ড্রইংরুমে বসে কফি খাচ্ছিল ওরা। কাপড় পরে নিয়েছে সোবহান। পত্রিকার অফিসে যাবে। হঠাৎ সন্ধ্যার আকাশ আচ্ছন্ন করে কালবোশেখির মহাতাণ্ডব শুরু হল। ধন ঘন বিজলির চমক আর বজ্রপারে বিকট আওয়াজ। টি. ভি.টা অফ করে দিয়ে একটা মহিলা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বসল সায়মা। কভার পৃষ্ঠায় গ্রিক দেবীর দীর্ঘাকার ছবি। সুন্দর নিটোল স্বর্ণাভ বক্ষ। পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের প্রতীক। অকারণে ম্যাগাজিনটার পাতা ওল্টাতে লাগল নীরবে।
বাইরে ঝড়ের দাপট বাড়ছ। কফির পেয়ালা উঠিয়ে নিতে এলে আয়াকে বললো সায়মা, ওদের ঘরে গিয়ে জানালাগুলো বন্ধ করে আসো। নইলে ধুলো ঢুকে ব ভরে যাবে। বালির ঝড় উঠেছে বাইরে।
ভীষণ শব্দ করে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিজলি চলে গিয়ে সারা শহর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘন কালো অন্ধকার। অজন্তা গুহারনিবিড় অন্ধকারের মতো। সরীসৃপের গায়ের মতো ঠাণ্ডা অন্ধকার।
চুপ করে বসে আছে সোবহান আর সায়মা। যেন দুই বাত্যাহত নিশাচর পাখি। বাইরে অশনি বিধ্বস্ত গাছগাছালির আর্তনাদ। বাজ পড়ছে বার বার।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সোবহান। অন্ধকারে এগিয়ে গেল সায়মার দিকে। অসমঞ্জস পায়ে। বুকে ওর দেয়ালঘড়ির ঢিপঢিপানি।
শরতের শিউলির মতো ঝরার জন্যই তো ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল সায়মা। দিনে দিনে, রাতে রাতে। শিউলির মতো ছুতেই সোবহানের উষ্ণ বাহুতে ঝড়ে পড়ল ও। সারা শরীর কাঁপছে গভীর আবেগে। অন্ধকারে ওর উন্মুখ অধরের পাপড়ি খুঁজে নিল সোবহান। কালবোশেখির মহাতাণ্ডব সোবহানের পেশিতে স্নায়ুতে, রক্তের প্রতি কণিকায়। অশনির কঠিন প্রহরে যেন বিধ্বস্ত হচ্ছে তার শালবন, ডোবার পাড়ে ঘন সবুজ গাছের সারি। সোবহানের উন্মাদ পেষণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল সায়মা।
দেড় ঘণ্টা পর আলো এল। সমস্ত শহর আবার ঝলমলিয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ সজ্জায়। ততক্ষণে অন্ধকারে পথ হাতড়ে অফিসে চলে গেছে সোবহান। ক্লান্ত, অবিন্যস্ত সায়মা। কোলে ফিল্ম ম্যাগাজিনটি আলতো করে ধরা। কভারে উন্নত গ্রীক দেবীর অপরূপ মূর্তি। সুঠাম সুডৌল স্তনযুগল তার। নত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সায়মা দেবমূর্তিটির দিকে। চোখে ওর হিজল ছায়ার গভীর স্নিগ্ধতা। তৃপ্তির নিবিড় আবেশ ওর সারা অঙ্গ জুড়ে। ঘুম ঘুম দৃষ্টি সায়মার। ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে একটা বড়ো হাই তুলল শব্দ করে।
শীতের পর গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মর র বর্ষা! মারে পর মাস পেরিয়ে গেল। গাছে গাছে এখন কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন। সবুজের সমারোহ পাতায় পাতায়। চন্দনার নাচন পার্কের কচি দূর্বাঘাসে। কাকেরা মিটিং করছে ইলেকট্রিক তারে।
দুপুরের অবেলায় লেকের ধারে এসে একাকি বসে পড়ে সোবহান। পত্রিকার অফিস থেকে আজ আর ঘরে ফেরেনি। কার ঘরে ফিরবে? আতিক চৌধুরীর সংসার। আর কত দিন পরগাছা হয়ে থাকবে ও।
আর যাবেই বা কেমন করে অন্যত্র। ওর সমস্ত স্নায়ু জুড়ে রয়েছে সায়মা। কী এক অদৃশ্য গ্রন্থি দিয়ে ওকে বেতলতার মতো বেঁধে রেখেছে সায়মা। আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। যাদুর সম্মোহন ওর চোখে, নাকের তিলে, দেহের প্রতিটি বাকে!
তবুও মাঝে মাঝে কথা তোলে সোবহান আতিকের সঙ্গে দেখা হলে, অনেক দিন তে থাকলাম আতিক ভাই আপনার ওপর। এবার একটা আলাদা বাসা করি।
ওর কথা শুনে মুখ শুকিয়ে কঠোর হয়ে যায় সায়মার। মাথা নিচু করে বসে থাকে চুপচাপ। অজানা ভয়ে বুকের ভেতর কেমন করে অকারণে জিভ ভেজায় স্যালাইভা দিয়ে। লম্বাটে নখ দিয়ে কপাল খোটে।
উদার হাসি হাসে আতিক চৌধুরী, অত ব্যস্ত হচ্ছো কেন সোবহান? যাবে আর কি আরে কিছুদিন থাকে না। বিনা বেতনে তুমি যে দিনের বেলা আমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, সেটা তো আমাদেরই ফাও লাভ।
কথা বলতে বলতে সোবহানের পিঠে আদরের সঙ্গে চাপড় মারে আতিকচৌধুরী। চোরা চোখে তাকায় সায়মা, উদ্বেগের ভার কেটে গিয়ে প্রশান্ত হয়ে ওঠে ওর মুখমণ্ডল। সোবহানকে থাকতে বলছে আতিক চৌধুরী। আরও কিছুদিন থাকবে ও।
লোহা কাঠের কাঠি আজ আতিক চৌধুরীর চেহারায়। হিমালয়ের মতো গম্ভীর মুখে অফিসের কাগজপত্র দেখছিল চুপচাপ। বেলা বারোটার দিকে বাসায় ফোন করল হঠাৎ করে। বেশ কিছুক্ষণ অপর দিক থেকে রিসিভার ওঠাল সায়মা।
হ্যালো, কে, সায়মা? কী করছ তুমি? এতক্ষণ ফোন ধরলে না যে?
ফোন? এতক্ষণ? এতক্ষণ কেথায়? ও বাথরুমে ছিলাম। শুনতে পাইনি।
কম্পিত কণ্ঠস্বর সায়মার। একটু নার্ভাস যেন।
কী করছো বাসায়? সোবহান নেই?
ততক্ষণে গলার আয়োজ সহজ হয়ে আসে সায়মার, কী আর করব? একা একা বোরড় হচ্চি। সোবহান ভাই? ও তো ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে গেছে। মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ওপর কী একটা ফিচার লিখবে।ওখানে গেছে ডাটা কালেক্ট করতে।
ও! আচ্ছা! আমি ফোন করলাম হঠাৎ সিঙ্গাপুর যাওয়ার দরকার হয়ে গেল। কাল আটটায় ফ্লাইট তুমি আমার স্যুটকেসটা গুছিয়ে রেখা। বাসায় ফিরতে ফিরতে আমার বেশ রাত হয়ে যাবে। ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাতে হবে। অফিরে অনেক কাগজপত্র গুছিয়ে সঙ্গে নিতে হবে।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে সোজা লিফট বেয়ে নীচে নেমে আসে আতিকচৌধুরী। নিজের গাড়িতে উঠে না। একটা স্কুটার ডেকে নেয় হাত বাড়িয়ে।
পা টিপে টিপে বাসায় ঢোকে। বেল টেপে আতিক। মৃদু টুং টুং শব্দ হয় বিলেতি কায়দার কলিং বেলের।