বিচারে হযরত মওলানার দুই বৎসর কারাদণ্ডের আদেশ হইল।
দেশের কাজে আহার দ্রিা পরিত্যাগ করিয়া শিবরাত্রির শলিতার মতো তিল তিল করিয়া আত্মদান করায় হযরত মওলানার স্বাস্থ্য ইতিপূর্বেই একরূপ নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। কারাবাসের কঠোরতায় তিনি একেবারে শয্যা লইলেন। তিন মাস কারাবাসের পর স্বাস্থ্যনাশের ভয়ে সরকার তাহাকে মুক্তি দিলেন।
হযরত মওলানা ভগ্নস্বাস্থ্য পুনঃলাভের জন্য রাচি চলিয়া গেলেন। আর ফিরিলেন না।
নেতার অভাবে আবার বাঙলা অন্ধকার হইল। ভক্তেরা তাঁহার পুনরাবির্ভাব সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিল। গুর্যের সম্পাদকীয় স্তম্ভে বাহির হইল।
বাংলায় ইসলামকে তার পূর্ণ গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করাই হযরত মওলানার আজীবন সাধনা। তিনি আজিও আগের মতই এই সাধনায় শিবরাত্রির শলির মতো লোক লোচনের অন্তরালে নিজেকে তিল-তিল করিয়া বিসর্জন দিতেছেন। তবে স্বভাবতঃই তার সাধনার বাহ্যরূপের একটু পরিবর্তন হইয়াছে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। হযরত মওলানাও জীবন-সায়াহ্নে উপস্থিত। এই সময়ে তিনি যদি দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য একটা স্থায়ী দান রাখিয়া না যান,তবে হযরত মওলানার অবর্তমানে মুসলিম বাংলা চিরতরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হইবে। অথচ রাজনৈতিক হৈ চৈ-এর মধ্যে সে আত্মিক সাধনা সম্ভব নহে। তাই তিনি সহকর্মীদের সনির্বন্ধ অনুরোধে স্থির করিয়াছেন? একদিন ইসলামের মহাপয়গম্বর। যেমন করিয়া সত্যের আলোকের জন্য হেরার নির্জন গহ্বরে আত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, এই তের শত বৎসর পরে তাঁরই নগণ্য উম্মত হযরত মওলানা ইসলামের উন্নতি ও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য রাঁচির শান্ত প্রকৃতির বুকে সাধনায় আত্মনিয়োগ করিবেন। তিনি বাকি জীবনে সেই কঠোর সাধনাতেই সমাহিত থাকিবেন। তাহার সাধনার ফল গ্রন্থাকারে বাহির হইবে। গুর্যের গ্রাহক-গ্রাহিকাদিগকে তাহা অর্ধমূল্যে দেওয়া হইবে।
প্রবন্ধের বাকি অংশ প্রকাশিতব্য গ্রন্থের সম্ভাব্য আকার, দাম ও অগ্রিম মূল্য প্রেরকদের বিশেষ সুবিধা বর্ণিত হইল। তারপর উপসংহারে বলা হইল। সশরীরে হযরত মওলানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে থাকিবে না বটে, কিন্তু তাহার প্রদর্শিত পথে। অগ্রসর হইলে মুসলিম-বঙ্গ তার অভীষ্ট লাভ করিতে পারিবে। সুতরাং কোনও ভয় নাই। মুসলমান সমাজ অগ্রসর হও। নসরুম মিনাল্লাহে ফহুন কবির।
হুজুর কেবলা
এক
এমদাদ তার সবগুলি বিলাতি ফিনফিনে ধুতি,সিল্কের জামা পোড়াইয়া ফেলিল; ফ্লেক্সের ব্রাউন রঙের পাম্প সুগুলি বাবুর্চিখানার বঁটি দিয়া কোপাইয়া ইলশা-কাটা করিল। চশমা ও রিস্টওয়াচ মাটিতে আছড়াইয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল; ক্ষুর স্ট্রপ,শেভিংস্টিক ও ব্রাশ অনেকখানি রাস্তা হাঁটিয়া নদীতে ফেলিয়া দিয়া আসিল;বিলাসিতার মস্তকে কঠোর পদাঘাত করিয়া পাথর-বসানো সোনার আংটিটা এক অন্ধ ভিক্ষুককে দান করিয়া এবং টুথক্রিম ও টুথব্রাস পায়খানার টবের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া দাঁত ঘষিতে লাগিল।
অর্থাৎ এমদাদ অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিল! সে কলেজ ছাড়িয়া দিল।
তারপর সে কোরা খদ্দের কল্লিদার কোর্তা ও সাদা লুঙ্গি পরিয়া মুখে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ঝাঁকড়া দাড়ি লইয়া সামনে-পিছনে সমান-করিয়া চুলকাটা মাথায় গোল নেকড়ার মতো টুপি কান পর্যন্ত পরিয়া চটিজুতা পায়ে দিয়া যেদিন বাড়িমুখে রওনা হইল,সে দিন রাস্তার বহুলোক তাকে সালাম দিল।
সে মনে মনে বুঝিল, কলিযুগেও দুনিয়ায় ধর্ম আছে।
কলেজে এমদাদের দর্শনে অনার্স ছিল।
কাজেই সে ধর্ম,খোদা,রসূল কিছুই মানিত না। সে খোদার আরশ,ফেরেশতা,ওহী,হযরতের মেরাজ লইয়া সর্বদা হাসিঠাট্টা করিত।
কলেজ ম্যাগাজিনে সে মিল,হিউম,স্পেন্সার,কোমতের ভাব চুরি করিয়া অনেকবার খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করিয়াছিল।
কিন্তু খেলাফৎ আন্দোলনে যোগদান করিয়া এমদাদ একেবারে বদলাইয়া গেল।
সে ভয়ানক নামাজ পড়িতে লাগিল। বিশেষ করিয়া নফল নামাজ সে একেবারে তন্ময় হইয়া পড়িল।
গোল-গাল করিয়া বাঁশের কঞ্চি কাটিয়া সে নিজ হাতে একছড়া তসবিহ তৈরি করিল। সেই তসবির উপর দিয়া অষ্টপ্রহর অঙ্গুলি চালনা করিয়া সে দুইটা আঙ্গুলের মাথা ছিঁড়িয়া ফেলিল।
কিন্তু এমদাদ টলিল না। সে নিজের নধর দেহের দিকে চাহিয়া বলিল : হে দেহ,তুমি আমার আত্মাকে ছোট করিয়া নিজেই বড় হইতে চাহিয়াছিলে! কিন্তু আর নয়।
সে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে তসবিহ চালাইতে লাগিল।
দুই
দিন যাইতে লাগিল।
ক্রমে এমদাদ একটা অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল।
বহু চেষ্টা করিয়াও সে এবাদতে তেমন নিষ্ঠা আনিতে পারিতেছিল না। নিজেকে বহু শাসাইল,বহু প্রক্রিয়া অবলম্বন করিল;কিন্তু তথাপি পোড়া ঘুম তাকে তাহাজ্জতের নামাজ তরক্ করিতে বাধ্য করিতে লাগিল।
অগত্যা সে নামাজে বসিয়া খোদার নিকট হাত তুলিয়া কাঁদিবার বহু চেষ্টা করিল। চোখের পানির অপেক্ষায় আগে হইতে কান্নার মতো মুখ বিকৃত করিয়া রাখিল। কিন্তু পোড়া চোখের পানি কোন মতেই আসিল না।
সে স্থানীয় কংগ্রেস ও খেলাফৎ কমিটির সেক্রেটারি ছিল।
সেখানে প্রত্যহ সকাল-বিকালে চারিপাশের বহু মওলানা মৌলবী সমবেত হইয়া কাবুলের আমিরের ভারত আক্রমণের কতদিন বাকি আছে তার হিসাব করিতেন এবং খেলাফত নোট-বিক্রয় লব্ধ পয়সায় প্রত্যহ পান ও র্জদা এবং সময়-সময় নাশতা খাইতেন।
ইহাদের একজনের সুফী বলিয়া খ্যাতি ছিল। তিনি এক পীর সাহেবের স্থানীয় খলিফা ছিলেন এবং অনেক রাত পর্যন্ত ‘এলহু’ ‘এলহু’ করিতেন।
অল্পদিন পূর্বে ‘এস্তেখারা’ করিয়া তিনি দেখিয়াছিলেন যে,চারি বৎসরের মধ্যে কাবুলের আমির হিন্দুস্থান দখল করিবেন।
তাঁহার কথায় সকলেই বিশ্বাস করিয়াছিলো;কারণ মেয়েলোকের উপর জিনের আসর হইলে তিনি জিন ছাড়াইতে পারিতেন।