- বইয়ের নামঃ অস্থির অশ্বক্ষুর
- লেখকের নামঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অস্থির অশ্বক্ষুর
স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিলো। মেয়েলি কণ্ঠে থমকে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখি একটি ছাত্রী, আমারই। বুক কি একটু কেঁপে ওঠে না? এখনো ঠিক অজর অক্ষর অধ্যাপকে পরিণত হই নি তো, একটু হাওয়া দিলেই কোথায় বাঁশপাতায় কাঁপন ধরে। সেই কাঁপন যথাসম্ভব আড়াল করে, স্বাভাবিক গলায় বলি, কী, বলুন। ছেলেদের সঙ্গে ‘আপনি-তুমি’ এলোমেলো করে ফেলি, মেয়েদের সঙ্গে অদ্বিধ ‘আপনি’ ছাড়া আর কোনো সম্বোধন আসে না আমার। কোনো-কোনো সহকর্মী অধ্যাপকের মতো মেয়েদের সঙ্গে অনায়াসে তুমি বলতে পারি না।
আপনি তো, স্যার, নজরুলগীরি ভক্ত। আমি একটু-আধটু নজরুলগীতি গাই–কাল সকালে রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম আছে একটা, আপনি যদি শোনেন—
বাহ–নিশ্চয় শুনবো বাহ, খুব ভালো তো–ততোক্ষণে আমার ভেতরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। মেয়েটিকে চিনি, বিবি ডাকনাম, তা-ও কবে যেন কীভাবে জেনেছিলাম; ভালো নাম আফরোজ জাহান। সকাল সাড়ে-আটটায় এদের সঙ্গে ছোট একটি ক্লাস ছিলো আমার। তারপর সারাদিন মুক্তি। তখনো কলেজের মাঠে ভোর বেলার সুঘ্রাণ লেগে আছে, কলেজের পুরনো বিশাল বিল্ডিংয়ের উপরে রোদ এখনো কাঁচা তাজা স্বচ্ছ স্নিগ্ধ রল সোনালি, বহুদিনের পুরনোর ওপরে নতুন সূর্য এসে পড়েছে।
২.
বুকের ভেতরে কবিতার ছেঁড়া উড়ো পঙক্তিমালা ঘোরে। আর কিছু নয়, ঘুরে-ঘুরে আজ মাত্রাবৃত্তে বাঁধবো তোমাকে, এই একটা লাইন ঘূর্ণিহাওয়ায় এক টুকরো কাগজের কুঁচির মতো কেবলি উড়ে-উড়ে ঘোরে। দিনরাত্রি রক্তের ক্ষরণ / এইখানে রাখো দেখি সিগ্ধ শাদা গভীর চরণ’— মেঘমেঘালির মধ্যে ওড়ে শাদা চাঁদ, অফুরন্ত মেঘমেঘালির মধ্যে এই ক্ষীণ শাদা চাঁদ। একা হতেই ক’একটি শব্দ মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে। মনে পড়ে বিবির চোখ যেন কলেজের কঠিন বিল্ডিং ও বাস্তবতার বাইরে অন্য কোনো দিগন্তের নীল আভাস দিচ্ছিলো; যেন তার কণ্ঠে লেগেছিলো না বলা বাণীর আভা।
৩.
আম্মা বললেন, মন্টু, দিলিনে এ মাসে?
দিচ্ছি শিগগিরই।
কবে আর দিবি। মাসের অর্ধেক হয়ে গেলো। সংসার কী করে চলে, তা তো বোঝে না। চালের দাম বেড়েছে আবার, তার খোঁজ রাখো? আমার হয়েছে যতো জ্বালা। দিনরাত কবিতা লিখলে কি আর সংসার চলে?
আমি হাসি, আম্মা, মনে আছে আপনার প্রথম যেদিন টেলিভিশনে কবিতা পড়লাম? বাড়িশুদ্ধ কী উৎসাহ আপনাদের সবার। আর এখন…।
আশ্চর্য, আম্মা হাসেন না তারপরও, কঠিন মুখ করে রাখেন। আমিও ভেতরে ভেতরে তিক্ত হতে থাকি। সময়, আমার সময়। বেলা হলে সমস্ত শিশির যায় শুকিয়ে। জীবন, ওগো জীবন।
৪.
বিবির মা বাপ সৌজন্য সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করে চলে গেলে আমি ভেতরে-ভেতরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। বিবির ছোট একটি কৌতূহলী ভাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো, বিবি কোথায় তাকে সরিয়ে রেখে আসে। এতোক্ষণ পর আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠি। আমি সিগারেট খাই না, বু একটা খেতে ইচ্ছে হয় এখন। শাড়ি পরে নি আজ বিবি, লতাপাতায় আচ্ছন্ন পাজামা কামিজে ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। সব মিলিয়েই ওকে আজ ‘তুমি’ বলে ফেলি।
আমি কিন্তু ভাবি নি, স্যার, আপনি শেষ পর্যন্ত আসবেন। বিবি বলে। তার মুখে এক ধরনের সুশাস্তি খেলে যায়।
চলে এলাম। আমি কিন্তু সহজে কোথাও যাই না। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তো যাই-ই না, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতেও খুব কম।
আমি জানি।
তবু তোমাদের বাড়ি কেন যে চলে এলাম হঠাৎ।
বিবির মুখে প্রত্যাশিত খুশির বদলে প্রশ্ন কীর্ণ হয়ে উঠলো। দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, কেন, খারাপ লাগছে?
না—বাহ–খারাপ লাগবে কেন? বিবির মুখে লু কীরকম বিমর্ষ সৌন্দর্য। ভেবেছিলাম, ওকে হাসিখুশি দেখাবে খুব। তা না। তবু ওর ভেতরে যে একটা হিরে জ্বলছে, তা-ও বোঝা যায়।
বিবি দাঁড়িয়েই থাকে। সোফা ধরে একটু আলগা হয়ে। আমি বসে থাকি। কী বলবো, ভেবে পাই না। উঠে, একটা বুক-কেসে কিছু বই ছিলো, দেখি। একেবারে সাধারণ বই-টই। তারপর দু-চারটে মামুলি কথা হয়। পড়ার বইটই-এর ব্যাপারে একটু পরামর্শ দিই। জেনেও বিবি আবার জিজ্ঞেস করে নেয় কলেজ কবে খুলবে।
যাবার সময় সত্যিই বিবিকে বেশ বিমর্ষ লাগে। বলে, এর মধ্যে আবার একদিন আসবেন তো, স্যার, কলেজ বন্ধ থাকতে-থাকতে?
দেখি।
দেখি কেন, আসবেন স্যার। আসবেন। একটু কি কাকুতি ফুটলো বিবির গলায়? যেমনই দেখাক তাকে, একেবারে বাচ্চা মেয়ে সে না–কিন্তু আবদারে বোধহয় সব মেয়েই ছোটো খুকিটির মতো হয়ে যায়।
সরাসরি আর ‘না’ করতে পারলাম না, এমনকি নৈর্ব্যক্তিক সুরেও না। বললাম— হয়তো একটু ইতস্তত করেই, কিন্তু ভদ্রতা বাদ দিয়ে নয় বললাম, তুমি একদিন এসো। বিবি কি জানে না, ঘরে তরুণী স্ত্রী আছে আমার? বিবি কি জানে?
আমার কথা থাক। আপনি এর মধ্যে আর একদিন আসছে। সব মেয়ের মধ্যেই কীরকম একটা শান্তির সুর— অঙ্কের শাস্তির সুর লেগে থাকে। আমি তো কোনোদিন পারি না। মিনাকেও দেখি। আশ্চর্য শান্তি ও সুরসাম্য। সকাল থেকে রান্নাঘরে, দুপুরে যথারীতি যথাসময়ে স্নানাহার করে রেডিওর কমার্শিয়াল সার্ভিস শুনতে-শুনতে চুল এলিয়ে ফ্যানের হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়া। আমি পারি না। একটা সফল দিন যাপনের পরেও, দেখি, আমার চোখে ঘুম নেই, ঘন্টার পর ঘণ্টা নিদ্রাহীন চলে যায়, কবিতা লিখতে লিখতে ঠিক শব্দ খুঁজে না-পেয়ে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হয়, আবার একটি কবিতা লিখে শেষ করে তৃপ্তিময় পড়তে-পড়তে দ্বিতীয় কবিতার কাঁটায় বিধে ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। এই সবই ভেবে নিলাম এক মুহূর্তে।
বেরিয়ে আসার সময়েও বিবি যখন বলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, স্যার— তখন ধক করে ওঠে বুকের ভেতরে। অসম্ভব-বেদনায় আর অসম্ভব-আনন্দে বিহ্বল হয়ে ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে আসি।
৫.
ধবল অশ্বের মতো দিন। বছর ফুরিয়ে আসছে। চৈত্র শেষ হাড়ে হাড়ে সূচিত হয়ে গেছে। লাইব্রেরিতে গিয়ে ঠাণ্ডায় বসে থাকি। ম্যাগাজিনের পাতা পাল্টাই। বিদেশি কবিতার সুস্বাদ রঙিন শরবতের মতো পান করি। বিদেশি কাগজের ঘ্রাণ নিই সোফার আরামে ডুবে গিয়ে। আমার পাশে একটি কিশোর লুকিয়ে ম্যাগাজিনের পাতা থেকে ব্লেড দিয়ে এক নিতম্বিনীর ছবি কাটছে। আমি আড়চোখে দেখি। একটুও উত্তেজিত হই না। মুচকি হাসি। কবিতার শব্দে মৌমাছির মতো উড়ে-উড়ে বসে আমার চোখ। তিরিশ পেরিয়ে এসে আস্তে আস্তে জীবনের সবকিছু, নিরুত্তেজ শান্তিতে দেখতে পাই, অনেকটা মেয়েদের মতো নিরুত্তেজ শান্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে, নিরাসক্ত নক্ষত্রের মতো। বয়সের দান? তবু পুরোপুরি সুস্থ ও শান্ত হতে পারছি কই। ভেতরে ছুটছে ঘোড়া, কবিতার শব্দ থেকে শব্দে তার খটাখট খটাখট শব্দ উঠছে, বুকের নক্ষত্র অব্দি ধুলো উড়ছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। পৃথিবীর আদিম আঁধার নেমে আসে সভ্যতার কেন্দ্রমণি এই গ্রন্থাগারে। নিউইয়র্কের হাজার-হাজার আলো-জ্বলা রাত্রিতে ব্রাজিলের গভীর অরণ্যের অন্ধকার। হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠি, এতোক্ষণ তাহলে একটা ধ্বনিময়তার মধ্যে ছিলাম। আমি চলে যাবার পর এমনিভাবে কি জেগে উঠবে আমার লেখা? তারপরই নিহিত ঝিঝিদলের ঝংকার শুরু হয়ে যায়। আলো জ্বলে ওঠে। ওদের নিজস্ব জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তখন কোথায়?
৬.
পিকনিক করতে গেছি কোন্ দূর বনে। আমরা ক’জন। ডালিয়া একসময় চলে আসে ভিড়ের ভিক্স থেকে আমার পাশে। কলাগাছের দঙ্গলে অন্ধ চামচিকে ঘোরে। ওমা! ডালিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে। কলাগাছের বনে ওড়ে অন্ধ চামচিকে।
৭.
চৈত্রমাস হা-হা করছে নগরীর পথে-পথে।
বিবি আর আমি গিয়ে বসি আইসক্রিমের ঠাণ্ডা দোকানে। মেয়েদের নিয়ে বসবার ভেতরের রুমটায় দুটি ছেলেমেয়ে এমন ভঙ্গিতে বসে যে, বাধ্য হয়ে বাইরে বসতে হয়। দুপুরবেলা এখন ভিড় নেই।
এখানে আবার কেউ দেখবে না তো? কেন তোমার ভয় লাগছে নাকি?
আমি সকৌতুকে জিজ্ঞেস করি।
না, আমার কী। আপনাকে নিয়েই তো ভয়। আপনি আবার, স্যার, অধ্যাপক মানুষ। কে কোথায় ছাত্র-টাত্র দেখে–।
ওরকম ভয় যে নেই, সত্যি কথা যদি বলতে হয় তাহলে তা আমি বলতে পারি না। ভেতরের রুমটায় বসতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু যা অবস্থা। আইসক্রিম খেতে-খেতে বারবার ভেতরে গিয়ে পড়ছে চোখ ভালো করে তাকাতে পারছি না। ছেলেটা বসে বসে কী করছে, কোথায় হাত দিচ্ছে জানি না, কিন্তু মেয়েটা বসেবসেও বারবার পা-টা লম্বা করে শুয়ে পড়ার মতো করছে। শীৎকারের ধ্বনি কি ভেসে এলো একবার? আমি তো ভাবতেই পারি না। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে নাকি? প্রেমিক প্রেমিকা নাকি? আমরাও তো একসময় ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে শুধু বুকের ভেতর না, পা অব্দি কাঁপতো।
বিবির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওরও চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক না, যে, এই নিয়ে একটু ঠাট্টা করতে পারি। কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলো, আইসক্রিম খাওয়া হতে বললো, “চলেন, স্যার, যাই’। বাধ্য হয়ে উঠতে হলো আমাকে।
৮.
শুয়ে আছি। দেখি, রান্নাঘরের কাজের ফাঁকে ঘরে এলো মিনা, এরকম মাঝে-মাঝে আসে, আঁচল হলদে দাগ, আধ-ময়লা, মুখ ঘামে তেলতেলে, চুল রুখু। খুটখাট করে কী কাজ করে ঘরের মধ্যে। একবার দেখে আমি আবার বই-এর মধ্যে ডুবে যাই।
ও, এই শোনো, একদম ভুলে গিছলাম, গা ঘেঁষে বসলো খাটে, আমার পাশে। আচ্ছা, সত্যি করে একটা কথা বলবে?
বলো না।
ঠিক বলবে কি না, বলো–
আহা, তুমি দেখছি একেবারে প্রেমিকার মতো গা ঘেঁষে আদুরে গলায়–
সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, আমার বলা উচিত হয় নি। সত্যি, আমিই না কতো মধুভাষী বিবির কাছে। কী যেন কেন, মিনার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, ভেতরের বিরক্তি আর অনীহা চেপে বসে কথায়, কথায় সুরে। অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ নেই? নিজেরই খারাপ লাগে শেষে, গ্লানি হয়। তখন বারবার খোশামোদ করি আবার। উঠে গিয়ে মিনাকে কাছে এনে বসাই।
শেষে নরম হয় মিনা, স্বাভাবিক হয়, হাসিখুশি মুখে বলে, আচ্ছা, ডালিয়া মেয়েটি কে সত্যি করে বলবে আমাকে? চোখেমুখে কৌতুক আর কৌতূহলের দ্যুতি ঠিকরে পড়ে মিনার।
বসন্তের ছুরি এসে পৃথিবীর মমতলে বিধলে তার যে চিৎকার জ্বলে ওঠে পলাশে আর কৃষ্ণচূড়ায় তেমনি আমূল রক্তিম চমকে উঠি। মুখে ঠিক হাসি টানতে পারি না, কে–কই আমি তো চিনি না!
নাহ, চেনে না— মেয়েলি ভঙ্গিতে হেসে ওঠে মিনা, ঘুমের মধ্যে ডালিয়া ডালিয়া বলে সে কী দীর্ঘশ্বাস!
যাহ! কী বলো! ভেতরে-ভেতরে অবাক হচ্ছিলাম, এখন বুঝলাম কী করে নাম জানলো মিনা, কিন্তু লজ্জায় আমার মুখ-চোখ লাল হয়ে যায়। হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে মিনা রক্তোচ্ছাসে সোনালি ফরসা মুখ ভরে যায় ওর, ওকে এমন হাসতে কোনোদিন দেখি নে, গভীর হাসতে হাসতে চোখে পানি এনে ফ্যালে। শল্যবিদ্ধ আমি মুগ্ধ তাকিয়ে থাকি।
৯.
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে স্টাডি ট্যুরে গতবছর গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। একদিন হুহু বাতাসে একজনের ডাকনাম রেখে দিয়েছিলাম। সবার অজ্ঞাতে একদিন বালির ওপর একজনের ডাকনাম লিখেছিলাম ওরই চোখের মতো বড় বড় হরফে। একদিন সারারাত সমুদ্রমেশিন শুধু একজনের ডাকনাম বুনে গিয়েছিলো— মোটেলে বিশাল কক্ষে নিদ্রাহীন নিশা ব্যেপে তার শব্দ শুনেছিলাম। একদিন বনঝাউ-এর বীজ-এর মতো আমার সমস্ত সৈকত ধরে উড়ে-উড়ে গিয়ে পড়েছিলো একটি নাম।
১০.
রাতে, কারফিউ শুরু হওয়ার আগে-আগে ফিরি আড্ডা দিয়ে। আমরা কজন কবিবন্ধু শক্রর অধিক বন্ধু শস্তা রেস্তোরাঁকে মাৎ করে, কাপের পর কাপ চা খেয়ে, ফিরি রোজ রাতে যতোটা রাত করা যায়। ঘুরেঘুরে আসে বিদেশি কটি নাম, বাঙালি কটি নাম, শব্দশাস্ত্র, ছন্দশাস্ত্র গভীর মন্থন করা চলে। ফিরি যখন, শেষ বসন্তের হাওয়া চলছে রাস্তায় রাস্তায়, ছেঁড়া পাতা:আর ঝরা পাতা আর ছেঁড়া কাগজ আর টুকরো চাঁদ ফাঁকা রাস্তায় রাস্তায় বেজে ওঠে নর্তকীর মতো। আমার কানে পাওয়ার হাউসের স্বর ময়ূরের পালকের মতো খুঁজে আছে। আমার কণ্ঠে কবিতার দুটি পঙক্তি বারবার আবৃত্ত হয় : তোমাকে আমার চাই ক্রমাগত অসিত কুকুর। ভিতরে কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায়।
সারা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। দরোজা খুলে দ্যায় কাজের মেয়েটি। অকারণে হাসে কেন-যেন। যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি, মাঝে-মাঝে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরলে পা যেমন টলটল করে, সমস্ত চেনা যেমন টলমল করে, মাথায় ভিতরে যেমন ভূমিকম্প হয়, আস্তে-আস্তে কবিতার লাইন যেমন অনন্ত থেকে চলে আসে, মুঠোর মধ্যে সূর্য, কন্ঠে চাঁদ— তেমনি, আশ্চর্য, মদ না খেয়েই যেন কী একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যেন আবৃত্ত হতে-হতে তোমাকে আমার চাই ক্রমাগত অসিত কুকুর / ভিতরে আমার কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায়, এই লাইন দুটি পরিণত হয়েছিলো এক গভীর ইদারায়, যার ভিতরে লাফ দিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আমি। মেয়েটার হাসি যেন সেই ইদারার মুখ মুহূর্তে বুজিয়ে দ্যায়, মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে আসি। আশ্চর্য, মেয়েটাকে কোনোদিন ভালো করে দেখি নি। এখন আশ্চর্য হয়ে। দেখি ঈশ্বর-রচিত এক প্রাকৃতিক ভাস্কর্য : ফুলকপির মতো স্তন, বাঁধাকপির মতো পাছা। কবিতার শব্দগুলি যেন ঘাসের মধ্যে এদিক-ওদিক নিঃশব্দে লুকিয়ে পড়ে। আমি নিজের ঘরের উদ্দেশে চলে যাই।
১১.
রাত্রিবেলা জেগে ওঠে আমার ঘর— নিঃশব্দায়মান। টেবিল ল্যাম্পের আলোর বলয়ে এসে বসতে না বসতেই কোত্থেকে চলে আসে মায়াবীর মতো জাদুবলে চারটি নিবিড় পঙক্তি :
‘তোমাকে আমার চাই’ ক্রমাগত অসিত কুক্কুর
ভিতরে আমার কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায় :
‘তোমাকে আমার চাই’ এই কান্না রাত্রিনীলিমায়
স্বপ্নে চড়ে ঘুরে-ঘুরে উঠে যায় দূর–বহুদূরে।
লাইনগুলি লিখে ফেলতে দেরি হয় না আমার।
সব বদলে যায় রাত্রিবেলা। ফ্যান ঘুরছে না তো, যেন মনে হচ্ছে গলায় দড়ি বাঁধা হরিণের ক্রমচক্কর। ব্রা-খোলা মিনার স্তন দুটি বাল্বের মতো দীপ্যমান, তার আলো একটা নীলাভকালো গোলাপের পাপড়ির ওপর পড়ে থাকে। আমার ঘরের সবুজ ডিসটেম্পার করা দেয়াল দেখে মনে হয় যে আমি দোতলা অরণ্যশিবিরে আছি। যেন ওআর্ডরোব দুটি ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় বিশাল প্রাচীনকালের পাখির মতো। ছাদের ওপর বাতাসে পাতা গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ বাজে নাচিয়ে মেয়ের পদসঞ্চালনের অতিদ্রুত বৃষ্টির মতো।
আহ, কতো টুকরো-টুকরো বিভক্ত হয়ে গেছি আমি। দিনের টুকরো, রাতের টুকরো, বাস্তবের টুকরো, স্বপ্নের টুকরো। টুকরো লাইন ছাড়া আমার দেবার আর কিছু নেই। এমন করে নিজেকে আত্মবিভক্ত আর কে করেছে? আমি তো ঈশ্বর নই, টুকরোগুলো জোড়া লাগাবো কী করে। নিজের জন্যে করুণার জল এসে যায় আমার
ওকে শাস্তি দাও— ওকে শাস্তি দাও ওকে শাস্তি দাও–
ওকে…
যে কাঁদে বিনিদ্র রাতে আমি ওকে করেছি আলাদা,
শিল্প রচা অন্য-আমি বিদেশী দূরত্বে আছি বাঁধা,
ওকে তুমি শাস্তি দাও, আমি ডুবে থাকি তীব্র শোকে।
অনন্তই হয়তো জীবনে–যদি একজনের কেন্দ্রে স্থিত হতো জীবন। নাকি এই আমাদের নিয়তি?
জানালা দিয়ে চোখে পড়ে, আকাশে চাঁদ উঠেছে একগুচ্ছ সাগরকলার মতো জ্বলজ্বলে সোনালি-হলুদ। তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখে একফোঁটা পানি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি একসময়।
১২.
মাঝরাতে কি গভীর বৃষ্টি নেমেছিলো? হরিণেরা জলপান করতে এসেছিলো মানুষের তৈরি লেকে? মনের মধ্যে একটি মুখের মতন সেই বৃষ্টিতে ভেসে যায়। ছাদের ওপর ঝিমিয়ে আসে জীবনের গহন নর্তকী। যেন নিশি-পাওয়া মানুষের মতো এসে বসি টেবিলে—
কখন প্রহর যায়, চন্দ্ররাত্রি ঘুমে ঢলে আসে,
দুই আমি জেগে ঘুমোবার সাধ ভালোবাসে;
ঘুমে-জাগরণে তারপর পরস্পরের সকাশে
এসে মেশে দু’জন আলাদা আমি— দুই পরস্পর;
ঘুম-চোখে দ্যাখে : এক চুল-চোখ-মন-কণ্ঠস্বর।
আধেক আমার জন্ম হয়ে ওঠে আধেক ঈশ্বর।
১৩.
আম্মা বললেন, এই ক’টা টাকা? এই ক’টা টাকায় আমি মাস চালাবো কী করে?
দেখি, আমি বলি, পরে আর-কিছু দেবোখন।
পেয়ে আর দিয়েছো তুমি। সে তো সব মাসেই শুনি। পর আর আসে না তোমার। তোমাদের সংসার তোমরাই নাও, বাবা আমাকে এই আজাব দেওয়া কেন?
১৪.
বিবি একদিন, রাত্রিবেলা অতিমৃদু অতিমধুর কণ্ঠে আমাকে শোনার ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’। ফিরে-ফিরে অনেকক্ষণ ধরে এই একটি গান গায়। আমার মনে হয়, আমার শ্রবণে উদিত হলো এক অমূলক, যার ঝিরিঝিরি শিরিশিরি এ জীবনে থামবে না আর। আর, যতোক্ষণ গান চলতে লাগলো, আমি মনে-মনে ভাবলাম, এই গানের কথার মধ্যে বিবির আত্মতা মিশে গিয়েই কি একে এমন অপরূপ করে তোলে নি!
গান শেষ হতে বিবি আমার দিকে তাকালো। আমি স্পষ্ট বুঝলাম, আমার প্রিয় আরো কিছু গান গাইবার জন্যে সে আজ প্রস্তুত। বললাম, বিবি, এই গানের মাধুরী আমি নষ্ট হতে দেবো না। আজ আর কোনো গান না। কিন্তু, একটা কথা বলবে আমাকে বিবি? এই গানটা তুমি নির্বাচন করলে কেন?
বিবি মুখ নত করে রইলো। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বললো–আমি দেখলাম ওর চোখের হ্রদের চিকচিকে জলে সোনা রঙের চাঁদ উঠেছে–বললো স্যার!
মুহূর্তে আমি বুঝলাম, শব্দ কিছু নয়, এই যে কবিতার শব্দের জন্যে এতো প্রাণপাত শ্ৰম–সে কিছু নয়; বুঝলাম শব্দের লক্ষ্য হচ্ছে শব্দের অতীতে যাওয়া।
চোখ বুজে এলো বিবির, নত হয়ে এলো ওর আনন আমার মুখের দিকে, আমার ঠোঁটের ওপর ওর ঠোঁটের প্রথম কম্পন আমি যেন আত্মার ভিতর দিয়ে শুনতে পেলাম। বিহ্বল আমার ভিতর থেকে উচ্চারিত হলো, ডালিয়া!
মুহূর্তে সোজা হয়ে বসলো বিবি, এক মুহূর্তে নিজেকে ঠিক করে নিলো, কঠিন অবোধ্য পরিষ্কার গলায় বললো, আমি বাড়ি যাবো।
আমি কিছু বলতে পারলাম না, একবার জিজ্ঞেস করতে পারলাম না কী হলো, আমার অপরাধের জন্যে মুখ ফুটে একবার ক্ষমা চাইতে পারলাম না।
অনেকক্ষণ পরে শুধু বললাম, তোমার কাছে একটাই দাবি আমার। এতো রাতে তোমার একা বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।
বিবি শুধু বললো, ঠিক আছে। আর কোনদিন আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন না।
আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। সারা রাস্তা নীরব থাকলো বিবি। রিকশা থেকে নেমে নীরবে সোজা বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।
১৫.
আমার শুধু টুকরো পঙক্তি আসে। আমি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ একটি কবিতা লিখে উঠতে পারি নি। সমস্ত টুকরোগুলো জুড়তে গেলে আমরা আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। জীবনটাকেও বড়ো বেশি এলোমেলা করে ফেলেছি। বড়ো সাধ হয়, একটি সম্পূর্ণ শান্তিময় জীবন সৃষ্টি করবো নিজের জন্যে। আ, স্বপ্নই রয়ে যায়। আমার জীবন, আমার কবিতা সবই এলোমেলো হয়ে রইলো। সবই এক সন্ধ্যার ঘোরের মতো যে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত গেছে, কিন্তু চাঁদ তখনো ওঠে নি। সময় ছুটেছে দুরন্ত এক ঘোড়ার মতো। তার পায়ের নিচে আমার জীবনের শতশত টুকরো স্পন্দিত হল, শুধু গ্রথিত হয় নি একটি মালায়। মালা ছিঁড়ে পুঁতিগুলো ঝরে পড়েছে স্বপ্নে, বাস্তবে, খাটের নিচে, আলমারির তলায়, কাদায়, নক্ষত্রে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিধি নেই কি কোথাও? কোনো এক জায়গায় আমিও কি নই টান করে বাঁধা? সবই কি শেকড় ছেঁড়া? সবই কি ভেসে যাওয়া? নাকি আমাদের জন্মের আগেই সব সুগোল-নিটোল চিরতরে চূর্ণ হয়ে গেছে?
১৬.
বিবি, মাফ করো আমাকে। মিনা, মাফ করো আমাকে। কাজের মেয়ে, মাফ করো আমাকে। কবিতা, আমাকে মাফ করো। রাত্রি, আমাকে মাফ করো। তোমাদের সবার মধ্যে অন্য-এক কেন্দ্রীয় ধ্যানের প্রতিরূপ খুঁজে ফিরেছি আমি। তোমাদের সবার প্রতি অন্যায় করেছি।
১৭.
সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণ, উন্মাতাল আর স্মৃতিসঞ্চারী আর কে আছে? সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে নেই কোনো দিন। হয় ফিরতে হয় অনেক বেলা থাকতে, না-হয় সন্ধ্যা পার করে দিয়ে। সেদিন সেই ভুলই করলাম। যানে যন্ত্রে উন্মথিত এক রাস্তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে সরু একটা গলিপথ, দেখে থমকে উঠলাম। এই-তো সাঁই পাড়ায় যাবার সেই বাঁকা রাস্তাখানি। মসজিদের পাশ দিয়ে, পুকুরের পাশ ঘেঁষে, ধুলো ওড়ানো এই পথটাই তো চলে গেছে আমাদের দেশগাঁয়ের বাড়িতে। সেই আটচালার সামনে দহলিজ-ঘর, দাদা হুঁকো হাতে, লোকজন সব বসে। ভেতরে ধানের গোলা। ঢেকির পাড় পড়ছে। সামনে বিশাল গোলাপখাশ আমগাছ। সেই গাছে এক পাগল কোকিল ডেকে চলেছে তো চলেছেই যতোবার সে ডাকছে ততোবার আনন্দের ঝলমলে মখমলের গা বেয়ে এক একটা হিরের আংটি গড়িয়ে পড়ছে শাদা বেদনার পাথরে। রিকশা থেকে লাফিয়ে নামছিলাম প্রায়, এমনিভাবে জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম।
১৮.
দুটো পঙক্তি মনের মধ্যে বেজে উঠছে বারবার :
ভালোবাসা, বেজেছে ঘণ্টার মতো, সন্ধ্যার মন্দিরে।
তোমার যাবার পথ গিয়েছে আমাকে চিরে-চিরে।
১৯.
এক কবিতা-পাঠ ও আলোচনা সভায় প্রায় জবরদস্তি করে ধরে নিয়ে গেলো আমাকে। সেখানে ‘জটিল’, ‘দুর্বোধ্য’, ‘শূন্যসাধক’, ‘অর্থহীন’, ‘অভিব্যাক্তিক’ প্রভৃতি শব্দ-ছড়ানো যে রচনাটি পাঠ করা হলো বোঝা গেলো তার উদ্দিষ্ট আমি বা আমার কবিতা। আমাকে একটা ভাষণ দিতেও বলা হলো। নিজের সম্বন্ধে আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। আমি যুক্তি জানি না।
২০.
ফেরার সময় একটা ছুটন্ত প্রাইভেটকারের পিছনে উড়ন্ত অসম্ভব সুন্দর আমার চেনা যে-মেয়েটিকে দেখে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম— এক মুহূর্ত পরেই খেয়াল হলো : আমি যাকে পনেরো বছর আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম একদিন, তার বয়স এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকবে না। এই মেয়ে সেই মেয়ে না। অথচ কী বলবো, মনে হলো একদম এক, অবিকল এক। আমি যুক্তি জানি না।
২১.
রাতে কবিতার একটা শব্দের জন্যে ক্রমাগত মাথা খুঁড়ছি— খুঁজে বেড়াচ্ছি আকাশের নীলিমা থেকে পাতালের কালি অবধি। কিন্তু ঠিক শব্দটি কিছুতেই খুঁজে পাই না। সেই শব্দ, যা দিয়ে সেই শব্দের অতীত এক ক্ষমাহীন স্বর্গে পৌঁছানো যায়। মাথা গরম হয়ে ওঠে।
তখন দরোজায় টোকা পড়ে। তাকিয়ে দেখি, মিনা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আলো জ্বেলে রেখে, দরোজা খুলে, বেরিয়ে আসি।
সিঁড়িতেই বসে আছে কাজের মেয়েটি। কিন্তু, একী সাজ-গোজ! চমকে উঠি আমি। গভীর করে কাজল-মাখা, আঁট করে শাড়ি পরা। হায়, অবোধ মেয়ে! প্রেম আর কামের তফাত জানে না। তফাত সত্যিই আছে কি? স্বজ্ঞার দৌলতে আমার চেয়ে প্রকৃত জেনেছে ও কি? কিন্তু আমাকে আবার ভালোবেসে ফেলে নি তো? অদ্ভুত মায়া লাগে। বুকের ভেতরে ছিঁড়ে যায় আমার। সমস্ত কাম মরে যায়। লু কীরকম অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ওকে আলিঙ্গন করি। শরীর প্রবেশের সময় আমার কণ্ঠ থেকে আমার অজ্ঞাতে যেন বেরিয়ে আসে ‘ডালিয়া। ডা-লিয়া! ডা-লি-য়া!’
বাতাসে কোনো দূরের ঘ্রাণ, দোতলায় শাসিঁকাচে ক্রমাগত ডাল ঘষটানির শব্দ, ক্রমাগত চৈত্রের পাতা পড়ার শব্দ।