হিন্দুরা কি বলিল কাসরের আওয়াজে তাহা বুঝা গেল না! মুসলমানরা বলিল : মসজিদে চব্বিশ ঘণ্টাই নামাজ পড়া ফরজ। লাট সাহেব আবার ভাবনায় পড়িলেন।
কিন্তু নিজে কিছুই ঠিক করিতে না পারিয়া বড়লাট সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিবার জন্য সংগপাংগসহ শিমলা চলিয়া গেলেন।
এদিকে হিন্দুরা অষ্টপ্রহর শঙ্খ-ঘণ্টা-কাঁসর বাজাইয়া পূজা অর্চনা করিতে থাকিল!
মুসলমানরা চব্বিশ ঘণ্টা আজান দিয়া নামাজ পড়িতে থাকিল।
সমস্ত বাড়ি-ঘর মন্দির ও মসজিদ হইয়া পড়াতেও লোকজনের রাত্রি বাসের কোনই অসুবিধা হইল না; কারণ চব্বিশ ঘণ্টাই যাহারা পূজা অর্চনা ও এবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত, তাহাদের আবার রাতদিন অথবা অন্দর বাহির কি?
সমস্ত হিন্দু পূজা-অর্চনায় এবং সমস্ত মুসলমান নামাজ-বন্দেগিতে চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকায় কলিকাতার কাজকর্ম থামিয়া গেল। ব্যবসায়-বাণিজ্য-দোকানপাট হোটেল-রেস্তোরাঁ গাড়ি-ঘোড়া ট্রাম-ট্যাক্সি সমস্ত বন্ধ হইয়া গেল।
সাহেবরা অন্তত নিজেদের অসুবিধা দূর করিবার জন্য গাড়ি-ঘোড়া চালাইবার চেষ্টা করিল।
কিন্তু পূজা ও নামাজ ছাড়িয়া কোন হিন্দু বা মুসলমান কাজ করিতে রাজি হইল না।
লোকাভাবে সাহেবদের চেষ্টা ব্যর্থ হইল।
কিছুদিন গেল এইভাবে। যাইতও আরো কিছুকাল–
কিন্তু লোকজনের ক্ষুধা লাগিল। অথচ ধর্মকাজ ফেলিয়া পেটের আয়োজন করিতে কেহই প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু ক্ষুধা বাড়িয়া চলিল। সকলের নাড়ি-ভুড়ি চু-চু করিতে লাগিল।
উভয় পক্ষেই দুই একজন অপেক্ষাকৃত কম ধার্মিক লোক ছিল। তাহারা প্রস্তাব করিলঃ কিছুক্ষণের জন্য উপাসনা মুলতবি রাখিয়া পেট ভরিয়া খাইয়া লওয়া যাক।
খাইয়া যে লওয়া উচিত, তা সকলেই স্বীকার করিল। কিন্তু খাইবে কি? খাবার কোথায়? চাউল-ডালও ত নাই। রাঁধিবে বা কে? কোথায় বা রাঁধিবে? মন্দির-মসজিদে ত আর রান্না চলে না?
বিবেচনা করিয়া দেখা গেল : খাইতে গেলে আবার দোকানপাট খুলিতে হয়, মন্দির মসজিদকে আবার রান্নাঘর বানাইতে হয়। কিছুক্ষণের জন্যও কোন উপাসনা বন্ধ করিলেই যে অপরপক্ষে তাহাদের মহল্লায় প্রবেশ করিয়া উপাসনা করিয়া যাইবে। খ্রিস্টান লাট সাহেবের যে হুকুম তাই!
কাজেই আহার করা আর হইল না।
নামাজ ও পূজা চলিতেই থাকিল।
ক্ষুধার জ্বালায় ক্রমে সকলে অচেতন হইয়া পড়িল।
.
চার
আমি ছিলাম বরাবরের অজীর্ণ অগ্নিমান্দ্যের রোগী। কাজেই ক্ষুধা আমাকে তেমন কাবু করিতে পারিল না।
তথাপি অনেক দিনের অনাহারে নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িলাম; মাথা ঘুরিতে লাগিল, চোখে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম! খুবই ঘুম পাইতে লাগিল। কিন্তু ঘুমাইয়া পড়িলে হিন্দুরা পাছে আবার বাদ্য বাজাইয়া যায় এই ভয়ে ঘুমাইলাম না, তাই বসিয়া-বসিয়া ঝিমাইতে লাগিলাম।
অবশেষে নিজের অজ্ঞাতেই ঘুমাইয়া পড়িলাম।
হঠাৎ কাহার ধাক্কায় ঘুম ভাংগিয়া গেল। চোখ মেলিয়া দেখিলাম : লাট সাহেব।
আমি তাহাকে ভক্তিভরে কুর্ণিশ করিতে গেলাম।
বাধা দিয়া তিনি নিঃশব্দে আমার হাত ধরিলেন এবং টানিয়া মসজিদের বাহিরে রাস্তায় আনিয়া আমাকে দাঁড় করাইলেন। তারপর হাতের ইশারায় চারদিক দেখাইলেন।
আমি ভাল করিয়া চোখ মুছিয়া চাহিয়া ভয়ে বিস্ময়ে শিহরিয়া উঠিলাম! দেখিলাম : সারি সার মৃতদেহ স্তূপাকারে পড়িয়া আছে। চিনিলাম : ইহারা সবাই আমার সহকর্মী উপাসনা-রত হিন্দু-মুসলমান। তাহাদের পচা দেহ হইতে দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে বটে, কিন্তু মুখ তাহাদের ধর্মের জ্যোতিতে উজ্জল! বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করিলাম : হিন্দু মৃতদেহগুলির বুকের উপর এক-এক খণ্ড গৈরিক বস্ত্রে আবিরের অক্ষরে লেখা রহিয়াছে—’আর্য বীর’ এবং মুসলমানদের বুকের উপর সবুজ-সবুজ বস্ত্রখণ্ডে রূপালী হরফে লেখা রহিয়াছে—’শহীদ’।
পুলকের আতিশয্যে আমার কান ভোঁ ভোঁ করিতে লাগিল। আমি সগর্বে লাট সাহেবের দিকে চাহিলাম।
বুকে একটি ক্রসচিহ্ন আঁকিয়া লাট সাহেব বলিলেন : বাঙালি জাতটা আজ ধর্মের জন্যেই প্রাণ দিল। ধন; এই জাতি। আফসোস! বড়লাট সাহেবের সংগে পরামর্শ করিতে-করিতে দেরি হইয়া গেল। আর একদিন আগে আসিতে পারিলে এই মহান জাতির অন্ততঃ দু’একজন লোককে বাঁচাইতে পারিতাম।
–তাঁহার চোখ হইতে দুই ফোঁটা পানি টস টস করিয়া পড়িয়া গেল।
আমি লাট সাহেবের এই অশ্রুপাতে কিছুমাত্র প্রভাবিত না হইয়া মাথা উঁচু করিয়া বলিলাম : খোদাকে ধন্যবাদ, আপনি একদিন আগে আসেন নাই। আসিলে গোটা বাঙালি জাতি ধর্মের জন্য এমন করিয়া নিঃশেষ প্রাণদান করিতে পারিত না। আমাদের ধর্মে হস্তবে উদ্দেশ্যে আপনারা যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন, খোদাই তাহা ব্যর্থ করিয়াছেন।
লাট সাহেব বলিলেন : আমাদের প্রতি আপনি অবিচার করিতেছেন। অন্য সময় হইলে এই অপরাধে আপনাকে অন্তরীণে আবদ্ধ করিতাম। কিন্তু মহান বাঙালি জাতির আপনি একমাত্র জীবিত লোক বলিয়া আপনাকে রেহাই দিলাম। ধর্মপ্রাণ বাঙালি জাতির প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধাবান তাহার প্রমাণ চান?
–বলিতে বলিতে তিনি অদূরে অবস্থিত স্বীয় এরোপ্লেনের দিকে অগ্রসর হইলেন এবং তাহা হইতে খুঁটিতে-বাঁধা একটি সাইনবোর্ড আনিয়া স্তুপাকার লাশের মধ্যে পুঁতিয়া দিলেন।
দেখিলাম : সাইনবোর্ডে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা রহিয়াছে—’ধর্ম-রাজ্য’।