বছর দেড়েক এমনি করেই কাটল। এ-সময়ের ব্যবধানে সহস্রভাবে মালেকা রউফকে ভালবাসবার চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। ফলে মালেকা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে রউফও যৌবনের অপরিমিত ক্ষুধায় গোপনে গোপনে বহির্মুখী হয়ে উঠছে। এমন অপরিবর্তিত কৃত্রিমতায় যদি অবস্থার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, তবে তা নিশ্চিতভাবে কেলেঙ্কারির স্তরে পর্যবসিত হবে। হতে বাধ্য।
সেদিন হাসি হাসি মুখে মালেকার কাছে এসে রউফ বললঃ একটা সুখবর আছে, আন্দাজ করতে পার?
—আমি গণক নই! মালেকার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
—অবশ্য এ-খবরে তোমার সুখি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু আমার মন নাচিছে আজিকে ময়ূরের মত নাচিছে।
বলেই ফেল খটা। দেখি এসুখ শুনে আমার মনও ময়ূরের মত নেচে ওঠে কিনা।
ব্যাপারটা হল এইঃ আমার এক বাল্যবন্ধু না হল না, আমার এক অভিন্নহৃদয় শ্রেষ্ঠবন্ধু দীর্ঘ বারো বৎসর পরে এ অভাগার গৃহে খুব শীঘ্র শুভাগমন করছে। ছেলেটা অদ্ভূত, এখন বিয়ে করেনি। আসামে ইঞ্জিনিয়ার রউফের স্বর ক্রমেই ভাবোদ্বীপক হয়ে উঠছে—আচ্ছা, এটা ভাবতে তোমার মজা লাগছে না যে যার সাথে এককালে আমার স্বচেয়ে বেশি ভাব ছিল তাকে এ বারো বৎসর না দেখেও আমার দিন সুখেই কাটছিল অথচ এখন সে আসবে বলে আমার মনে খুশি উপচে পড়ছে। সত্যি সত্যি আজকাল সকলের সাইকোলজি পড়া উচিত।
কিন্তু রউফ উৎসাহের প্রাবল্যে যদি অনর্গল কথা না বলে যেত, তাহলে সে দেখতে পেত, মালেকার মুখ ছাইয়ের মত ধ্বির্ণ হয়ে ওঠে রাগরক্তিম প্রখরতায় ঝলসাচ্ছে। এবং তাহলে নিশ্চয়ই সে অবাক হবার সময় পেত।
রউফ বলে যেতে লাগল। ছেলের নাম মফিজুল। কম বজ্জাত ছিল ছোটবেলায়? লালমনির হাটে থাতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে কি বিপদেই না ফেলেছিল।
কথা বলার মাঝখানে যদি রউফ একবার মালেকার দিকে চেয়ে দেখত, সে আবার দেখতে পেত, মালেকার মুখ পাষাণের মত স্থির অস্বাভাবিক।
মালেকার ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি শাণিত তীক্ষ্ণতায় ঝকঝক করতে থাকে। রউফের বন্ধু অনেক দিন পরে কি এক কাজে এখানে আসছে, তাতে মালেকার খুশি বার বাস্তবিকই কি থাকতে পারে? মফিজুল হল রউফে ভিন্ন হৃদয় শ্রেষ্ঠবন্ধু। নয় মালেকার।
মনোবিচ্ছেদের একাহিনী যে সর্পিল গতিতে ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে, তাতে একটা জিনিস সম্বন্ধে অবহিত হবার সময় আমরা পাইনি। মালেকার মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যের মূলভিত্তি কোথায় সে সম্বন্ধে মালেকার কোন স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও আমরা অন্তত আংশিকভাবে তা অনুমান করতে পারি। সংক্ষিপ্ত কথায় ও কিশোর বয়সে মালেকা একবার প্রেমে পড়েছিল। তার বিস্তৃত আলোচনা আমাদের আগ্রহের বিষয় নয়। লু মালেকার মনের অশাস্তির সঙ্গে ও এ অতীত প্রেম এক সূক্ষ্ম সূত্রে গ্রন্থিত, এমন এক সংশয় আমাদের মনে ছায়াপাত করা অন্যায় হবে না।
যে বয়স সবেমাত্র পৃথিবীর অজস্র ইঙ্গিতে ধ্বনিত হয়, রূপস গন্ধের নিটোল সমারোহ ধরিত্রীকে মর্মরিত করে, ছায়াস্বপ্নে মানুষের মন মদির আকুলতায় হয়ে ওঠে আবেশমুগ্ধ, ধরনী যখন সঙ্কেতময়, সঙ্গীতময় অপরূপ, মালেকা তার কিশোরহৃদয়ে সমস্ত সুধা উজাড় করে একজনকে ভালবেসেছিল তখন।
–আমাদের মফিজুলকে।
তবে মালেকাকে যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ মফিজুলকে তুমি এখনও ভালবাস কিনা, ব্যর্থ প্রণয়ের বেদনাই তোমার, অসুখি হওয়ার কারণ কিনা মালেকা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিবে না। সে যে সুখি হতে পারছে না তার কারণ নয় সে অতীত প্রেম! অন্তত মালেকা তা কিছুতেই মানবে না। মফিজুল সম্বন্ধে তার সমস্ত দুর্বলতা এখন মৃত, নির্জীব।
সুতরাং একাহিনী যে বিরক্তিকর মনোবিচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একটা ভীতিপ্রদ রূপ নেবার অপেক্ষায় ছিল তা আকস্মিক পরিবর্তনের আঘাতে একটা স্বতন্ত্র গতি বেছে নিচ্ছে। মালেকার জীবনে এসেছে বসন্ত এসেছে আকাশকে রক্তিম স্মৃতিতে রঞ্জিত করে, বাতাসকে নিগূঢ় মাধুর্যে উজ্জীবিত করে, হৃদয়ের নবোগত মুকুলকে পুষ্পসৌরভে আকুল করে। হোক সে ক্ষণিক। সমুদ্রের বুকে সাইক্লোনের ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি ক্ষণিক হলেও বিপজ্জনক।
অবশেষে মফিজুলের আসারদিন আসন্ন হয়ে এল। দিন সাত পরেই সে আসবে। আশা করা যায়। বাসার বাগানে বেড়াতে বেড়াতে রউফ মালেকাকে প্রশ্ন করল? যাঃ, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে একেবারে ভুল হয়ে গেছে। মফিজুল এখানে। আসবে বলে তোমার তো কোন অসুবিধা হবে না?
–অর্থাৎ? মালেকার–দুটো প্রশ্নে শরনিক্ষেপ করল।
—মানে, একটা অপরিচিত লোক এখানে আসবে, তাতে তুমি খানিকটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও তো করতে পার।
-কোন ভদ্রলোকের বাসায় একজন ভদ্রলোক এলে কোন ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা সঙ্কোচ হওয়ার কথা নয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কথ্যভাষার ওপর মালেকার দখল যথার্থই লক্ষযোগ্য।
—আই বেগ ইওর পাৰ্ডন। রউফ যেন লজ্জিত।
শীতকালের দ্বিপ্রহরে। শীতল বাতাসের শন শন ধ্বনি নারকেল গাছের পাতাগুলোতে দোল দিচ্ছে। বহু ঊর্ধ্বে দিগব্যাপী আকাশে পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। মুক্ত বন্য অপ্রতিহত তাদের গতি। মফিজুলকে আনতে রউফ স্টেশনে গেছে। ঘরে মালেকা একা। জানলা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে। শ্রান্তির আবেশে মালেকার শরীর শিথিলিত। মন তার ফাঁকা।
সহসা মৃদু শীতল বাতাস চাপা সঙ্কেতের শিহরণে মালেকার শরীর বিদীর্ণ করে তার হৃদয়ের সর্বত্র ভীরু রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলে। মর্মনিহিত আনন্দের কুণ্ঠিত স্পন্দনে তার প্রাণ কাঁপছে ভীরু পায়রার মত। কাঁপছে, কাঁপছে। মৃদু সঙ্গীতময়। অনেক দুরে ঝাঁপসা রেখার ছায়াবরণে যেন দেখা যায়, কোন নারীর চুম্বন-শিথিল ওষ্ঠ কাঁপছে, প্রিয়তমের দিকে চেয়ে প্রণয়িণীর মায়াকাজল চোখে যেন লেগেছে কুহকের প্রলেপ। সূক্ষ্ম গোপন অব্যক্ত আনন্দের গাঢ়চ্ছন্দ। এবং মালেকা তার কম্পিত দৃষ্টির সম্মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মফিজুলের মুখ।