কারণ তিনি তাহার ওয়াজে হাদিস-কোরআনের বাহিরের এক আলফাযও এস্তেমাল করিতেন না।
এই উপলক্ষে তিনি মনগড়া হাদিস ব্যাখ্যাকারী আলেম নামধারী জাহেলদের ফেরেব হইতে পরহে থাকিবার জন্য হাযেরানে-মজলিসকে বিশেষ সাবধান করিয়া দিলেন এবং মুন্সী গরীবুল্লাহও যে এই শ্রেণীর লোক; নিতান্ত প্রসঙ্গক্রমে তিনি তারও দু’একটা চাক্ষুষ প্রমাণ উপস্থিত করিয়া রসিকতা করিলেন। সকলেই হাসিয়া সে-রসিকতার মর্যাদা রক্ষা করিল।
ভূমিকাতে ঘণ্টা দেড়েক কাবার হইল।
বাড়িওয়ালা পিছন হইতে বলিয়া গেলেন : খানা তৈয়ার।
সুতরাং মৌলবী সাহেব ভূমিকা হইতে সটান উপসংহারে চলিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন যে, সময় কম বলিয়া আজ কেবল মুখৃতসর-মুখতসর বয়ান করিলেন। আল্লাহর কালাম খোলাসা বয়ান করিতে অনেক সময়ের দরকার। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার খেয়ালে এতই মশগুল হইয়া গিয়াছে যে দীনের কথা শোনার কাজে তাহারা মোটেই সময় ব্যয়। করতে চায় না।
যাহারা মৌলবী সাহেবের সারবান্ ওয়াযের গুরুপাকত্ব হজম করিতে না পারিয়া ইতিমধ্যে উঠিবার জন্য উসপিস করিতেছিল, লজ্জা পাইয়া তাহারাও আবার ভাল হইয়া বসিল।
মৌলবী সাহেব বলিয়া যাইতে লাগিলেন ও হাদিস-কোরআনে কেয়ামতের যে সমস্ত আলামৎ বয়ান করা হইয়াছে, আজকালকার জমানার হালচাল তার সঙ্গে ঠিক ঠিক মিলিয়া যাইতেছে। আজকার মুসলমানরা আখেরাত ছাড়িয়া দুনিয়ার আয়েশ-আরামের জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। দুনিয়ার সুখ মুসলমানের জন্য হারাম একথা তাহারা ভূলিয়া গিয়াছে। হযরত পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পেটে পাথর বাঁধিয়া দিন কাটাইয়াছেন, আজ তাহার উম্মত আমরা কিনা দুনিয়ার ফেকেরে মসরুফ আছি।
এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলবী সাহেব কাঁদিবার মতো মুখ ভঙ্গি করিয়া কোর্তার খুঁটে চোখ মুছিয়া লইলেন।
হাযেরানে-মজলিসেরও অনেকের চক্ষু ছলছল হইয়া আসিল। মৌলবী সাহেব আবার বলিতে লাগিলেন : আমরা ধন-দৌলৎ পাইয়া শয়তানের ওসওয়াসায় খোদাকে ভুলিয়া গিয়াছি। বড়ই আফসোসের কথা, ধন-দৌলতের মায়া আমরা কাটাইতে পারি না। নেহায়েত শরমের কথা, আমরা আজ যাকাত-খয়রাত দেই না। আলেমের হক আদায়। করি না। নায়েবে-নবী, হাদিয়ে উম্মত চেরাগে দিন আলেম ফাযেলের খেদমত করি না। দিনের চেরাগ আলেম ফাযেলেরা দুনিয়ার চিন্তা হইতে ফারেগ হইতে না পারিলে তাহারা এস্লামের রওনক বৃদ্ধি করিবেন কেমন করিয়া? মুসলমানদের যে আজ তদস্তি হইতেছে, তার কারণ ইহারা আলেম-সমাজের হক আদায় করিতেছে না। আলেম সমাজকে যদি পেটের চিন্তা করিতে হয়, তবে আর এসলামের চেরাগ জ্বালাইয়া রাখিবে কাহারা? এইজন্য হাদিস শরীফে আসিয়াছে : নায়েবে-রসুলদের ভরণপোষণের দায়িত্ব সমাজের।
এখানে মৌলবী সাহেব নিজের আর্থিক দুরবস্থার কথা তুলিলেন।
কিভাবে এক দুষ্টের পাল্লায় পড়িয়া নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাটের কারবার করিতে গিয়া তিনি দেনাগ্রস্ত হইয়া পরিয়াছেন। কিভাবে বেদিন কাফের মহাজন মাসে মাসে সুদের টাকা আদায় করিয়া নিতেছে, কিভাবে তিনি ছেলেমেয়েদের লইয়া মহাবিপদে পড়িয়াছেন, কিভাবে তিনি দেশের বিবি ও ছেলেমেয়েদের জন্য দেড় বৎসর যাবৎ একটা পয়সাও পাঠাইতে পারিতেছেন না; সমস্ত বিষয় ছল ছল চোখে বয়ান করিলেন।
এবার সত্য সত্যই তাঁহার চোখে পানি দেখা দিল। তিনি বাম হাতের পিঠ দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিলেন। আলেম ফাযেলকে খোদা বিপদে ফেলেন মুসলমানদের ঈমান পরীক্ষার জন্য। মৌলবী সাহেবকে অর্থ সাহায্য করিয়া এই পরীক্ষায় পাশ করিবার জন্য তিনি সকলকে অনুরোধ করিলেন।
এতক্ষণ শ্রোতৃমণ্ডলী কোনরূপে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল।
এইবার কেহ কাহারও মুখের দিকে না চাহিয়া সকলেই উঠিয়া পড়িল। কেহ-কেহ অতিসন্তর্পণে রওয়ানার উদ্যোগ করিল।
মৌলবী সাহেব পাশে দাঁড়ানো বাড়িওয়ালা মাতব্বর সাহেবের দিকে ছল-ছলে নেত্রে চাহিলেন।
মাতব্বর সাহেব উচ্চস্বরে বলিলেন : মৌলবী সাহেবের এখনও খাওয়া হয় নাই। আপনারা কে কি দিবেন, একটু শীগগির শীগগির দিয়া যাবেন।
কথা শেষ করিয়া মাতব্বর সাহেব দেখিলেন : বাড়ি যাওয়ার আয়োজনে সবাই এত ব্যস্ত যে, কেহ তাহার কথা শুনিয়াছে বলিয়া বোধ হইল না।
তখন তিনি অপেক্ষাকৃত উঁচু গলায় হুকুমের সুরে বলিলেন : যাবেন না মিয়ারা। মৌলবী সাহেবের একটা ব্যবস্থা না করে কেউ যাবেন না।
প্রধান প্রধান অনেকেই ফিরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য হইল। কিন্তু টাকা-পয়সা দানের একটা ফ্যাসাদে পড়িয়া অনেকেরই মুখ একটু ভার বোধ হইতে লাগিল।
অবশেষে এক এক করিয়া প্রায় সকলেই বলিল যে, তার টাকার আজকাল বড় টানাটানি। মাতব্বর সাহেবই তার চাঁদাটা চালাইয়া দিন।
দানের টাকা চালাইয়া দিলে যে তা আর ফিরিয়া পাওয়া যায় না, মাতব্বর সাহেবের সে অভিজ্ঞতা ছিল।
তিনি বলিলেন : নূতন করে চাঁদা আদায় করায় হাঙ্গামা অনেক। লোকের সত্যই আজকাল বড়ড় টানাটানি। আমি বলি কি, কোরবানির চামড়ার যে-টাকা আমার নিকট আমানত আছে, সেই টাকাটাই মৌলবী সাবকে দিয়ে দেওয়া যাক।
ত্রিপলি-যুদ্ধরত তুরস্ককে সাহায্য করিবার জন্য মাত্র তিন চার দিন পূর্বে যে ঐ টাকা দান করিবার ওয়াদা করা হইয়াছে, এবং সে টাকা আদায় করিবার জন্য যে আজকালই লোক আসিতে পারে, মৌলবী সাহেব হইতে আরম্ভ করিয়া মাতব্বর সাহেব পর্যন্ত উপস্থিত সকলেরই সে কথা মনে পড়িয়া গেল।