ওর কাণ্ড দেখে হাসে আতিক। হাসে সোবহানও। একলা পেয়ে বলে, এমনিতেই তো তোমার স্লিম ফিগার। অর্ডে হেপবার্নের মতো। তা আবার অত পরিশ্রম করে কমানোর চেষ্টা কেন? এমনিতেই ফেদার ওয়েট! আরো শুকোলে তো তুলো হয়ে যাবে।
রেশমী চুলে গোছা নাচিয়ে হাসে সায়মা, ফেদার ওয়েট না হাতির ওয়েট। তুমি বুঝলে কেমন করে সোবহান ভাই?
বুঝবো একদিন। বলতে বলতে প্রগাঢ় হয়ে উঠে সোবহানের স্বর। ঝকঝকে হাসিটা হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে ওর ঠোঁটের প্রান্তে। শ্রাবণের আকাশের মত বিষয়।
মাঝে মাঝে দোকানে ঘুরতে যায় সায়মা। ওর নতুন শখ। সঙ্গে সোহান। শাড়ির দোকান, চুড়ির দোকান, ফুটপাথের কাটা কাপড়, স্ব কিছুতেই এখন উৎসাহ সায়মার।
পারফিউমের দোকান থেকে একটা ছোট্ট শিশি কিনে ওকে উপহার দেয় সোবহান। খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে সায়মা। সুগন্ধিটার কাছে নাক নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে, একদম পাটনাই গোটের গন্ধ।
আর আমিই সেই পাটনাই গোট। উচ্ছলভাবে হাসে সোহবান। পারফিউমের শিশিটা তে গিয়ে সায়মার হাত ছুঁয়ে ফেলে আলগোছে। ওর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় দোকানির সামনে। কাকরা চুলের গন্দ শোঁকে শাস টেনে।
চন্দ্রায় পিকনিক করতে এসেছে আতিক চৌধুরীরা। একদঙ্গল বন্ধুবান্ধব, কাচ্চা বাচ্চা, খাবার-দাবার, গানবাজনার লটবহর নিয়ে। অনেককে চেনে না সোবহান, আসতে চায়নি সোহবান। হেসে বলেছে ভালই হল আতিক ভাই। আমি বাড়ির চৌকিদারি করি রোব্বারটা। আর একটা আর্টিকেল লিখব বিশ্ব রাজনীতির ওপর। বাসাটা খালি পেলে সিরিয়াসলি কাজ করতে পার সারাদিন।
আড়ালে একা পেয়ে সোবহানকে চেপে ধরে সায়মা, তুমি চলো আমাদের সঙ্গে। একটুও ভাল লাগবে না আমার তুমি না থাকলে।
ঘাড় কাত করে সায়মার চোখের দিকে অপলক চেয়ে বলে সোবহান, সত্যি?
সত্যি। সজল মেঘের ছায়া সায়মার চোখে।
চন্দ্রা ফরেস্টের গাছ-পালা কাপিয়ে গান বাজছে একটানা। শীতের আকাশে মিষ্টি নরম রোদ। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে শালিক পাখির পেছনে। নেট টাঙ্গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে পুরুষেরা, মেয়েরা কেরাম। তারে আসরে জমে বসেছে আতিক চৌধুরী। স্টেকের খেলা। দার্শনিকের মতো মুখ বানিয়ে খেলছে মাথা ঝুঁকিয়ে। দুনিয়ার হুঁশ নেই ওর।
এই চলো না জঙ্গলটা ঘুরে ঘুরে দেখে আসি। শাল গাছের ফাঁক দিয়ে লাল মাটির অনেকগুলো কাঁচা পথ রয়েছে। হেঁটে বেড়াতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। আতিকের কাঁধের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলে সায়মা।
চোখ দুটো পাকা শিকারির মতো তারে ওপর নিবদ্ধ রেখে আতিক বলে, হু।
হুঁ কী? আতিকের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে কোমর দুলিয়ে বলে সায়মা, এ ডিলটা শেষ করে চলো ঘুরতে যাই।
ঘুরতে যাবে? মাথা একটু তোলে আতিক, সোবহানটাকে নিয়ে যাও। ওটাতো দেখলাম বাট্রেন্ড রাসেলের মোটা বই নিয়ে এসেছে পড়ার জন্য। ভাবখানা যেন কালকেই ওর অনার্স পরীক্ষা।
সত্যি বই পড়ছিল সোবহান মুখ গোমড়া করে। একটা গাছের ছায়ায় পা গুটিয়ে বসে। কারুর সঙ্গে যেন মিশতে পারছে না আজ।
শালবন পেরিয়ে একটা ছোট্ট নিচু ডোবা। তার পাড়ে কাটাবনের ঝোঁপঝাড়। গাছের ছায়া পড়ে ডোবার পানি কালো হয়ে উঠেছে কষ্টিপাথরের মতো। হাঁটতে হাঁটতে তার পাড়ে এসে বসল সায়মা আর সোবহান। শান্ত জলে ওদের ছায়া পড়েছে। কয়েকটা বেগুন খেত পেরিয়ে একটা গোপাট। তার কিনারে বসে হুঁকো ফুঁকছিল এক বুড়ো খেতমজুর। দূর থেকে লক্ষ্য করছিল সায়মাদের মিটি মিটি দৃষ্টি যেন ও পদ্মার চরে রোদপোহানো কুমিরের মতো।
লোকটা দেখছ কেমন হাঁ করে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে? বলে সায়মা, যেন আস্ত গিলে খাবে।
তাকাতে দাও। ও গাঁও গেরামে তোমার মতো কয়টাই বা সুন্দরী দেখেছে? ও তো আর জঙ্গলের বাঘ নয় যে হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বাঘ হলেই বা কী? তুমি তো পাশে আছ। তুমি বাঁচাবে না?
বাঁচাব? না। তোমাকে বাঘে খেলে আমার কী? অভিমানের বিষণ্ণতা সোবহানের কণ্ঠস্বরে! হাসতে হাসতে হঠাৎ গভীর হয়ে যায় আজকাল।
খাপছাড়া কথা বলতে বলতে সায়মার একটা হাত কোলে তুলে নেয় সসবহান। বাধা দেয় না সায়মা। হারে পাতা মেলে ধরে ওর লাভ লাইনটা নখ দিয়ে খুটতে থাকে আস্তে আস্তে। ওটাকে যেন খুঁটে গভীর আর দীর্ঘ করে ছাড়বে। বেলা বাড়ে। ডোবার জলেতে গাছের ছায়া খাটো হয়ে আসে। উঠি উঠি করেও উঠতে পারে না ওরা। দূরে একটা কই গাছে একটানা ডাকতে থাকে ক্লান্তিহীন একজোড়া ঘুঘুপাখি।
পেছন থেকে কথা শোনা যায় আতিক চৌধুরী আর অন্য কয়েকজরে। আলাদা হয়ে বসে সোবহান। সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে।
এই তোরা করছ কী এখানে? এঁদো ডোবার ধারে? দিল খোলা সরল হাসি আতিকের টোপ গেথে বড়শি ফেলছ না তো?
উঠে দাঁড়ায় সোবহান, সায়মা ভাবীকে সোনা ব্যাঙ দেখাচ্ছি। অসংখ্যা ব্যাঙ ডোবাটায়। কলমি দামের ফাঁকে ফাঁকে ভাসছে আরামসে। ডোবার ব্যাঙ শহরে দেখনি কখনো।
বলে কী? ব্যাঙ? ঝুঁকে পড়ে ব্যাঙ দেখে আতিক, বাহু, সত্যি তো অসংখ্য ব্যাঙ ডোবাটায়। গ্রামের লোকগুলো করে কী? ধরে ধরে আমাদের কাছে বেচলেই তে পারে। যা ডিমান্ড ব্যাঙের ঠ্যাংয়ের সারা দুনিয়া জুড়ে? ফ্রগ লেগ ডেলিকেসি।
হাসে সায়মা, আপাদমস্তক ব্যবসায়ী আমার হাসবেন্ড। মগজের প্রতে পরতে ব্যবসার ধান্দা। পিকনিকে এসেও পয়সা কামাইয়ের চিন্তা। বলতে বলতে হঠাৎ গভীর হয়ে ওঠে, একটা দীর্ঘশ্বাস টুকরো টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসে সায়মার বুক থেকে। আতিক দেখে না। সোবহান লক্ষ করে সেটা, আতিক চৌধুরীর ব্যবসায়ী মনে রোমান্সের নামগন্ধও নেই।