কিছুদিন গেল এইভাবে।
ইংরাজ ও মুসলমানদের অনুপস্থিতিতে প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ করিয়া আমাদের বংশবৃদ্ধি হইতে লাগিল।
দুধের আতিশয্যে আমাদের পরিবারদের বাঁট ফাটিয়া যাইতে লাগিল।
কিন্তু দোয়াইবার বা খাইবার লোকের নিতান্ত অভাব।
মুষ্টিমেয় আর্য আর কত দুধ খাইবে?
দুধের টাটানিতে আমাদের পরিবার’রা ছটফট করিতে লাগিল। নিরুপায় হইয়া তাহারা মাটিতে, গাছের গুঁড়িতে বাঁট ঘষিতে লাগিল। তাতে প্রচুর দুধ বাহির হইয়া গেল। সকলে যৎকিঞ্চিত আরাম পাইল।
.
চার
সেই হইতে ঐ উপায়ে দুধ বাহির করা চলিতে লাগিল।
ফলে যা হইল, তা আমরাও আগে কল্পনা করি নাই। অসংখ্য গাভীর দুধে নগর শহর, পল্লী-পাথার ভাসিয়া যাইতে লাগিল। জলের স্রোতের মতো দুগ্ধ প্রবাহিত হইয়া নদী-নালা, খাল-বিল সমস্তই ভরিয়া গেল। সে সমস্তেও যখন আর ধরিল না তখন ক্রমে দেশ ডুবিয়া যাইতে লাগিল।
ক্রমে কাশীতেও বাস করা অসম্ভব হইল। সমস্ত বাড়িঘর দুধে ডুবিয়া গেল।
আর্য সমাজীরা বলিল : চল, পাহাড়ে গিয়া চড়ি।
আমরা সকলে দুধের সাগরে সাঁতার কাটিতে-কাটিতে হিমালয় পর্বতের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
মানুষজাতি আমাদের মতো কষ্টসহিষ্ণু নয়। পথে এক এক করিয়া সমস্ত আর্য দুধের সাগরে ডুবিয়া মরিল।
আমরা বহুকষ্টে এই পাহাড়ে চড়িয়া আত্মরক্ষা করিলাম।
সেই হইতে পাহাড়ে চড়িয়া বাস করিতেছি; কিন্তু দুধের পরিমাণ যেভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাইতেছে তাতে অতি শীঘ্র পর্বতও ডুবিয়া যাইবে। তখন আমরা কোথায় যাইব তা ভাবিয়া নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছি। তোমার আসিবার আগে আমরা সে কথাই আলোচনা করিতেছিলাম। ঐ যে দুধের বান আসিতেছে। সতর্ক হও।
–বলিতে বলিতে বলদ খাড়া হইয়া উঠিল।
আমি ভয় পাইয়া পিছন ফিরিলাম। দেখিলাম : দুধের বিরাট ঢেউ পর্বত প্রমাণ উঁচু হইয়া আমাদের দিকে আসিতেছে।
বলদ এক লাফে দশ হাত দূরে ছিটকাইয়া পড়িল এবং লেজ তুলিয়া দৌড় মারিল।
আমি নড়িবার অবসর পাইলাম না। প্রকাণ্ড একটা ঢেউ আসিয়া আমাকে তলাইয়া ফেলিল।
আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া গেল।
আমি কথা বলিবার চেষ্টা করিয়া গোঙাইয়া উঠিলাম।
আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
দেখিলাম : সেই প্রচণ্ড গরমে আমি তিন-চারটা লেপ-চাপা পড়িয়া আছি! ঘামে সর্বশরীর ভিজিয়া গিয়াছে। আমার স্বপ্নের আমেজ তখনও কাটে নাই। ব্যাপার কি ভাবিতে লাগিলাম।
হঠাৎ স্ত্রীর খিলখিল হাসিতে আমার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম।
স্ত্রী হাসিতে হাসিতে বলিল : রাগ করিয়া নৌকা-ভ্রমণে যাওয়া হইতেছিল বুঝি? নাও আর রাগের সুবিধা হইল না। গোসল করিয়া ভাত খাও।
–বলিয়া একখানা কাগজ হাতে দিল।
দেখিলাম রশিদ লিখিয়াছে : গায়ক সুরেন বাবুর অসুখ হওয়ায় আজ নৌকা-ভ্রমণ স্থগিত রাখা হইল।
ধর্ম রাজ্য
………র সম্পাদক সাহেব ধরিলেন : তাহার কাগজের জন্য একটা গল্প চাই।
বিষম ভাবনায় পড়িলাম। দ্বিজেন্দ্রলালের বীরবর ‘হাতে পার্তামের’ মত চেষ্টা করিলে আমিও যে একজন গল্প-লেখক হইতে পারিতাম তাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু হইতে যে পারি নাই তাতেও সন্দেহ নাই। অথচ গল্প একটা দিতেই হইবে।
তাই এই ভাবনা।
সেদিন অফিস হইতে সকাল-সকাল বাসায় ফিরিয়া টেবিলের সামনে দোয়াত-কলম লইয়া বসিলাম। অনেক ভাবিলাম, কাগজে অনেক আঁচড় কাটিলাম, বন্ধু-বান্ধব স্ত্রী-শালী যাহার কথা মনে আসিল তাহারই নাম লিখিলাম। মানুষের মাথা আঁকিলাম পাখির ঠ্যাং আঁকিলাম কিন্তু গল্পের কোনও কিনারাই করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
মনে করিলাম : একটু তামাক না খাইলে মাথা পরিষ্কার হইবে না। নিজ হাতে তামাক সাজিলাম, একা-একা অনেকক্ষণ তামাক টানিলাম; অনেক কালের অনেক কথা মনেও পড়িল, কিন্তু গল্পের প্লট একটাও আসিল না।
তামাক পুড়িয়া গেল। হুঁক্কাটা সরাইয়া রাখিয়া আবার ভাবিতে বসিলাম।
ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ মনে পড়িল : বসিয়া লিখিতে হলে আমার কলমে লেখা আসে না; বুকের নিচে বালিশ দিয়া উপুড় হইয়া লেখা শুরু করিলে আমার ভাবের অভাব হয় না।
এতক্ষণ এই কথাটা মনে না হওয়ায় নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে শয্যা গ্রহণ করিলাম।
প্রথমতঃ পা গুটাইয়া বুকের নিচে বালিশ দিয়া লেখার ভংগিতেই বসিলাম। কিন্তু অতি অল্পক্ষণেই পা দুইটা সটান লম্বা হইয়া গেল। বালিশটাও দুষ্টামি করিয়া আস্তে-আস্তে বুকের নিচ হইতে ক্রমে মাথার দিকে আসিতে লাগিল। আমার তাতে আপত্তি ছিল না মোটেই।
আমি বালিশের উপর মাথা রাখিয়া গল্পের প্লট আবিষ্কারের গভীরভাবে মনোনিবেশ করিলাম।
.
দুই
হঠাৎ বাহিরে কোলাহল শুনিলাম।
দৌড়িয়া আসিলাম।
দেখিলাম : বিরাট ব্যাপার! কাতারে-কাভারে হাজার-হাজার মুসলমান ইট পাটকেল ছুরি লাঠি গাছের ডাল ইত্যাদি হতে করিয়া দ্রুতগতিতে শহরের পশ্চিম অংশের দিকে অগ্রসর হইতেছে।
আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না শহরের মধ্যে এত বড় একটা ব্যাপার ঘটিয়াছে, অথচ আমি তার কিছুই জানি না।
অবশেষে সাহস করিয়া অপেক্ষাকৃত অল্প-দ্রুতগামী একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম : ব্যাপার কি সাহেব, আপনারা এত লোক কোথায় যাইতেছেন?
লোকটি আমার দিকে চোখ রাংগাইয়া বলিলেন : তুমি কোথাকার লোক বটে হে? ইসলাম আজ বিপন্ন, তুমি তার কোনো খবর রাখ না?
–বলিয়াই তিনি আবার ছুট দিলেন।