কথাটা বলে ফেলেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠ সোবহান। একটা মৃদু রোমাঞ্চ যেন ওর বুকের ভেক্স ধাক্কা দিতে থাকে। নিচু হয়ে বুনতে থাকে। শিথিল হয়ে আসে ওর হাতের গতি। বিষণ্ণ আকাশের ছায়া ওর অবয়বে মৃদু কাঁপন তোলে। রাতে ডিনার খেতে বসেছে আতিক চৌধুরী আর সায়মা। প্রায়ই বাইরে খেয়ে আসে আতিক। নানা পার্টি, ফাংশন। বিদেশি পার্টনারদের নিজে নিয়ে গিয়ে চাইনিজ খাওয়ায় দামি দামি উপঢৌকন দেয়। মাঝে মাঝে সন্দেহের বুদবুদ উঁকি দেয় সায়মার মনে। আতিকের মুখের দিকে নিবিষ্ট ভাবে চেয়ে থেকে বলে, এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকো তুমি। আমার দারুণ অস্বস্তি লাগে। আমাকেও পার্টি-টার্টিতে নিয়ে গেলেই পারো।
কী যে বলো সায়মা, ওসব বিজনেস ডিল উপলক্ষে যত ডিনার আর পার্টি। ওসবের সঙ্গে ঘরের বউকে জড়াতে চাই না আমি। ওতে গেলে ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো তড়পাবে তুমি। তার চেয়ে ঘরে বসে গান শোনো, বাটিক করো, বাগানের তদারক করো, দুএকটা ডিস রান্না করো। দু’এক বার মীনাবাজারে ঢু মারো। ফুর ফুর করে দিন কেটে যাবে।
একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরতে পুরতে যোগ দেয় আতিক, তাছাড়া দিনের বেলা সোবহান তো আছে কুঁড়ে লোকটা তো তেমন সোশাল নয়। ওর সঙ্গে গাল গল্প করে সময় কাটিয়ে দিলেই তো পারো। পাইথনটা বোধ হয় সারাদিন ঘুমোয়।
সোহান ভাই। ও তো বলেছে, আগামী মাসের পয়লা তারিখে অন্যখানে চলে যাবে। অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছে। ওর আগের মেসেও যেতে পারে। ওর একটা গতি করে দিয়েছ তুমি। তাতেই কৃতজ্ঞ। আর কত থাকবে আমাদের ঘাড়ে?
না না ও যাবে না। ও সঙ্কোচের কোন দরকার নেই আমাদের সঙ্গে। ও থাকলে রং বাসাটা পাহারার কাজও হবে। পেটে ভাতে চৌকিদার। ভোরে অফিস যাবার পথে আমিই সোবহানকে বলে দেব। কাল একটু দেরিতে বেরুলে ততক্ষণ ও প্রেস থেকে এসে যাবে।
চুপ করে খেতে থাকে সায়মা। টেপরেকর্ডারে একটা গজল হচ্ছিল ড্রইংরুমে। উৎকর্ণ হয়ে শোনে প্রেমের আকুতি মেহদি হাসানের ললিত কণ্ঠে। ভাবে, ভারী আমুদে লোক সোবহান ভাই। দারুণ আলাপি। ও আছে বলেই তো একটুও আলসেমি আসে না আমার। কবুতরের মতো বকম বকম করে দিন কেটে যায়।
রান্নাঘরে আলুর চপ ভাজছিল সায়মা। কপালে ওর কনক ঘাম। চুলোর আগুনে আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে ওর চেহারার সোনালি আভা। পাশে মাটিতে পা মেলে মটরশুটির খোসা ছাড়াচ্ছে আয়া মরি মা। দুপুরে রান্নার আয়োজন।
কখন যে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সোবহান, একটু টের পায়নি সায়মা। চমকে উঠল ছায়া দেখে।
আরে সোবহান ভাই, আপনি হেঁসেলে কেন? আপনি না ঘুমুচ্ছিলেন লেপের নীচে অজগরের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে?
আপনাকে খুঁজে না পেয়ে এদিকে এলাম। আমার ভারী খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবেন ভাবী?
খিদে পেয়েছে, এগারোটা না বাজতেই? বলেন কী? পত্রিকার অফিসে রাত জেগে কি হাডুডু খেলেন নাকি যে পেটে আগুন জ্বলছে।
আগুন তো জ্বলছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় সোবহান। কিচ্ছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়।
ওর পেছনে এক প্লেট আলুর চপ হাতে করে বেরিয়ে আসে সায়মা।
খান সোবহান ভাই। শরৎ চ্যাটার্জি বলেছেন, পুরুষকে খাওয়ানোতেই নারীর আনন্দ। পুরো প্লেটটা আমাকে শেষ করতে হবে।
একটা ক্ষীণ নিশ্বাস ফেলে সায়মা, আপনার বন্ধুতে সপ্তাহে তিন বেলাও বাসায় খায় না। শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা। জানিনা, কিরে পেছন ছুটছে লোকটা দিনরাত? টাকার পাহাড় দিয়ে কি হবে আমার? ওকে যে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াবো, সে কপালটা কোন দিনই হলো না আমার।
বাইরের লনে শীতের ফুল ফুটেছে। দেদার রঙের বাহার ওদের পাপড়িতে, রঙের বাহার ফুলে ফুলে উড়ে যাওয়া। প্রজাপতিদের পাখনায়। এক দঙ্গল চড়ুই শেফালি গাছের ডালে বসে একটানা লড়াই করছে।
বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে বাইরের সোনালি রোদ দেখছিল সায়মা। গায়ে ওর বুটিদার পশমি শাল। শেষের কবিতার লাবণ্য যেন।
আরে ভাবী, বাইরে কী দেখছে এত মন দিয়ে আমার মতো কবিতার রোগে ধরেনি তো আপনাকে? সোবহানের কথার জবাব দেয় না সায়মা। উদাস চোখ মেলে বলে, সোবহান ভাই, আমি আপনার কত ছোট। ‘ভাবী’ ‘ভাবী’ করে আপনি কি আমাকে দাদি বুড়ি বানিয়ে ছাড়কেন? আমাকে তুমি বলে ডাকবেন এখন থেকে। আদরের ধমক কণ্ঠে।
সায়মার চোখের ঝিলে অপলক চেয়ে থাকে সোহবান। গায়ে ওর বিদ্যাসাগরের মতো শাদা খদ্দরের চাদর। আঙ্গুল দিয়ে চাদরের কোণে গেরো দেয় অজান্তে।
‘সায়মা!’ চাদরের গিট খুলতে খুলতে বলে সোবহান, তুমি ঠিকই বলেছ, আমাদের মধ্যে আপনি সম্পর্কটা আরা নিজের অজ্ঞাতেই পেরিয়ে এসেছি। অনেক দূর যেন পাশাপাশি হেঁটে এসেছি মেঠো পথ ধরে। কচি কচি বুজ পাট খেরে মাঝদিয়ে দীর্ঘ মেঠো পথ। অনেক কাছাকাছি এসে গেছি সমান্তরাল হেঁটে।
আবেগের ভারে গভীর হয়ে ওঠে সোবহানের কণ্ঠ, চলো, আজ থেকে সম্ভাষণের শেষে ‘দন্ত্য ন’ উঠিয়ে দেই আমরা। কী বলো? কথাটা বলেই উদাস হয়ে ওঠে সোবহান। বাইরের চিল-ওড়া আকাশের দিকে অপলক চেয়ে থাকে চোখ মেলে।
চলো। ভেতরে চলো। কফি খাবে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝে খুঁটতে খুঁটতে বলে সায়মা। একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর বুক থেকে।
উচ্ছল চঞ্চল ঝর্নার মতো আজকাল কলকল করে সায়মা। বেদেরি মতো পাতলা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে কাজ করে। ঝাড়ামোছা করে, চেয়ার টেবিলের জায়গা বদল করে, গাদা গাদা কাপড় ধোয়, কখনো ঘর মুছতেও লেগে যায়। শোয়া থেকে উঠে আধ ঘন্টা যোগাসন করে। খুব ভোরে উঠে যায় আজকাল। আতিক চৌধুরী ওঠার ঘণ্টা দেড়েক আগে। নিজেই নাস্তা বানাতে লেগে যায় কিচেনে।