সোবহানের নিষ্প্রভ মলিন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে। কৃতজ্ঞতার নীরব ভাষা ওর গাঢ় দৃষ্টিতে।
উদারভাবে হাসে আতিক চৌধুরী, যুগবার্তা মোটা বিজ্ঞাপন পায় মাসে মাসে আমার ফার্মের। ওদের বলে দেখি, তোমার একটা ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। আরে জার্নালিস্ট, টেক হার্ট, নো ওয়ারি।
স্ফটিকের মতো নির্মল আর স্বচ্ছ হাসি সায়মার মুখে। ব্যস্ত যেন প্রজাপতি। ঘরময় ঘুরঘুর করে সারাদিন। ড্রইং রুমের জিনিসপত্র মোছে, রান্নাঘরে গিয়ে অকারণে আয়ার কাজের তদারকি করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে রং লাগায়। গুণগুণ করে আবার গান গায় ডায়নিং টেবিলের ন্যাপকিন বদলাতে বদলাতে।
পর্যাপ্ত অবসর সায়মার। সময় যেন কাটতে চায় না। বাইরে ঘুরঘুর করার অভ্যেস নেই ওর। গল্পের বই পড়তেও তেমন ভাল লাগে না।
রাতে পাশে শুয়ে আঙ্গুল দিয়ে সায়মার কানের লতি খুঁটতে খুঁটতে বলে আতিক চৌধুরী, সোবাহানটা আসাতে ভালই হল। কথা বলার লোক পাওয়া গেল একটা। তোমার বোরনেসও কাটবে।
বাইরের লোক। আমাদের প্রাইভেসি নষ্ট হবে না বুঝি? আমার কেমন যেন সঙ্কোচ লাগে ওর সামনে বেরুতে।
ওমা সঙ্কোচ কীসের? ও তো আমার বন্ধু মানুষ, ছোট ভাইয়ের মতো। ইউনিভার্সিটিতে আমার এক ক্লাস নীচে পড়ত। চমৎকার কবিতা লিখত তখন। আবৃত্তিতে অনেকগুলো প্রাইজ পেয়েছে সোবহান। খুব ট্যালেন্টেড। ভাল একটা কাজ জুটাতে না পেরেই বেচারা বেশ দমে আছে। না হলে খুব হাসিখুশি ছেলে।
দিন দশেকের মধ্যে চাকরি জুটে গেল সোবহানের। যুগবার্তা পত্রিকায়। অবশ্য আতিক চৌধুরীর ফোনের জোরেই কাজটা পাওয়া গেল।
নাইট শিফটের কাজ। সন্ধ্যায় খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়ে সোবহান। ফিরতে ফিরতে ভোর আটটা নয়টা। এসে নাকে মুখে নাস্তা খুঁজে বাদুরেরমতো লম্বা ঘুম। জাগতে জাগতে দুপুর গড়িয়ে যায়। কখনো কখনো সন্ধ্যা।
চোখ মুখ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সোবহানের। এত অল্প সময়ে একটা পছন্দসই চাকরি জুটে যাবে, ভাবতেও পারেনি ও। সাংবাদিকতায় ওর নেশা খুব সেদিক থেকে খুব খুশি। খাওয়া দাওয়াও ভাল করে জুটেছে এখানে।
ভোরে তড়িঘড়ি পোশাক পরে বেরিয়ে যায় আতিক চৌধুরী। চা-টা ভাল করে খাবারও সময় পায় না। একটু দেরি হলে অফিস থেকে ফোন আসতে থাকে। টেলেক্স যাবে জাপানে, মালের অর্ডার এসেছে অ্যামসটারডাম থেকে, ব্যাঙ্কে এল. সি. নিয়ে গোলমাল বেধেছে। আরো কত কী।
কনকর্ড প্লেনের মতো খাড়া উন্নতির শীর্ষে উঠছে আতিক। প্রথম বছর দুই স্ট্রাগল করেছে। কাজ রপ্ত করতে যা সময় লেগেছে। এখন তো ব্যবসার জারিজুরি ওর নখদর্পণে। অহংকার করে বলে সহযাত্রীদের, টাকা? টাকা তো বাতাসে ভাসছে লাখে লাখে। শুধু হাত বাড়িয়ে ধরতে জানলেই হল। এতদিন উর্দুওয়ালারা জানত ট্রিকসটা। এখন আমরা বাঙালিরা লাইন পেয়ে গেছি।
সোবহানের সঙ্গে কমই দেখা হয় আতিক চৌধুরীর। ও ফেরবার আগেই বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত নয়টা দশটায়। ততক্ষণে ডিনার খেয়ে সোবহান চলে গেছে। প্রেসে। প্রায় দুপুরের খাওয়া হালকা স্যান্ডউইচ দিয়ে অফিসেই সেরে নেয় আতিক। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর মতো মোটা হওয়ার ইচ্ছা নেই, ওর। চমৎকার ফিগার। যেমন লম্বা, তেমনি স্লিম। হাসতে হাসতে বলে, শরীর পাতলা আছে বলেই এত খাটতে পারি অসুরের মতো।
রোব্বার বার ছুটি। বাড়ি থাকে আতিক চৌধুরী। সোবহান একটা খদ্দরের চাদর জড়িয়ে বারান্দায় পায়চারি করে। কবিতা আবৃত্তি করে শোনায় সায়মাকে। রাজনীতি নিয়ে দুই বন্ধু তর্কের তুফান তোল। ঘন ঘন চা আর চানাচুর খায়।
ছুটির দিন বলে আরও এক আধ জন বন্ধুবান্ধব আসে তাস খেলতে। রামি কি কাজু। খেলতে গিয়ে রোজ হারে আতিক চৌধুরী। হারে সায়মাও। খুব সিরিয়াস মুখ বানিয়ে খেলে সোবহান, যেন সংবাদপত্রের পুফ দেখছে অতি সাবধানে। জেতেও প্রায়ই।
নদীর ঢেউয়ের মতো কল কল করে হাসে সায়মা, সোবহান ভাই একটানা জিতেই যাচ্ছেন। লাকি ইন কার্ডস কিন্তু আনলাকি ইন লাভ।
সর চুরি করা বেড়ালের মতো মিটমিটিয়ে হাসে সোবহান। কৌতুকের দীপ্তি ওর চোখে, কী যে বলে ভাবী, প্রেমে যদি একবার কোমর বেঁধে ঝাঁপ দেই, হারব না আমি নিশ্চয়ই। আমার শকল সুরত তো আর শিম্পাঞ্জির মতো নয় যে, মেয়েরা দেখে ছুট দেবে। কলেজে রািজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করেছি আমি।
তাদের ওপর চোখ নিবদ্ধ রেখেই বলে আতিক চৌধুরী, শিম্পাঞ্জির মতো হতে যাবে কেন? অযোধ্যার নবাবের চেহারা আমাদের সোবহানের। চেষ্টা করলে নবাব পতৌদীর মতো আরেকটা শর্মিলা ঠাকুর বাগাতে পারবে ও।
আজকাল দুপুর না হতেই ঘুম ভেঙে যায় সোবহানের। শুয়েশুয়ে শোনে, ড্রইং রুমে পায়চারি করছে সায়মা। মিউজিক সেন্টারে ডিক্স চাপিয়ে ডিসকো মিউজিক শুনছে। তড়কপূজার ধূমধাড়াক্কা যেন সারা রময়। দালানটা যেন লাফাতে থাকে বাদের আওয়াজে।
অনেকক্ষণ ধরে সায়মার পদচারণা শোনে সোহবান। তারপর গেস্ট রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। একটা নীল পুলওভার বুনছে সায়মা। হলুদ আভা ওর চাপারং আঙ্গুলে। বোনার কাঁটা দুটো আলোতভাবে ধরা চিকন আঙুল দিয়ে। নিবিষ্ট মনে বোনা দেখে সোবহান। অজান্তেই বলে ফেলে, কী দ্রুত বুনতে পারেন আপনি ভাবী। অপূর্ব!
কী অপূর্ব?
আপনার আঙুলগুলো।