাছে শিখতে, দ্বিতীয়বার যান ইউরোপকে শেখাতে, যদিও ইউরোপকে শেখানোর কাজটি করেন তিনি মনে মনে। নিজেকে তিনি গণ্য করেন এক তরুণ ভারতীয় গুরু ব’লে, যিনি ইউরোপ সম্পর্কে তৈরি ক’রে ফেলেছেন বা আহরণ করেছেন এমন এক ভুল দর্শন যে কর্ম-আবিষ্কার-উন্নতি মানুষকে অসুখী করে, আর ইউরোপ যেহেতু ওইসব করছে, তাই ইউরোপ খুব অসুখী! দ্বিতীয়বারের বিলেত যাত্রার বিবরণ লেখেন তিনি য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারিতে (১৮৯১), যার খসড়া অংশে প্রকাশ পায় ইউরোপ ও নারী সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ভারতীয় বদ্ধ মানসিকতা। তিনি পরে তা বাদ দেন বই থেকে; তবে নারী সম্পর্কে তার ওই সময়ের মত মেলে ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য” (১২৯৮, রব; ১২, ২৩৬-২৫০) প্রবন্ধে। তিনি বলেন, ‘য়ুরোপে সভ্যতা যত অগ্রসর হচ্ছে স্ত্রীলোক ততই অসুখী হচ্ছে’, যা শুনলে মনে হয় সুখ সম্বন্ধে সর্বজ্ঞ এক মহর্ষি বলছেন জীবনের সারকথা। এখানে অবশ্য কথা বলছেন রুশো, যার মতে সভ্যতা কৃত্রিম ব্যাপার, যা মানুষের সুখ নষ্ট করে। রবীন্দ্রনাথ একে একটু সংশোধন ক’রে প্রয়োগ করেন ইউরোপি নারীর ক্ষেত্রে। তার উক্তি পুরোপুরি ভুল ধারণার ফল : ‘সুখ’ ব্যাপারটিই বিভ্রান্তিকর, কেননা তা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত; আর সভ্যতার অগ্রসরতা নারীপুরুষ উভয়েরই জন্যে হয়েছে কল্যাণকর। তার কথার মধ্যে রয়েছে এক গোপন তুলনাও;– তিনি বলতে চান ভারতে সভ্যতা এগোচ্ছে না ব’লে ভারতীয় নারীরা খুব সুখে আছে!
রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের অধীনে ও ঘরে আটকে রাখার জন্যে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, নৈতিক কোনো অস্ত্রই অব্যবহৃত রাখেন নি; এবং শেষ অস্ত্রটি, আধুনিক কালে যার মহিমার শেষ নেই, সে-বৈজ্ঞানিক অস্ত্রটিও ব্যবহার করতে ভোলেন নি। তিনি নিউটনীয় সৌরলোকের দু-রকম শক্তির রূপ দেখেছেন নারীপুরুষের মধ্যে :
‘স্ত্রীলোক সমাজের কেন্দ্রানুগ (centrapetal ) শক্তি; সভ্যতার কেন্দ্রাতিগ শক্তি সমাজকে বহির্মুখে যে-পরিমাণে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে, কেন্দ্ৰানুগ শক্তি অন্তরের দিকে সে-পরিমাণে আকর্ষণ করে আনতে পারছে না।…স্ত্রীলোকের রাজত্ব ক্রমশ উজাড় হয়ে যারার উপক্রম হয়েছে।‘
‘কেন্দ্ৰানুগ : কেন্দ্রাতিগ’ পরিভাষা ব্যবহার ক’রে রবীন্দ্রনাথ যে-কথাটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করেছেন, তার সরল বাঙলা অনুবাদ হচ্ছে যে নারীর জগত ঘর, আর পুরুষের জগত বাইর। নিউটনীয় সৌরজগতের সাথে ভিক্টোরীয়দের মতো তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন পরিবারের, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন নারীপুরুষের পৃথক জগত ও ভূমিকা। তবে এটা বিজ্ঞান নয়, অপবিজ্ঞান। সভ্যতার সংকটের জন্যে তিনি দায়ী করেছেন নারীকে; পুরুষ তার সাফল্যের জন্য বেরিয়ে পড়েছে বাইরে, শেষ নেই তার কর্ম-উত্তেজনার, কিন্তু নারী ঘরকে আকর্ষণীয় ক’রে তুলতে পারছে না বলে পুরুষ ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ছন্দ, দেখা দিচ্ছে সভ্যতার সংকট। এর জন্যে দায়ী নারী। পুরুষ তো বেরিয়ে পড়বেই, নারীর কাজ তাকে ঘরে ফিরিয়ে এনে সুখশান্তিতে ভ’রে দেয়া, কিন্তু নারী তা আর পারছে না। রাসকিনও নারীপুরুষকে দেখেছেন এভাবেই। রুশো, রাসকিন ও আরো অসংখ্য ভিক্টোরীয়র মতো রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখছেন ঘরের সম্রাজ্ঞীরূপে, তিনি চান নারী থাকুক সেখানেই; নারী ঘরে না থাকলেই নষ্ট হয় সমাজের সামঞ্জস্য। নারীপুরুষকে এমন কেন্দ্রানুগ : কেন্দ্রাতিগ, ঘর : বাইর ধরনের সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় ও ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য একটিই; নারীকে পুরুষের অধীনে রাখা। নারী কেনো হবে কেন্দ্রানুগ, তার কেন্দ্রাতিগ হওয়ার কোনো বাধা নেই; পুরুষ কেনো হবে শুধু কেন্দ্রাতিগ, তার কেন্দ্রানুগ হওয়ার কোনো বাধা নেই। নারীপুরুষ একই সাথে হতে পারে ঘর ও বাইর, কেন্দ্রানুগ ও কেন্দ্রাতিগ; কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ভাবতে পারে না। প্রথা হিশেবে যা চ’লে এসেছে, তাকেই রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুব সূত্ৰ!
রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের নারীমুক্তির আন্দোলনকে মনে করেছেন সমাজের সামঞ্জস্যনাশের পরিণতি। যদি পশ্চিমি সভ্যতার কেন্দ্ৰানুগ-কেন্দ্রাতিগ শক্তি ঠিক মতো কাজ করতো, অর্থাৎ নারী থাকতো ঘরে আর পুরুষ বাইরে, তাহলে, তার বিশ্বাস, এমন নারীমুক্তির আন্দোলন দেখা দিতো না। ধ’রে নিতে পারি। যে তখন যেহেতু ভারতে ইউরোপীয় ধরনের নারীমুক্তির আন্দোলন দেখা দেয় নি, তাই ভারতীয় সমাজের সামঞ্জস্য ছিলো অটুট, বা ভারতীয় পুরুষেরা সমাজের সামঞ্জস্য রক্ষা করতো। সে-উপায়ে যেভাবে তারা পুনায় থামিয়ে দিয়েছিলো নারীমুক্তিবাদী রামাবাইর বক্তৃতা! নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
‘য়ুরোপে স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারপ্রাপ্তির যে-চেষ্টা করছে সমাজের এই সামঞ্জস্যনাশই তার কারণ বলে বোধ হয়। নরোয়েদেশীয় প্ৰসিদ্ধ নাট্যকার ইবসেন-রচিত কতকগুলি সামাজিক নাটকে দেখা যায়, নাট্যোক্ত অনেক স্ত্রীলোক প্রচলিত সমাজবন্ধনের প্রতি একান্ত অসহিষ্ণুতা প্ৰকাশ করছে, অথচ পুরুষেরা সমাজপ্রথার অনুকূলে। এইবকম বিপরীত ব্যাপার পড়ে আমার মনে হল, বাস্তবিক, বর্তমান য়ুবোপীয় সমাজে স্ত্রীলোকের অবস্থাই নিতান্ত অসংগত।‘
রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রস্তাব করেছেন এক ভয়ঙ্কর প্রগতিবিরোধী তত্ত্ব যে সমান অধিকার পাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সমাজের সামঞ্জস্যনাশ। তার কাছে অসাম্য হচ্ছে সামাজিক সামঞ্জস্য, আর সাম্যের অধিকার দাবি হচ্ছে সমাজের সামঞ্জস্য নষ্ট করা। তাঁর তত্ত্বানুসারে দরিদ্র সাম্য দাবি করতে পারবে না ধনীর সাথে, শোষিত সাম্য দাবি করতে পারবে না শোষকের সাথে, নারীও সাম্য দাবি করতে পারবে না পুরুষের সাথে; তাতে নষ্ট হয়ে যাবে সামাজিক সঙ্গীতের সুর, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য। অসাম্যই যে সামঞ্জস্যহীনতা, বিভিন্ন ধরনের অসাম্যের জন্যেই যে মানবসমাজ আজো সামঞ্জস্যহীন, তাই অসাম্য দূর ক’রেই যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রকৃত সামঞ্জস্য বা সৌন্দর্য, তা মনে পড়ে নি তাঁর। নারীমুক্তিবাদীরা চাইছিলো সমাজের বিশুদ্ধ সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে, তা তিনি বোঝেন নি, কেননা তার মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করছিলো প্ৰথা। তিনি ইবসেনের ‘পুতুলের খেলাঘর’ (১৮৭৯) নাটকের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তবে তিনি নোরা হেলমারের বিদ্রোহের প্রকৃতি অনুভব করার মতো সংবেদনশীল ছিলেন না। ইবসেন নাটকটিতে সরলভাবে বলেছেন যে নারী মানুষ। নোরা, লৈঙ্গিক বিপ্লবের প্রথম নায়িকা, যা প্রকাশ করে তা ‘অসহিষ্ণুতা’ নয়, সে সূচনা করে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের। নোরা তার স্বামীকে বলে :
‘তুমি আমার প্রতি সব সময়ই সদয় ছিলো। তবে তোমার গৃহটি ছিলো খেলাঘর। আমি ছিলাম তোমার পুতুল বউ, যেমন আমাদের বাড়িতে আমি ছিলাম বাবার পুতুল মেয়ে; আর এখানে শিশুরা আমার পুতুল। তুমি যখন আমাকে নিয়ে খেলতে তখন আমার খুব মজা লাগতো, যেমন শিশুদের নিয়ে আমি যখন খেলতাম তখন তারা খুব মজা পেতো। টোরভান্ড, এই হচ্ছে আমাদের বিয়ে… সন্তানদের মানুষ করার জন্যে আমি কীভাবে উপযুক্ত? তার আগে আমার আরেক কাজ আছে। আমি প্রথম শিক্ষা দেবো নিজেকে–তুমি আমাকে তাতে সহায়তা করাব মতো মানুষ নও। আমার নিজেকেই তা করতে হবে। আর সে-জন্যেই আমি ছেড়ে যাচ্ছি। তোমাকে, নিজেকে আর আমার চার পাশের সব কিছু বোঝার জন্যে আমাকে দাঁড়াতে হবে সম্পূর্ণ একলা! সে-জন্যেই আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারি না…’
এমন কথায় সমগ্র পুরুষতন্ত্র ও রবীন্দ্রনাথ আহত বোধ করবেন, এবং আহত বোধ করে নোরার স্বামীও। খাঁটি পুরুষাধিপত্যবাদী স্বামী হিশেবে সে নোরাকে বোঝায় স্বামী ও সন্তানের প্রতি নারীর রয়েছে ‘পবিত্র দায়িত্ব’; সবার আগে নোরা হচ্ছে ‘স্ত্রী ও মা’। কিন্তু নোরা মনে করে অন্যরকম :
‘আমার বিশ্বাস সবার আগে আমি একজন মানুষ, ঠিক তুমি যেমন; বা আমি চেষ্টা করবো একজন মানুষ হয়ে উঠতে। টোরভাল্ড, আমি জানি অধিকাংশ মানুষই মনে করবে যে তুমিই ঠিক, আর ওই ধরনের কথা পাওয়া যাবে বইপুস্তকে; তবে অধিকাংশ মানুষ কী বলে আর বইতে কী পাওয়া যায়, তা নিয়ে আমি খুশি থাকতে পারি না। নিজের জন্যে সব কিছু আমার নিজেকেই ভাবতে হবে, বুঝতে হবে…’
নোরা, ও পশ্চিমের নারীমুক্তিবাদীরা, নারীর জন্যে চেয়েছে মানুষের অধিকার; তারা অভিনয় করতে চায় নি। পুরুষতন্ত্রের দেয়া স্ত্রী বা মায়ের পার্টে। এটা কোনো অসঙ্গত ব্যাপার না হ’লেও রবীন্দ্রনাথের কাছে তা ‘অসংগত’। বৈষম্য আর নারীর পুরুষাধীনতা সঙ্গত তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ইউরোপের ‘স্ত্রীলোকেরা যেন তাদের স্ত্রীস্বভাবের জন্যে লজ্জিত।‘ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন ‘স্ত্রীস্বভাব’ ব’লে একটা কৃত্রিম বিকৃত জিনিশে, যা মিল বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন ‘নারী-অধীনতায়’ (১৮৬৯)।
‘এক দশক আগে প্ৰথমবার বিলেতে গিয়ে সেখানকার নারীদের স্বাধীনতা দেখে তার মনে হয়েছিলো যে ভারতীয়রা নিজেদের প্রয়োজনে নারীদের ক’রে তুলেছে ‘জন্তু’ আর ‘জড়পদাৰ্থ’। এক দশকের মধ্যে তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ ভারতীয়, যিনি নারীদের ক’রে রাখতে চান ওই জন্তু আর জড়পদার্থ, যিনি বিশ্বাস করেন না নারীমুক্তিতে, যিনি প্রচার করেন ভারতীয় নারীর সুখের রূপকথা :
‘আমরা তো দেখতে পাই আমাদের দেশের মেয়েরা তাদের সুগোল কোমল দুটি বাহুতে দু-গাছি বালা পরে সিঁথের মাঝখানটিতে সিঁদুরের রেখা কেটে সাদাপ্রসন্ন মুখে স্নেহ প্ৰেম কল্যাণে আমাদের মধুর করে রেখেছেন। কখনো কখনো অভিমানের অশ্রুজলে তাদের নয়নপল্লব আর্দ্র হয়ে আসে, কখনো-বা ভালবাসার গুরুতর অত্যাচারে তাদের সরল সুন্দর সুখশ্ৰী ধৈর্যগম্ভীর সকরুণ বিষাদে স্নানকান্তি ধারণ করে;…যা হোক, আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি এবং তাঁরা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনো প্রকাশ করেন নি, মাঝের থেকে সহস্ৰ ক্রোশ দূরে লোকের অনৰ্থক হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় কেন।‘
যে-চোখে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এখানে ভারতীয় নারীদের, সে-চোখকে অন্ধ বললে ভুল বলা হয় না। তিনি নারীদের দেখেছেন পুরুষতন্ত্রের চোখে, আর রোম্যানটিকের দৃষ্টিতে; তার চোখে পড়েছে নারীর সুগোল কোমল বাহু, দু-গাছি বালা, স্নেহ প্রেম কল্যাণের মতো কল্পিত ব্যাপারগুলো। এ-বৰ্ণনা পড়ে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বাস্তব নারীদের কখনো দেখেন নি, বা দেখেছেন সামন্ত সচ্ছল পরিবারের অবাস্তব নারীদের, যাদের ছিলো সুগোল বাহু, এবং তা কোমলও, আর তাতে বালাও ছিলো; কিন্তু অধিকাংশ ভারতীয় নারীর রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতীয় নারীর দুর্দশা থেকে গেছে তার চোখের আড়ালে। ‘আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি’, তার এ-স্বীকারোক্তি হয়তো সত্য; তবে তারা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনো প্ৰকাশ করেন নি, একথা সত্য নয়। নারীরা তাদের অসুখের কথা বলেছে বা জানিয়েছে বারবার, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তাতে কান দেয় নি, বা তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। যেমন স্তব্ধ করেছে তারা রমাবাইকে। নারী যে অসুখী হতে পারে, তা-ই বিশ্বাস করতে পারে নি পুরুষাধিপত্যবাদীরা রবীন্দ্রনাথ তাদেরই একজন।
তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আমাদের সমাজের যেরকম গঠন, তাতে সমাজের ভালোমন্দ যা-ই হোক আমাদের স্ত্রীলোকেরা বেশ রকম সুখে আছেন। ইংরেজেরা মনে করতে পারেন লনটেনিস না খেললে এবং ‘বলে’ না নাচলে স্ত্রীলোক সুখী হয় না, কিন্তু আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস, ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ। তবে সেটা একটা কুসংস্কার হতেও পারে।’ একজন খাঁটি প্রথাবাদী ভারতীয় হিশেবে রবীন্দ্রনাথ জোর ক’রেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সুখে আছে ভারতীয় নারীরা। সুখ ব্যাপারটি খুবই মানসিক, সুখে থাকতে পারে রবীন্দ্রনাথের ভূত্য আর অসুখে থাকতে পারেন প্ৰভু রবীন্দ্রনাথ, তবে ভারতীয় নারীরা আসলে বেশ রকম সুখে ছিলো না। তিনি লন টেনিস খেলা আর বল নাচাকে নিন্দা করেছেন, তিনি মনে করেন ওগুলো নারীর সুখের জন্যে দরকার নয়; কিন্তু তিনি যদি ভারতীয় নারীদের কাছে জানতে চাইতেন এ-সম্পর্কে, তাহলে যে-উত্তর পেতেন তাতে ক্ষুব্ধ বোধ করতেন। দেখতেন খেলতে আর নাচতে চায় ভারতীয় নারীরাও! তিনি বিশ্বাস করেন, ‘ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ।’ তার উপলব্ধি চমৎকার, তবে প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষের সুখ কীসে;–ভালো না বেসে, ভালোবাসা না পেয়ে? পুরুষের জন্যে কি ভালোবাসা নিরর্থক? পুরুষ কি এমন জন্তু, যার দরকার নেই ভালোবাসার ও ভালোবাসা পাওয়ার? রবীন্দ্রনাথ নারীকে মনে করেছেন খেলার পুতুল, টোরভান্ডের মতো তিনিও পছন্দ করেন পুতুল খেলতে; মনে করেন নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষকে ভালোবাসা, আর কখনো কখনো পুরুষের আদর পাওয়া। পুরুষের এ-ভালোবাসা যে অপমান, তা বুঝেছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘নারীর উক্তি’র নারীটি; সে জানিয়েছিলো, ‘আছি যেন সোনার খাঁচায় /একখানি পোষ-মানা প্ৰাণ! /এও কি বুঝাতে হয়–/প্রেম যদি নাহি রয়/হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান।’ ভারতীয় নারী হয়তো প্রাণভ’রে ভালোবেসেছে তাদের পুরুষদের, কিন্তু তারা ভালোবাসা পায় নি, পেয়েছে সোহাগের নামে অপমান। তবে ওই সোহাগও জোটে নি। অধিকাংশ নারীর ভাগ্যে।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, ‘আমাদের পরিবারে নারীহৃদয় যেমন বিচিত্রভাবে চরিতার্থতা লাভ করে এমন ইংরেজ-পরিবারে অসম্ভব।‘ ইংরেজ পরিবারের তুলনায় হিন্দু/ব্ৰাহ্ম পরিবারে নারীহৃদয়ের বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থ লাভের যে-বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তা চূড়ান্তরূপে মর্মস্পর্শী। নারীর ধারাবাহিক লাঞ্ছনাকে তিনি বলেছেন নারী হৃদয়ের চরিতার্থতা/ ভারতীয় নারীহৃদয়ের চরিতার্থতা প্রমাণের জন্যে তিনি তুলনা করছেন ইংরেজ চিরকুমারী ও ভারতীয় বিধবার মধ্যে :
‘বাহ্য সাদৃশ্যে আমাদের বিধবা য়ুরোপীয় চিরকুমারীর সমান হলেও প্রধান একটা বিষয়ে প্রভেদ আছে। আমাদের বিধবা নারীপ্রকৃতি কখনো শুষ্ক শূন্য পতিত থেকে অনুর্বরতা লাভের অবসর পায় না। তাঁর কোল কখনো শূন্য থাকে না, বাহু দুটি কখনো অকৰ্মণ্য থাকে না হৃদয় কখনো উদাসীন থাকে না। তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী। এইজন্যে চিরজীবনই তিনি কোমল সরস স্নেহশীল হয়ে থাকেন। বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ববন্ধন, বাড়ির পুরুষদেব সঙ্গে স্নেহভক্তিপরিহাসের বিচিত্র সম্বন্ধ; গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তার অভাব নেই।…বরং একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে, কিন্তু বিধবাদের হাতে হৃদয়ের সেই অতিরিক্ত কোণটুকুও উদ্যুবৃত্ত থাকতে প্রায় দেখা যায় না।‘
রবীন্দ্রনাথের মতো একজন স্পর্শকাতর রোম্যানটিক কবি কী ক’রে এতো সংবেদনহীন হয়ে উঠতে পারেন, তা ভাবতেও শোক জাগে। তিনি স্তব করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে শোচনীয় মর্মান্তিক এক ব্যাপারের। হিন্দু বিধবা সব ধরনের বিধবার মধ্যে শোচনীয়তম, তার জীবন হচ্ছে ধারাবাহিক সতীদাহ; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকেই বলেছেন ‘হৃদয়ের চরিতার্থতা’। যার জীবন সম্পূর্ণ শূন্য শুষ্ক পতিত অনুর্বর, তার জীবনকে কতকগুলো নিরর্থক শব্দে পূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ কি মনে করেন যে বিধবার জীবন ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তার নারীপ্ৰকৃতি হয়ে ওঠে বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থ, কেননা তার আশ্রয়দাতা পরিবারটি তাকে এতো কাজ দেয় যে তাতেই সে ভরে ওঠে? রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা বাস্তবভাবে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় যে বিধবার নিজের সন্তান না থাকলেও পরের সন্তান পালন করতে করতে কাটে তার সকাল থেকে সন্ধ্যা। পরের সন্তান পালন কী কঠিন কাজ, তা জানে শুধু বিধবারাই। ‘তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী’;–এটা মধুর শোনালেও মধুর ব্যাপার নয়, খুবই বিষাক্ত ব্যাপার। এর বাস্তব অনুবাদ হচ্ছে বিধবা এমন মানুষ, যার নিজের কোনো সত্তা নেই জীবন নেই, সে ঘোরে অন্যদের কেন্দ্র করে; তার জীবন নিরবচ্ছিন্ন লাঞ্ছনার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই মধুর। ‘গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তাঁর অভাব নেই’, এর প্রথমাংশ সত্য না হ’লেও দ্বিতীয়াংশ খুবই সত্য যে বিধবা ক’রে থাকে দাসীর কাজ, আর তার কাজের কোনো শেষ নেই। ওই কাজের জন্যে সে পারিশ্রমিক পায় না, তার ভাগ্যে জোটে লাঞ্ছনা। ‘একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে’, কিন্তু তা থাকে না বিধবার; এর কারণ এ নয় যে তার হৃদয়পাত্র থেকে অমৃত উপচে পড়েছে, এসব তুচ্ছ কাজ করার মতো অবসর তার নেই। এর কারণ হচ্ছে দাসীর কোনো সুযোগ নেই ওই সব সামন্ত শখের। বিধবা হচ্ছে দণ্ডিত নারী, যে কোনো অপরাধ করে নি; কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথ নিরপরাধ নারীর ওই দণ্ডকেই মনে করেন। হৃদয়ের চরিতার্থতা!
এ-সময়ে (১৮৯১) তিনি নারীমুক্তি সম্পর্কে স্বেচ্ছায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নারীমুক্তিবাদী কৃষ্ণভাবিনী দাসের সাথে। কৃষ্ণভবিনী ‘শিক্ষিতা নারী’ (১২৯৮) নামের একটি প্রবন্ধে দাবি করেন নারীশিক্ষা, চান কিছুটা স্বাধীনতা। নারীকে ঘরছাড়া করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিলো না, তিনিও চেয়েছিলেন শিক্ষার সাহায্যে উন্নতজাতের নারী উৎপাদন করতে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যগ্র হয়ে পড়েন নারীকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে। তিনি নিজেকে দেখেন পুরুষতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে, যাকে বাঁচানো তার কাজ, যার মহিমা রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব। পুরুষই যে নারীকে আটকে রেখেছে ঘরে, কৃষ্ণভাবিনীর এ-অভিযোগ কাটানোর জন্যে তিনি আবার দোহাই দেন প্রকৃতির [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ১৯)] :
‘প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কাৰ্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন–পুরুষের সাৰ্ব্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে–অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।‘
উনিশশতকের বাঙালি নারীরা নিজেদের অবস্থা বর্ণনার জন্যে দুটি রূপক ব্যবহার করেছেন বারবার : পিঞ্জর ও কারাগার। গৃহকে তারা দেখেছেন ওই রূপকে, তাঁরা দাবি করেছেন নারীকে সেখানে ঢুকিয়েছে পুরুষেরাই। কৃষ্ণভাবিনীও তা-ই বলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একে মনে করেন প্রকৃতির শাশ্বত বিধান। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস প্রকৃতিই বিকলাঙ্গ ক’রে তৈরি করেছে নারীকে, তাই তাকে থাকতে হবে ঘরে, মানতে হবে পুরুষাধিপত্য। ভিক্টোরীয়দের মতো রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নিজেকে উৎসর্গ করাই নারীত্ব। এ-সম্পর্কে কৃষ্ণভাবিনী যা বলেন, তা অবিস্মরণীয় [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ২০)] :
‘পরোপকার ও অন্যের জন্যে জীবন ধারণ করা যেমন নারীর উদ্দেশ্য, রমণী তেমনি নিজের নিমিত্তও বাঁচিয়া থাকে।‘
কৃষ্ণভাবিনীর উক্তির প্রথমাংশ উগ্র পুরুষতন্ত্রের সাথে আপোষ, আর দ্বিতীয়াংশ নিজেকে আবিষ্কার। নোরার মতো কৃষ্ণভাবিনী শুধু নিজের জন্যে বাঁচতে চান নি, জীবন ধারণ করতে চেয়েছেন প্রধানত পরেরই জন্যে, একটুকু শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছেন নিজের জন্যে। পুরুষতন্ত্র আর রবীন্দ্রনাথ তাতে রাজি নন; তিনি চান নারী হবে ক্রুশবিদ্ধ জিসাস, ত্যাগ স্বীকার করে যাবে আমরণ। নারীর যে-স্তব করেন তিনি, তা পুরুষ করেছে বারবার নারীকে নিজের বশে রাখার জন্যে [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ২১)] :
‘নারী নারী বলিয়াই শ্রেষ্ঠ। তিনি পুরুষের কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে যে শ্ৰেষ্ঠতর হইবেন তাহা নহে বরং বিপরীত ঘটিতে পারে, তাহাতে তাঁহাদের চরিত্রের কোমলতা, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তার সমাঞ্জস্য নষ্ট হওয়া আশ্চৰ্য নহে।‘
ভিক্টোরীয়রা নারীকে পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট ব’লে অবিরাম প্রশংসা করেছে, কিন্তু তাকে অধীনে রাখার সব রকম কৌশল নিয়েছে; ‘উৎকৃষ্ট’ কথাটি ছিলো এক নিরর্থক সুভাষণ। সে-নারীই ছিলো তাদের কাছে উৎকৃষ্ট, যে পুরুষের অধীনে থাকে। একে বিদ্রুপ ক’রে উনিশ শতকের এক বিলেতি ব্যঙ্গচিত্রকর একটি ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন, যাতে একটি পুরুষ চেয়ারে বসে তার স্ত্রীর দিকে পা বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘হে নারী, সৃষ্টির শ্ৰেষ্ঠ, মানবতার সমাজী, মানবজাতির জননী, আমার জুতো খোলো’ [দ্র ট্যানাহিল। (১৯৮০, চিত্র ১৯)]। মিল বলেছিলেন এটা এক পরিহাস যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে! নারী নারী বলিয়াই শ্ৰেষ্ঠ এক শূন্য বুলি। রবীন্দ্রনাথ ভালোভাবেই বিশ্বাস করেন ভিক্টোরীয় ঘরে বাইরে বা ভিন্ন এলাকাতত্ত্বে, এবং বিশেষ ধরনের নারীস্বভাবে। তিনি নারীকে মনে করেন প্রকৃতির হাতে তৈরি বিশেষ এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যদি নারী চেষ্টা করে বাইরে আসার। ওই দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যাবে নারীর স্বভাব-কোমলতা, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা! নারীর স্বভাব যে পুরুষতন্ত্রেরই তৈরি, তা ভাবেন নি রবীন্দ্রনাথ।
নারী সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি ও বদ্ধমূল ক’রে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিশ-একুশ বছর বয়সে, যা তিনি পুষেছেন আশি বছর বয়স পর্যন্ত। নারীর দুটি বিপরীত ধ্রুবরূপে বিশ্বাস করেছেন তিনি; প্রিয়া ও জননী, উর্বশী ও কল্যাণী, বা পতিতা ও গৃহিণী। প্রিয়া-উৰ্বশী-পতিতা নারীর একরূপ, জননী-কল্যাণী-গৃহিণী আরেক রূপ। প্রথম রূপটির স্বপ্ন দেখেছেন তিনি কবিতার জন্যে, দ্বিতীয় রূপটিকে তিনি চেয়েছেন বাস্তবে। তার কবিতা, গল্প, উপন্যাসে এ-রূপ দুটি ফিরে ফিরে এসেছে। এ-রূপ দুটি তিনি পেয়েছেন হিন্দুপুরাণের সমুদ্রমন্থন উপাখ্যানে, এবং এদের মনে করেছেন শাশ্বত, চিরন্তন। নারীকে তিনি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, আর্থনীতিকভাবে স্বনির্ভর দেখতে চান নি। তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে দেখতে চাই তিনি নারীকে দেখেছেন কী রূপে, আর কোন রূপ চেয়েছেন স্বপ্নে ও বাস্তবে। ‘ উর্বশী’ [১৩০২, চিত্রা] কবিতাটিতে পাওযা যায় নারীর এক রূপ, যে ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নাহ বধু’, সে ‘সুন্দরী রূপসী’। তার জন্ম হয়েছিলো ‘মন্থিত সাগরে’। সে সৌন্দর্য, কিন্তু সে ‘বৃন্তহীন পুষ্প’, তার জীবন ট্র্যাজিক বেদনাপূর্ণ, কেননা সে কল্যাণী নয়। নারীর ওই রূপের জন্যে তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে পারেন, কিন্তু তাকে গৃহে কামনা করেন না। বলাকার (১৩২১) ২৩-সংখ্যক কবিতায়ও মেলে নারীর দুই রূপ :
‘কোন ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
অতলের শয্যাতল ছাড়ি
একজন উর্বশী, সুন্দরী,
বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
স্বর্গের ঈশ্বরী।
রবীন্দ্রচিন্তায় এ-দু-নারী আদিম, চিরন্তনী, শাশ্বতী; এদের পরিবর্তন নেই, এরা রবীন্দ্রনাথ ও পুরুষতন্ত্রের দুই নারী স্টেরিওটাইপ। তাই নারী চিরকালই থেকে যাবে। পৌরাণিক উর্বশী, যে কামনার তৃপ্তি যোগাবে পুরুষের, আর কল্যাণী, যে পুরুষের গৃহকে ক’রে তুলবে স্বর্গের মতো সুখকর। এরা পরস্পরের বিপরীত; উর্বশী রূপসী, সে বেশ্যা, তাকে দেবদানব আর পুরুষ কেউ গ্রহণ করে নি; আর কল্যাণীকে পুরুষ বন্দী করেছে নিজের গৃহে। নারীর দু-রূপকে পুরুষ ও রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখেছেন, তাতে নারী হয়ে উঠেছে এক শোচনীয় প্রাণী; যাকে গৃহে গ্ৰহণ করা হয় নি, সে হয়েছে বেশ্যা-তার কাজ সকলের চিত্ত ও শরীরবিনোদন; আর যাকে গ্ৰহণ করা হয়েছে, সে হয়েছে দাসী। নারীর এ-দু-রূপই কাজ করেছে তাঁর কবিতার প্রেরণারূপে, সম্ভবত উর্বশী রূপটিই তাকে বেশি প্রেরণা দিয়েছে, তবে তিনি স্তব করেছেন নারীর কল্যাণী বা দাসী রূপটির। কল্যাণীর ভবনখানি, রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ [১৩০৭, ক্ষণিক ] কবিতার পরিকল্পনা অনুসারে, পুষ্পকানন-মাঝে সাধারণত থাকে না, তবে একথা ঠিক যে ‘কল্যাণী, নিত্য আছ আপন গৃহকাজে।’ ভিক্টোরীয়দের ‘অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ দেবী, তাই ভাবতেই বিবমিষায় ধরে যে দেবী সরক্ষণ করছে গৃহকাজ, অর্থাৎ দাসীবৃত্তি। পুরুষ দেবীকে ক’রে তুলেছে গৃহপরিচারিকা! এ-দাসীর নামে তিনি ‘সর্বশেষের শ্রেষ্ঠ’ গানটি উৎসর্গ করেছেন, তাকে উপাধি দিয়েছেন ‘স্বর্গের ঈশ্বরী’, এবং তাকে করেছেন পার্থিব নারীর অনুসরণীয় আদর্শ : ‘রূপসীরা তোমার পায়ে রাখে পূজার থালা,/বিদুষীরা তোমার গলায় পরায় বরমালা।’ রূপসীরা ওই দাসীকে পুজো করে, বিদুষীরা তাকে অভিনন্দিত করে! অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সারকথা হচ্ছে নারীর রূপের মূল্য নেই, জ্ঞানের মূল্য নেই। আরো, নারীর মহিমা তার গৃহকাজে বা দাসীত্বে; এবং তাকে বন্দী ক’রে রাখতে হবে গৃহে।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীকে হ’তে হবে নারী; পুরুষ হবে কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, শাসক প্রভৃতি, অর্থাৎ প্ৰভু বা স্রষ্টা। পুরুষতন্ত্র যে-ছকে তৈরি করেছে ও দেখতে চায় নারীকে, তিনি নারীকে দেখেন সে-ছক অনুসারেই; নারী যখন ছক ভেঙে ফেলে, তখন দেখা দেয় বিপর্যয়। এমনকি তিনি নিজেও যখন ছক ভেঙে নারীকে ব্যক্তি ক’রে তোলেন, তখন অবিলম্বে তাকে পুনর্বিন্যস্ত করেন ছকের মধ্যে। ‘সাধারণ মেয়ে’ [১৩৩৯, পুনশ্চ] কবিতাটিতে মেলে এর পরিচয়। মালতী এ-কবিতায় নিতে চেয়েছে মহৎ প্রতিশোধ। দেবযানীর মতো অভিশাপ দেয়ার সুযোগ সে পায় নি, তাই সে গণিতে হ’তে চেয়েছে প্ৰথম, বিলাতে গিয়ে সম্ভবত করতে চেয়েছে ডক্টরেট। নরেশ যদি তাকে বিয়ে করতো, তবে সে ঢাকাই শাড়ি পরে কপালে সিঁদুর মেখে হয়ে উঠতো প্রথাগত কল্যাণী–তার নাম হতো শ্ৰীমতি মালতী দাসী; তবে ব্যর্থতা যেমন অনেক মহৎ কাজের প্রেরণা, মালতীর প্রেমের ব্যর্থতাও মালতীকে অনুপ্রাণিত করে মহৎ প্রতিশোধের স্বপ্ন দেখতে। মালতী ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়ে; প্রতারিত প্রেমিকা দিবাস্বপ্নে হয়ে ওঠে মেধাবী ছাত্রী;–সাহিত্যের নয়, গণিতের। সে বিলেতে যায়, তার কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে পড়ে চারপাশ। তবে মালতী ছক ভাঙতে-না-ভাঙতেই রবীন্দ্ৰনাথ তাকে ফিরিয়ে আনেন পুরুষতন্ত্রের চিরন্তন ছকের মধ্যে :
‘মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদেব মতো আবিষ্কার করুক ওকে–
শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে:
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য—‘
যদি নারীত্বই হয় তার শ্রেষ্ঠ পরিচয়, তাহলে গণিতে প্রথম শ্ৰেণী আর বিলেতে গবেষণা হয়ে ওঠে শোচনীয় পণ্ডশ্রম। মালতী এতো কিছু ক’রেও অর্জন করে নি কোনো সাফল্যই, তার পরম সাফল্য পরনে ঢাকাই শাড়ি আর কপালে সিঁদুরে! জ্ঞানী, বিদ্বান, বীর, কবি, শিল্পী, রাজারা ওর মাঝে আবিষ্কার করবে এক ছক-বাঁধা নারীকে, আর বিদুষী মালতী, রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ কবিতা অনুসারে, বরণমালা পরাবে কল্যাণী বা দাসীর কণ্ঠে। এ-ছকের মধ্যেই নারীকে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি তার বিদ্রোহী নারী, যে উদ্ধত প্রশ্ন করে : ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার /কেন নাহি দিবে অধিকার /হে বিধাতা?’, যে ঘোষণা করে, ‘যাব না বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী’, সেও ছকের মধ্যেই থেকে বলে; “যাহা মোর অনির্বাচনীয় /তারে যেন চিত্তমাঝে পায় মোর প্রিয়’ [‘সবলা’ (১৩৩৫); মহুয়া)]। ওই অনির্বচনীয়টুকু হচ্ছে নারীত্ব, যা পুরুষতন্ত্রের অত্যন্ত প্রিয়।
ছক-ভাঙা নারীকে ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করার সফল উদাহরণ চিত্রাঙ্গদা (১২৯৯)। চিত্রাঙ্গদা ভিক্টোরীয় ঘরেবাইরে বা পৃথক এলাকা বা সহচরীতিত্ত্বের এক নিরীক্ষা, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে নারী স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার অযোগ্য; সে হ’তে পারে বড়জোর পুরুষের সহচরী। ভিক্টোরীয়রা নারীকে ততোটুকু শিক্ষা দিতে রাজি হয়েছিলো, যতোটুকুতে তারা হতে পারে স্বামীর যোগ্য সহচরী:–নারী নিজে প্রধান হয়ে উঠবে না, পুরুষই থাকবে প্রধান, নারী পালন করবে। সহকারী সহচরীর ভূমিকা। নারী যদি ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়ে, তবে তাকে ছকের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে যে-কোনো কৌশলে, বা ঠেলে তাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে ঘরের কারাগারে। টেনিসনের প্রিন্সেস (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে পাওয়া যায়। এর আদর্শ ভিক্টোরীয় রূপ। ওই কাব্যে বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসনলিঙ্গু রাজকন্যা আইডাকে ক’রে তোলা হয় স্বামীর পদানত, তার প্রতিষ্ঠিত নারী-বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে রূপান্তরিত ক’রে ওই বিদ্রোহিনীকে পরিণত করা হয় পুরুষেয় সেবিকা ও স্বামীর সহচরীতে। পুরুষতন্ত্র প্রতিশোধ নেয় চরমভাবে।
‘চিত্রাঙ্গদা’র কাঠামো অভিন্ন, একটি বিদ্রোহী স্বাধীন রাজকন্যাকে এতে কামের সহযোগিতায় রূপান্তরিত করা হয় পুরুষের সহচরীতে। চিত্রাঙ্গদার শুরু ছক-ভাঙা নারীরূপে, আর তার বিলুপ্তি ঘটে ছকবদ্ধ নারীতে; ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্রের তৈরি ছকে তাকে চমৎকারভাবে পুনর্বিন্যস্ত করেন রবীন্দ্রনাথ, যাতে মুগ্ধ হয় পুরুষেরা, এবং উন্নতজাতের নারী-উৎপাদনকারীরা। কাব্যনাটকটির যে-অংশ নারী-স্বাধীনতার বিভ্রান্তিকর শ্লোগান হিশেবে খ্যাতি অর্জন কবেছে, তা হচ্ছে [চিত্রাঙ্গদা : ১১] :
‘আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।
পূজা কবি রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে, সেও আমি নাহি। যদি পার্শ্বে রাখ
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্ৰতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়।‘
এখানে পাওয়া যাচ্ছে এক ভিক্টোরীয় চিত্রাঙ্গদাকে, যে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার সমস্ত স্বপ্ন বাতিল ক’রে বেছে নিয়েছে সহচরীর ভূমিকা। সে দেবী নয়, দাসী নয়, তবে স্বাধীন সত্তাও নয়; সে পুরুষের সহচরী বা প্রিয় পরগাছা। সে নিজে যাবে না। কোনো সংকটের পথে, নিজে করবে না কোনো দুরূহ চিন্তা, নিজে গ্রহণ করবে না। কোনো কঠিন ব্ৰতা; ওই সমস্ত কাজ পুরুষের, সে-সব করবে। তার স্বামী, সে হয়ে থাকবে স্বামীর সহচরী, বা শিক্ষিত দাসী। রুশো-রাসকিন নারীকে দিতে চেয়েছিলেন এ-ধরনের শিক্ষাই। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো ‘রঘুবংশ’-এর ‘প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ’ শ্লোকটি, পছন্দ ছিলো স্ত্রীর সখি, সচিব, মিত্রের ভূমিকা; এর সাথে মিলে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় মতবাদ যে নারী হবে স্বামীর সহচরী। চিত্রাঙ্গদায় সহচরী নামের সুভাষিত দাসীর ভূমিকায় বিলুপ্তি ঘটে এক স্বায়ত্তশাসিত তরুণীর। চিত্রাঙ্গদার সাথে মিল আছে শেষের কবিতার (১৩৩৬) লাবণ্যের, তাকেও চিত্রাঙ্গদার মতো ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। লাবণ্যের বাবা অধ্যক্ষ অবনীশ দত্ত মেয়েকে বিদুষী ক’রে গ’ড়ে তুলতে চেয়েছিলো; কিন্তু মেয়েটি একদিন জ্ঞান বাদ দিয়ে জেগে ওঠে কামের মধ্যে, যেমন জেগে উঠেছিলো চিত্রাঙ্গদাও। রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের জ্ঞান সহ্য করেন না, তাদের জাগিয়ে তোলেন কামে বা প্ৰেমে-নারীত্বে; এবং মনে করেন এখানেই নারীর জীবনের সার্থকতা। তবে ওই প্ৰেমই নারীর জীবনকে ব্যর্থ ক’রে দেয়, নারী হয়ে ওঠে পুরুষের দাসী বা সহচরী। পুরুষতন্ত্রের শেখানো প্ৰেম নারীর জন্যে এক বড়ো সমস্যা।
রবীন্দ্রচিন্তায় পুরুষ অনন্য সত্তা, পুরুষ স্রষ্টা, ধ্যানী, শিল্পী, নারী গৌণ। সাতাত্তর বছর বয়সে লেখা ‘নারী’ [১৯৩৭, সনাই] নামের একটি কবিতার উল্লেখযোগ্য অংশ এমন :
‘ স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধায় মত্ত পুরুষেরে করিবারে বশ
যে-আনন্দরস
রূপ ধরেছিল রমণীতে ,
ধরণীর ধমনীতে
তুলেছিল চাঞ্চল্যের দোল
রক্তিম হিল্লোল ,
সেই আদি ধ্যানমূর্তিটিরে
সন্ধান করিছে ফিরে ফিরে
রূপকার মনে-মনে
বিধাতার তপস্যার সংগোপনে ।…
পুরুষের অনন্ত বেদন
মর্তের মদিরা-মাঝে স্বর্গের সুধারে অন্বেষণ ।…
সেই পূর্ণ লোকে —
সেই ছবি আনিতেছ ধ্যান ভরি
বিচ্ছেদের মহিমায় বিরহীর নিত্যসহচরী । ‘
এর অর্থ আদিতে ছিলো পুরুষ, যে স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধী, স্বর্গের অধিবাসী। তখন নারী ছিলো না। নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো পুরুষের অনন্ত স্বাতন্ত্র্যস্পৃহা নিয়ন্ত্রণের জন্যে, নারী দেখা দিয়েছিলো আনন্দরূপে। কে সৃষ্টি করেছিলো নারীকে? সৃষ্টি করেছিলো সম্ভবত পুরুষ নিজেই, পুরুষই নারীর বিধাতা, নারী পুরুষের ধ্যানলব্ধ মূর্তি। তবে নারী সে-মূর্তি আর আনন্দ ধ’রে রাখতে পারে নি, তাই পুরুষ শিল্পী হয়ে বারবার সৃষ্টি করছে সে-মূর্তি। পৃথিবীতে নারী আছে, কিন্তু তারা পৃথিবীর শস্তা মদ, পুরুষ এ-মর্ত্যের মদেই আস্বাদ করার চেষ্টা করছে স্বর্গের সুধা। পুরুষ স্বৰ্গ থেকে নির্বাসিত হয়ে নানা শিল্পকলায় সৃষ্টি করছে আদিনারীকে। পৃথিবীতে যে-নারীরা আছে, তারা একদা অপূর্ব আলোতে উদ্ভাসিত ছিলো, এখন নেই। পুরুষ তাই চিরবিরহী, তার স্বপ্নে আছে আদিনারী; পার্থিব নারী পুরুষের সহচরী মাত্র। এ-নারী পুরুষের সেবা করবে, গৃহকাজ করবে, পুরুষ একে সম্ভোগ করতে করতে স্বপ্ন দেখবে আদি ধ্যানমূর্তিটির! কাব্যিকভাবে একে স্বর্গীয় মনে হতে পারে, তবে গদ্যে বা বাস্তবে এ খুবই শোচনীয় ব্যাপার।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো গল্প-উপন্যাসও কল্যাণী বা গৃহবন্দী নারীর স্তব। নারীর বেদনা স্থান পেয়েছে তাঁর কথাসাহিত্যে, তবে তা প্রেমহীনতার বেদনা, নারীর স্বায়ত্তশাসনহীনতার বেদনা নয়। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নারীর রূপও এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাকে তিনি স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন নি। তাঁর কোনো কোনো উপন্যাস, যেমন ‘দুই বোন’ (১৩৩৯), লেখা হয়েছে দুই নারীতত্ত্ব–নারীর এক রূপ উর্বশী আরেক রূপ কল্যাণী–প্রমাণের জন্যে; কোনো কোনো উপন্যাস, যেমন ঘরে-বাইরে (১৩২৩), চার অধ্যায় (১৩৪১), লেখা হয়েছে পৃথক এলাকা তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্যে। তিনি বিশ্বাস করেন গৃহ আর ভালোবাসা পেলে এবং ভালোবাসতে পারলেই চরিতার্থ নারীর জীবন। বাইরের জগত নারীর জগত নয়, সেখানে নারী প্রবেশ করলে শুভকে গ্ৰাস করে অশুভ, দেখা দেয় সর্বনাশ। প্রেমের ওপর চরম গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নষ্ট করেছেন নারীদের সম্ভাবনা। প্ৰেম নামক ভাবাবেগ নারীপুরুষ উভয়ের জীবনেরই খণ্ডকালীন সত্য, কিন্তু প্রেমই জীবনের সাফল্য নয়; ভাবাবেগকাতর একটা সময় কেটে যাওয়ার পর পুরুষ প্রেমের জন্যে কাতরতা বোধ করে না, কিন্তু নারী কেনো আত্মবিনাশ ঘটাবে ওই প্রেমেই? প্ৰেমকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে পুরুষতন্ত্রই, তবে পুরুষ নিজেকে তার গ্রাস থেকে মুক্ত রেখে নারীকে ঠেলে দিয়েছে প্রেমের কারাল গ্রাসে। বাইরের জগত প্রেমের নয়, তা স্বাধীনতা ও সাফল্যের। ওই স্বাধীনতা ও সাফল্য রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন। পুরুষের জন্যে, আর নারীকে গ্রস্ত ক’রে রেখেছেন প্রেমের ভাবালুতার মধ্যে! নারী হবে বাইরে সফল পুরুষের অনুরাগিণী। রবীন্দ্রনাথের নারীদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিদ্রোহী ‘স্ত্রীর পত্র’-এর (১৯১৪) মৃণাল। সে তার স্বামীকে জানিয়েছে, ‘আমি আর তোমাদের সেই সাতাশ-নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না’; কারণ সে জেনেছে ‘সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা’ কী। তবে সংসার ছেড়ে মৃণাল গিয়েছে শ্ৰীক্ষেত্রে সমুদ্রের ধারে জগদীশ্বরের কাছে। পুরুষ যে ওই জগদীশ্বরের নামেই তাকে মেয়েমানুষ ক’রে রেখেছে, তা জানে না মৃণাল। মৃণাল স্বামীর ঘরে ফিরে নাও আসতে পারে, তবে সে বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠা পাবে না; তার বিদ্রোহ বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠালাভের নয়। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে পৃথক এলাকা তত্ত্ব প্রমাণের জন্যে রবীন্দ্রনাথ নিরীক্ষা চালিয়েছেন। বিমলার ওপর; এবং দেখিয়েছেন বাইরে গেলে নারী সর্বনাশ করে বাইরের ও ঘরের। বিমলার জীবন তখনি সার্থক যখন সে অবনত স্বামীপ্রেমে, আর ব্যর্থ যখন সে সাড়া দেয় বাইরের হাতছানিতে; চার অধ্যায় এ-তত্ত্বের আরেক নিরীক্ষা ও প্রমাণ। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি রবীন্দ্রনাথের চোখে খুবই জঘন্য, আর তা চরম জঘন্য হয়ে ওঠে যখন তাতে যোগ দেয় নারী। নারী সন্ত্রাসে যাবে না, তারা যাবে প্রেমে; আর প্রেমের পবিত্র জায়গা হচ্ছে গৃহ, যেখানে নারী হবে তার স্বামীর খণ্ডকালীন খেলার পুতুল ও আমরণ দাসী।
রবীন্দ্রনাথের আমেরিকায় (১৯১৭) প্রদত্ত বক্তৃতার একগুচ্ছ প্রকাশিত হয় পারসনালিটি (১৯১৭) গ্রন্থে। বইটির শেষ নিবন্ধের নাম ‘নারী”। বইটি বাঙলাদেশে দুষ্পপ্ৰাপ্য ব’লে আমি পড়ার সুযোগ পাই নি, তবে কেতকী কুশারী (১৯৮৫, ২৪৮-২৫৩) পশ্চিম ও নারী সম্পর্কে এ-বইতে রবীন্দ্ৰমতের যে-পরিচয় দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় এতে পশ্চিম ও নারী সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ধারণারই (১৮৯১) পুনরাবৃত্তি করেছেন তিনি। দ্বিতীয়বার তিনি যখন ইউরোপে গিয়েছিলেন, তখন তিনি মনে মনে নিজেকে গণ্য করেছিলেন এক তরুণ ভারতীয় ঋষি ব’লে, এবং ইউরোপ সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন অনেক গ্ৰহণঅযোগ্য বাণী, তবে তখন পশ্চিম তাঁর বাণী শোনার জনো প্রস্তুত হয় নি। আমেরিকায় বক্তৃতার সময় তিনি নোবেলপ্রাপ্ত প্রাচ্যের পুরোহিত, যাঁর কথা টিকেট কেটে শুনতে চায় আমেরিকা, এবং তিনি পশ্চিমকে শোনান প্রচুর ভারতীয় কথামৃত। তিনি বলেন, পশ্চিমা সভ্যতা বড়ো বেশি পুরুষালি হয়ে উঠেছে ব’লেই ভরে গেছে সংকটে। এ-সংকটের সমাধান হচ্ছে নারী : ‘অবশেষে সে-সময় এসেছে, যখন প্ৰবেশ করতে হবে নারীকে, ক্ষমতার এ-বেপরোয়া গতির মধ্যে নারীকে সঞ্চারিত করতে হবে আপন জীবনছন্দ’ [দ্ৰ কেতকী (১৯৮৫, ২৪৮)]। রবীন্দ্রনাথ তিরষ্কার করছেন পুরুষ ও পশ্চিমের পুরুষালি সভ্যতাকে, কেননা পশ্চিমকে সমালোচনা করাই ছিলো তখন প্রাচ্য ঋষিত্ব; তবে তিনি তা করতে পারেন না, কেননা ‘পুরুষ’ বলতে তিনি বোঝেন যে অসামান্য ভাবকে, পশ্চিমের পুরুষ তা-ই। পুরুষ, রবীন্দ্ৰচেতনায়, কল্পনাপ্রতিভা, সৃষ্টি, গতি, অনন্ত অস্থিরতা, উদ্ভাবন, বিধাতা যাকে সম্পূর্ণ সৃষ্টি করতে পারে নি ব’লে যে নিরন্তর সৃষ্টি ক’রে চলছে নিজেকে। তাই তিনি পশ্চিমের পুরুষদের নিন্দা করতে পারেন না, কেননা তারা করেছে পুরুষেরই কাজ। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু পশ্চিমকে বাণী শোনাতে গেছেন, তাই পশ্চিমের যে-পুরুষ কাজ করেছে তাঁরই আদর্শ অনুসারে, তাকেই তিনি আক্রমণ করেছেন। তবে এ-বাহ্যিক আক্রমণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখি রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছেন আসলে নারীকেই, যারা নিজেদের জীবনছন্দ সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে সভ্যতায়, তাই পশ্চিমের সভ্যতা ভরে গেছে সংকটে। রবীন্দ্রনাথের পুরুষধারণা ‘নারী’ (১৯৩৭) কবিতায় যেমন, গদ্যেও তেমনি; ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’তে (১৩৩৬) পুরুষ এমন :
‘পুরুষের কর্মপথে এখনো তার সন্ধানচেষ্টায় শেষ হয় নি। কোনো কালেই হবে না। অজানার মধ্যে কেবলই সে পথ খনন করছে, কোনো পরিণামের প্রান্তে এসে আজও সে অবকাশ পেলে না। পুরুষের প্রকৃতিতে সৃষ্টিকর্তার তুলি আপন শেষ রেখাটা টানে নি। পুরুষকে অসম্পূর্ণই থাকতে হবে (রর : ১৯, ৩৭৯)।
গতিবেগমত্ত পুরুষের চলমান সৃষ্টি সর্বদাই স্থিতির একটা মূল সুরকে কানে রাখতে চায়; পুরুষের শক্তি তার অসমাপ্ত সাধনার ভার বহন ক’রে চলবার সময় সুন্দরেব প্রবর্তনার অপেক্ষা রাখে (রবী; ১৯, ৩৮০)।‘
রবীন্দ্রনাথের পুরুষধারণার সাথে পশ্চিমের পুরুষকে মিলিয়ে নিলে দেখি পাশ্চাত্য পুরুষ অন্যায় করে নি কোনো; তারা যা করছে, তাকেই পুরুষের কাজ বলে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ। পুরুষ সন্ধান করবে, গতিবেগমত্ত হয়ে ছুটে চলবে, উদ্ভাবন করবে, নিজের অসম্পূর্ণ রূপটিকে সম্পূর্ণ করে তুলবে। তাই পশ্চিমে যদি কোনো সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে, তা পুরুষের দোষ নয়, দোষ নারীরই; কেননা নারীই তার রবীন্দ্ৰকথিত ‘জীবনছন্দ সঞ্চার করতে পারে নি। সভ্যতায়, গতিবেগমত্ত পুরুষকে শোনাতে পারে নি তার স্থিতির মূল সুর’। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নারীকে দোষী করতে চান না, দোষী করেন পশ্চিমের পুরুষকেই, কেননা তিনি দণ্ড দিতে চান পশ্চিমা সভ্যতাকে। এটা খুবই অন্যায় দণ্ড। রাসকিন বলেছিলেন পুরুষ যখন যুদ্ধ বাধায়, তার জন্যে পুরুষের চেয়ে নারীই বেশি দোষী; কেননা নারী তার নারীত্ব দিয়ে পুরুষকে শান্তির দিকে টেনে রাখতে পারে নি! রবীন্দ্রনাথও অনেকটা তাই বলেন, নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা রাসকিনের ধারণার মতোই। পুরুষ যোগাবে সভ্যতার গতি, নারী যোগাবে স্থিতি; তাহলেই সভ্যতা হয়ে উঠবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতার মতো ছন্দাবেদ্ধ। পুরুষ গতি, তাই সে তার স্বাভাবিক গতিকে সঞ্চার করবেই সভ্যতায়; নারীর কাজ যদি হয় সভ্যতায় স্থিতি সঞ্চার করা, আর তা যদি না পারে নারী, তবে দণ্ড প্ৰাপ্য নারীরই। তাই রবীন্দ্ৰনাথ পশ্চিমের সভ্যতার সংকটের জন্যে মূল দোষী করেছেন নারীকে, যদিও রবীন্দ্রনাথ তা অবধান করেন নি। রবীন্দ্রনাথ সভ্যতায় নারীর যে-ভূমিকা নির্দেশ করেন, তা হচ্ছে ছক-বাঁধা কল্যাণীর ভূমিকা, যার কাজ পুরুষকে গৃহের স্থিতির মধ্যে মাঝেমাঝে স্থিত ক’রে পুরুষের অনন্ত গতিকে ছন্দোবদ্ধ করা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘স্থিতির আদর্শ নারীর প্রকৃতি-দ্বারা গভীরভাবে সমাদৃত’, নারীর কাজ হচ্ছে ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ ও আরোগ্যসাধন’। নারীর যে-প্রকৃতি ও ভূমিকা তিনি নির্দেশ করেছেন, তা নারীকে সীমাবদ্ধ করে রাখে গৃহে, আর তাকে পংক্তিভুক্ত ক’রে রাখে আদিম পশুরই সাথে। তিনি মনে করেন, নারীর দায়িত্ব ছিলো পশ্চিমা সভ্যতার সেবিকারূপে আবির্ভূত হওয়া, নারী হবে সভ্যতার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, কিন্তু নারী তা পারে নি। রবীন্দ্রনাথ নারীকে প্রকাশ্যে দোষী করেন নি; কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার সংকটের দায়ভার, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনছন্দ’ ও ‘স্থিতির মূল সুর’ তত্ত্বানুসারে, বইতে হচ্ছে নারীকেই। রবীন্দ্রনাথ আগের মতো এ-প্রবন্ধেও বলেন যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ। রাসকিনের মতোই গৃহকে একটু সম্প্রসারিত করে বলেন, ‘মানবিক জগতই নারীর জগত’ [দ্র কেতকী (১৯৮৫, ২৮৪-২৮৫)]। তবে ওই মানবিক জগত গৃহেরই সম্প্রসারিত রূপ; সেখানে সেবা আছে, গ্ৰীতি আছে, কল্পনাপ্রতিভা নেই, আবিষ্কার বা সৃষ্টি নেই।
রবীন্দ্রনাথের নারী জৈবিক। জৈবিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে নারী মানুষ হয়ে ওঠে নি; তার কাজ সন্তান ধারণ আর লালন ক’রে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা। পুরুষের কাজ সভ্যতা সৃষ্টি করা। রবীন্দ্রনাথের নারীর মূল কাজ যেখানে গর্ভধারণ আর প্রসব, সেখানে পুরুষের কাজ হচ্ছে সভ্যতা সৃষ্টি; মৃণালিনী দেবীর গর্ভধারণ করবে, টিকিয়ে রাখবে মানবপ্রজাতিকে, আর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ক’রে চলবেন সভ্যতা। প্রাণসৃষ্টি এক দরকারি আদিম কাজ, সেটা সভ্যতা সৃষ্টি নয়, ওই কাজটি নারীর; ওই কাজ কাউকে মহৎ বা মানুষ করে না। পুরুষ করে সভ্যতা সৃষ্টির মহৎ কাজ; রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এই প্রাণসৃষ্টি-বিভাগে পুরুষের প্রয়োজন অত্যত্র, এইজন্যে প্রকৃতির একটা প্রবল তাগি থেকে পুরুষ মুক্ত। প্রাণের ক্ষেত্রে ছুটি পেয়েছে ব’লেই চিত্তক্ষেত্রে সে আপন সৃষ্টিকার্যের পত্তন করতে পারলে। সাহিত্যে কলায় বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে যাকে আমরা সভ্যতা বলি সে হল প্রাণপ্ৰকৃতির পলাতক ছেলে পুরুষের সৃষ্টি’ (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রর : ১৯, ৩৮০)। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ’, তা কোনো কৃতিত্বের ব্যাপার নয়, তাকে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর প্রধান সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্ৰনাথ সভ্যতা থেকেই বহিষ্কার ক’রে দিয়েছেন নারীকে তিনি মনে করেন সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে পুরুষের সৃষ্টি; এবং পুরুষ তা পেরেছে, কেননা পুরুষকে জীবন পোষণ আর সংরক্ষণ করতে হয় নি। এ-সভ্যতা যে পুরুষতান্ত্রিক, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু সভ্যতা শুধু পুরুষের সৃষ্টি নয়, নারী আছে এর ভিত্তিতে আর ওপরকাঠামোতে, কিন্তু পুরুষাধিপত্যবাদীদের মতো রবীন্দ্রনাথের তা মনে পড়ে নি। তিনি বলেন, ‘প্ৰাণের টানে মেয়ে আটকা পড়েছে আর পুরুষ ছুটেছে মনের তাড়ায়’ (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮২)। দুটি বিপরীত বস্তু পাচ্ছি। এখানে : প্ৰাণ আর মন; নারী ওই প্রাণসৃষ্টি সৃষ্টি করে চলছে সভ্যতা। এর অর্থ হচ্ছে নারী মানহীন প্রাণী, যার কাজ নিজের অভ্যন্তরে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করা। নারী যেখানে জৈবস্তরে রয়ে গেছে, সেখানে পুরুষ উত্তীর্ণ হয়েছে অভিনব দেবতার স্তরে :
‘মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্রেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টিব আলো কল্পনাবৃত্তি। পুরুষের চিত্ত আপন ধ্যানেব দৃষ্টি দিয়ে দেখে, আপনি ধ্যানের শক্তি দিয়ে গড়ে তোলে। We are the dreamers of dreams-এ কথা পুরুষের কথা। পুরুষের ধ্যানই মানুষের ইতিহাসে নানা কীর্তির মধ্যে নিরন্তর রূপ পরিগ্রহ কবছে।… নারীর সৃষ্টি ঘরে, এই জন্যে সব-কিছুকেই সে যত্ন করে জমিয়ে রাখতে পারে: তাব ধৈর্য বেশি কেননা, তার ধারণার জায়গাটা বড়ো। পুরুষের সৃষ্টি পথে পথে, এই জন্যে সব-কিছুর ভার লাঘব করে দিয়ে সমগ্রকে সে পেতে ও রাখতে চায়। এই সমগ্রের তৃষ্ণা, এই সমগ্রের দৃষ্টি, নির্মম পুরুষের কত শত কীর্তিকে বহুব্যয়, বহুত্যাগ, বহু পীড়নের উপন: স্থাপিত করেছে।…পুরুষের কল্পনাবৃত্তির সাহস এত অত্যন্ত বেশি তার কারণ, স্থিতির ক্ষেত্রে স্থির হযে বসে বিচিত্রের সহস্ৰ খুঁটিনাটিকে মমত্বের আঁকড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরবার দীর্ঘ সময় তাব কখনো ছিল না। এই জন্যে সৃষ্টির প্রয়োজনে প্ৰলয় করতে তার দ্বিধা নেই (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮৫-৩৮৬)।
এ-বৰ্ণনায় নারী সামান্য প্রাণী পুরুষের তুলনায়; নারীর রয়েছে তুচ্ছ প্রেম আর গৃহ, তাও পুরুষেরই জন্যে; আর পুরুষের রয়েছে ‘কল্পনাবৃত্তি’, রয়েছে ‘ধ্যানের দৃষ্টি’, সে সৃষ্টি করে ‘ধ্যানের শক্তি দিয়ে’। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো ও’শনেসির “আমরা সঙ্গীতরচয়িতা, /এবং আমরা স্বপ্নের স্বাপ্লিক” পংক্তিগুচ্ছ, অনেক স্থানে তিনি এগুলো উল্লেখ করেছেন কবির নাম না নিয়ে- মূল কবির নাম না নেয়া তার স্বভাব (যেমন The Religion of Man -এ ‘The Music Maker’ পরিচ্ছেদে), এখানে উল্লেখ করেছেন; এবং রবীন্দ্রনাথের পুরুষ হচ্ছে সঙ্গীতরচয়িতা, স্বপ্নের স্বাপ্লিক, তার ধ্যান রূপ পরিগ্রহ করছে নানা কীর্তির মধ্যে। পুরুষ তৈরি করে চলছে নতুন পথ, সমগ্রের তৃষ্ণায় আর্ত তার প্রকৃতি, এবং সৃষ্টির জনো ধ্বংস করতেও পুরুষ দ্বিধাহীন তাই দু-দুটি মহাযুদ্ধ এবং সভ্যতার সংকটের জন্যে রবীন্দ্রনাথ দায়ী করতে পারেন না পশ্চিমের পুরুষকে, কেননা তারা সৃষ্টির প্রয়োজনে আয়োজন করেছিলো প্রলয়ের। এ-পুরুষের তুলনায় নারী একটি জরায়ু। পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক ভাববাদী মহত্ত্ব বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ অক্লান্ত :
[ক] পুরুষের অধ্যবসায়ের কোথাও সমাপ্তি নেই, এইজন্যেই সুসমাপ্তির সুধারাসের জন্যে তার অধ্যবসায়ের মধ্যে একটা প্রবল তৃষ্ণা আছে। মেয়েদের হৃদয়ের মাধুর্য এই রসই তাকে পান করায়। পুরুষের সংসারে কেবলই চিন্তার দ্বন্দু, সংশয়ের দোলা, তর্কের সংঘাত, ভাঙাগড়ার আবর্তন—এই নিরন্তর প্রয়াসে তার ক্ষুব্ধ দোলায়িত চিত্ত প্ৰাণলোকের সরল পরিপূর্ণতার জন্যে ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে থাকে (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯,৩৮১)।
[খ] পুরুষ তার আপনি জগতে বারে বারে নূতন আগন্তুক। আজ পর্যন্ত কতবার সে গড়ে তুলেছে আপন বিধিবিধান। বিধাতা তাকে তার জীবনের পথ বাঁধিয়ে দেন নি; কত দেশে কত কালে তাকে আপন পথ বানিয়ে নিতে হল (‘নারী’, কালাস্তর, রব : ২৪, ৩৭৮)।
[গ] পুরুষের সৃষ্টি বিনাশের মধ্যে তলিয়ে যায়, নূতন করে বাঁধতে হয় তার কীর্তির ভূমিকা।…পুরুষের বিচিত সভ্যতায় আদিকাল থেকে এইরকম ভাঙা-গড়া চলছে (‘নারী’, কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৮)।
[ঘ] নানা বিঘ্ন কাটিয়ে অবস্থার প্রতিকূলতাকে বীর্যের দ্বারা নিজের অনুগত করে পুরুষ মহত্ত্ব লাভ করে (‘নারী’ কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৯)।
রবীন্দ্রনাথের পুরুষ নিরন্তর সক্রিয় দেবতা, সে বিধাতার থেকেও শক্তিমান; সে অবিরাম সৃষ্টি ক’রে চলছে নিজেকে, সম্পূর্ণ করছে বিধাতার অসম্পূর্ণ কাজ। রাসকিনের মতোই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ যে পুরুষের কেবলই চিন্তার দ্বন্দ্ব, সংশয়, সংঘাত, ভাঙাগড়া; নারী হচ্ছে ওই দেবতার শান্তির পানীয়। রবীন্দ্রবিশ্বে নারীর প্রয়োজন বেশি নয়, পুরুষকে সন্তান ও প্ৰেম দেয়ার জন্যেই দরকার নারী। পুরুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ভাববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক।
পুরুষ, রবীন্দ্রনাথের ধারণা, পুরুষ হয়েছে এজন্যে যে প্রাণসৃষ্টিতে পুরুষের ভূমিকা ক্ষণউত্তেজনার; আর নারী নারী হয়েছে ওই প্রাণ সৃষ্টি, পোষণ আর সংরক্ষণ করতে গিয়েই। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন আদিম শেকলে নারীকে বেঁধেছে। প্রকৃতি, তাই নারী রয়ে গেছে প্রাকৃতিক আদিম স্তরে। নারীর এ-আদিমতার কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন, এমনকি ১৩৪৩-এ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীসম্মিলনে যখন তিনি ‘নারী’ বিষয়ে প্ৰবন্ধ পড়েন, তখনও নারীদের তাদের আদিমতার কথা স্মরণ করাতে ভোলেন নি। রবীন্দ্ৰচেতনায় নারী :
[ক] জীবপ্রকৃতিব একটা বিশেষ অভিপ্রায় তার মধ্যে চরম পরিণতি পেয়েছে। সে জীবধাত্রী, জীবপালিনী: তাব সম্বন্ধে প্রকৃতির কোনো দ্বিধা নেই। প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্ৰাণতোষণের বিচিত্র ঐশ্বৰ্য তার দেহে মনে পর্যাপ্ত (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮০)।
[খ] প্ৰকৃতির ব্যবস্থায় মেয়ের একটা জায়গা পাকা করে পেয়েছে, পুরুষরা তা পায় নি (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮৩)।
[গ] মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী। নারীসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে।…প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদন প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীবপালনের সমস্ত প্ৰবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহামনের অন্তুতে অন্তুতে। এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেযে হৃদয়বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্তভাবে। এই সেই প্রবৃত্তি নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাঁথছে নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখবার জন্যে প্রেমে, মেহে, সকরুণ ধৈৰ্যে। মানবসংসারকে গড়ে তোলবার, বেঁধে রাখবার এই আদিম বাঁধুনি (‘নারী’, কালান্তর, রুর : ২৪, ৩৭৭)।
[ঘ] তাই গৃহে নারী যেমনি প্রবেশ করেছে কোথা থেকে অবতীর্ণ হল গৃহিণী, শিশু যেমনি কোলে এল মা তখনই প্রস্তুত। জীবরাজ্যে পরিণত বুদ্ধি এসেছে অনেক পরে (নারী’, কালান্তর, রব ২৪, ৩৭৮)।
পারসন্যালিটিতে (১৯১৭) রবীন্দ্রনাথের যে-কথা কেতকী কুশারীর (১৯৮৫, ২৪৮) অনুবাদে হয়েছে ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ ও আরোগ্যসাধনা’, তাকে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারিতে (১৩৩৬) বলেছেন, ‘প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণ’; এবং এ-ই হচ্ছে নারীর মৌল কাজ। নারীর এ-কাজটি আদিম জৈবিক, এবং রবীন্দ্রনাথের মতে এটা উদ্দেশ্যহীন ঘটনা নয়; ‘জীবপ্রকৃতির একটা বিশেষ অভিপ্ৰায়’ নারীর মধ্যে ‘চরম পরিণতি পেয়েছে’। নারী হচ্ছে প্রকৃতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জরায়ুসম্বলিত জীব। প্রকৃতি দ্বিধাহীনভাবে প্রাণসৃষ্টির দায়িত্ব দিয়েছে নারীকে। একথা তিনি ১৯১৭তে, ১৯১৯-এ, ১৯৩৬-এ বলেছেন; এবং এতে বিশ্বাস করেন তিনি যৌবনকাল থেকেই। ১৯৩৬-এ তিনি নারীদের সভায়ই বলেছেন, ‘মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী’; নারী ‘জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে’, ‘প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে’, এবং জীবপালনের সমস্ত প্রবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহমানের তত্ত্বতে তন্তুতে।’ নারী সন্তানধারণ করে, প্রসব করে এটা সত্য; তবে রবীন্দ্রনাথ এখানে নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে যেভাবে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে প্ৰকাশ পেয়েছে নারী সম্পর্কে তাঁর ভাববাদী পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা পোষণ করে যে নারী পুরুষের থেকে অনেক বেশি ‘প্রাকৃতিক’; ভারতীয় অঞ্চলে প্রকৃতি ও নারীর ভেদ অস্বীকার করে নারীকে ‘প্রকৃতি’ই বলা হয়। পুরুষতন্ত্র মনে করে যে নারী অচ্ছেদ রূপে জড়িত প্রকৃতির সাথে, তাই নারীর পক্ষে অসম্ভব প্রকৃতি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া। অন্যদিকে পুরুষের রয়েছে দ্বৈত প্রকৃতি : পুরুষ তার দ্বিতীয় প্রকৃতির সাহায্যেই সৃষ্টি করে সভ্যতা। পুরুষ সম্বন্ধে ভাববাদী ধারণা জোর দেয় পুরুষের এ-দ্বিতীয় প্রকৃতির ওপর, যেমন জোর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং পুরুষকে ক’রে তুলেছেন দেবতা। পুরুষতন্ত্র নারীর জন্যে নির্দেশ করেছে একক প্রকৃতি, যা জড়িত আদিম জৈবিকতার সাথে; আর পুরুষের জন্যে দ্বৈত প্ৰকতি, যার দ্বিতীয়টি পুরুষকে করেছে। জৈবিকতা-পেরিয়ে-যাওয়া মানুষ। এটা শুধু পুরুং, তন্ত্রের দার্শনিকতা নয়, এর রয়েছে বাস্তব রূপ : এটা জীবনকে ভাগ করেছে দুটি পৃথক এলাকায়, একটি গাৰ্হস্থ ও অন্যটি সামাজিক জীবন। পুরুষ জীবন যাপন করে দু-এলাকায়ই, তবে সামাজিক এলাকায়ই পুরুষ যাপন করে তার মানবিক জীবন। গাৰ্হস্থ্য জীবন হচ্ছে পুরুষের জৈবিক জীবন, আর সামাজিকটি তার মানবিক জীবন। গাৰ্হস্থ্য জীবন হচ্ছে প্রকৃতির, প্রয়োজনের, অস্বাধীনতার জীবন, যেখানে বাস করে নারী; আর পুরুষ এ-জীবনকে পেরিয়ে সামাজিক জীবনে লাভ করে মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা। নারী গাৰ্হস্থ্যু জৈবিকতার জীবনে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্ৰকথিত ‘প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণের’ জন্যে, এবং এটাকে তিনি ও পুরুষতন্ত্র একটা পাশবিক কাজ ব’লেই মনে করেন। এর প্রভাব এতো প্রবল যে নারীবাদী দ্য বোভোয়ারও মনে করেছেন যে সন্তানধারণ ও প্রসব একটি হীন পাশবিক কাজ, এবং নারী অভিশপ্ত এ-জৈবিক অভিশাপে। এ-অভিশাপের ফলেই নারী বন্দী হয়ে আছে গৃহে, আদিম প্রকৃতির শেকলে জড়িয়ে আছে, তার মুক্তি নেই। নারী বন্দী হয়ে আছে মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার অমানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই! শুলামিথ ফায়ারস্টোন এ-তত্ত্বটিকে তার যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, নারী-অধীনতার মূল কারণ হয় যদি সন্তানপ্রজনন, তাহলে নারীমুক্তির জন্যে দরকার নারীর সন্তানধারণ করতে অস্বীকার করা [দ্র ওব্রিয়েন (১৯৮২, ১০৪)]। মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়; পুরুষ যদি চায় যে টিকে থাকুক মানবপ্রজাতি, তাহলে তাকে উদ্ভাবন করতে হবে সে-প্ৰযুক্তি, যা টিকিয়ে রাখবে মানবপ্রজাতিকে।
রবীন্দ্রনাথ নারীকে গৃহে দেখতে চান, এবং সব সময় মনে করেছেন প্রকৃতিই নারীর মধ্যে নিজের অভিপ্ৰায় বাস্তবায়িত করার জন্যে নিয়েছে। এ-ব্যবস্থা। পুরুষই যে নারীকে ঢুকিয়েছে ঘরে, একথা তিনি স্বীকার করতে চান নি। ১৯৩৬-এ নারীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি এ-মত কিছুটা বদলান; স্বীকার করেন, ‘মেয়েদের হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্যকে পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপনি ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে কড়া পাহারার বেড়া দিয়ে রেখেছে’ (‘নারী’, কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৯)। পুরুষকে এবার তিনি স্নেহের সাথে দায়ী করেন; এবং সাথেসাথে উচ্চারণ করেন এক সাংঘাতিক কথা : ‘মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বাঁধন-মানা প্রবণতা আছে, সেইজন্যে এটা সর্বত্রই এত সহজ হয়েছে‘ (ওই, ৩৭৯)। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে রয়েছে জন্মক্রীতদাসের বৈশিষ্ট্য, তাই পুরুষ পেরেছে নারীকে বন্দী করতে। পুরুষ যে-জন্যে গৃহে অবরুদ্ধ করেছে নারীকে, তা হচ্ছে ‘হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্য’, বা নারীত্ব, যা নারী পেয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর থাকতেই হবে ওই গুণ : ‘প্রকৃতির কাছ থেকে তারা পেয়েছে অশিক্ষিতাপটুত্ব, মাধুর্যের ঐশ্বর্য তাদের সহজে লাভ করা। যে মেয়ের স্বভাবের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সহজ রসটি না থাকে, কোনো শিক্ষায়, কোনো কৃত্রিম উপায়ে সংসারক্ষেত্রে সে সার্থকতা পায় না’ (ওই, ৩৭৯)। রবীন্দ্রনাথের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ছকবাধা নারীত্ব নামের ‘সহজ রসটি’, যার অভাবকে তিনি মনে করেন ‘দুৰ্ভাগ্য’। কোনো শিক্ষাই ওই রসাভাবের ক্ষতিপূরণ করতে পারে না; নারী কবি, বৈজ্ঞানিক, প্রধান মন্ত্রী হ’লেও বা নোবেল পুরস্কার পেলেও কিছু যায়-আসে না, ওই সব নারীর দুর্ভাগ্য মাত্র। তার সব সাফল্যই, রবীন্দ্ৰমতে, চরম ব্যর্থতা, যদি তার না থাকে ওই সহজ রসটি।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর পক্ষে কবি-বৈজ্ঞানিক-প্রধান মন্ত্রী হওয়া অস্বাভাবিক, কেননা নারী সহজাতভাবেই পায় নি মানুষের সে-গুণ, যা দরকার ওই সব সামাজিক-মানবিক সাফল্যের জন্যে। ‘পুরুষের আছে বীৰ্য আর মেয়েদের আছে মাধুর্য’; আর ‘মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্ৰেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টির আলো কল্পনাবৃত্তি’ (পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি, রব; ১৯, ৩৭৯, ৩৮৫)। প্ৰেম-মাধুর্য নারীকে গৃহে আটকে রাখে, তা মধুর ও আলোকিত করে ঘরকে; আর পুরুষের বীর্য ও প্রতিভা উপভোগ ও আলোকিত করে বিশ্ব ও সভ্যতাকে। নারীর ব্যর্থতার মূলে তার জরায়ু; রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বস্তৃত জীবপালনের কাজটাই ব্যক্তিগত। সেটা নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের কোঠায় পড়ে না, সেই কারণে তাঁর আনন্দ বৃহৎ তত্ত্বের আনন্দ নয়; এমন-কি, মেয়েদের নৈপুণ্য যদিও বহন করেছে রস, কিন্তু সৃষ্টির কাজে আজও যথেষ্ট সার্থক হয় নি’ (‘নারী’, কালাস্তর, রব :২৪, ৩৭৯)। পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরা এমন বিশ্বাস পোষণ ও প্রচার করেছেন ধর্মগ্রন্থে, দর্শনশাস্ত্রে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, ও তাদের সব কিছুতে; নারীর প্রতিভার সৃষ্টিকে তারা শুধু অবহেলাই করেন নি, নারীর প্রতিভা থাকতে পারে বলেই বিশ্বাস করেন নি তারা। নারীর প্রতিভাহীনতার কারণ তার জরায়ু, তার অপরাধ সে পালন করে মানুষকে গর্ভে ধারণের মতো অমানবিক কাজ। নারী কীভাবে কাটাবে তার এ-প্রতিবন্ধিতা? যদি জরায়ই তার শক্ৰ হয়, তাহলে জরায়ুকেই বাতিল ক’রে দিতে হবে তার। নারীকে যদি সৃষ্টশীল হতে হয়, তাহলে সন্তানধারণ ও লালনের ব্যক্তিগত কাজ অস্বীকার ক’রে মন দিতে হবে নৈর্ব্যক্তিক কাজে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ নারীকে নৈব্যক্তিক কাজের এলাকায় ঢোকার অনুমতি দিতে রাজি নন।
নারী কী কাজের উপযুক্ত, ঘরের বাইরে গেলে নারীকে মানায় কোন কাজে? নারীর মানানসই কাজের নমুনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন জাপানযাত্রীতে (১৯১৯)। বর্মীনারীদের কর্মের হিল্লোল দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাদের দিয়েছেন। এ-প্ৰশংসাপত্ৰ :
‘লোকের কাছে শুনতে পাই এখানকার পুরুষেরা অলস ও আরামপ্ৰিয়, অন্য দেশের পুরুষের কাজ প্রায সমস্তই এখানে মেয়েরা কবে থাকে। হঠাৎ মনে আসে, এটা বুঝি মেয়েদের উপরে জুলুম করা হয়েছে। কিন্তু, ফলে তো তার উলটোই দেখতে পাচ্ছি–এই কাজকর্মের হিল্লোলে মেয়েরা আরো যেন বেশি করে বিকশিত হয়ে উঠেছে। কেবল বাইরে বেরতে পারাই যে মুক্তি তা নয়, অবাধে কাজ করতে পাওয়া মানুষের পক্ষে তাধ চেয়ে বড়ো মুক্তি। পরাধীনতাই সব চেয়ে বড়ো বন্ধন নয়, কাজের সংকীর্ণতাই হচ্ছে সব চেয়ে কঠোর খাঁচা।
এখানকাব মেয়েরা সেই খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে এমন পূর্ণতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তারা নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজের কাছে সংকুচিত হয়ে নেই; রমণীর লাবণ্যে যেমন তারা প্রেয়সী, শক্তির মুক্তিগৌরবে তেমনি তারা মহীয়সী! কাজেই যে মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, সাঁওতাল মেয়েদের দেখে তা আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলুম। তারা কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু কারিগর যেমন কঠিন আঘাতে মূর্তিটিকে সুব্যক্ত করে তোলে তেমনি এই পরিশ্রমের আঘাতেই এই সাঁওতাল মেয়েদের দেহ এমন নিটোল, এখন সুব্যক্ত হয়ে ওঠে; তাদের সকল প্রকার গতিভঙ্গিতে এমন একটা মুক্তির মহিমা প্ৰকাশ পায়’ (জাপানযাত্রী, রক্স : ১৯, ৩১৫০)।
কী কাজ করতে দেখেছেন তিনি ওই নারীদের? অধ্যাপকের, চিকিৎসকের, প্রকৌশলীর, বিজ্ঞানীর, পৌরপতির, সেনাপতির, মন্ত্রীর? এমন কোনো কাজে তিনি দেখেন নি তাদের; দেখেছেন হয়তো মেয়েরা বাজারে যাচ্ছে, চাষ করছে, পানি আনছে, মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে, বা কারখানায় করছে শ্রমিকের কাজ। তিনি মনে করেন এ-ধরনের কাজে বিকশিত হয় মেয়েরা। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে কাজই মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, কিন্তু তিনি কি চাইবেন জোড়াসাঁকোর মেয়েরাও ওই ধরনের কাজ ক’রে অর্জন করুক ‘যথাৰ্থ শ্ৰী’? তিনি তা চাইবেন না; তাই রবীন্দ্রনাথ বর্মীনারীদের যে-প্ৰশংসাপত্র দিয়েছেন, তার মূল্য বেশি নয়। পৃথিবী জুড়েই মেয়েরা চিরকাল ধ’রে এ-ধরনের নিম্নকাজ করে আসছে, তা সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্যে নয়; সামাজিক ব্যবস্থাই তাদের বাধ্য করেছে এসব কাজে। সাঁওতাল মেয়েদের কাজেরও তিনি প্রশংসা করেছেন, তাদের কাজের থেকে অবশ্য তার চোখে বেশি পড়েছে ওই নারীদের দৈহিক নিটোলতা। কাজ তাদের দেহকে নিটোল করে নি, কাজ নারীদেহকে নিটোল করলে পৃথিবী জুড়েই দরিদ্র নারীদের দেহ নিটোল হতো, রূপসীশ্রেষ্ঠরা দেখা দিতো সামাজিক শূদ্ৰদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন বাইরের শারীরিক কাজ মেয়েরা ভালোই করতে পারে, এবং এটা যদি তারা করে, বেশ হয়, বা মেয়েদের খামোখা বাইরে বেরোনো ঠিক নয়, তাদের বাইরে বেরোনো উচিত শুধু কাজ করতে। তিনি মুগ্ধ হয়েছেন নারীদের ভূমিদাসী বা শ্রমিকের কাজ করতে দেখে।
তিনি মনে করেন মেয়েরা ভালো দাসীবৃত্তিতেই; জাপানি দাসীদের দেখে তাঁর মনে হয়েছে :
‘এখানকাব ঘরকন্নার মধ্যে প্রবেশ কলে সব-চেয়ে চোখে পড়ে জাপানি দাসী। … যেন মানুষের সঙ্গে পুতুলের সঙ্গে, মাংসের সঙ্গে মোমের সঙ্গে মিশিয়ে একটা পদার্থ: আর সমস্ত শরীরে ক্ষিপ্ৰতা, নৈপুণ্য, বলিষ্ঠতা।… জানালার বাইরে চেয়ে দেখলুম, প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘবকন্নার হিল্লোল তখন জাগতে আরম্ভ করেছে–সেই হিল্লোল মেয়েদের হিল্লোল। ঘরে ঘরে এই মেয়েদের কাজের ঢেউ এমন বিচিত্র বৃহৎ এবং প্রবল ক’রে সচরাচব দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু, এটা দেখলেই বোঝা যায়, এমন স্বাভাবিক আর কিছু নেই। দেহযাত্ৰা জিনিসটার ভাব আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মেয়েদেরই হাতে; এই দেহযাত্রার আযোজন উদ্যোগ মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক এবং সুন্দর। কাজেই এই নিয়ত তৎপরতায় মেয়েদের স্বভাব যথার্থ মুক্তি পায় ব’লে শ্ৰীলাভ করে। বিলাসের জড়তায় কিম্বা যে-কারণেই হোক, মেয়েরা যেখানে এই কর্মতৎপরতা থেকে বঞ্চিত সেখানে তাদের বিকার উপস্থিত হয়, তাদের দেহমনের সৌন্দর্যহানি হতে থাকে, এবং তাদের যথার্থ আনন্দের ব্যাঘাত ঘটে (জাপানযাত্রী, রব : ১৯, ৩৩৫)।
রবীন্দ্রনাথের জাপানি দাসীবন্দনার নিচে লুকিয়ে আছে নারীদের কর্মযোগ্যতা সম্বন্ধে এক ভীতিকর দর্শন : দাসীবৃত্তি নারীদের জন্যে স্বাভাবিক। নারীদের রূপান্তরিত করতে হবে দাসী নামের পদার্থে, একাকার করে দিতে হবে মানুষ-মোম-মাংসকে; তারা হিল্লোল জাগিয়ে কাজ করবে, এতে তাদের স্বভাব বিকাশ লাভ ক’রে হয়ে উঠবে সুন্দর। ‘স্বাভাবিক’ হচ্ছে ‘প্রাকৃতিক’-এর অন্যনাম; তাই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীদের দাসীবৃত্তি প্রাকৃতিক। নারীদের বিলাস অবৈধ, কাজ না করলে বিকৃত হয় নারীরা, হানি ঘটে তাদের দেহমানসৌন্দর্যের। মনু বিধান দিয়েছিলেন যে নারীদের কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়, নইলে নারীরা পরপুরুষের চিন্তায় নষ্ট হয়ে যাবে; বাইবেলে ঈশ্বর ও গুণবতী ভাৰ্যার প্রশংসা করে বলেছে যে সে আলস্যের খাদ্য খায় না। জাপানি দাসীরা আলস্যের অন্ন তো খায়ই না, বরং তারা কাজকে পরিণত করে সৌন্দর্যের হিল্লোলে, বা কর্মনাট্যে, যা অনুমোদন করবেন মনু আর ঈশ্বর, যার বন্দনা করেন রবীন্দ্রনাথ। নারীরা শুধু দাসীত্বে সফল নয়, রবীন্দ্ৰনাথ দেখেছেন তারা ব্যবসাও করতে পারে :
‘এই ব্যবসাটি এই স্ত্রীলোকেরই নিজের হাতে তৈরি। আমি যে-কথা বলছিলুম এই ব্যবসায়ে তারই প্রমাণ দেখতে পাই। মানুষের মন বোঝা এবং মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা স্ত্রীলোকের স্বভাব সিদ্ধ;… কর্মকুশলতা মেয়েদের স্বাভাবিক।…যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না সে-সব কাজ মেয়েরা পুরুষের চেয়ে ঢের ভালো করে করতে পারে, এই আমার বিশ্বাস।… যে-সব কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে-সব কাজে পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার, সে-সব কাজ মেয়েদের’ ( জাপানযাত্রী, রব :১৯, ৩২৩)।
রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন নারীদের কয়েকটি স্বাভাবিক বা প্ৰাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : নারীরা মানুষের মন বুঝতে পারে; মানুষের সাথে সম্বন্ধ রক্ষা করতে পারে; এবং তারা কর্মকুশল। পিতৃতন্ত্র নারীদের এ-গুণগুলোর প্রশংসা করে আসছে কয়েক সহস্ৰক ধরে, এবং নারীরা যাতে বিরত না হয় এগুলোর চর্চা থেকে তার ওপর রেখেছে তীক্ষ দৃষ্টি। এগুলো দাসদের গুণ; মন বুঝে চলতে হয় তাদের, নইলে তাদের পড়তে হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে; সম্বন্ধও রক্ষা করতে হয় তাদের, এবং কর্মকুশলতায় তারা জয় করে প্রভুর মন। স্বাধীন পুরুষের কাছে এসব কাপুরুষতা; কিন্তু নারী যেহেতু দাসশ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত, যেমন দাবি করেছেন আমূল নারীবাদীরা, তাই তারা চলার চেষ্টা করে অপরের মন বুঝে, মানিয়ে নিতে চায় অপরের সাথে। একে স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে শূদ্ৰদের শূদ্ৰত্ব স্বাভাবিক। পিতৃতন্ত্র সমস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাপারকে জৈবিক ও শাশ্বত বলে গণ্য করেছে, রবীন্দ্রনাথও করেছেন। পুরুষতন্ত্র নারীদের বিকৃত করে নিজের উপযোগী ক’রে নিয়েছে, এসব নারীদের স্বাভাবিক স্বভাব নয়। নারীরা ব্যবসা করতে পারে, এতে তিনি বিশ্বাস করেন, এবং তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন; তবে তিনি ব্যবসা বলতে বোঝেন মুদিদোকান চালানো, যার যোগ্য নারীরা। নারীরা যে শারীরিকভাবে দুর্বল, এটা সকলের জানা; রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীরা মানসিকভাবেও দুর্বল। ‘যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না’, রবীন্দ্রনাথের মতে, সে-সব করতে পারে নারীরা। তাঁর এ-মত অভিনব নয়, পুরুষ নারীদের সম্পর্কে এ-ধারণা পোষণ ও প্রচার করে আসছে পিতৃতন্ত্রের সূচনাকাল থেকেই। রুশো ‘এমিল’-এ এটা আলোচনা করেছেন বিশদভাবে; রবীন্দ্রনাথের মত রুশোর মতেরই প্ৰতিধ্বনি। নারী যেমন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তেমনি প্রতিবন্ধী মানসিকভাবে; তারা করতে পারে সে-সব কাজ যাতে ‘উদ্ভাবনার দরকার নেই’, যাতে ‘পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার’। রবীন্দ্ৰনাথ নারীদের প্রশংসাপত্র দিয়েছেন যে তারা ব্যবসা করতে পারে, তবে ‘ব্যবসা’ বলতে তিনি আসলে ব্যবসা বোঝান নি। ব্যবসার জন্যে দরকার সাহস, উদ্ভাবন শক্তি, তাই নারীরা ব্যবসার উপযুক্ত নয়; রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারী বড়োজোর হতে পারে মুদি; তিনি তা বিলেতে দেখেছেন, জাপানে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন নারীপুরুষের পৃথক এলাকায় বিশ্বাসী, তেমনি নারী যখন বাইরের কাজে আসে তখনও তিনি নারীপুরুষের পৃথক কাজে বিশ্বাসী। একশ্রেণীর তুচ্ছ কাজ আছে, যা করবে নির্বোধ দুর্বল নারী; আর অধিকাংশ সভ্যতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। উদ্ভাবনশীল সাহসী পুরুষ। নারী হবে মুদি, সেবিকা, বিমানবালা, পুরুষ নিৰ্বাহীর ব্যক্তিগত সহকারী; আর পুরুষ হবে সভ্যতার নিয়ন্ত্রক।
রবীন্দ্রনাথ, তার কালের অধিকাংশ মহাপুরুষের মতোই, বিরোধী ছিলেন নারীমুক্তির; যে-নারীরা পুরুষাধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্তির কথা বলে, তারা বিকারগ্রস্ত ব’লে বিশ্বাস করেন তিনি। প্রাকৃতিক স্বাভাবিক নারী কল্যাণী হয়ে থাকবে গৃহে, প্রেম হবে তাদের জীবনের মূলধন; শুধু বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা পেতে চায় বাইরে। পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারিতে (১৩৩৬) তিনি লিখেছেন :
‘প্রকৃতিস্থ অবস্থায় সাধারণত কোনো মেয়ের দল বলে না, পুরুষকে সম্পূর্ণ বর্জন করাটাই তাদের জীবনের চরম ও মহোচ্চ লক্ষ্য। সম্প্রতি কোথাও কোথাও কখনো এমন কথার আভাস শোনা যায়, কিন্তু সেটা হল আস্ফালন। প্রাণের রাজ্যে মেয়েদের যে চিরকেলে স্থান আছে সেখানকার বন্দরের নোঙর ছিঁড়ে মনটাকে নিয়ে তারা নিরুদেশ হয়ে যাবে, এমন কথা দুই-একজন মেয়ে বলতেও পারে: কারণ যাত্রারম্ভে ভাগ্যদেবতা যখন জীবনের সম্বল স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেয় তখন প্যাক করবার সময় কিছু যে উলটোপালটা হয় না, তা নয়’ (বর : ১৯, ৩৮৩)।
নারীমুক্তির কথা, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, কোনো নারী ‘প্রকৃতিস্থ’ অবস্থায় বলতে পারে না; উন্মাদিনীরাই শুধু বলতে পারে এমন অস্বাভাবিক কথা। নারীমুক্তি হচ্ছে পাগলামো! তিনি পশ্চিমের নারীমুক্তিবাদীদের লক্ষ্য ক’রেই এসব বলেছেন, তাদের ক্রিয়াকলাপকে নিন্দা করেছেন ‘আস্ফালন’ বলে। তিনি চান নারী থাকবে ‘প্ৰাণের রাজ্যে’ চিরস্থায়ীভাবে; নারী সন্তান ধারণ ও প্রসব করবে, মনের রাজ্যে তার অধিকার নেই। যদি কোনো নারী মনের রাজ্যে ঢুকতে চায়, বুঝতে হবে তার ভেতরে রয়েছে কোনো গোলমাল। যে-নারী কবিতা লেখে, বিজ্ঞানচর্চা করে সে বিকৃত, প্রকৃতি ভুল করে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা পুরুষকে। যারা বাইরে নারী আর ভেতরে পুরুষ, তারা অবশ্যই বিকৃত। রবীন্দ্রনাথের প্যাকিংতত্ত্ব অনুসারে কৃতী সব নারীই বিকৃত : স্বর্ণকুমারী দেবী, বা বেগম রোকেয়া, মেরি ওলস্টোনক্রাফ্ট্, জর্জ এলিয়ট, মাদাম ক্যুরি বিকৃত, তাঁদের ভেতরে প্রকৃতি ভুল ক’রে বোঝাই করেছে পুরুষের স্বভাব। রবীন্দ্রনাথের এ-মতের সাথে মিল আছে ফ্রয়েডের ‘পুংগূঢ়ৈষা’র, যার সারকথা হচ্ছে ব্যর্থ বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা চায় বাইরের জগতে। মেয়েরা মুক্তি চায় কেনো? তার কারণ নির্দেশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ :
একদল মেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, ‘মেয়ে হওয়াতে আমাদের মগৌরব, আমাদের ক্ষতি। অৰ্থাৎ, আমাদের আত্মপ্রকাশের ধাবায় পুরুষের সঙ্গে প্রভেদটাতে পীড়া পাচ্ছি।’ এর থেকে বোধ হচ্ছে, একদিন যে পুরুষ সাধক ছিল এখন সে হয়েছে বণিক (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রব :১৯, ৩৯১)।
পুরুষ সম্পর্কে অসাধারণ ভাববাদী ধারণা পোষণ রবীন্দ্রনাথের স্বভাব; যে-পুরুষ সফলভাবে নারীকে গৃহে আটকে রাখতো, সে তাঁর চোখে সাধক; যে-পুরুষ নারীকে আটকে রাখতে পারছে না, সে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চোখে সবচেয়ে ঘৃর্ণিত মানুষ-বণিক। তিনি আরো বলেছেন, ‘পুরুষ একদিন ছিল মিষ্টিক, ছিল অতল রসের ডুবারি। এখন হয়েছে মেয়েদের মতোই সংসারী।’ (ওই, ৩৯২)। পুরুষ বণিক হয়ে পড়েছে, সংসারী হয়ে পড়েছে, তাই নারী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে চাইছে, এটা বেশ আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষীয় ব্যাখ্যা। নারীরা কেনো মুক্তি চায়, রবীন্দ্রনাথের এ-রচনা লেখার সময় তা নারীরা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কি নারীবাদীদের কোনো লেখা পড়ার আগ্রহ বোধ করেন নি কখনো?
১৯৩৬-এর অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীসম্মিলনে পড়েন ‘নারী’ (কালান্তর, রব :২৪, ৩৭৭-৩৮৩) প্ৰবন্ধটি। প্ৰবন্ধটি লিখেছিলেন তিনি নারীদের আমন্ত্রণে যে-নারীরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন মুক্ত বা মুক্তিপিপাসু, বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অপ্ৰকৃতিস্থ’, বা ভুলপ্যাককরা। প্রবন্ধটিতে পাই দুই রবীন্দ্রনাথকে : এক রবীন্দ্রনাথ পিতৃতান্ত্রিক, যিনি নারীকে মনে করেন প্রকৃতির অভিপ্ৰায় বাস্তবায়নের মাংসল যন্ত্র, যার কাজ সন্তানধারণ ও পালন, যে বইছে ‘আদিপ্রাণের সহজ প্রবর্তনা’ নিজের স্বভাবের মধ্যে; আরেক রবীন্দ্রনাথ, অনেকটা বাধ্য হয়ে, মেনে নেন যে নারীকে বেরিয়ে আসতে হবে বাইরে। যে-নারীরা আর কল্যাণী হয়ে থাকতে চান না, তাদের আমন্ত্রণে তাদের সম্মেলনে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে বলবেন, এমন অরুচিকর স্বভাব ছিলো না তাঁর। তিনি খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন নতুন নারীদের সাথে। এ-প্রবন্ধে নারীবাদবিরোধী রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ওপরে দিয়েছি, এখন দেখতে চাই রবীন্দ্রনাথ কতোটা মেনে নিয়েছেন নারীমুক্তিকে। কৃতজ্ঞ বোধ করছি নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের প্রতি, কেননা তারা নিজেদের সভায় আমন্ত্ৰণ ক’রে উদ্ধার করেছিলেন পিতৃতান্ত্রিক রবীন্দ্রনাথকে। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ না জানালে তাঁর তিরোধান ঘটতো নারীমুক্তিবিরোধী পুরুষতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত রূপে; আমন্ত্রিত হয়ে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, কাটিয়ে ওঠেন নিজের আযৌবন প্রগতিবিরোধিতা, স্বীকার ক’রে নেন নারীমুক্তিকে, অনেকটা বাধ্য হয়ে। নারীরাই সৃষ্টি করেন এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে, যখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর। যে-নারীমুক্তি একদিন তাঁর কাছে ছিলো অপ্রকৃতিস্থ ভুলপ্যাককরা একদল নারীর আস্ফালন, তা এখন তার কাছে হয়ে ওঠে অনিবাৰ্য :
‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এসিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে।…বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, নূতন নূতন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার-বিচারের পরিবর্তন অনিবাৰ্য হয়ে পড়ছে’ (ওই ৩৭৯-৩৮০)।
অনেক কাল তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিই নারীকে বন্দী করেছে। ঘরে, এখন প্রকৃতির সে-অমোঘ নিয়ম হয়ে ওঠে। ‘আচার-বিচার’ অর্থাৎ প্রথা। তাঁর সব বিশ্বাসই বাতিল হয়ে যায় এর ফলে। যে-গৃহ একদা ছিলো তার চোখে নারীর অনিবাৰ্য এলাকা, তা হয়ে ওঠে। অতীতের ব্যাপার :
‘কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই-যে স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এই-যে মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে, এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মানের জন্যে তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা, বিদ্যার চর্চা, একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল’ (ওই, ৩৮১)।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন মেয়েদের এলাকা ‘স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে’, ‘মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়েছে’; তবে একটু ভুল বুঝেছেন তিনি, কেননা ঘটনাটি এতো স্বতই-ও আপনিই ঘটে নি। এর জন্যে নারীদের লড়াই করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাথেও। যে-রবীন্দ্রনাথ নারীদের বিশেষ বুদ্ধি ও বিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি এখন তার আবশ্যক বোধ করেন নারীদের জন্যে; তিনি দেখেন তার ‘কল্যাণী’র বদলে গেছে, বদলে দিচ্ছে পুরুষের সভ্যতাকে :
‘ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই উপলক্ষে মানুষের সৃষ্টিশীল চিত্তে এই-যে নূতন চিত্তের যোগ, সভ্যতায় এ আর-একটি তেজ এনে দিলে। আজ এর ক্রিয়া প্রত্যক্ষে অপ্রত্যক্ষে চলছে। একা পুরুষের গড়া সভ্যতায় যে ভারসামঞ্জস্যের অভাব প্রায়ই প্ৰলয় বাধাবার লক্ষণ আনে, আজ আশা করা যায় ক্ৰমে সে যাবে সাম্যের দিকে … একটিমাত্র বড়ো আশ্বাসের কথা এই যে, কল্পান্তের ভূমিকায় নূতন সভ্যতা গড়বার কাজে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে–প্ৰস্তুত হচ্ছে তারা পৃথিবীর সর্বত্রই। …এখন অন্ধসংস্কারের কারখানায় গড়া পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করা আর তাদের সাজবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবপালিনী বুদ্ধি, কেবল ঘরের লোককে নয়, সকল লোককে রক্ষার জন্যে কায়মনে প্রবৃত্ত হবে’ (ওই, ৩৮২-৩৮৩)।
তাঁর এতোদিন প্রিয় ছিলো ভুবনের মেয়েকে ভবনেয় মেয়েরূপে দেখা, বিশ্বাস ছিলো প্রকৃতির বিধান তাই। এক সময় মনে করতেন তিনি মেয়েরা বাইরে এলে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে; এখন তিনি তাদের প্রতিভাকে, যাতে তাঁর বিশ্বাস ছিলো না, কাজে লাগাতে চাইলেন সভ্যতার ভারসাম্য সৃষ্টিতে। নারী পুরুষকে অনুপ্রাণিত ক’রে, নিজের নারীত্বকে সভ্যতায় সংক্রমিত ক’রে পুরুষালি সভ্যতাকে কোমল করবে, বিধান করবে সভ্যতার সামঞ্জস্য, এমন কথা তিনি আগে (১৯১৭) বলেছেন; তবে এখন যে-ভারসাম্যের কথা বলেন তা প্রকৃতিতে ভিন্ন। তবে নারী যে সন্তান জন্ম দেয় আর লালন করে, তা ভোলেন নি তিনি, তাই নারীকে দেন ‘সকল লোককে রক্ষার দায়িত্ব’। রবীন্দ্রনাথের মুক্ত নারী হয়ে ওঠে সব মানুষের মা। তাহলে পুরুষ কী করবে? রবীন্দ্রনাথ নারীপুরুষের নতুন সভ্যতার রূপরেখাও আঁকেন :
‘সভ্যতা সৃষ্টির নূতন কল্প আশা করা যাক। এ আশা যদি রূপ ধারণ করে তবে এবারকার এই সৃষ্টিতে মেয়েদের কাজ পূর্ণ পরিমাণে নিযুক্ত হবে সন্দেহ নেই। নবযুগের এই আহ্বান আমাদের মেয়েদের মনে যদি পৌঁছে থাকে। তবে তাদের রক্ষণশীল মন যেন বহু যুগের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাকে একান্ত আসক্তিব সঙ্গে বুকে চেপে না ধলে। তাঁরা যেন মুক্ত করেন হৃদয়কে, উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়। সামনে আসছে নূতন সৃষ্টির যুগ’ (ওই ৩৮৩)।
রবীন্দ্রনাথ নতুন কল্প আশা করেন, যাতে পুরোপুরি অংশ নেবে নারীরা। তবে তিনি যেনো মনে করেন এ-নতুন কল্প সূচনা করেছে পুরুষ, তারা ডাকছে নারীকে, আর নারীদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজেদের রক্ষণশীলতা ছেড়ে নতুন কল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করা। অভিযুক্ত করছেন তিনি নারীদেরই, যেনো তারা হৃদয়কে মুক্ত আর, বুদ্ধিকে উজ্জ্বল করে নি ব’লে, জ্ঞানের তপস্যায় নিষ্ঠা প্রয়োগ করে নি ব’লে বিলম্বিত হয়েছে নতুন কল্প। কিন্তু ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত, পুরুষেরাই—যাদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথও, সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ ক’রে এসেছে নতুন কল্পকে। তবু সুখকর হচ্ছে যে পঁচাত্তর বছব বয়সে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, এবং আরো সুখকর হচ্ছে যে নারীরাই রূপান্তরিত করেছিলো তাঁকে।
ফ্ৰয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা
বিশশতকের এক বড়ো স্থপতির মহিমা পেয়েছেন সিগমুন্ড ফ্ৰয়েড; অবচেতনার আবিষ্কারকরূপে তাঁর জুটেছে খণ্ডকালীন অমরতা। এ-শতকের মানবিক সমস্ত কিছুর ওপর পড়েছে এ-মনোবিশ্লেষকের প্রভাব, নারীও তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে নি। তার আবিষ্কার মূল্য পেয়েছে নতুন কোনো সৌরলোক আবিষ্কারের থেকেও বেশি, কেননা তিনি উদঘাটন করেছেন মহাজগতের দুর্জেয়তম সৌরলোক–মানুষের মন-এর সূত্র! তবে এখন খুব বিরক্তিকর প্রশ্ন জাগছে তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে বিশশতকের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি যে-অবচেতনা, তাও আজ বিপন্ন। নারীসম্পর্কে ফ্ৰয়েডের সমস্ত সিদ্ধান্ত এখন গণ্য হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক বলে; শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলও : একরাশ পিতৃতান্ত্রিক, গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত কুসংস্কার তিনি পেশ করেছিলেন মনোবিশ্লেষণরূপে। ফ্ৰয়েড যখন উদঘাটন ও প্রকাশ করে চলছিলেন ‘মনের অদৃশ্য’ সূত্র, শোনাচ্ছিলেন লিবিডো, অহম্, অবচেতনা, ইডিপাস-ইলেক্ট্রা গুঢ়ৈষা, শিশ্নাসূয়ার পুরাণ; কামকে ক’রে তুলছিলেন বিশশতকের আল্লা; বিহ্বল হয়ে পড়ছিলো চারদিক। কেউ কেউ বিরোধিতা করেছেন তার : অ্যাডলার, হোরনি, টমসন সরে এসেছিলেন ফ্রয়োড়ীয় আঁধার থেকে; তবে ফ্রয়েডীয় আদিম অন্ধকারের পাতালে নেমে-যাওয়া বিশশতক তাদের আলোর ডাকে সাড়া দেয় নি। ফ্রয়েডের মানুষধারণাকেই ভুল মনে হয় আজ; পিতৃতন্ত্রের, গোত্রের ও নিজের দুঃস্বপ্ন মানুষ নামে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে। ফ্রয়েডের মানুষ জৈবিকভাবে নিয়ন্ত্রিত, যার মুক্তি নেই প্রবৃত্তির কারাগার থেকে; ফ্রয়েডের মানুষ এমন জীব, যার জন্ম সংঘাত থেকে, যে চালিত প্রবৃত্তি দিয়ে, যাকে ঘিরে আছে স্তরেস্তরে নিরাশা; যে নিরন্তর সংঘাতরতা নিজের আর বিশ্বের সাথে। ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্ব সহজাত প্রবৃত্তির তত্ত্ব; লিবিডো হচ্ছে মানুষের মৌল কামশক্তি; মানুষের বিকাশ ঘটে ওই অন্ধ আদিম কামশক্তির সাথের ভয়াল সংঘাতের মধ্য দিয়ে; এ-সংঘাতের ভেতর দিয়ে বিকশিত হয় মানুষের চরিত্র, বিবেক ও সৃষ্টিশীলতা। ফ্রয়েডের জৈবিক প্রবৃত্তিনিয়ন্ত্রিত কামচালিত মানুষের সমস্ত বাস্তব কাজ তার অবদমিত কামের বহিঃপ্রকাশ। গীতাঞ্জলি অবদমিত কামের প্রকাশ, আপেক্ষিকতত্