স্পষ্ট অনুভব করছেঃ দুর্বল হৃদয়, নিজের অধিকার সম্বন্ধে সদা-সঙ্কুচিত মফিজুল তাকে না পাওয়ার সান্ত্বনাহীন দুঃখে কেঁদে কেঁদে হয়রান হচ্ছে। কাছে বোকার মত, শিশুর মত। অবোধ বোকা শিশু মফিজুল!
বিদ্রোহের নিরুদ্ধজ্বালা মালেকার মনকে আবেগের কঠিন প্রতিঘাতে দুর্দমনীয় করে তুলছে। হঠাৎ মালেকার দুর্বার ইচ্ছা হয় বারান্দায় টহল দিতে। ইংরেজি অনেক বইয়ে সে পড়েছে, এমন অবস্থায় এমন সময় বারান্দা পরিভ্রমণ করলে আকাঙ্খিত প্রিয়জনের দেখা পাওয়া যায়। পালিয়ে যাবে তারা এখান থেকে অনেকদূরে, কোন। অদৃশ্য ছায়ালোকে—যেখানে বেণীকুঞ্জ পাখি ফুল নদী আর তারা দুজন। কিন্তু অপরিসীম আলস্যে মালেকার শরীর ও মন দুই ভেঙে পড়েছে। মালেকার সামর্থ্য নেই সাড়া দেবার। মালেকা প্রাণহীন অচেতন।…..
এত গভীর রাতেও আকাশ আশ্চর্যভাবে নীল। আকাশ থেকে নীল গলে গলে পড়ছে যেন। আকাশস্থিত অজস্র তারা দিগ্বিদিকে একটা বিভ্রমকারী শোভর সৃষ্টি করেছে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছে যেন অগণিত শাদা ফুল! মালেকা অবাক হয়। নিজের নিরুপম সৌন্দর্যে আকাশকে নিত্যই নীলায়িত করবার এ কি লজ্জাকর নিবিষ্টতা! কেউ বোঝে না, কি এ শোভার অর্থ!
মফিজুলকে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে লাভ আছে। এত ভোর যে আকাশ এখনও ঠিক করে রাঙেনি। দূরবর্তী বৃক্ষরাজির নিবিড় শ্যামলতায় ঈষৎ রক্তাভ আভা লেগেছে মাত্র। স্টেশনটা খুব কাছে। ট্রেন আসার ঘণ্টা পড়ল। ক্রমে পূর্বদিক লালটকে হয়ে সূর্য উঠছে। ট্রেনটা এসে পড়ল। তখন বহুদুরের গাছের সারি দেখা যাচ্ছে–স্বচ্ছ আকাশ ধীরে ধীরে প্রভাত্রে প্রথম বর্ণচ্ছটায় রঞ্জিত হচ্ছে সহসা-উদিত সূর্যের দিকে চেয়ে মালেকার চোখ জলে ভরে ওঠে।
তোমার রাগরক্তিম বদনের দিকে চেয়ে যদি কোন কলঙ্কিনী বন্ধুর আনত চোখপল্লব ভাবাবশে মিছিমিছি কেঁপে ওঠে বা তার নিষ্ঠুর প্রেমিকের কথা মনে কোন হতভাগিনীর বুক কেঁপে ওঠে এমনিই, তাহলে হে মোহিনী উষা, তাদের চোখে বুকে তোমার মায়া-স্নিগ্ধ মমতা বুলিয়ে দিও! তৃতীয় ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে ট্রেনটা চলতে আরম্ভ করল। গতি ক্রমেই বাড়ছে। আচ্ছা এটা কি অদ্ভুত নয়, যখন পৃথিবীময় নূন আশার স্পন্দন, তখন তার চোখে জল কেন? মালেকা কি জানে! অনেক দূরে চলে-যাওয়া ট্রেনের ক্ষীণ শব্দ যখন একেবারে মিলিয়ে গেল, পাখির কলরবে তখন রাচর মুখরিত হয়ে উঠেছে।