বুঝিলাম : লাট সাহেব শুধু আমাদের ধর্মপ্রাণতায় শ্রদ্ধাবানই নন, ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও বটে; তাই তিনি আগে হইতেই সব ঠিকঠাক করিয়াই আনিয়াছেন।
আমি লাট সাহেবের কাছে মাফ চাহিলাম এবং তাঁহাকে ধন্যবাদ দিলাম।
তিনি সিল্কের রুমালে চোখ, গাল এবং কপাল মুছিয়া গুড়াই বলিয়া এরোপ্লেনে চড়িলেন এবং দিল্লী কিংবা বিলাত রওয়ানা হইলেন।
আমি নড়িতে পারিলাম না। লাট সাহেব আকাশে উড়িতে উড়িতে আমার দিকে রুমাল উড়াইতে লাগিলেন, একদৃষ্টে তাহাই দেখিতে লাগিলাম।
লাট সাহেবের এরোপ্লেন অদৃশ্য হইলে সেই জনহীন দুর্গন্ধময় শ্মশানে লক্ষ-লক্ষ মৃতদেহের মাঝখানে আমি নিঃসঙ্গ বোধ করিলাম এবং ভয়ে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলাম।
কিছুক্ষণ পরে দেখিলাম : আসমান হইতে একজন ফেরেশতা একথাল মেওয়া লইয়া আসিয়া আমার শিহরে বসিলেন এবং আমার হাত ধরিয়া টানতে-টানতে বলিতে লাগিলেন : বেহেশতে সমস্ত শহীদানের খাওয়া হইয়া গিয়াছে। তুমি খাইবে কখন? শিগগির উঠ।
ফেরেশতার টানাটানিতে আমি জাগিয়া উঠিলাম। দেখিলাম, আমার রুমমেট আমার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিতেছেন : রাত নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, মেসের সক্কলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে তুমি খাইবে কখন? শিগগির উঠ।
নায়েবে নবী
ওয়াযের মজলিস্।
গ্রামের মাতব্বরের বহির্বাটীর প্রাঙ্গণে শামিয়ানা টাঙাইয়া বসিবার জায়গা করা হইয়াছে।
বহু যোগাড়যন্ত্র করিয়া এই মহফেলটি ডাকা হইয়াছে। সাতদিন পূর্ব হইতে ঘোষণা এবং তিনদিন আগে হইতে তাগিদ করিবার পরও যাহারা স্বেচ্ছায় মহফেলে যোগদান করে নাই এবং স্বয়ং ওয়ায়েয সাহেবের পুনঃ অনুরোধে মাতব্বর সাহেব একাধিকবার লোক পাঠাইয়া যাহাদিগকে একমাত্র মাঠ হইতে ধরিয়া আনিয়াছেন, হাযেরানে মজলিসের অধিকাংশই সেই শ্রেণীর লোক।
ওয়ায়েয মৌলবী সুধারামী সাহেব।
তিনিই গ্রামের সরদার বা শরিয়তী শাসক।
কয়েক গ্রামের পরবর্তী এক গ্রামে তিনি বাস করেন। তিনি সেখানকার পুরাতন বাসেন্দা নহেন। তাঁহার জন্মস্থান সুধারাম। তারও আগে তাঁহার পূর্বপুরুষরা পশ্চিম হইতে তথায় তশরিফ আনেন।
দীনি-এলেম হাসেল করিলে তার যাকাৎ দিতে হয় শরা জারি করিয়া। এই সুধারামী সাহেব শরা জারির উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে এক শুভ মুহূর্তে পদার্পণ করেন।
কোথাও দীর্ঘদিন থাকিতে গেলে তথায় বিবাহ করা সুন্নত। তা না হইলে শহওয়াৎ গালেব হয় এবং নফসে-আম্মারা দেহের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ঢালিয়া দেয়।
তাই সুধারামী সাহেব কেবল সুন্নতের ইযযত রক্ষা ও শয়তানের বদৃমায়েসির রাস্তা বন্ধ করিবার জন্য ঐ গ্রামের পুত্রহীন এক গৃহস্থের একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন।
তথাপি দেশের দুই বিবির প্রতি তিনি কদাচ অবহেলা করেন না। শরিয়তের ঠিক ঠিক ব্যবস্থা মতো যথারীতি তাঁহাদের খোরপোষ যোগাইয়া থাকেন এবং সময় পাইলে বৎসরে এক-আধবার দেশেও গিয়া থাকেন।
হাদিস-কোরআনে লার্নি কাবেলিয়ৎ থাকার দরুন তিনি অল্পকাল মধ্যেই পার্শ্ববর্তী তিন-চারিখানা গ্রামের সরদারি দখল করিয়াছেন।
প্রথম-প্রথম কয়েকখানা গ্রাম বাহাস করিয়াই জিতিয়াছিলেন বটে, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবী (সুধারামী সাহেবের মতে মুনশী) গরিবুল্লাহর গোয়ার্তুমিতে শেষ কয়েকটি গ্রাম দখল করিতে হাদিস কোরআন রাখিয়া লাঠি-সোটার ও আদালতের সাহায্য লইতে হইয়াছিল।
সে-সব নিতান্ত পুরান কথা।
ইহার পরে গরীবুল্লাহ সাহেব ও সুধারামী সাহেবের মধ্যে একটা রফা হইয়া গিয়াছে। এই রফার ফলেই সুধারামী সাহেব এই সমস্ত গ্রামের সরদারি ভোগ করিতেছেন।
তবে গরীবুল্লাহ লোক মোতেবর নহেন বলিয়া তিনি ভিতরে ভিতরে এই সমস্ত গ্রামের লোককে গোমরাহ্ করিয়া ফেলিতে যাতে না পারেন, সুধারামী সাহেবের সেদিকে নজর আছে।
গ্রামের সকলে বিশেষ করিয়া অবস্থাশালী সকলে, উপস্থিত আছে কি না, তা নিজে জনে-জনে নাম ডাকিয়া পরীক্ষা করিয়া মৌলবী সাহেব ওয়াজ শুরু করিলেন। মোরেজ ও তালাফফুযের ইযৎ রক্ষা করিয়া, আইন-গাইন কাফের কারী উচ্চারণ করিয়া এবং হায় হুত্তির উচ্চারণ ঠিক হম হইতে বাহির করিয়া তিনি মিস্ত্রী এলহানে যথাক্রমে আউযু, বিসমিল্লাহ ও সূরা ফাতেহা পড়িলেন।
হাযেরানে-মজলিসের কাহারও পক্ষে তাঁহার কথা না শুনিবার কোনও সুবিধা থাকিল; কারণ হাযেরানে-মজলিসের সুবিধার জন্যই হউক, কিম্বা অন্দরে যে, মুরগী পাক হইতেছিল তার খুশবু নাকে প্রবেশ করাতে উৎসাহিত হইয়াই হউক, তিনি কালামে-পাক এত বুলন্দ আওয়াজে পড়িলেন যে, উহা শুনিবার জন্য গ্রামের অনেকেরই পক্ষে কষ্ট করিয়া বাড়ি ছাড়িয়া আসার কোন প্রয়োজন ছিল না।
তিনি আউযু ও বিসমিল্লাহ শরিফের টিকাটিপ্পনি ও সূরা ফাতেহার তফসির বয়ান করিবার পর আরেকবার গলা সাফ করিয়া “ওই কোরিয়াল কুরআনু ফাসতামেউ” আখেরতক পাঠ করিলেন এবং উহার শানে-নযুলও খোলাসা বয়ান করিলেন। এই উপলক্ষে তিনি আল্লাহপাকের বহুৎ বহুৎ তারিফ, কোরআন-মজিদ ও ফোরকানে-হামিদের বরহকত্ব, উহা শ্রবণ করিবার সোওয়াবের বেশুমারত্ব, সোওয়াবের বদলা যে বেহেশত পাওয়া যাইবে তার হুর ও গেলমানদের সুরত ও চান্দের সুরতের পার্থক্য, বেহেশতের শারাবন-তহুরার মিষ্টতা ও মধুর মিষ্টতার আনুপাতিক হিসাব ওগায়রা বয়ান করিলেন এবং তাঁহার ওয়াজ চুপ করিয়া শুনিলেই যে সমস্ত পাওয়া যাইবে, সে সম্বন্ধে হাযেরানে মজলিসকে পুনঃপুনঃ গ্যারান্টি দান করিলেন।