কিন্তু ঐ প্রতিশ্রুতি উপস্থিত সকলেরই স্বার্থের প্রতিকূল বলিয়া কেহ সে কথার উল্লেখ করিলেন না।
ঐ টাকা মৌলবী সাহেবকে দেওয়াই সাব্যস্ত হইল।
মৌলবী সাহেবের মুখের গাম্ভীর্য বাড়িয়া গেল।
তিনি এতক্ষণে জোর গলায় বলিলেন : মোনাজাত না করিয়া মজলিস ভাঙ্গিতে নাই, কারণ ওয়াযের মজলিসে ফেরেশতা আসে।
এই বলিয়া তিনি উচ্চস্বরে উর্দুতে উপস্থিত সকলের, তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের, তামাম জাহানের মুসলমান যিন্দা ও মুর্দা মরদ ও আওরতের, বিশেষ করিয়া হযরত ইব্রাহিম মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হেওসাল্লামের আল-আওলাদের উপর আহসানি পৌঁছাইবার জন্য ও তাঁহাদের প্রত্যেকের কবর মগরেব হইতে মশরেক পর্যন্ত কুশাদা রওশন করিবার জন্য আল্লাহ পাকের নিকট বহুৎ বহুৎ সুপারিশ করিয়া এবং সমস্ত মোমেন মুসলমানকে দুনিয়াবী ধন-দৌলতের ফেরেব হইতে হামেশা দূরে রাখিবার জন্য খোদাকে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করিয়া মোনাজাতের উপসংহার করিলেন। উপস্থিত সকলে পিছন হইতে “আমিন। ইয়া রাব্বেল আলামিন!” বলিয়া তাহার সুপারিশের গোড়া শক্ত করিয়া দিল।
খানা আসিল।
মৌলবী সাহেব খাইতে বসিলেন।
চাঁদা সম্বন্ধে উপরোক্ত মীমাংসা হইবার পূর্বে কামকাজের তাড়নায় যাহাদের এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিবার জো ছিল না, তাহারা এখন নিরুদ্বেগে গল্পগোযারি ও মাতব্বর সাহেবের তামাক ধ্বংস করিতে লাগিল।
মৌলবী সাহেবের খাওয়া আধা-আধি হইয়াছিল। হঠাৎ অদূরে বহু কণ্ঠের মিলিত ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শোনা গেল। মৌলবী সাহেব ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করিলেন।
উপস্থিত সকলে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল।
মৌলবী সাহেব কথার জবাব দিবার ফুরসৎ হইল না। প্রায় জন কুড়ি পঁচিশেক ছেলেপিলে এক যুবকের নেতৃত্বে আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। সকলের হাতে চাঁদ তারা মার্কা নিশান, গলায়-কোমরে প্যাঁচ দেওয়া সবুজ রঙের ব্যাজ!
ইহারা ভলান্টিয়ার। পাশের গ্রামের মাইনর স্কুলের ছাত্র। যুদ্ধরত তুরস্কের জন্য চাঁদা আদায় করা এবং তুর্কীটুপি পোড়ানো ইহাদের কাজ।
স্কুলের জনৈক যুবক শিক্ষক ইহাদের নেতা।
ঘরে প্রবেশ করিয়াই ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলিয়া নেতা মাস্টার সাহেব একটি টুলে বসিয়া পড়িলেন।
ছেলেরা সব জটলা করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল কেহ-কেহ ছেলেদেরও বসিতে বলিল। কিন্তু বসিবার কোন স্থান না থাকায় ছেলেরা দাঁড়াইয়া থাকিল।
মাস্টার সাহেব চারিদিকে চাহিয়া বলিলেন : থাক, থাক, ওদের আর বসতে হবে না। কতক্ষণেরই বা কাজ!
ছেলেরা বসিতে না পারিয়া স্বভাবতই কোন কাজ খুঁজিতে লাগিল।
মৌলবী সাহেবের পাশে পার্টির উপর তাঁহার পাগড়ি পড়িয়াছিল। সেই পাগড়ির ভিতর হইতে একটি টুপির অর্ধেক বাহির হইয়াছিল।
টুপিটি এককালে লাল রঙেরই ছিল; কিন্তু আজকাল তার যে রঙ হইয়াছে, তাকে কোন মতেই লাল বলা চলে না।
তথাপি উহা যে তুর্কীটুপি–অন্ততঃ এককালে তাই ছিল, তাহা বুঝতে দুষ্ট ছেলেদের আর বাকি রহিল না। দুই-তিনজন এক সঙ্গে লম্ফ প্রদান পূর্বক সেই টুপির উপর পড়িল এবং কাড়াকাড়ি করিতে-করিতে তারা আগুন খুঁজিতে লাগিল।
তামাক খাইবার জন্য বিচালির বেণীতে আগুন রাখা হইয়াছিল। মুহূর্তে টুপিটি তারা সেই বেণীতে গুঁজিয়া ধরিল।
মৌলবী সাহেব ‘হেই, কি কর’ বলিয়া এঁটো হাতেই এক লাফে ছেলেদের উপর পতিত হইলেন এবং তাহাদিগকে সজোরে ধাক্কা মারিয়া সরাইয়া দিয়া টুপি উদ্ধার করিলেন।
বহুদিন ধরিয়া মৌলবী সাহেবের বাবরী চুল হইতে পরের বাড়িতে দেওয়া খাঁটি সরিষার তেল চুষিয়া-চুষিয়া টুপিটি এমন সরস হইয়াছিল যে নিংড়াইলে বেশ দুই-চার ফোঁটা তেল বাহির হইত। কাজেই উহাতে বেণীর আগুন অত তাড়াতাড়ি ধরিতে পারে নাই। মৌলবী সাহেব মুখে ছেলেদের বেআদব, বেতমি, রযিল, আতরাফ, বলিয়া গাল দিতে দিতে ঝুটা হাতে টুপি সাফ করিতে গিয়া উহাকে কাল ও হলুদ রঙে রঞ্জিত করিয়া ফেলিলেন।
উপস্থিত সকলে ব্যাপারটা আকস্মিকতায় হতভম্ভ হইয়া গেলেও ছেলেদের উদ্দেশ্য সকলেই বুঝিতে পারিল। তাই মাস্টার সাহেব ছেলেদের তম্বি করিতে গেলে দুই একজন আস্তে-আস্তে বলিল : ছেলেদের আর দোষ কি?
মাস্টার সাহেব ছেলেদের পক্ষ হইতে মৌলবী সাহেবের নিকট মাফ চাহিয়া বলিলেন : ছেলেরা তাদের নেতৃস্থানীয় লোকের আদেশেই তুর্কি টুপি পোড়াচ্ছে। কেউ তাতে রাগ করে না। আপনি আলেম, আপনিও রাগ করবেন না, এই ভরসাতেই তারা আপনার টুপিতে হাত দিয়েছিল।
মৌলবী সাহেব তখনও রাগে ফেঁপাইতেছিলেন। তিনি মুখ ভ্যাঙচাইয়া বলিলেন :, রাগ করব না! ছোকরারা বে-আদবি করবে আমি রাগ করব না। আপনিই বা কেমন ধারা মাস্টার? আপনার ছাত্ররা একজন আলেমের সঙ্গে বে-আদবি করল, আর আপনি তাদেরই তরফে ওকালতি করছেন।
মাস্টার সাহেব বলিলেন : কাজটা যেভাবে করেছে; সেটা সত্যি দোষের, কিন্তু যে কাজটা করতে ওরা যাচ্ছিল, তার আমরা সমর্থন করি।
মৌলবী সাহেব গর্জন করিয়া উঠিলেন : টুপি পোড়ান আপনি সমর্থন করেন?
মাস্টার সাহেব শুদ্ধ করিয়া দিলেন : তুর্কী টুপি পোড়ান।
তুর্কী-ফুকী আমি বুঝি না। টুপি তো? যে টুপি মাথায় দেওয়া হযরতের সুন্নত, যে টুপি মাথায় না দিলে নামাজ হয় না, সেই টুপি আপনারা পুড়িয়ে ফেলেছেন? এসলামের এ বে ইজ্জতি আপনারা মুসলমান হয়ে করেছেন? ইংরাজি পড়লেই এমন হবে, তা আলেমরা আগেই জানত।