বুঝিলাম : ঝড় উঠিয়াছে। নৌকা তীরে ভিড়াইবার জন্য সবাই মাঝিকে গালাগালি করিয়া উপদেশ বর্ষণ করিতেছে।
আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম; সুতরাং গোলমালে যোগ দিলাম না।
ঝড়ের বেগ বাড়িয়া গেল। বন্ধুরা কাপড়-চোপড় খুলিয়া পানিতে ঝাপাইয়া পড়িবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল।
আমি নিরুদ্বেগে বসিয়া রহিলাম।
একটা প্রকাণ্ড ধমকা হাওয়া আসিয়া নৌকা উল্টাইয়া ফেলিল। বন্ধুরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলিয়া পানিতে ঝাঁপ দিল।
আমি একটুও নড়িলাম না। সাঁতার দিবারও চেষ্টা করিলাম না; কারণ ও বিদ্যা আমার জানা ছিল না।
আমি ধীরে ধীরে তলাইয়া যাইতে লাগিলাম।
কিন্তু মরিলাম না।
কিসের ধাক্কায় আবার ভাসিয়া উঠিলাম। উপরের দিকে চাহিয়া আকাশ দেখিলাম, চারিদিকে চাহিয়া অনন্ত জলরাশি দেখিলাম, কিন্তু কোথাও কোন জন-প্রাণী দেখিতে পাইলাম না।
পানির স্রোতে ভাসিয়া চলিলাম।
কতক্ষণ, কতদিন বা কতমাস সেইভাবে ভাসিয়া গেলাম, ঠিক স্মরণে পড়িল না।
হঠাৎ নিজের অনাহারের কথা মনে পড়িল। তৃষ্ণা বোধ করিলাম।
পানিতেই ভাসিতেছিলাম, সুতরাং পানির অভাব ছিলো না; ঠোঁট খুলিয়া এক ঢোক পানি গিলিয়া ফেলিলাম।
একি! এত চমৎকার পানি! একেবারে দুধের মতো স্বাদ।
আমি মাথা উঁচু করিয়া ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিলাম; কেবল স্বাদই নহে, রংও দুধের মতো।
অবাক হইয়া গেলাম। এ কোন দেশে আসিলাম, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
ভাসিয়া যাইতে লাগিলাম।
আরও কতদিন ভাসিয়া গেলাম, তার হিসাব নাই।
অবশেষে একদিন হঠাৎ শরীরে কিসের ধাক্কা লাগিল।
আমি হাত দিয়া দেখিলাম ও শক্ত জিনিস, হয়তো বা পাথর হইবে। ফিরিয়া দেখিলাম, পাথর ত বটেই, তা ছাড়া খানিক দূরে স্থলও দেখা যাইতেছে।
আমি পায়ে ভর করিলাম। মাটি ঠেকিল। হাঁটিয়া কুলের দিকে অগ্রসর হইলাম। নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম। বহু কষ্টে পা টানিয়া টানিয়া দুগ্ধ-সাগর অতিক্রম করিয়া তীরে উঠিলাম।
দেখিলাম : পাথরের দেশ। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে দুধের নহর বহিয়া সাগরে পড়িতেছে।
সেই নহর উজাইয়া আমি আরও অগ্রসর হইলাম। দেখিলাম পালে পালে গরু এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করিতেছে। আমি অবাক হইয়া গেলাম এতসব গরু কার?
আরও অগ্রসর হইলাম। কিন্তু একজন মানুষও দেখিতে পাইলাম না।
গুরুগুলি আমাকে দেখিয়া পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল।
আমি অবলা গো-জাতির এই ভাব দর্শনে বিস্মিত হইলাম।
হঠাৎ পাল হইতে একটা গাভী আমার দিকে অগ্রসর হইয়া কথা বলিতে লাগিলো। বিশুদ্ধ হিন্দি ভাষায় আমাকে বলিল : তুমি দেখিতেছ মানুষ জাতি। তুমি কি করিয়া আজও বাঁচিয়া আছ বাবা?
আমি গভীর বিশুদ্ধ হিন্দী কথায় অবাক হইলাম।
বলিলাম : বাঁচিয়া থাকিব না কেন? কি হইয়াছে? তোমার এ প্রশ্নের উত্তর কি?
গাভী হাসিয়া বলিল : তুমি দেখিতেছি কিছু জান না। আচ্ছা, তুমি কোনদেশী লোক, বাবা?
বলিলাম : আমি বাংলাদেশের লোক।
সমস্ত গরু একযোগে হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল। গাভী দন্তবিকাশ করিয়া বলিল : আপনি। তবে ‘আনন্দবাজার’-এর দেশের লোক।
আমি আরও আশ্চর্য হইয়া বলিলাম : আনন্দবাজার’-এর দেশ কেমন?
গাভী বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফোরিত করিয়া বলিল : আনন্দবাজার’! কেন, ‘আনন্দবাজার চেন না? ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা। আহা, সেই কাগজের সম্পাদক আমাদের জাতির রক্ষা করিবার জন্য কাগজে কত আন্দোলনই না করিয়াছেন।
–বলিয়া বৃদ্ধ গাভী ‘আনন্দবাজার’-সম্পাদকদের উদ্দেশ্যে নমস্কার করিবার জন্য সামনের দুইটা পা কপালে ঠেকাইবার চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেল।
আমি অসহ্য কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করিলাম : এদেশে কি মানুষ নাই?
গাভী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল : সেই কথাইত তোমাকে বলিতে চাহিয়াছিলাম। আচ্ছা, চল আমাদের দলপতির নিকট। তিনিই সব কথা তোমাকে খুলিয়া বলিবেন।
–বলিয়া আমাকে লইয়া সে অগ্রসর হইল।
সমস্ত গরু আমাদের পিছু লইল।
অগ্রসর হইতে-হইতে দেখিলাম : চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল গরু আর গরু! হাজার লক্ষ কোটি কি পদার্থ হইবে তা অনুমান করা গেল না।
আমার বিস্ময় বাড়িতে লাগিল।
গাভী আমাকে তাদের সরদারের নিকট হাজির করিল।
দেখিলাম : সরদার একটা বৃদ্ধ বলদ। তার কপালে চন্দনের ত্রিশুল ও মাথায় টিকি আছে এবং একটা বন্য লতা সামনের দু’পায়ের ভিতর দিয়া শরীর বেষ্টন করিয়া বুঝি বা পৈতার কাজ করিতেছে।
গাভী সরদারের দিকে অগ্রসর হইয়া বলিল : প্রভু, ‘আনন্দবাজার’র দেশের একটা লোক কি অজ্ঞাত উপায়ে আজও বাঁচিয়া আছে কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
বলদ আসন হইতে উঠিয়া আমাকে প্রণাম করিল। আমি আমার অভ্যাসমত এক হাত তুলিয়া সালামের ভঙ্গিতে প্রত্যাভিবাদ করিলাম।
বলদ গাভীর দিকে চাহিয়া ইঙ্গিত করিল। তারপর আমার দিকে চাহিয়া বলিল : তুমি কোন জাত?
আমি বললাম : মুসলমান।
বলদের রোমাঞ্চ হইল।
চতুর্দিকে সমস্ত গরুর পাল হইতে ‘অনার্য’ ‘ম্লচ্ছ’ বলিয়া চিৎকার উঠিল।
গাভীটা “আমার জাত গিয়াছে গো, মুচুনমানটাকে আমি চুঁইয়া ফেলিয়াছি। কাশীও ডুবিয়া গিয়াছে। হায় হায়, আমি কোথায় গিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিব গো”-বলিয়া সম্মুখের একটা পা কপালে ঠেকাইবার চেষ্টা করিয়া কাঁদিতে লাগিল।
আমি অবাক হইয়া চারিদিকে তাকাইতে লাগিলাম। দেখিলাম : ক্ষিপ্ত বঁড়গুলো শিং বাকাইয়া আমাকে গুতাইতে আসিতেছে।