প্রতিষেধক – আবু ইসহাক
কিতাব্বে কথা বলতে বলতে নানি লক্ষ্য করেন–নাতনি অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘কিরে আতিয়া’ তুই কিছু শুনছিস না?
হ্যাঁ শুনছি, তুমি বলে যাও। চমক ভেঙে আতিয়া বেগম বলেন।
হ্যাঁ, মন দিয়ে শোন। শুনলি তো? ঐ মেয়েলোকগুলোও তোর মতো প্রশ্ন করেছিল।
নানি তার কাহিনীর জের টেনে চলেন :
পরের দিন মেয়েলোকগুলো তার কাছে এল। তিনি বললেন, তোমাদের সওয়ালের জওয়াব আমার মেয়ের কাছে পাবে। তারা তখন তার মেয়ের কাছে গেল। তিনি তাদের বললেন, তোমাদের সওয়াল কী? কী জানতে চাও তোমরা?
মেয়েলোকগুলো বলল, আমরা জানতে চাই, একজন পুরুষ যদি চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে, তবে একজন স্ত্রীলোক কেন চারজন স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না?
তিনি বললেন, তোমাদের সওয়ালের জওয়াব দেব, কিন্তু তার আগে এক কাজ করো। চার রঙের চারটা বকরির দুধ চারটা আলাদা পাত্রে করে আমার কাছে নিয়ে এসো।
তারা চলে গেল এবং দুধ নিয়ে ফিরে এল। তিনি তখন চারটা পাত্রের দুধ একটা পাত্রে মিশিয়ে বললেন, কালো বকরির দুধ কে এনেছে? বেছে নিয়ে যাও। সাদা বকরির দুধ কার, বেছে নিয়ে যাও। বাই বললে, দুধ তত মিশে গেছে, এখন কেমন করে বেছে নেবে?
তিনি তাদের বললেন, এখন বুঝতে পেরেছ তো, না, বুঝিয়ে বলতে হবে? মেয়েলোকগুলো তাদের সওয়ালের জওয়াব পেয়ে চলে গেল।
নানি তার কাহিনী শেষ করে একটু দম নেন। আতিয়া বেগমের বিষণ্ণ মুখে আরও মেঘ জমেছে। তার দিকে চেয়ে নানি বলেন, এবার তোর প্রশ্নের জওয়াব পেয়েছি তো? আর চিন্তা করে কী করবি,বোন? আমরা মেয়েলোক মেয়েলোকই। পুরুষরা যেভাবে চালায়, সেভাবে চলতে হবে।
না, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমি তা সহ্য করতে পারব না।
সহ্য না করে উপায় কী বোন? আমরা কত সহ্য করেছি। আমার বিয়ের সময় আমার খেদমতের জন্যে আব্বজন একজন বান্দী সঙ্গে দিয়েছিলেন। বান্দীটাকে আবার তোর নানার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন চিন্তা করে দ্যাখ, আমরা বাপের বাড়ি থেকেই সতীন সঙ্গে করে স্বামীর ঘর করতে গেছি। তারপরেও তোর নানা আরও দুইখান সাদী করেছিলেন।
তোমাদের যুগ আর নেই। তোমাদের সময়ের মেয়েরা ছিল হাঁসী আর মুরগির মতো। কিন্তু আমরা তা নই। আমরা মানুষ। মানুষের মতো বাঁচতে চাই। মানুষ হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার চাই।
অধিকার চাইলেই তো আর পাওয়া যাবে না। শরাশরীয়ত তো মানতে হবে।
আতিয়া বেগম দাঁড়ান। বলেন, নাহু, তোমার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। রাত অনেক হয়েছে। এবার শুয়ে পড়ো, আমি যাই।
আতিয়া বেগম শোবার ঘরে যান। দুই পাশে দুই খাটে ঘুমুচ্ছে শাহীন ও মমতা। আট বছরের ছেলে আর দু’বছরের মেয়ে।
শাহীনের একটা হাত লেপের বাইরে বেরিয়ে আছে। তিনি খাটের পাশে বসে তার হাতটা লেপের মধ্যে গুঁজে দেন। তারপর চেয়ে থাকেন ছেলের মুখের দিকে। একই ছাঁচে গড়া পিতা-পুত্রের মুখ। দশ বছর আগে আফতাবের মুখ অনেকটা এ রকমই ছিল। অন্তত তাঁর চোখ সে মুখ তখন এমনি নিষ্পাপ, এমনি স্নিগ্ধ মনে হয়ত অতীত দিনের স্মৃতি তার মনের পর্দায় ছায়া ফেলতে শুরু করে।
লন্ডনে অধ্যয়নরত বাংলাভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আফতাব আহমদের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় ধাপ বেয়ে বেয়ে কেমন করে ভালোবাসার মিনার-চূড়ায় আরোহণ করেছিল, তা ভাবতে আজও তাঁর মনে দোলা লাগে। আফতাব স্থাপত বিদ্যায় উচ্চডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ভালো মাইনের চাকরি নেয় গিলবার্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে।
আতিয়া বেগম এম. এড. ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন তার পরের বছর। শিক্ষা বিভাগে তারও ভালো চাকরি জুটে যায়।
দুই মন যখন একঠাই হয়ে আছে, তখন দুই হাত এক করতে আর অসুবিধা কী? বেশ ধুমধামের সঙ্গেই আফতাব ও আতিয়ার শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়ে যায়।
বিয়ের পরের সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই আতিয়া বেগমের চোখের কোলে পানি চকচক করে। তিনি ভেবে পান না, সেদিনের সেই আফতাব কেমন করে আজকের এই আফতাবের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে। হ্যাঁ, তাই। আজ তিনি বড় কন্ট্রাকটর। কোয়ালিটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক। টাকা-পয়সার হিসেব নেই। আর সেদিন তো ছিলেন আট শটাকা মাইনের কোম্পানির আর্কিটেক্ট।
আতিয়া বেগম আঁচলে চোখ মোছেন। তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে পড়ার ঘরে বসেন। পাশের থাক থেকে টেনে নেন একখানা বই। বইটা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন আজ।
“রক্ত ও তার শ্রেণীবিভাগ” পরিচ্ছেদটার ওপর তিনি তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। পড়তে পড়তে তার মুখের মেঘ কেটে যায়। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বারবার পড়ে একা বিশেষ অধ্যায়ের কতগুলো কথা তিনি মুখস্থ করে ফেলেন।
আতিয়া বেগম টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে শুরু করেন, কিন্তু দুটো সংখ্যা ডায়াল করেই কী ভেবে রিসিভারটা রেখে দেন। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখেন রাত পৌনে এগারোটা। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যান। ছোট অস্টিনটা তাকে নিয়ে দ্রুত ছুটে চলে।
গন্তব্যস্থল আর বেশি দূর নয়। রাস্তার কিনারায় গাড়িটা রেখে আতিয়া বেগম হেঁটে চলেন, গেটের কাছে গিয়ে তাকান একবার বাড়িটার দিকে। ওপরতলার বদ্বার ঘরে আলো জ্বলছে। আর কোন ঘরে আলো নেই। চাকরবাকরেরা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়।