আমরা জানি না, মালেকাকে দেখে মফিজুলের মন কেমন করেছিল-সে বিবরণ আমাদের কাহিনীতে প্রক্ষিপ্ত। তবে মফিজুল সম্বন্ধে আমরা একটা ধারণা করতে পারি। মফিজুল সে শ্রেণীর লোক, যাদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল। প্রেমের মধ্যে যারা নিজেদেরকে পরিপূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিতে পারে, অথচ প্রেম-পথ যদি বাধাসঙ্কুল হয়, তারা বুঝতে পারে না–তলিয়ে যায়, হারিয়ে যায় যদিও মালেকাকে রউফের স্ত্রী হিসাবে দেখবার প্রত্যাশা মফিজুল তথাপি করেনি, তথাপি এ-আবিষ্কার তার পক্ষে এমন-কিছু নয় যাতে একটা রোমান্টিক সম্ভাবনা কাউকে চকিত করে তুলতে পারে।
চায়ের জলসায়।
মফিজুল বললঃ থাকিত জঙ্গলে, তাই এখানে এসে মনে আনন্দ অনুভব করতেও ভয় হয়। এ-টাউনটা সত্যিই চমৎকার।
রউফ আচমকা প্রশ্ন করল? তোমার বয়স কম-সেকম ত্রিশের কোঠায়। অতএব এখনও তোমার বিয়ে না করাটা আশ্চর্য ব্যাপার।
চোখ নিচু করে শান্তস্বরে মফিজুল বলে? বিয়ে করার আকর্ষণ এখনও টের পাচ্ছিনে। যখন দেখব, বিয়ে করাটা আমার পক্ষে খুব দরকারি হয়ে উঠেছে, তৎক্ষণাৎ বিয়ে করে ফেলব। মালেকার মাথায় বিদঘুঁটে খেয়াল আসে। দুঃসাহসী কণ্ঠে বলল : যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি।
–বলুন! মফিজুলের স্বর অবিচলিত।
–কখন কোন মেয়েকে আপনি ভালবেসেছিলেন?
এ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে খানিকক্ষণের মত মফিজুল স্তব্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তে সামলিয়ে নিয়ে বল ব্যবহারিক দিকটা আমার মধ্যে এত নিবিড় যে আমার পক্ষে প্রেমে পড়া কস্টিটিউশানালি অসম্ভব।
—ওঃ মালেকা যেন ক্ষুব্ধ হয়েছে।
শহরের যে দিকটায় নদী, ওখানে যারা থাকে না, তারা কয়েক দিন সেদিকে বেড়িয়ে আনন্দ পেতে পারে। সেদিকেই রউফ, মফিজুল আর মালেকা যাচ্ছিল। আজকের সন্ধ্যা মিষ্টি। শীতের হাওয়া তীক্ষ্ণ হয়নি। রঙের প্রদীপ্ত বৈচিত্র্যে আকাশ রক্তিম, মনোহর। কোথায়ও রেডিওতে গান হচ্ছে। শীতের মৃদু বাতাসে সে মাধুর্যের প্রলেপ। নানারকমের বিচিত্র পাখির ধ্বনি চিত্তহারী। শীতকালে এমন স্বচ্ছ মধুর সন্ধ্যা সচরাচর দেখা যায় না।
—মফঃস্বল শহরে এসে খানিকটা ভোলা জায়গা পাওয়া আর ফ্রি এয়ার নেওয়া মনের পক্ষে বাস্তবিকই স্টিমুলেটিং! নীরবতা ভেঙে মফিজুল বলে উঠল।
-মাস দুয়েক থেকে যাও, দেখবে এখান থেকে পালিয়ে যাবার জন্য তোমার মন ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছেড়েছে। রইফের ঠাট্টা করবার একটা সরল ভঙ্গী আছে।
–আপনার মত কি? মালেকার দিকে আড়চোখে চেয়ে মফিজুল জিজ্ঞেস করে।
মালেকা মৃদু হেসে জবাব দিল : এ মফঃস্বল শহরে একটানা আমি আট বৎসর ধরে আছি তাই আপনার কথার ঠিক জবাব আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ছোট বেলায় স্বাস্থ্যশিক্ষায় যা পড়েছি, সে-বিচারে আপনার কথাটা নিখুঁতভাবে সত্যি।
—আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মফিজুল বিনা দ্বিধায় স্বীকার করল।
এবার নির্দয়ভাবে মালেকা খোঁচা দেয় ও কয়েকটা এমন এলেমেন্ট্রি কথা আছে। যা বোঝাতে গেলেই বরং গোলোযোগ হয়ে পড়ে।
প্রত্যাগমন। ইতিমধ্যে কখন পৃথিবীর বুকে গাঢ় হয়ে আঁধার নেমে এসেছে। ঝি ঝি পোকার ধ্বনি। চলতে চলতে এমন জায়গা এল যেখানে দুপাশে ঝোঁপের মাঝখান দিয়ে একটা খুব সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে। যেতে যেতে মালেকা তার আনত চোখ তুলে মফিজুলের দিকে সহসা চায়। তার মনে হয়, কোন এক নিপুণ শিল্পী একটা কঠিন শীতল ভাব মফিজুলের মুখে খুদে খুদে বসিয়ে দিয়েছে। আর কেমন অদ্ভুত বিষণ্ণ! হয়ত মালেকা ঠিক দেখেনি। অথবা আঁধার সেখানে নিঃসীম বলেই হয়ত মালেকার এ সাময়িক বিভ্রম। কে জানে! তারপর খানিকদূরে গিয়ে বিস্মিত মালেকা বিমূঢ় দৃষ্টিতে ওপরে চেয়ে দেখে শীতের ধূসর সবুজ আকাশে সোনালী চাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে একটুকরো মেঘ চাদকে ছেয়ে ফেলল। পাণ্ডুর চাঁদ। নিষ্কম্প। মলিন। বেদনার বিকৃতিতে নীল। কঠিন ব্যথার দুঃসহ আঘাতেই হয়ত বা পাণ্ডুর; কিন্তু মালেকা জানে, চ্যাঁদের এ মলিন আবিলতা ক্ষণস্থায়ী, কিছুক্ষণ পরেই চাঁদের শুভ্র সোনালী দ্যুতি এই ক্ষণিক মলিনতা দূর করে ধরণীর সমস্ত কিছুকে আনন্দোজ্জ্বল মাধুর্যে ঝলমলে করে তুলবে। কি আশ্চর্য! মালেকা কিন্তু জানে না, সে মফিজুলকে ভালবাসে কি না? প্রেম? ধ্যেৎ। কি ও? ভালবাসা, মফিজুল; রউফ। ফু।
কালকে ভোরে মফিজুল আসামে ফিরে যাবে। যে নিরতিশয় মধুর উচ্ছ্বাসে মালেকার হৃদয়কে এ কয়দিন উদ্বেলিত করে আসছে, কালকে তার অপমৃত্যু। মালেকার জীবনে যে ক্ষণবসন্ত সুপ্রচুর আনন্দ নিয়ে দেখা দিয়েছিল, আর ঘণ্টা কয়েক বাদে তার আকস্মিক পরিসমাপ্তি। তার হৃদয়ে যে অঙ্কুর এতদিন মুকুলে রূপান্তরিত হয়ে পুষ্পপল্লবের অপেক্ষায় ছিল, ঘনঝঝা তাকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
মাঝরাতে মালেকার ঘুম ভেঙে যায়। পাশে চেয়ে দেখে, রউফ অঘঘারে ঘুমুচ্ছে। মালেকার মন ধীরে ধীরে বিপজ্জনকভাবে উন্মাদ হয়ে উঠছে। মালেকা এ কথাটা এখন অভ্রান্তভবে বুঝেছে : মফিজুল তার মন, হৃদয়, সমস্ত সত্তা জুড়ে বিরাজ করছে। বিবাহ-অবধি যে-সুখের সামান্য ছোঁয়াচ তার মনে লাগেনি, সে কয়দিন এসে মফিজুল সে তুলনারহিত সুখের প্রখর প্রবাহে তার মনকে উদ্দাম করে তুলেছে। মালেকা এটা নিশ্চিতভাবে জানে যে মফিজুলও তাকে ভালবাসে। চিরকালের ভীরু মফিজুল এখনও তাকে আগেকার মতই নিবিড়ভাবে জানে যে মফিজুলও তাকে ভালবাসে। চিরকালের ভীরু মফিজুল এখনও তাকে আগেকার মতই নিবিড়ভাবে কামনা করে। সন্দেহ নাই, পরস্পরের প্রতি তাদের প্রেম এখনও অম্লান। তবু একটা কি অদ্ভুত, তারা মিলিত হতে পারছে না তাদের মাঝখানে একি দুস্তর বাধা? মালেকা