আমি বিপদ গণিলাম।
হঠাৎ শুনিলাম, সরদার বলদটা উচ্চস্বরে চিৎকার করিয়া বলিল : বৎসগণ, এই আর্যভূমিতে একটিমাত্র মানুষ বাঁচিয়া আছে। সে আর্য হোক অনার্য হোক তাকে মারা যায় না। মানবজাতিকে নির্মূল করা উচিত নয়। তোমরা শিং সামলাও।
সমস্ত গরু শিং সংযত করিল।
আমি বাঁচিয়া গেলাম।
সরদার আমার দিকে চাহিয়া বলিল : বৎস, তোমাদের জাত আমাদের গোজাতি ধ্বংস করিবার অনেক চেষ্টা করিয়াছে। তথাপি আজ তোমাকে আমরা ক্ষমা করিলাম। আর্যভূমিতে বুদ্ধ, চৈতন্য, গান্ধি প্রভৃতি অনেক মহাপুরুষ ক্ষমা ও প্রেম প্রচার করিয়াছেন। তাদের সম্মানের জন্য আমরা শত্রুকেও ক্ষমা করিলাম। তোমার কোনও ভয় নেই।
আমি সাহস পাইয়া বলিলাম : সরদার, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আমি এ কোন দেশে আসিয়াছি?
বলদ বলিল : এ-জায়গার নাম ছিল হিমালয়। ভারতবর্ষ বাসের অযোগ্য হইয়া যাওয়ায় আমরা এই পর্বতে আশ্রয় লইয়াছি।
আমি অধিকতর বিস্মিত হইয়া বলিলাম! ভারতবর্ষ বাসের অযোগ্য হইয়া গেল কিরূপে?
বলদ বলিল : সমস্ত দেশ দুধে ডুবিয়া গিয়াছে।
আমি স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম : ভারতের মানুষেরা সব গেল কোথায়?
বলদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল : সব মরিয়া গিয়াছে।
আমি শিহরিয়া উঠিলাম! অতিকষ্টে বলিলাম : কিরূপে?
বলদ বলিল : তবে বসিয়া শোন।
.
তিন
আমি মাটিতে বসিয়া পড়িলাম।
বলদ বলিতে লাগিল : এই দেশে হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্ম-সম্প্রদায় বাস করিত। ইংরেজ নামে–
বাধা দিয়া আমি বলিলাম : সে-কথা আমি জানি।
বলদ ঈষৎ উষ্ণ হইয়া বলিল : বাধা দিও না, শুনিয়া যাও।
আমি অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিলাম।
বলদ আরম্ভ করিল : ইংরাজ নামে এক বিদেশী জাতি এই দেশ শাসন করিত। তারা এদেশের উপর সুবিচার করিত না। তাই হিন্দু-মুসলমান একযোগে ইংরাজের হাত হইতে দেশ উদ্ধার করিবার জন্য স্বরাজ আন্দোলন আরম্ভ করিল। দেশ সুদ্ধ লোক ইংরাজের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়া উঠিল। ইংরাজের রাজত্ব যায় আর-কি!
এমন সময় ইংরাজ হিন্দুদের কয়েকজনকে ডাকিয়া কানে-কানে কি বলিল! হিন্দুদের মধ্যে আর্যসমাজ নামে এক দল বাহির হইল। তারা চিৎকার করিয়া হিন্দুদিগকে বলিতে লাগিল : ইংরাজ গো-মাতার হত্যসাধন করে বলিয়াই ত আজ আমরা ইংরাজ তাড়াইবার চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু আমাদের সঙ্গীরাই যে গো-হত্যা করে, তাদের আমরা কি করিব?
হিন্দুরা ফিরিয়া দাঁড়াইল। বলিল : তাই তো!
মুসলমানদিগকে বলিল : তোমরা যদি এদেশে থাকিতে চাও তবে গরু খাওয়া ছাড়। অন্যথায় ইংরেজের সঙ্গে একই জাহাজে চড়িয়া পশ্চিমের দিকে সাগর পাড়ি দাও।
মুলমান বলিল : বাঃ রে? আমরা বুঝি এদেশের কেউ নই? কেন আমরা এদেশ ছাড়িয়া যাইব?
হিন্দুরা বলিল : এদেশ না ছাড়, গরু খাওয়া ছাড়।
মুসলমান জাতটা ছিল বড় একগুয়ে; আমাদের ধ্বংস করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্যে।
তারা বাকিয়া বসিল। বলিল : আমরা গরু খাওয়া ছাড়িব না, এদেশও ছাড়িব না। কারণ গরু আমাদের খাদ্য এবং এদেশ আমাদের জন্মভূমি।
হিন্দুরাও রাগিয়া গেল! বলিল : তবে রে বেটারা! আমাদের দেশে বাস করিয়া আমাদেরই সঙ্গে আড়ি। জলে বাস করিয়া কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া? ইংরাজ তাড়াইবার আগে তোদেরই এদেশ হইতে তাড়াইব।
মুসলমানরাও বলিল : আস তবে, আজ একহাত হইয়া যাক্। উভয় দলে সাজ সাজ সাড়া পড়িয়া গেল।
গো-রক্ষা আন্দোলনের প্রবর্তক আর্যসমাজীরা হিন্দুদিগকে বলিল : সবাই মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গেলে গো-মাতার সেবার অসুবিধা হইবে। তোমরা যুদ্ধে যাও, আমরা গরুর ঘাস কাটি।
হিন্দুরা দেখিল : কথা মন্দ নয়। যে গো-দেবতার জন্য যুদ্ধ, তার সেবার ত্রুটি হইলে। দেবতাও অসন্তুষ্ট হইবেন, যুদ্ধ করাও ব্যর্থ হইবে।
হিন্দুরা বলিল : তথাস্তু।
আর্যরা গরুর ঘাস কাটিতে গেল।
হিন্দুরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতরণ করিল।
ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হইল! দিনরাত অবিরাম লড়াই চলিতে লাগিল।
ইংরাজ দেখিল : এভাবে রাজ্য শাসন করা চলে না। অতএব তারা পুলিশ দিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা করিতে লাগিল।
যুদ্ধক্ষেত্রের আশ-পাশে ঘাস কাটা নিরাপদ নয় মনে করিয়া এবং যোদ্ধাগণের হস্তচ্যুত তরবারি গো-দেবতার গায়ে লাগিয়া গো-হত্যা পাপের অনুষ্ঠান হইতে পারে ভয়ে, আর্য-সমাজীরা ভারতের সমস্ত গরু লইয়া বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বোডিং-এ আশ্রয় লইল।
ইংরাজ তার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত থাকিল। সুতরাং খুব শান্তির সঙ্গেই যুদ্ধ চলিতে লাগিল। প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হইতে লাগিল। অবশেষে উভয় পক্ষের সকলেই নিহত হইল, একজন লোকও বাঁচিয়া রহিল না।
সুতরাং যুদ্ধ থামিয়া গেল।
স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইল দেখিয়া ইংরাজ নিশ্চিন্ত আনন্দে ক্লাবে ফিরিয়া গেল।
কিন্তু অধিকদিন আরামে কাটিল না। ত্রিশকোটি লাশ যখন একসঙ্গে পচিতে আরম্ভ করিল, তখন তা হইতে অসহ্য দুর্গন্ধ বাহির হইল।
ইংরাজ নাক বন্ধ করিয়া এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করিতে লাগিল। নাকে এসেন্সের ছিপি চব্বিশ ঘণ্টাই ঢুকাইয়া রাখিল। কিন্তু কোনও ফল হইল না।
কতক দুর্গন্ধে, কতক কলেরায়, অল্পদিনেই সমস্ত ইংরাজও মরিয়া গেল। আর্য সমাজীরা ইতিমধ্যে আমাদিগকে লইয়া কাশীর মন্দিরে আশ্রয় লইল। কাশী নিতান্ত পূণ্যস্থান, তাই সেখানে দুর্গন্ধ প্রবেশ করিল না। আমাদিগকে লইয়া সেখানে আর্যরা নিশ্চিন্তে বাস করিতে লাগিল।