ইসলামের অনিষ্টের ভয়ে প্রতিবাদীদের অনেক চুপ করিয়া গেল; কিন্তু সকলে চুপ করিল না। কেহ কেহ বলিতে লাগিল : তবলিগকার্য যদি আজকাল স্থগিতই থাকে, তবে উহার তহবিলের একটা হিসাব প্রকাশ করিয়া কত টাকা আছে তা দেখান হউক।
কতিপয় দুষ্ট লোকের উদ্যোগে অস্বরাজী ও অখেলাফতী নেতৃবৃন্দের এক সভা আহুত হইল। হযরত মওলানাকে সে সভায় বিশেষভাবে দাওয়া করা হইল। তিনি অসুস্থ শরীরে সেই সভায় যোগদান করিলেন। সভায় তবলিগ ফাণ্ডের সঙ্গে খেলাফত রিলিফ ফাণ্ডাদির কথা উঠিল।
হযরত মওলানা রুগ্ন শরীর লইয়া দাঁড়াইয়া অশ্রুপূর্ণ লোচনে বলিলেন একটা প্রাণ তিনি কতদিকে দিতে পারেন! তবলিগ নয়ত রিলিফ, নয় ত খেলাফত-সবইত তাহার একার ঘাড়ে। তিনি আহার ন্দ্রিা ত্যাগ করিয়া শিবরাত্রির শলিতার মতো নীরবে লোক। লোচনের অন্তরালে তিল তিল করিয়া সমাজ, দেশ ও ধর্মের জন্য প্রাণ দিয়া শরীরের অবস্থা এই করিয়াছেন! অতগুলি তহবিল তাহার হাত দিয়া খরচ হওয়ায় তিনি যদি খরচাদির চুল চেরা হিসাব রাখিতে নাই পারিয়া থাকেন, তজ্জন্য কি তাহার দোষ দেওয়া যায়? সদস্যবৃন্দ কি তাঁহার সন্দেহ করেন? সত্যই যদি তিনি দেশবাসীর এবং সহকর্মী সুহৃদগণের বিশ্বাস হারাইয়া থাকেন, তবে তাহার আর বাঁচিয়া লাভ কি? তবে আর তিনি বাঙলায় মুখ দেখাইবেন না। তিনি বাঙলার নেতৃত্ব ফেলিয়া রাচি চলিয়া যাইবেন।
ইতিমধ্যে দেশের ‘তালুক-মূলক বিক্রয় করিয়া’ হযরত মওলানা রাচিতে একখানি কুটির’ কিনিয়াছেন বলিয়া লোকে বলাবলি করিত।
হযরত মওলানা রাচি চলিয়া গেলে মুসলিম-বঙ্গের গুরুতর অনিষ্ট হইবে নিশ্চিত বুঝিতে পারিয়া উপস্থিত সদস্যবৃন্দের অনেকে মওলানার নিকট ক্ষমতা চাহিলেন এবং যাহারা তাঁহার সততায় সন্দেহ করিয়াছে তাহাদের উদ্দেশ্যে গালাগালি করিয়া সভা ভঙ্গ করিলেন।
‘অকৃতজ্ঞ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পর সপ্তাহে ‘গুর্য’ সন্দেহ-বাদীদিগকে খুব তেরেসে কষাঘাত করা হইল।
সন্দেহবাদীর সংখ্যা হ্রাস পাইল।
.
ছয়
হিসাব-পত্রের ফ্যাসাদ সম্বন্ধে এরূপ নিশ্চিন্ত হইয়া হযরত মওলানা আবার হিন্দু মুসলিম একতা এবং স্বরাজের আবশ্যকতা বর্ণনায় অনলবর্ষণ করিতে লাগিলেন। এই কার্যে তিনি অনেক হিন্দু চরমপন্থীকে লজ্জা দিতে লাগিলেন।
চাকুরি ব্যতীত অন্য সর্বত্র হিন্দুরা মুসলিম প্রতিভার সমাদর করে। তাহাদের নিকট হযরত মওলানার কদর ধাপে ধাপে বাড়িতে লাগিল। কংগ্রেস হইতে আরম্ভ করিয়া ব্ৰহ্ম মন্দির, অদ্বৈতবাদ সভা, থিওসফিক্যাল সোসাইটি, তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ সভা ইত্যাদি সকল সভ–সমিতিতেই মওলানা সাহেবের নাম সভাপতি রূপে বিজ্ঞাপিত হইতে লাগিল। হিন্দু বক্তা ও শ্রোতা সবাই স্বীকার করিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে অত ভাল বাঙলা বক্তা আছে, হযরত মওলানা সাহেবের বক্তৃতা শুনিবার আগে একথা তাহারা বিশ্বাসই করিতেন না।
‘গুর্যে’র অনেক হিন্দু গ্রাহক হইয়া গেল।
একদিন হযরত মওলানা কেবল তবলিগ, আঞ্জুমান ও খেলাফতের নেতা ছিলেন, হিন্দুদের কদবদানিতে এইবার তিনি কংগ্রেসেরও অন্যতম প্রধান নেতায় উন্নতি হইলেন। বাঙলার মুসলমানদের মুখোজ্জ্বল হইল।
স্মাইলস সাহেব বলিয়াছেন : প্রতিভা কখনও চাপা থাকে না। হযরত মওলানা ইসমাইলের প্রতিভাও চাপা রহিল না। হযরত মওলানা প্রতিভা বলে আরও উন্নতি করিতেন, যদি না একটা বিষম বাধা সামনে পড়িল। এই বাধা আমলাতন্ত্র।
আমলাতন্ত্র কেবল নিজেদের দফতরেই মুসলমানকে দাবাইয়া রাখিয়া সন্তুষ্ট নহে, বাহিরে কোথাও মুসলমান উন্নতি করিবে, এটাও তাহারা সহ্য করিতে পারে না। হযরত মওলানা লোকচক্ষুর গোচরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁহার পিছনে লাগিল।
দেশময় ধরপাকড় আরম্ভ হইল। হযরত মওলানার বিবি বিষম শয্যগেত কাতর থাকার দরুণ মওলানা সাহেব অনেক সভায় অনুপস্থিত থাকিতে বাধ্য হইতে লাগিলেন।
কিন্তু আমলাতন্ত্র হিংসুক। তাই তাহাদের পুলিশ হযবত মওলানার গ্রেফতারি পরওয়ানা লইয়া তাহার বাড়িতে উপস্থিত হইল।
নির্জন বাড়িতে কাপুরুষের মতো ধরা দিতে হযরত মাওলানা অপমান বোধ করিলেন এবং গ্রেফতারের সময় দেশবাসীকে অভয়বাণী দিয়া যাওয়া কর্তব্য বিবেচনা করিলেন। তাই তিনি পশ্চাৎদ্বার দিয়া এক পার্কে উপস্থিত হইয়া বক্তৃতা শুরু করিলেন। হযরত মওলানাকে প্রায় সবাই চিনিত। লোকের ভিড় হইল। পুলিশ সংবাদ সংগ্রহ করিয়া সেখানে পৌঁছিতে পার্ক জনাকীর্ণ হইয়া গেল।
তুমুল ‘বন্দেমাতরম্’ ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির মধ্যে হযরত মওলানা গ্রেফতার হইলেন। কিন্তু মরণাপন্ন বিবি সাহেবের শুশ্রূষার জন্য জামিনে খালাস হইতে বাধ্য হইলেন।
‘গুর্যে’ ‘অশনিস্পাৎ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ বাহির হইল। বাঙলা যে নেতৃত্বশূন্য হইল প্রবন্ধের গোড়ার দিকে সেজন্য দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হইল; হযরত মওলানার গ্রেফতারে স্বরাজ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা যে দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল, প্রবন্ধর মধ্যভাগে তা বলা হইল এবং দেশবাসীর প্রাণ-পুলি অদ্বিতীয় নেতা যে কারা-প্রাচীরের অন্তরাল হইতেও তাঁহার আধ্যাত্মিক শক্তি বলে দেশবাসীর অন্তরে অনুপ্রেরণা যোগাইবেন, প্রবন্ধের উপসংহারে সে আশাও প্রকাশ করা হইল।