এই সুফী সাহেবের নিকট এমদাদ তার প্রাণের বেদনা জানাইল।
সুফী সাহেব দাড়িতে হাত বুলাইয়া মৃদু হাসিয়া ইংরাজী-শিক্ষিতদের উদ্দেশ্য করিয়া অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলিয়া উপসংহারে বলিলেন : হকিকতান যদি আপনি রুহের তরক্কী হাসেল করিতে চান,তবে আপনাকে আমার কথা রাখিতে হইবে। আচ্ছা;মাস্টার সাহেব,আপনি কার মুরিদ?
এমদাদ অপ্রতিভভাবে বলিল : আমি ত কারো মুরিদ হই নাই।
সুফী সাহেব যেন রোগ নির্ণয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন এইভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন : হ-ম্,তাই বলুন। গোড়াতেই গলদ। পীর না ধরিয়া কি কেহ রুহানিয়ৎ হাসেল করিতে পারে? হাদীস শরীফে আসিয়াছে : [এইখানে সুফী সাহেব বিশুদ্ধরূপে আইন-গাইনের উচ্চারণ করিয়া কিছু আরবী আবৃত্তি করিলেন এবং উর্দুতে তার মানে-মতলব বয়ান করিয়া অবশেষে বাংলায় বলিলেন] : জযবা ও সলুক খতম করিয়া ফানা ও বাকা লাভে সমর্থ হইয়াছেন এরূপ কামেল ও মোকাম্মেল,সালেক ও মজযুব পীরের দামন না ধরিয়া কেহ জমিরের রওশনী ও রুহের তরক্কী হাসেল করিতে পারে না।
হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের কথা শুনিয়া এমদাদ নিতান্ত ঘাবড়াইয়া গেল।
সে ধরা-গলায় বলিল : কি হইবে আমার তাহা হইলে সুফী সাহেব?
সুফী সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন : ঘাবড়াইবার কোন কারণ নাই। কামেল পীরের কাছে গেলে একদিনে তিনি সব ঠিক করিয়া দিবেন।
স্বস্তিতে এমদাদের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
সে আগ্রহাতিশয্যে সুফী সাহেবের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল : কোথায় পাইব কামেল পীর? আপনার সন্ধানে আছে?
উত্তরে সুফী সাহেব সুর করিয়া একটি ফরাসী বয়েত আবৃত্তি করিয়া তার অর্থ বলিলেন : জওহরের তালাশে যারা জীবন কাটাইয়াছে,তারা ব্যতীত আর কে জওহরের খবর দিতে পারে? হাজার শোকর খোদার দরগায়,বহু তালাশের পর তিনি জওহর মিলাইয়াছেন।
সুফী সাহেবের হাত তখনও এমদাদের মুঠার মধ্যে ছিল। সে তা আরো জোরে চাপিয়া ধরিয়া বলিল : আমাকে লইয়া যাইবেন না সেখানে?
সুফী সাহেব বলিলেন : কেন লইয়া যাইব না? হাদীস শরীফে আসিয়াছে : (আরবী ও উর্দু) যে ব্যক্তি আল্লাহ্র রাস্তায় আসিতে চায়, তার সাহায্য কর।
সংসারে একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক বৃদ্ধা ফুফুকে কাঁদাইয়া একদিন এমদাদ সুফী সাহেবের সঙ্গে পীর-জিয়ারতে বাহির হইয়া পড়িল।
তিন
এমদাদ দেখিল : পীর সাহেবের একতলা পাকা বাড়ি। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অন্দরবাড়ির সব ক’খানা ঘর পাকা হইলেও বৈঠকখানাটি অতি পরিপাটি প্রকাণ্ড খড়ের আটচালা।
সে সুফী সাহেবের পিছনে পিছনে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল। দেখিল : ঘরে বহু লোক জানু পাতিয়া বসিয়া আছেন। বৈঠকখানার মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁষিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চ আসনে মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ লোক তাকিয়া হেলান দিয়ে আলবোলায় তামাক টানিতেছেন।
এমদাদ বুঝিল : ইনিই পীর সাহেব।
‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিয়া সুফী সাহেব সোজা পীর সাহেবের নিকট উপস্থিত হইয়া হাঁটু পাতিয়া বসিলেন। পীর সাহেব সম্মুখস্থ তাকিয়ার উপর একটি পা তুলিয়া দিলেন। সুফী সাহেব সেই পায়ে হাত ঘষিয়া নিজের চোখে মুখে ও বুকে লাগাইলেন।
তৎপর পীর সাহেব তাঁর হাত বাড়াইয়া দিলেন। সুফী সাহেব তা চুম্বন করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং পিছাইয়া-পিছাইয়া কিছু দূর গিয়া অন্যান্য সকলের ন্যায় জানু পাতিয়া বসিলেন।
পীর সাহেব এতক্ষণে কথা বলিলেন : কিরে বেটা,খবর কি? তুই কি এরই মধ্যে দায়েরায়ে হকিকতে মহব্বত ও জযবায়েযাতী-বনাম হোব্বে এশক হাসিল করিয়া ফেললি নাকি?
পীর সাহেবের এই ঠাট্টায় লজ্জা পাইয়া সুফী সাহেব মাথা নিচু করিয়া মাজা ঈষৎ উঁচু করিয়া বলিলেন,হযরত,বান্দাকে লজ্জা দিতেছেন!
পীর সাহেব তেমনি হাসিয়া বলিলেন : তা না হইলে নিজের চিন্তা ছাড়িয়া অপরের রুহের সুপারিশ করিতে আমার নিকট আসিলেন কেন? কই তোর সঙ্গী কোথায়? আহা! বেচারা বড়ই অশান্তিতে দিনপাত করিতেছে।
এই বলিয়া পীর সাহেব চক্ষু বুজিলেন এবং প্রায় এক মিনিট কাল ধ্যানস্থ থাকিয়া চক্ষু মেলিয়া বলিলেন: সে এই ঘরেই হাজির আছে দেখিতেছি।
উপস্থিত মুরিদগণের সকলে বিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। এমদাদ ভক্তি ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া একদৃষ্টে পীর সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি-গোঁফের ভিতর দিয়া পীর সাহেবের মুখ হইতে এক প্রকার জ্যোতি বিকীর্ণ হইতে লাগিল।
সুফী সাহেব এমদাদকে আগাইয়া আসিতে ইশারা করিলেন। সে ধীরে ধীরে পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সুফী সাহেবের ইঙ্গিতে অনভ্যস্ত হাতে কদম-বুসি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পীর সাহেব “বস বেটা,তোর ভাল হইবে। আহা,বড় গরীব!” বলিয়া আলবোলার নলে দম কষিলেন।
সুফী সাহেব আমতা-আমতা করিয়া বলিলেন : হযরত এর অবস্থা তত গরীব নয়। বেশ ভাল তালুক সম্পত্তি-
পীর সাহেব নলে খুব লম্বা টান কষিয়াছিলেন;কিন্তু মধ্যপথে দম ছাড়িয়া দিয়া মুখে ধোঁয়া লইয়াই বলিলেন : বেটা,তোরা আজিও দুনিয়ার ধন-দৌলত দিয়া ধনী-গরিব বিচার করিস। এটা তোদের বুঝিবার ভুল। আমি গরিব কথায় দুনিয়াবী গোরবৎ বুঝাই নাই। মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার ধন-দৌলত হারাম। এই ধন-দৌলত এনসানের রুহানিয়ত হাসেলে বাধা জন্মায়,তার মধ্যে নফসানিয়ত পয়দা করে। আল্লাহতালা বলিয়াছেন : (আরবী ও উর্দু) বেশক দুনিয়ার ধন-দৌলত শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা,ইহা হইতে দূরে পলায়ন কর। কিন্তু দুনিয়ার মায়া কাটান কি সহজ কথা? তোদের আমি দোষ দিই না। তোদের অনেকেই এখন যেকেরের দরজাতেই পড়িয়া আছিস। যেকরে জলী ও যেকরে খফী- এই দুই দরজার যেকের সারিয়া পরে ফেকেরের দরজায় পৌঁছিতে হয়। ফেকের হইতে যহুর এবং যহুর হইতে মোরাকেবা-মোশাহেদার কাবেলিয়ত হাসেল হয়। খোদার ফজলে আমি আরেফিন,সালেহীন ও সিদ্দিকিনের মোকামাতের বিভিন্ন দায়েরার ভিতর দিয়া যেভাবে এলমে-লাদুন্নির ফয়েজ হাসেল করিয়াছি,তোদের কলব অতটা কুশাদা হইতে অনেক দেরি অনেক-
-বলিয়া তিনি হুক্কার নলটা ছাড়িয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিলেন এবং চোখ বুজিয়া ধ্যানস্থ হইলেন।