- বইয়ের নামঃ তুমি আমি দুজনেই
- লেখকের নামঃ আবদুল জব্বার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
তুমি আমি দুজনেই
বিয়ের পর দুবছর সুজাতা ছাড়া দুটো দিন কাটাতে হলে অস্থির হয়ে পড়ত প্রিতম। জলছাড়া মাছের মত তার অবস্থা, তারপর সাজানো গোছানো সংসারের সুখে অশান্তি এসে ঢুকতে লাগল। সেটা বাড়ল প্রিতম যখন তার চাকরির ক্ষেত্রে ম্যানেজার পোস্টে উঠে গেল। বিশাল বিদেশি এক স্যু ফ্যাক্টারির প্রতিষ্ঠা পেতে পঞ্চাশ বছর সময় লেগেছে–তার নানান বিভাগে মাথা ভারি প্রশাসনের মতো বহু ম্যানেজার একটা বিরাট বাগান জোড়া ম্যানেজার কুঠি। সুন্দর সুন্দর সাহেব বাড়ি। একেবারে দুধসাদা। প্রত্যেকটির সামনে পাশে সবুজ গাছপালায় নানা রঙের ফুলফল। লনে মোটর ঢোকার কেয়ারি করা পথ। চল্লিশজন ম্যানেজার আছেন।
প্রিতমের ডিপার্টমেন্টে পঁচিশজন কর্মদক্ষ নতুন লোক নেওয়া হবে–যারা দু বছর ধরে ট্রেনিং নিয়েছে তারা প্রায় দেড়শোজন। তাদের মধ্যে থেকে পঁচিশজন বাছাই করা কঠিন কাজ। জনা দশেক টেকনিক্যাল পাশ করা মেয়েও আছে। এরা হিসেবপত্রও করতে জানে।
প্রত্যেককেই চেনে জানে প্রিতম্। তারা তার বাসায় আসতে লাগল। প্রত্যেককেই আশা দেয়, সে হাসি মাখিয়ে।
শ্রীলেখাকে যেমন দেখতে ভাল, তেমনি সে স্মার্টও। একদিন শ্রীলেখা কাঁটায় কাঁটায় সকাল ছ’টার সময় এসে হাজির। কলকাতার হেড অফিসে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা। সেখানে সুপার ম্যানেজার ওলন্দাজ ডাচ্ এ্যালেমের সঙ্গে আলোচনা আছে। বিদেশি বহু রকম লেডিস শু্যর নমুনা আর ছবি দেখানো হবে।
প্রিতম্ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুজাতাও এলো পিছনে পিছনে।
কিসে এলে?!
ভাই দিয়ে গেল মোটর বাইকে। ভয় হচ্ছিল, হাইব্রিজ থেকে নামার সময় যদি শ্লিপ করি দুজনেই খতম হয়ে যাব।
জীবনটা কি রকম এখন দেখ।
কোম্পানির মোটর এসে গেল। দুজনে হাওয়ায় ধোঁয়া ছেড়ে যেন উড়ে গেল।
সুজাতা সাহেব কুঠিতে সারাবেলা বসে ভাবে। বই পড়ে। মাকে ফোন করে। আগে তারা ছিল অন্য কোয়ার্টারে একসঙ্গে অনেক বাবু। সে বাড়িটা চারতলা ফুটবল গ্রাউন্ডের পিছনে নদীর বাঁধের কোলে। পশ্চিমে নদী আর আকাশের বিস্তার কত নৌকা আর ফেরিঘাটের লোক চোখে পড়ত। ঝড়বৃষ্টি এলে তাড়াতাড়ি জানালা কপাট বন্ধ করতে হতো। আর বিদ্যুৎ চলে যেত।
এখানে ম্যানেজার পাড়ায় বাগানে শব্দ বলতে গাছে গাছে পাখির ডাক, কারো কারো কুঠি থেকে এ্যালসেশিয়ানের চিৎকার, মোটর এলে গেলে তার শব্দ আর রেডিও বা টিভির গানবাজনা।
এই শ্ৰীলা মেয়েটিকে নিয়ে সুজাতার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ গায়ে পড়া আদুরে স্বভাবের মেয়ে। কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমে পর্ণশ্রীর আধুনিক পল্লীতে তাদের চমৎকার তিনতলা পর্ণকুটির। কনট্রাক্টরের মেয়ে। টাকা পয়সা প্রচুর আছে বাবার। তবু কুমারী বয়সেই চাকরির কি দরকার? বিয়ে করে সংসারী হলেই পারত।
শ্ৰীলা বলে, বিয়ে! আরে রাম! ঠাকুমা আর মা-মাসিদের তো দেখেছি তাঁদের চেহারা আর জীবন-যাপনে কত সুখ। একটা সংসারে বাঁধা গরুর মতো সামাজিক দড়িতে ঘুরপাক খেয়ে পঁচিশ তিরিশ পঞ্চাশ বছরে কাঁথাকানি হয়ে বাঁচা। তারপর ওঁগঙ্গা! বিয়ে আমি করবই না।
সুজাতা বলেছে, বিয়ে নাই করো, যত সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকো, তবু তো প্রকৃতির হাতে রেহাই নেই। যৌবনকাল মলিন হবে? রানী এলিজাবেথকে তো দেখতে পাচ্ছ।
বেলা একটায় ওদের ফেরার কথা ছিল কিন্তু ফিরল সন্ধ্যা সাতটার পর। একা প্রিতমই শুধু ফিরেছে। পর্ণশ্রীতে শ্ৰীলাকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। ওর মা নাকি আদর করে কত কি খাওয়ালেন। বাপ বললেন, কত টাকা চাই ওর চাকরিটার জন্যে?
না, কি বলছে!
এক লাখ!
স্যরি মিঃ মুখার্জি। শ্ৰীলা চাকরি পাবে। ডাচ্ সাহেবকে ও সন্তুষ্ট করতে পেরেছে।
শ্ৰীলার চাকরি হয়ে গেল।
ম্যানেজার কুঠিগুলোয় সন্ধ্যা আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত সাহেবরা আড্ডা মারেন। তাস খেলেন টাকা হারজিতের, মদ খান। কোনো বাইরের লোক এসে পড়লে তাড়াতাড়ি বোতলগ্লাস লুকিয়ে ফেলেন। কোনো বুড়ো সাহেবের বড় মেয়ে আমেরিকায় থাকেন জামাইয়ের চাকরির ক্ষেত্রে ফোন আসবে অপেক্ষা করেন মেজ মেয়ে ইংলিশে এম.এ. পড়ে— খুকি সেজে ম্যাক্সি পরে বাগানে ঘুরে বেড়ায়— কবিতার লাইন ঠিক করে। প্রিতমদের পাশেই আছে জগন্নাথবাবু নামে তেমন একজন ম্যানেজার। তাঁর ভাই মল্লুিনাথও ম্যানেজার।
শ্ৰীলার সঙ্গে আরো সাতজন মেয়ে চাকরি পেলে। বাকি সব ছেলেরা। লু বেশির ভাগই বাদ গেল। ডাচ্ সাহেব নিজেই বসেছিলেন ইন্টারভিউ নিতে।
বছর তিনেক আগে এই বিশাল শু্য ফ্যাক্টরিতে রাজনীতির লড়াই হলে প্রায় সাতমাস কারখানা লক আউট হয়ে পড়ে ছিল। অনেকগুলো পার্টির ইউনিয়ন। অনেক লিডার। বক্তৃতা। মারপিট পুলিশ সন্ত্রাসের রাজত্ব হয়ে গিয়েছিল।
তারপর মালিক জিতে গেলেন। দাসখত দিতে হলো। এখন দুবছর সুস্থ সাবলীল অবস্থা।
সুজাতা কেবল উপন্যাস পড়ে। কি আর করবে? টিভি দেখে সময় আর কতক্ষণ কাটে?
শ্ৰীলার সঙ্গে, তনুজার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করে প্রিতম। রাতে সে যেন বিছানায় মড়া কাঠ। বড়ি গিলে ঘুমোয়। সাতরাত পার হয়ে গেল। কথাবার্তা প্রায় নেই বললেই হয়। কাজের মেয়েটি খাবার দাবার দেয়।