আমি একটা খবরের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি; অথচ কলিকাতায় ইসলাম বিপন্ন হওয়ার মতো এত বড় একটা খবর জানি না।
নিতান্ত শরমিন্দা হইলাম।
তাই দ্রুতগতিশীল লোকটির পিছনে দৌড়াইতে-দৌড়াইতে মিনতি করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম : আমি একটা খবরের কাগজের সম্পাদক; সব কথা আমাকে খুলিয়া বলুন, আমি কাগজে ভীষণ আন্দোলন শুরু করিব।
লোকটি গতি একেবারে থামাইয়া ফেলিলেন। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন : কাগজের সম্পাদক? হিন্দু কাগজ নয়ত?
আমি আমার দাড়িতে হাত দিয়া বলিলাম : আমি নিজে খাঁটি মুসলমান, এবং এক মুসলমান কাগজে সম্পাদকতা করি।
লোকটি মুখ ভেংচাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন : স্বরাজ্য দলের টাকা খাও?
আমি খুব জোরের সঙ্গে বলিলাম : এক কানাকড়িও না।
ভদ্রলোক খুশী হইলেন।
বলিলেন : হিন্দুরা মসজিদের সামনে দিয়া বাদ্য বাজাইয়া মিছিল বাহির করিবে। আমরা বাধা দিব। সে বাধা ঠেলিয়া হিন্দুরা দলে বলে লাঠি সোটা লইয়া অগ্রসর হইবে। তাই আমরা ইসলামের ইযযতের জন্য জান নেসার করিতে ছুটিয়াছি। তোমার যদি মুরাদ থাকে, তবে ধর্মের জন্য প্রাণ দিয়া শহীদ হইবার এই সুযোগ ছাড়িও না।
–বলিয়াই লোকটি হাতের লাঠি ঘুরাইতে ঘুরাইতে অগ্রগামী জনতার সঙ্গে মিশিবার জন্য ছুটিতে লাগিলেন।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া ভাবিলাম।
মনে হইল : ইসলামের ইয়ৎই যদি নষ্ট হয়, তবে আমাদের বাঁচিয়া লাভ কি? দুষ্ট হিন্দুরা পবিত্র মসজিদের সামনে দিয়া বাদ্য বাজাইয়া যাইবে, ইহাও কি আমাদিগকে চোখ মেলিয়া বরদাশত করিতে হইবে? না, ইহা হইতেই পারে না।
আমি রাস্তা হইতে একটা লাকড়ি কুড়াইয়া লইয়া জনতার সহিত মিশিবার আশায় প্রাণপণ ছুটিলাম।
আমি যখন জনতার সঙ্গে আসিয়া মিশিলাম, তখন জনতা একটা বড় মসজিদের সামনে কাতার করিয়া দাঁড়াইয়া গিয়াছে। দৌড়াইয়া হাঁপাইয়া পড়িয়াছিলাম। এইবার খানিকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া চারিদিকে চাহিবার সুযোগ পাইলাম।
দেখিলাম : বিরাট ব্যাপার।
শহরের চারিদিক হইতে দলে-দলে মুসলমান আসিয়া সেখানে বিরাট জনতার সৃষ্টি করিয়াছে। রাস্তায় একটি সুই ফেলিবার জায়গা নাই। সবারই মুখ ধর্মের জ্যোতিতে জ্যোতিষ্মান।
কলিকাতার মুসলমানদের মধ্যে এরূপ ধর্ম-জ্ঞান দেখিয়া আমার মৃত প্রাণে আশার সঞ্চার হইল। তবে ত মুসলমান আজো মরে নাই। সত্যই ত এরা আজো একটা জীবন্ত জাতি।
প্রাণে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো একটা পুলকের ঢেউ আসিয়া লাগিল।
আপন মনে ইসলামের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ছবি আঁকিয়া তাহাই নিরীক্ষণ করিতে ল্যাগিলাম।
হঠাৎ বিপুল ‘কালী মাইকি জয়’-ধ্বনিতে আমার চমক ভাংগিয়া গেল।
সম্মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম : ব্যাপার আরও বিস্ময়কর! হাজার হাজার হিন্দু কাতার করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। গুজরাটী, মদ্রাজী, কাশ্মিরী, মাড়োয়ারী, বিহারী, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, শুদ্র প্রভৃতি নানা জাতের নানা বর্ণের হিন্দু গায়ে-গায়ে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়া হিন্দু জাতির ঐক্য ঘোষণা করিতেছে। তাহারা নিশ্চয় হিন্দু ধর্মের ইজ্জত রক্ষায় প্রাণদানের জন্যই অপেক্ষা করিতেছে। হিন্দু জনতার মধ্যে ঐ যে শিখ পাশী বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতির দু’চার জন দেখা যাইতেছে! তবে কি তাহারাও নিজেদের হিন্দুত্বে সচেতন হইয়া উঠিয়াছে? তাহারাও কি তবে মসজিদের সামনে বাদ্য বাজাইয়া হিন্দুর নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হইয়াছে?
আমার পুলকানন্দ দ্বিগুণ হইয়া গেল। স্বধর্মে শিথিল ও আস্থাহীন বলিয়া আমি এতদিন হিন্দুদের নিন্দা করিতাম। বিভিন্ন বর্ণের হিন্দুর মধ্যেকার তীব্র অনৈক্যের জন্য আমি হিন্দু বন্ধুদের অনেক সময় তিরস্কারও করিয়াছি। সেই বিচ্ছিন্ন হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে, ধর্ম ত বড় কথা, বাদ্যের জন্য এমন করিয়া প্রাণ দিতে প্রস্তুত দেখিয়া আমি হিন্দুদের সম্বন্ধে আমার পূর্বের ধারণা বদলাইলাম।
এমন সময় হিন্দু ধর্ম কি জয়’ ধ্বনি গগন বিদীর্ণ করিল। আমার সামান্য সন্দেহটুকু দূর হইয়া গেল।
মুসলমান জনতা এর জবাব দিল। তাহাদের ‘আল্লাহু-আকবর’ ধ্বনি আসমান ফাটাইল।
আমি বুঝিলাম : ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যখন এমন ধর্মভাব জাগরুক হইয়াছে, তখন স্বরাজ না হইবার আর কোন কারণ থাকিল না। কংগ্রেস-খেলাফত নেতারা এতদিন এই বস্তুটির অভাবের জন্য আফসোস করিতেছিলেন।
গান্ধী টুপি-পরা মালকাছা-মারা কয়েকজন কংগ্রেস নেতা মিলিটারী ভংগিতে হিন্দু জনতা তদারক করিয়া বেড়াইতেছিলেন।
সব ঠিক আছে দেখিয়া তাহারা জনতাকে মার্চিং অর্ডার দিলেন।
হিন্দু মিছিল অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিল।
চান-তারা মার্কা মোহাম্মদ আলী ক্যাপ-পরা খেলাফতী নেতারা মুসলিম জনতার নেতৃত্ব করিতেছিলেন।
তাঁহারা বিউগল বাজাইলেন।
মুসলমান জনতা মুযবুত হইয়া পথ আগুলিয়া দাঁড়াইল।
ইট-পাটকেল ছুড়াছুড়ি চলিল।
ক্রমে দুইপক্ষের জনতার দূরত্ব কমিতে লাগিল।
অবশেষে ছুরি খেলায় হাত সাফাইর প্রতিযোগিতা আরম্ভ হইল।
তুমুল সংগ্রাম বাধিয়া গেল।
সমবেত পুলিশ ফুটপাতে কাতার করিয়া উপরওয়ালার হুকুমের অপেক্ষা করিতে লাগিল। গোরা সার্জেন্টরা ঘোড়ায় চড়িয়া ধর্ম-যুদ্ধে রত ভারতবাসীর স্বর্গগমনের ধারা পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল।