আর একটি শ্যু ফ্যাক্টরি বসছে নাকি উত্তরবাংলায় শিলিগুঁড়ির কাছে। পনেরো দিনের জন্যে প্রিতম ডাচ্ সাহেব ইঞ্জিনিয়ার দল আরো সব দক্ষ কর্মীরা যাবেন। নতুন মহিলা কর্মীরাও বাদ যাচ্ছে না। হোটেল বুক করা হয়ে গেছে।
সুজাতা বলে, শ্রীলা, মুজারা তো যাবেই তাই না?
হ্যাঁ, তুমি কোথায় থাকবে বলে তো?
গর্তয়! আমার আর কোন চুলো আছে? মা বাবা এখন পরভুখ। দুই দাদার সংসারে বেশিদিন মাথা গুঁজে থাকলে তারা কি সোনার আদর করবে? বাবার যা দেবার দিয়ে দিয়েছে লাখ তিনেক টাকা খরচ করে। তাতেই তোমার সংসারে আসবাবপত্র আর সাজ-শয্যায় ভরা ভরা। আমি এই একাঘরে কতদিন জেলখানার কয়েদির মতো থাকব? এখন তোমার বাঁ-পাশে শ্ৰীলা— ডানপাশে তনুজা! আমি এখন তোমার কেউ না।
ছিঃ! এসব কথা বলো না। তুমিই আমার রাজলক্ষ্মী আমার রাজরানী!
সরো তো! আর অভিনয় করতে হবে না। একটা চিঠি এসেছে তোমার কলেজের বান্ধবী ললিতার দেখাব?
ললিতা মুখার্জি? আরে তার তো বিয়ে হয়ে দু-দুটো বাচ্চা হয়ে গেছে! গো টু হেল প্রিতম ঘোষ কুলীন ব্রাহ্মণ নয় বলে তার বাপ নাক সিটকে ছিলেন।
ওর স্বামীর চাকরি চলে গেছে। বড় অসুস্থ। যদি কিছু সাহায্য করো।
সেসব উত্তর বাংলা থেকে এসে দেখা যাবে। এই তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
তাই কি হয়? কোম্পানির খরচে যাবে তোমরা আমার খরচ দেবে কেন? এটা তুমি শুধু মন রাখা কথা বলছ।
তাহলে তুমি কি বাপের বাড়ি যাবে? গিয়ে তোমার পুরোনো বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে–পনেরো দিন তো নয়— একমাস না-হোক কুড়ি-পঁচিশদিন হয়ে যেতেও পারে।
পরদিন সকালে গ্যাং চলে গেল। দশখানা মোটরে ঠাসাঠাসি। প্রিতমের দু-পাশে শ্ৰীলা আর তনুজা ঠিক দু-জনে আছেই।
কুড়িদিন কেটে গেল। এক একটা দিন যায় যেন পাহাড় সমান। আষাঢ়ের বেলা বৃষ্টি ঝরিয়ে শুধু কাঁদে। গর্ভে এসেছে মাতৃত্বের দায়। মান-অভিমানের আর দিন কোথায়? বি-এ পড়ার সময় সুদর্শন বাংলা একাদেমির লনে বসে কতদিন তার হাত ধরে কেঁদেছে। ওর চোখের জলে রুমাল ভিজেছে। তবু ও সে অচলা হয়নি। ঠাকুমা আর মা তাকে পইপই করে সাবধান করতেন, মেয়েদের জীবন বহুমূল্যে রত্নের মতো–ভুলের মধ্যে পা ফেলেছ তো মরেছ আর কুলকিনারা পাবে না। রত্ন তখন কয়লা–অংগার হয়ে যাবে।
সেই সুদর্শন শেষ পর্যন্ত যখন প্রিতমের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল যেন পাগল হয়ে গেল। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল।
ঘাড় ধাক্কা মেরে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন তার দাদা।
হঠাৎ কেঁদে ওঠে সুজাতা! কাঁচের টেবিলে মাথা গড়ায় তার। তারপর হঠাৎ শক্ত হয়। একটা রিভলবার কোথাও পাওয়া যায় না? কত দাম? শ্রীলাকে সে গুলি করে মারবে!
হাত কাঁপবে। গুলি ফসকে যাবে? পুলিশে ধরবে? জেলখানায় থাকতে হবে?
কাজের মেয়েটিও যুবতী। পাড়া-গাঁ থেকে আসে সে খুব ভাবন করে। প্রায়ই টিভি দেখে। হিন্দি ছবি আর গান তার খুব প্রিয়। তার বন্যতার দিকে প্রিতম তাকায় কিন্তু…
একমাস পড়ে প্রিতমরা স্বাই ফিরে এলেন।
দু-দিন সম্পূর্ণ ছুটির বিশ্রাম।
প্রিতম সুস্থ স্বাভাবিকভাবেই ঘুমোল। সুজাতাকে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করল না। কাজ নিয়ে নাকি পাগল।
পরদিন সকালে বাহু বেড়ে তাকে ধরল প্রিতম্। আদর করল। বলল, বড্ড একা একা লেগেছে তোমার! ঠিক হয়েছে, শ্রীলা আর তনুজা শিলিগুঁড়িতেই থাকবে।
সুজাতার সব অভিমান জল হয়ে গলে গেল যেন।
গান হচ্ছিল—ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন উষাপানে, জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।
একদিন দুপুরে একা ছিল সুজাতা। কে যেন তার নাম ধরে ডাকল?
উঠে এলো গায়ে আঁচল জড়াতে জড়াতে একি! সুদর্শন! পাগল চেহারা। এলোমলো চুলদাড়ি। ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে নোংরা স্যান্ডেল।
সুদর্শন, তুমি এখানে?
তোমার হাজবেন্ড কিন্তু খুব ভাল লোক হয়েছে। তুমি আমাকে কিছু খেতে দেবে? দু-তিন দিন বোধহয় খাইনি।
মেঝেতেই বসল সুদর্শন। তাকে কাজের মেয়েটিকে ডেকে খেতে দিতে না বলে নিজেই খাওয়াল। মাছ-ভাত-ডাল-ডিম-দই-সন্দেশ।
তোমার স্বামীকে বলবে আমাকে একটা চাকরি দিতে?
এখানে তো টেকনিক্যাল কাজ। তাছাড়া তোমার সঙ্গে পরিচয় নেই। তোমার কয়েকটি চিঠি রেখেছিলাম–প্রিতম্ পড়েছে। বলেছিল, ভদ্রলোক ভাল আধুনিক কবিতা লিখতে পারেন। অসম্ভব ভাষায় কারিকুরি আর তীক্ষ্ণতা।
হাত-মুখ ধোবার পর ঝোলা থেকে চটি মততা পাঁচ ফর্মার একটি সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই দিল। সৃষ্টি প্রকাশনীর ছাপা। উৎসর্গ : সুজাতা তোমাকে—
এসব কবিতা সুজাতা কতবারই না শুনেছে।
দাম্পত্য কলহ যেন আষারে আকাশ
রোদ ঝলমল এই তো এখন
আবার ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে যায়…
তোমাকে হারালে আমি ভিখারিণী—
.
আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিল সুদর্শন তার নোংরা পোষাকেই মেঝেয় বসে বিছানায় মাথা রেখে।
হঠাৎ বাসায় এলো প্রিতম্।
দেখ কে এসেছে–নাম বলো? সুজাতা বলল।
তোমার বর্ণনায় সুদর্শন। নমস্কার। উঠে চেয়ারে বসুন।
সুজাতা বইটা দিল প্রিতমকে।
আমার নামটা লিখে দিন। বলল প্রিতম।
সুদর্শনকে নিয়ে সারা বিকেল কাটল ভাল ধুতি পাঞ্জাবি পরাল নিজের। নদীর রে বেড়াতে নিয়ে গেল। কাজের কথা বলতে প্রিতম বলল, কি কাজ দোব? আচ্ছা, দেখছি।
সন্ধ্যায় যাবার সময় এক হাজার টাকা সুদর্শনের পকেটে গুঁজে দিয়ে দিল প্রিতম। বলল, আমাদের সন্তান আসবে— যদি পুত্র হয়, কি নাম রাখব বলে যান।