- বইয়ের নামঃ অস্থির অশ্বক্ষুর
- লেখকের নামঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অস্থির অশ্বক্ষুর
স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিলো। মেয়েলি কণ্ঠে থমকে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখি একটি ছাত্রী, আমারই। বুক কি একটু কেঁপে ওঠে না? এখনো ঠিক অজর অক্ষর অধ্যাপকে পরিণত হই নি তো, একটু হাওয়া দিলেই কোথায় বাঁশপাতায় কাঁপন ধরে। সেই কাঁপন যথাসম্ভব আড়াল করে, স্বাভাবিক গলায় বলি, কী, বলুন। ছেলেদের সঙ্গে ‘আপনি-তুমি’ এলোমেলো করে ফেলি, মেয়েদের সঙ্গে অদ্বিধ ‘আপনি’ ছাড়া আর কোনো সম্বোধন আসে না আমার। কোনো-কোনো সহকর্মী অধ্যাপকের মতো মেয়েদের সঙ্গে অনায়াসে তুমি বলতে পারি না।
আপনি তো, স্যার, নজরুলগীরি ভক্ত। আমি একটু-আধটু নজরুলগীতি গাই–কাল সকালে রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম আছে একটা, আপনি যদি শোনেন—
বাহ–নিশ্চয় শুনবো বাহ, খুব ভালো তো–ততোক্ষণে আমার ভেতরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। মেয়েটিকে চিনি, বিবি ডাকনাম, তা-ও কবে যেন কীভাবে জেনেছিলাম; ভালো নাম আফরোজ জাহান। সকাল সাড়ে-আটটায় এদের সঙ্গে ছোট একটি ক্লাস ছিলো আমার। তারপর সারাদিন মুক্তি। তখনো কলেজের মাঠে ভোর বেলার সুঘ্রাণ লেগে আছে, কলেজের পুরনো বিশাল বিল্ডিংয়ের উপরে রোদ এখনো কাঁচা তাজা স্বচ্ছ স্নিগ্ধ রল সোনালি, বহুদিনের পুরনোর ওপরে নতুন সূর্য এসে পড়েছে।
২.
বুকের ভেতরে কবিতার ছেঁড়া উড়ো পঙক্তিমালা ঘোরে। আর কিছু নয়, ঘুরে-ঘুরে আজ মাত্রাবৃত্তে বাঁধবো তোমাকে, এই একটা লাইন ঘূর্ণিহাওয়ায় এক টুকরো কাগজের কুঁচির মতো কেবলি উড়ে-উড়ে ঘোরে। দিনরাত্রি রক্তের ক্ষরণ / এইখানে রাখো দেখি সিগ্ধ শাদা গভীর চরণ’— মেঘমেঘালির মধ্যে ওড়ে শাদা চাঁদ, অফুরন্ত মেঘমেঘালির মধ্যে এই ক্ষীণ শাদা চাঁদ। একা হতেই ক’একটি শব্দ মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে। মনে পড়ে বিবির চোখ যেন কলেজের কঠিন বিল্ডিং ও বাস্তবতার বাইরে অন্য কোনো দিগন্তের নীল আভাস দিচ্ছিলো; যেন তার কণ্ঠে লেগেছিলো না বলা বাণীর আভা।
৩.
আম্মা বললেন, মন্টু, দিলিনে এ মাসে?
দিচ্ছি শিগগিরই।
কবে আর দিবি। মাসের অর্ধেক হয়ে গেলো। সংসার কী করে চলে, তা তো বোঝে না। চালের দাম বেড়েছে আবার, তার খোঁজ রাখো? আমার হয়েছে যতো জ্বালা। দিনরাত কবিতা লিখলে কি আর সংসার চলে?
আমি হাসি, আম্মা, মনে আছে আপনার প্রথম যেদিন টেলিভিশনে কবিতা পড়লাম? বাড়িশুদ্ধ কী উৎসাহ আপনাদের সবার। আর এখন…।
আশ্চর্য, আম্মা হাসেন না তারপরও, কঠিন মুখ করে রাখেন। আমিও ভেতরে ভেতরে তিক্ত হতে থাকি। সময়, আমার সময়। বেলা হলে সমস্ত শিশির যায় শুকিয়ে। জীবন, ওগো জীবন।
৪.
বিবির মা বাপ সৌজন্য সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করে চলে গেলে আমি ভেতরে-ভেতরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। বিবির ছোট একটি কৌতূহলী ভাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো, বিবি কোথায় তাকে সরিয়ে রেখে আসে। এতোক্ষণ পর আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠি। আমি সিগারেট খাই না, বু একটা খেতে ইচ্ছে হয় এখন। শাড়ি পরে নি আজ বিবি, লতাপাতায় আচ্ছন্ন পাজামা কামিজে ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। সব মিলিয়েই ওকে আজ ‘তুমি’ বলে ফেলি।
আমি কিন্তু ভাবি নি, স্যার, আপনি শেষ পর্যন্ত আসবেন। বিবি বলে। তার মুখে এক ধরনের সুশাস্তি খেলে যায়।
চলে এলাম। আমি কিন্তু সহজে কোথাও যাই না। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তো যাই-ই না, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতেও খুব কম।
আমি জানি।
তবু তোমাদের বাড়ি কেন যে চলে এলাম হঠাৎ।
বিবির মুখে প্রত্যাশিত খুশির বদলে প্রশ্ন কীর্ণ হয়ে উঠলো। দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, কেন, খারাপ লাগছে?
না—বাহ–খারাপ লাগবে কেন? বিবির মুখে লু কীরকম বিমর্ষ সৌন্দর্য। ভেবেছিলাম, ওকে হাসিখুশি দেখাবে খুব। তা না। তবু ওর ভেতরে যে একটা হিরে জ্বলছে, তা-ও বোঝা যায়।
বিবি দাঁড়িয়েই থাকে। সোফা ধরে একটু আলগা হয়ে। আমি বসে থাকি। কী বলবো, ভেবে পাই না। উঠে, একটা বুক-কেসে কিছু বই ছিলো, দেখি। একেবারে সাধারণ বই-টই। তারপর দু-চারটে মামুলি কথা হয়। পড়ার বইটই-এর ব্যাপারে একটু পরামর্শ দিই। জেনেও বিবি আবার জিজ্ঞেস করে নেয় কলেজ কবে খুলবে।
যাবার সময় সত্যিই বিবিকে বেশ বিমর্ষ লাগে। বলে, এর মধ্যে আবার একদিন আসবেন তো, স্যার, কলেজ বন্ধ থাকতে-থাকতে?
দেখি।
দেখি কেন, আসবেন স্যার। আসবেন। একটু কি কাকুতি ফুটলো বিবির গলায়? যেমনই দেখাক তাকে, একেবারে বাচ্চা মেয়ে সে না–কিন্তু আবদারে বোধহয় সব মেয়েই ছোটো খুকিটির মতো হয়ে যায়।
সরাসরি আর ‘না’ করতে পারলাম না, এমনকি নৈর্ব্যক্তিক সুরেও না। বললাম— হয়তো একটু ইতস্তত করেই, কিন্তু ভদ্রতা বাদ দিয়ে নয় বললাম, তুমি একদিন এসো। বিবি কি জানে না, ঘরে তরুণী স্ত্রী আছে আমার? বিবি কি জানে?
আমার কথা থাক। আপনি এর মধ্যে আর একদিন আসছে। সব মেয়ের মধ্যেই কীরকম একটা শান্তির সুর— অঙ্কের শাস্তির সুর লেগে থাকে। আমি তো কোনোদিন পারি না। মিনাকেও দেখি। আশ্চর্য শান্তি ও সুরসাম্য। সকাল থেকে রান্নাঘরে, দুপুরে যথারীতি যথাসময়ে স্নানাহার করে রেডিওর কমার্শিয়াল সার্ভিস শুনতে-শুনতে চুল এলিয়ে ফ্যানের হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়া। আমি পারি না। একটা সফল দিন যাপনের পরেও, দেখি, আমার চোখে ঘুম নেই, ঘন্টার পর ঘণ্টা নিদ্রাহীন চলে যায়, কবিতা লিখতে লিখতে ঠিক শব্দ খুঁজে না-পেয়ে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হয়, আবার একটি কবিতা লিখে শেষ করে তৃপ্তিময় পড়তে-পড়তে দ্বিতীয় কবিতার কাঁটায় বিধে ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। এই সবই ভেবে নিলাম এক মুহূর্তে।