অবশ্য এমন নয় যে নিত্যই তাদের ঝগড়া হচ্ছে। যেখানে প্রেমের ভিত্তি সুদৃঢ় নয়, সেখানে বিবাদ হয় কচিৎ। যা রউফ পৌরুষের বর্বর শাসনে মালেকাকে নিপীড়িত করেছে। মনে মনে মালেকা তার প্রতি রউফের বিস্ময়কর কোমলতার কথা উপলব্ধি করে অভিভূত, বিমূঢ় ও শঙ্কিত হয়। রউফের আশ্চর্য বিবেচনা-বোধ মালেকার মানসিক অশান্তিকে নানাভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। তবুও বাইরে থেকে দেখলে এটা বোঝা যাবে না যে তারা অসুখি। সামাজিক প্রয়োজনের চাপে মাঝে মাঝে তাদের এমন জায়গায় এসে পড়তে হয়, যেখানে ভালবাসার অভিনয় করা অপরিহার্য এবং সংসারে থাকতে হলে আরও বিবিধ আনুষঙ্গিক অনুশাসন তো আছেই।
অত্যন্ত নবীন উকিল বলে রউফের ওপর কোন মামলা-মকদ্দমার ভার ছেড়ে দিতে অনেকেই ভরসা পায় না। যে দু’একটা পায় তা সময়ের অন্তহীন প্রাচুর্যকে পূরণ করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এখানে এমন কোন লোকের সাথে রউফের জানাশোনা নেই যাদের বন্ধু বলা যেতে পারে। আর আড্ডা দিতে ভালও লাগে না রউফের। কিন্তু যে অখণ্ড অবসর এখনও রউফকে পীড়া দিচ্ছে তা রসে, লীলায় ও যৌবনোচ্ছল কামনায় ভরপুর হয়ে উঠতে পারত, যদি….তবে মানব জীবন ‘যদি’র স্থান নেই। তাই রউফের ওকথা নিয়ে আফসোস করা শোভা পায় না যে মালেকা তার প্রেয়সী নয়। তথাপি রউফ তার জীবনের এ বৃহৎ দুঃখ নিয়ে সব সময় দুঃখাভিভূত হয়ে থাকতে পারে না। আচম্বিতে তার মন এক-এক সময় অযথা খুশি হয়ে ওঠে—মনের চাপা আনন্দ আকস্মিক আশ্রয় পেয়ে দিগ্বিদিকে সুতীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে এমন হয়। অকারণ পুলকের গাঢ়চ্ছন্দে মন নাচতে তাকে। টুকরো টুকরো রঙ মনের সর্বত্র একটা মদির-মোহ জাগিয়ে তোলে। ইচ্ছে হয়, লুকিয়ে গান করবে। আর গোপনে চোখের পাতা ভিজে ওঠে। পরিব্যাপ্তিহীন আনন্দের রঙ্গ ঝলকে ঝলকে রূপান্তরিত হয়ে মনে জন্ম দেয় এক অধকরুণ বিভ্রম। একারণেই সহস্র দুঃখ-বেদনা সত্ত্বেও মানব-জীবন এত অসম্ভবভাবে অপরূপ। রউফের মনে সে পরিমাণহীন সুখ উত্তাল হয়ে উঠলো সন্ধ্যারদিকে। কি এক উৎসব উপলক্ষে রউফের কোন এক আত্মীয় তাদের নিমন্ত্রণ করেছেন। মালেকা সেজেগুঁজে এল। মালেকার সাজসজ্জার নিপুণ ভঙ্গিমা রউফকে বিস্মিত, অভিভূত, বিমুগ্ধ করে তুলল। পশ্চিমের আকাশে তখন রঙের আগুন লেগেছে। রঙের বিচিত্র সমারোহে ঘন-সন্নিবিষ্ট শ্যামল বৃক্ষের পত্র পুষ্প-পল্লব বিচিত্র হয়ে এক বিভ্রান্তকারী শোভার সৃষ্টি করেছে। বিলীয়মান সূর্যরশ্মির সুরঞ্জিত তির্যক গতি মালেকার শাড়িতে চোখে ঠোঁটে গালে ও কেশের মধুর হিল্লোলে প্রতিফলিত হয়ে রউফের মনকে অদম্য আকাঙ্খায় উদ্বেলিত করছে। মালেকার কি পরিমাণ-জ্ঞান নেই। এ কি কৌতুক? রউফ আজকে সুখি—পরিপূর্ণ নিবিড় একান্তভাবে সুখি।
করুণাময়ীর মত মিষ্টি হেসে মালেকা বলল–অমন করে তাকিয়ে আছ যে! যাবে না?
—নিশ্চয়ই। মিনিট দশেক দাঁড়াও, এবান্দা এখনই এসে হাজির হবে। বলে রউফ বিসদৃশ এক দ্রুত ভঙ্গিতে চলে গেল।
ঘোড়ার গাড়িতে। যে-গতিতে গাড়িটা চলছে তাতে মনে হয় না ঘণ্টাখানেক আগে নির্দিষ্ট জায়গায় তারা পৌঁছতে পারবে। নীরবতা জানালা দিয়ে চোখ বাড়িয়ে মালেকা বাইরের দিকে চেয়ে আছে। ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য। আড়চোখে মালেকার দিকে চেয়ে রউফ দেখল সমস্ত বিশ্বের নির্লিপ্ততা যেন তার মুখে। কিন্তু রউফ পুরুষ, সেও কঠিন হতে জানে। বাইরের দিকে চেয়ে মালেকা বুঝি কিছু একটা সঙ্কল্প ঠিক করছিল। হঠাৎ নিষ্কম্প চোখ রউফের দিকে চেয়ে মালেকা বল্লে : তুমি আমার থেকে পালিয়ে থাক কেন? কে তোমায় বলেছে তোমায় যে তোমায় আমি ভালবাসি না বা তোমায় কখনও ভালবাসতে পারব না?
চারদিকে যে মধুর পারিপার্শ্বিকতা মোহিনী মায়ায় কোমল ও মৃদু হয়ে আছে, তার সাথে, মনে হয়, সুন্দরী মালেকার এই মায়া-স্মিত অভিযোগের কেমন বিচিত্র সামঞ্জস্য। রউফ খানিকক্ষণের মত হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু মালেকার স্বরে এমন এক শীতল অনাসিক্ত, এমন এক অথর্ব ঢং আছে যে রউফ সহসা হেসে ওঠে। তাই তো, কে বলল আমাকে যে তুমি আমায় ভালবাসো না। তাই তো রউফের মুখ কৃত্রিম বিস্ময়ে হাল্কা। রউফের ঘুম অনেক, তবে অভিনয়ে সে পটু নয়। কিন্তু তাকে নিয়ে মালেকা ছিনিমিনি খেলবে— এ্যাবসার্ড। মালেকা হাজার হলেও স্ত্রীলোক। তাকে না ভালবাসার যথার্থ অধিকার মালেকার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাই বলে সে রউফকে এমন করে আঘাত করতে পারে না। মালেকা ভুলে গিয়ে ভাল করেনি যে তার সমস্ত সুখ ও সম্মান রউফের করুণার উপর নির্ভর করছে। ইচ্ছে করলেই রউফ তার জীবনকে কুত্র শাসনে অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে। তার রূপ সুখ-সমৃদ্ধি সব কিছু সে নির্দয় ঝটিকাঘাতে করে দিতে পারে বিধ্বস্ত। সে সীজার।
ফেরবার সময়! এত রাতে মফঃস্বল শহরে গাড়ি পাওয়া যায় না। তাদের বাসা অবশ্য মাইলখানেকের বেশি হবে না। সুতরাং হেঁটে ফিরে আসতে এমন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। হেঁটে হেঁটে তারা এগিয়ে চলেছে। আকাশে চাঁদ নেই। চারদিকে নিবিড় আঁধার। সুউচ্চ বৃক্ষের শাখায়, দুপাশের গভীর খাদে নিস্তব্ধ নিশীথের নিরঙ্কু আঁধারের ভয়াবহ নিষ্পেষণ। টর্চের আলো ফেলে পথ চিনে নিতে হয়, মনে হয় কোন বিশাল কৃষ্ণগ্রহ আকাশ থেকে বিপুল বেগে খসে পড়ে তার বিরাট অবয়বের নির্দয় চাপে ধরিত্রীকে এসে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে। পাঁচগজ দূরের জিনিস দেখা যায় না। সর্বত্র দিকচিহ্নহীন তমিস্রার অন্তহীন পরিব্যাপ্তি আঁধারে ভয় পেয়েই হয়ত মালেকা রউফের একান্ত সন্নিকটে সরে এল। এত কাছে সে সচকিতা মালেকার ভীরু মৃদুশ্বাস রউফের মনে এক উষ্ণ শিহরণ জাগিয়ে তোলে। কি পরিপূর্ণ নির্ভরতা মালেকার এ করুণ অসহায়তার মধ্যে ফুটে উঠেছে! চারদিক স্থির নিষ্কম্প। কেউ কোথাও নেই। খালি রউফ আর মালেকা। চন্দ্রহীন রাত্রি নিরস্ত্র তমিস্রা যৌবনচঞ্চলা ধরিত্রীকে সমাধি-ভূমির বীভৎস গোপনতায় সমাহিত করছে। আর সে-ধরিত্রীর কর্কশ বুকে বিচরণ করছে মাত্র দুটো মানুষ রউফ আর মালেকা। খালি মালেকা–রউফকে ভালবাসে না। হঠাৎ রউফের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে! আচ্ছা, এখন যদি সে মালেকাকে বুকে পিষে ধরে অজস্র চুম্বনের বন্যায় তার ঠোঁট পুড়িয়ে দেয়, নির্দয় দস্যুর মত মালেকার শরীরের সমস্ত সৌরভ কলঙ্কিত করে দেয়—পারবে মালেকা তার বর্বর শক্তি প্রতিরোধ করতে? পারবে? মালেকার দেহ নিয়ে রউফ এখন ছিনিমিনি খেলতে পারে। পারে। পারে তো? আলবৎ পারে। কিন্তু মালেকা একথা কি বোঝে? উত্তেজনার চাঞ্চল্যে রউফ লক্ষ করবার সময় পায়নি, স্টেশনটা কাছে এসে পড়েছে। বাসা আর নি মিনিটের রাস্তা। মালেকা রউফের আর অত কাছ ঘেঁষে নেই। সিগন্যালের লাল সবুজ হলদে রঙের তীক্ষ্ণ প্রখরতা চারদিকের গাঢ় আঁধারকে রহস্যাচ্ছন্ন করে তুলছে।