‘গুর্য’র সম্পাদকীয় স্তম্ভে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ভাষার বোমাবাজি হইতে লাগিল। হযরত মওলানা সাহেবের প্রশংসাসূচক কবিতা ছাপা হইতে লাগিল। বাঙলার মুসলমান বুঝিল, এতদিনের অধঃপতিত মুসলমানের সুদিন আবার ফিরিয়াছে। মফস্বলের বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতি মজলিস-মহফিল, সম্মিলন কনফারেন্স হইতে লাগিল। বিভিন্ন স্থান হইতে হযরত মওলানা সাহেবের দাওয়াত তিনি রক্ষা করিতে লাগিলেন। যাহারা বড় বড় কনফারেন্স করিয়া হযরত মওলানা সাহেবের সম্বর্ধনা করিলেন এবং মালা ও অভিনন্দনপত্র ছাড়া যাহারা মোটা মোটা চাঁদা তুলিয়া দিল, ‘গুর্যে’ তাহাদের সম্বন্ধে প্রশংসাসূচক রিপোর্ট ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হইতে লাগিল।
চাঁদা আদায় হইয়াছিল আশাতীত, সুতরাং ইসলাম প্রচারের কাজ নিশ্চয় আরম্ভ হইত, কিন্তু উপযুপরি নূতন-নূতন কতকগুলি দুর্ঘটনা ঘটায় ইসলাম প্রচারের কাজে বাধা পড়িল।……..
বেআক্কেলপুরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হইল। হিন্দু প্রধান স্থান বলিয়া হিন্দুরা মুসলমানদিগকে বেদম মার দিল। ‘গুর্যে’ নির্যাতিত মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থার মর্মভেদী বর্ণনা বাহির হইতে লাগিল। ‘গুর্য’ কার্যালয়ে হযরত মওলানা সাহেবকে সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ করিয়া এক রিলিফ ফাণ্ড খোলা হইল। স্বয়ং হযরত মওলানা সাহেব দিনরাত খাঁটিয়া অকুস্থানে গমন করিয়া রিলিফের কাজ করিতে লাগিলেন।
হযরত মওলানা সাহেবের অদৃষ্টেও বিশ্রাম ছিল না, বাঙলায় ইসলামেরও ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না।
তাই বেআক্কেলপুরের রিলিফ কার্য সমাধা করিয়া যেই হযরত মওলানা ইসলাম প্রচারের কাজে হাত দিবেন, অমনি দুর্ভাগ্যপুরে ভীষণ বন্যা হইল।
জনসেবক হযরত মওলানার প্রাণ আবার কাঁদিয়া উঠিল। বেআক্কেলপুবের মুসলমানদের জন্য কান্না রঙিন চোখে তিনি আবার দুর্ভাগ্যপুরের বন্যাপীড়িতদের জন্য অশ্রু বহাইতে লাগিলেন। আবার রিলিফ ফাণ্ড খোলা হইল। ‘গুর্যে’র পৃষ্ঠায় আবার উদ্দীপনার তুবড়ি ফুটিতে লাগিল।
টাকা আসিতে লাগিল।
রিলিফ চলিতে লাগিল।
সত্যিকার কর্মীদের জীবনে বিশ্রাম নাই। তাহাদের নিঃশ্বাস ফেলিবারও অবকাশ নাই। তাই দুর্ভাগ্যপুরের রিলিফ কার্য শেষ হইবার পূর্বেই দেশ খেলাফত আন্দোলনের বন্যায় ভাসিয়া গেল।
হযরত মওলানা মুসলিম-বঙ্গের সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য বিশ্বমুসলিমের বিরাট স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারিলেন না। তিনি খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। দেশ
তাঁহার বক্তৃতায় মাতিয়া উঠিল।
ইতিমধ্যে হযরত মওলানা উর্দু বয়ানও আয়ত্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং বাঙলার বাহিরেও তিনি বক্তৃতা দিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
‘গুর্যের’ সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাঁহাকে বঙ্গ-গৌরব বলিয়া অভিনন্দিত করা হইল।
দেশময় সম্মিলন-কনফারেন্স হইতে লাগিল।
হাজি সাহেবের উদ্যোগে এই আহলে হাদিস কনফারেন্সের এক অধিবেশনের আয়োজন হইল।
হযরত মওলানাও নিমন্ত্রিত হইলেন। কিন্তু তিনি নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিলেন।
‘গুর্যে’ হযরত মওলানার এই অসম্প্রদায়িক স্পষ্টবাদিতার জন্য তাঁহার প্রশংসা করা হইল এবং ইসলামের এই দুর্দিনে যাহারা মযহাবী সভা-সমিতি করিয়া ইসলামের শক্তিকে শতধা বিভক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাদের তীব্র নিন্দা করা হইল।
গোঁড়া আহলে হাদিস ব্যতীত আর সকলে হযরত মওলানা সাহেবকে সাধুবাদ দিতে লাগিল। ‘গুর্যের’ জনপ্রিয়তা বাড়িয়া গেল।
দেশ খেলাফতের বন্যায় ভাসিয়া গেল।
কংগ্রেসও খেলাফত আন্দোলনকে নিজের বলিয়া গ্রহণ করিল।
‘গুর্যে’ হিন্দু-মুসলিম একতার মহিমা কীর্তিত হইতে লাগিল।
হযরত মওলানা সাহেব দেশময় লাটিমের মতো ঘুরিয়া হিন্দু-মুসলিম একতা প্রচার করিতে লাগিলেন। পরাধীন জাতির কোনও ধর্ম নাই, কোরআন-হাদিস দ্বারা তিনি ইহা প্রমাণ করিতে লাগিলেন। ভারতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত না হইলে যে মুসলিম-দুনিয়ার আবাদি, এমন কি মক্কা-মদিনার হুরমত রক্ষা হইবে না, মাসের পর মাস ধরিয়া গুর্যের সম্পাদকীয় স্তম্ভে এই সত্য প্রচার চলিতে লাগিল।
যাহারা খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিল না শুধু তাহারাই এবং যাহারা কমিশন-রাস্তা খরচ-ও-ভাতা-বাদে ত্রিশ টাকা বেতনের চাকুরীর জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করিয়া এইরূপ অতীষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহারাই পত্র লিখিয়া ‘গুর্য’ অফিসে এবং সভা-সমিতিতে স্বয়ং হযরত মওলানার কাছে তবলিগের কি হইল জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।
প্রথম-প্রথম ঐ সকল প্রশ্ন উপেক্ষা করা গেল। কিন্তু যখন প্রশ্ন-কর্তার সংখ্যাবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তখন ‘গুর্যে’র সম্পাদকীয় স্তম্ভে এবং সভা-সমিতিতে স্বয়ং হযরত মওলানার বক্তৃতায় যে কৈফিয়ত দেওয়া হইল, তার সারমর্ম এই : ভারতে স্বরাজ সমস্যাই এখন ভারতবাসীর জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা। এই স্বাধীনতার উপর কেবল যে ভারতীয় মুসলমানের জীবন মরণ নির্ভর করিতেছে তা নয়, উপরন্ত ইহার উপর মধ্য প্রাচ্যের সমস্ত মুসলিম রাজশক্তির স্বাধীনতা নির্ভর করিতেছে। এই স্বরাজ সাধনায় হিন্দু মুসলিম একতা অপরিহার্য। বর্তমান অবস্থায় তবলিগকার্যে হাত দিলে হিন্দু-মুসলিম একতায় বিঘ্ন উৎপন্ন হইবে। সুতরাং যাহারা দেশের সংকট অবস্থায় তবলিগ কার্যে হাত দিয়া হিন্দু-মুসলিম একতার মূলে কুঠারাঘাত করিতে চায়, তাহারা শুধু দেশের শত্রু নয়, ইসলামের শত্রু।