এও বেশ বোধগম্য যে নারীবস্ত্রপ্রস্তুতকারীর শিক্ষানবিশটি, দোকানের কর্মচারী মেয়েটি, সহকারিণীটি পুরুষের ভরণপোষণের সুবিধা ছাড়তে চাইবে না। ইতিমধ্যেই আমি উল্লেখ করেছি যে একটি সুবিধাভোগী গোত্রের অস্তিত্ব থাকা তরুণীর কাছে একটি প্রায়-অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন, কেননা শুধু নিজের দেহ সমর্পণ করেই সে যোগ দিতে পারে ওই গোত্রে, তার নিয়তিই হচ্ছে ‘বীরপুরুষ’-এর কাছে নিজেকে দান করা, এজন্যে যে তার মজুরি ন্যূনতম, আর সেখানে সমাজ তার কাছে জীবনযাপনের যেমান প্রত্যাশা করে, তা খুবই উচ্চ। যদি সে নিজের মজুরি দিয়েই চালাতে চায়, তাহলে সে হয়ে ওঠে একটা অস্পৃশ্য মানুষ : খারাপ বাসা, খারাপ পোশাক, সে বঞ্চিত হবে সমস্ত আমোদপ্রমোদ, এবং এমনকি প্রেম, থেকে। ধার্মিকেরা তাকে দেয় কৃচ্ছতের উপদেশ, এবং আসলেই তার খাবারদাবার অধিকাংশ সময়ই কার্মেলীয় তপস্বিনীর খাবারের মতোই বিশু। দুর্ভাগ্যবশত, বিধাতাকে সবাই প্রেমিক হিশেবে নিতে পারে না : নারী হিশেবে সে যদি জীবনে সফল হতে চায়, তাহলে তাকে সুখী করতে হবে একটি পুরুষকে। তাই সে সাহায্য নেবে, এবং তাকে অনাহারে থাকার মতো মজুরি দেয়ার সময় এর ওপরই সিনিকের মতো নির্ভর করে তার নিয়োগদাতা। এ-সাহায্য কখনো কখনো তার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে এবং প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে সহায়তা করে; তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে, সে ছেড়ে দেবে তার কাজ এবং হয়ে উঠবে একটি রক্ষিতা নারী। সে প্রায়ই রক্ষা করে আয়ের উভয় উৎসকেই এবং এর প্রতিটি কম-বেশি কাজ করে অন্যটির থেকে মুক্তির উপায়রূপে; তবে প্রকৃতপক্ষে সে থাকে দ্বিগুণ দাসত্বে : কাজের কাছে ও রক্ষকের কাছে। বিবাহিত নারীর কাছে তার মজুরিকে মনে হয় টুকিটাকি জিনিশ কেনার টাকা; যে-মেয়েটি ‘পাশ থেকে একটু আয় করে’, তার কাছে পুরুষের দানের টাকাকেই মনে হয়অতিরিক্ত; তবে নিজের চেষ্টায় তাদের কেউই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে না।
তবে আছে প্রচুর সংখ্যক বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত নারী, যারা আর্থনীতিক ও সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের একটি উপায় লাভ করে তাদের পেশার মধ্যে। নারীর সম্ভাবনা ও তার ভবিষ্যৎ বিবেচনা করতে গেলে এগুলোর কথা মনে আসে। যদিও এখনো তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু, তবু এ-কারণেই তাদের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক; নারীবাদী ও নারীবাদবিরোধীদের মধ্যে তারা একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে আছে। পরের দলটি দাবি করে যে আজকের মুক্তিপ্রাপ্ত নারীরা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই করে উঠতে পারে নি এবং নিজেদের আন্তর ভারসাম্য অর্জন করাও তাদের পক্ষে কঠিন। আগের দলটি অতিরঞ্জিত করে পেশাজীবী নারীদের সাফল্যকে এবং দেখতে পায় না তাদের আতর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। প্রকৃতপক্ষে, তারা ভুল পথে আছে বলার বিশেষ কারণ নেই; এবং ত এটা নিশ্চিত যে তারা তাদের এলাকায় প্রশান্তভাবে স্থিত হয় নি : এখন পর্যন্ত ওই দিকে তারা আধাপথ এগিয়েছে। যে-নারী আর্থনীতিকভাবে মুক্তি পেয়েছে পুরুষের থেকে, সে পুরুষের সাথে অভিন্ন নৈতিক, সামাজিক, ও মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতিতে অবস্থান করে না। যেভাবে সে কাজ করে তার পেশায় এবং পেশার প্রতি দেয় যে-মনোযোগ, তা নির্ভর করে তার সমগ্র জীবনপদ্ধতি তাকে দিয়েছে যে-পরিস্থিতি, তার ওপর। কেননা সে যখন তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবন শুরু করে, তখন তার পেছনে থাকে না একই অতীত, যা থাকে একটি ছেলের পেছনে; সমাজ তাকে একইভাবে দেখে না; বিশ্ব তার সামনে উপস্থিত প্রেক্ষিতে। নারী হওয়া আজ একটি স্বাধীন ব্যক্তিমানুষের সামনে উপস্থিত করে বিশেষ ধরনের সমস্যা।
পুরুষ ভোগ করে যে-সুবিধা, যা সে বোধ করে শৈশব থেকেই, সেটা হচ্ছে মানুষ হিশেবে তার বৃত্তি কিছুতেই পুরুষ হিশেবে তার নিয়তির বিপক্ষে যায় না। শিশ্ন ও সীমাতিক্ৰমণতার সমীকরণের মাধমে এটা এমন রূপ নেয় যে তার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সাফল্য তাকে ভূষিত করে এক পৌরুষেয় মর্যাদায়। সে খণ্ডিত নয়। আর সেখানে নারীর নারীত্বকে বাস্তবায়িত করার জন্যে নিজেকে তার আবশ্যিকভাবে করে তুলতে হয় বস্তু ও শিকার, এর অর্থ হচ্ছে তাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে সার্বভৌম কর্তা হিশেবে তার দাবি। এ-বিরোধই বিশেষভাবে লক্ষণীয় করেতোলে মুক্তিপ্রাপ্ত নারীর পরিস্থিতিকে। সে অস্বীকার করে নারী হিশেবে তার ভূমিকায় নিজেকে আবদ্ধ রাখতে, কেননা সে বিকলাঙ্গতাকে মেনে নেবে না; তবে তার লিঙ্গকে অস্বীকার করাও হবে একটি বিকলাঙ্গতা। পুরুষ একটি কামসম্পন্ন মানুষ; নারীও তখনই হয়ে ওঠে পুরুষের সমান একটি পরিপূর্ণ ব্যক্তি, শুধু যখন সে হয় একটি কামসম্পন্ন মানুষ। তার নারীত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে তার মনুষ্যত্বের একটি অংশকে অস্বীকার করা। ‘নিজেদের অবহেলা’ করার জন্যে নারীবিদ্বেষীরা প্রায়ই ভসনা করেছে বুদ্ধিজীবী নারীদের; তবে তারা নারীদের কাছে প্রচার করেছে এ-মতবাদ : যদিতোমরা সমান হতে চাও আমাদের, তাহলে প্রসাধন আর চারিমিনা ছাড়ো।
এ-উপদেশ একটা বাজেকথা। নারীত্বের ধারণাটি যেহেতু কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়েছে প্রথা ও ফ্যাশন দিয়ে, তাই এটা বাইর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় প্রতিটি নারীর ওপর; তাকে ধীরেধীরে রূপান্তরিত করা সম্ভব যাতে তার শোভনতা-শালীনতাবোধের বিধিবিধান হয়ে ওঠে পুরুষের গৃহীত বিধিবিধানের মতো: সমুদ্রসৈকতে এবং প্রায়ই অন্যত্র–ট্রাউজার হয়ে উঠেছে নারীসুলভ। এটা বিষয়টির কোনো মৌল পরিবর্তন ঘটায় না : ব্যক্তিটি এখনো ইচ্ছেমতো তার নারীত্বের ধারণাকে রূপায়িত করার মতো স্বাধীন নয়। যে-নারী খাপ খায় না, সে লৈঙ্গিকভাবে করে নিজের অবমূল্যায়ন, সুতরাং অবমূল্যায়ন করে সামাজিকভাবে, কেননা লৈঙ্গিক মূল্যবোধ সমাজের একটি অচ্ছেদ্য অংশ। নারীর গুণাবলি প্রত্যাখ্যান করলেই কেউ পৌরুষেয় গুণাবলির অধিকারী হয়; এমনকি পুরুষেরপোশাক পরে যে-নারী, সেও নিজেকে পুরুষ করে তুলতে পারে–সে পুরুষের ব্যঙ্গরূপ। আমরা যেমন দেখেছি, সমকাম হচ্ছে একটি বিশেষ মনোভাব : নিরপেক্ষতা অসম্ভব। এমন কোনোনেতিবাচক মনোভাব নেই, যা নির্দেশ করে না একটি ইতিবাচক প্রতিরূপকে। কিশোরী মেয়ে প্রায়ই মনে করে যে প্রথাকে সে অবজ্ঞা করে যেতে পারে; তবে সেখানেও সে বিজড়িত প্ৰকাশ্য বিক্ষোভে; সে একটি নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যার পরিণতির দায় অবশ্যই তাকে নিতে হয়। যখন কেউ একটা গৃহীত বিধানের সঙ্গে সেঁটে থাকতে ব্যর্থ হয়, তখন সে হয়ে ওঠে একটি বিদ্রোহী।অদ্ভুত ধরনের বেশবাস করে যে-নারী, সে যখন সরল ভঙ্গিতে দৃঢ়তার সাথে বলে যে তাকে যে-পোশাকে মানায়, সে তা-ই পরে, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, তখন সে মিথ্যে কথা বলে। সে খুব ভালোভাবেই জানে যে মানানোর জন্যে তাকে হতে হবে অদ্ভুত।