- বইয়ের নামঃ রবিবার ছুটির দিন
- লেখকের নামঃ আফসার আহমেদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
রবিবার ছুটির দিন
গত রাতে ঘুমোতে যাবার সময়ও নীলা ভাবেনি, আজ সারাদিন সে কি করবে। বাড়ি ফিরতে রাত নটা বেজে যায়। তখন তার পরের দিনের পরিকল্পনার কথা মাথায় আসেনি। পরিবারের আর সকলের দিকে চোখাচোখি, প্রশ্নোত্তরে, বিশ্রামের পরিতৃপ্তিতে তখন সে তখনকার মতো ছিল। এখন এই ছুটির দিনে রবিবারে, আর এক রকমভাবে আছে। বস্তির দুপুর যেমন থাকে, তেমনটাই ছিল তার চারপাশে। ধোঁয়া ধুলো-গরম-চিৎকার-চেঁচামেচি।
নোংরা-দুর্গন্ধ যেমন থাকার তেমনই ছিল। কিন্তু নীলা কীভাবে এই ছুটির দিনটা কাটাবে, তার হারে কাছে কিছুই ছিল না। ছুটির দিন বলেই বড়জোর সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল। তারপর থেকে এই দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত যাপনের সংকটের মধ্যে পড়েছে। নীলা। কীভাবে এই এখানে একা একা সারাটা দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা পার করবে? তারপরই পরিবারে আর সকলে ফিরে আসবে। ফিরলই যদি, তাহলেও নীলার সংকট কাটছে না। তারপর তো রান্নার আয়োজন, ঘষা-মাজা, জল তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মাবাবা দাদা-বৌদি বড়দিরা। উনুন ধোঁয়া উগরোবে। নানা কিছু। যে সমস্ত নানাকিছুতে থাকতে ভাল লাগবে না নীলার। অন্য দিনগুলোতে তো থাকে! ছুটির দিরে সন্ধ্যায় তার এ ভাবে কাটানো খুবই অসহ্য মনে হবে।
এই দুপুরই কি সহনীয় তার কাছে? এইভাবে একা একা থাকা? এইভাবে ছুটির দিনটাকে শেষ করতে দেওয়া উচিত হবে না তার। শেষ করতে না দেওয়া, সেটা একটা অন্য জিনিস। এই মহার্ঘ দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যাকে সে না হয় আঁকড়ে ধরে যথার্থ খরচ করতে চাইবে। সেটা হবে তার যথার্থ যাপন। কিন্তু সেই যান খুঁজে না পেলে বিপদ হয় তার। নিমেষে দুপুর বিকেল-সন্ধ্যা উৎরে গেলে বাঁচত সে। তা তো হবার নয়! আর এমন দুটির দিনটা! সারা সপ্তাহের পর একদিন পায় সে। ভোলার সঙ্গ আশা করেছিল সে কাল থেকে। ভোলাকে পায়নি বস্তিতে তার মাসির ঘরে। হয়তো এসে যাবে, এই অপেক্ষায় আড়াইটে বাজিয়েছে নীলা।
সকাল নয়টায় সাবান ঘষে ঘষে স্নান করেছে। চুলে শ্যাম্পু লাগিয়েছে। মাথার ক্লিপ থেকে গার্ডার শৌখিনতার মৃদু আয়োজনে প্রস্তুত রেখেছিল। ভোলা এসে ঘরে দরজার সামনে টুকুতে ছোট ছোট টুল পেতে গল্প করবে, নয়তো প্ল্যাটফরমের বেঞ্চে গিয়ে বসবে, গল্প করবে। কিংবা ভোলা যদি কিছু একটা কাজে ব্যস্ত থাকল তার মাসির ঘরে, তা হলে সে মাসির ঘরের উঠোনে বসে ভোলার সঙ্গে কথার ফুলঝুরি ফোঁটাত। টুকরো টুকরো কাঠ জুড়ে নানা কিছু বানিয়ে দেয় ভোলা তার মাসির। টুল বানায়, সিঁড়ি বানায়, ঠাকুরের আসন বানায়। প্রায় দিনই দেখা যায় ভোলা মাসির ঘরে কিছু না কিছু কাজ করছে। একদিন ওখানে গিয়েই ভোলার সঙ্গে ভাব জমে নীলার। কয়েক পা পরেই ভোলার। মাসির ঘর। ভোলার মাসির রেডিওতে গান বাজছে তাদের ঘর থেকে শুনে গায়ক গায়িকার নাম বলা সম্ভব হয়—এমনই স্পষ্ট শোনা যায়। কত ছেলেই না এ বস্তিতে আছে। কিন্তু কেনই ভোলার সঙ্গে নীলার দেখা হয়, কথা হয়, সেটা একটা রহস্যই। হঠাৎ ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনার ভেত্র দিয়েই এই ঘনিষ্ঠতা। একবার ভো কাটা ঘুড়ি উড়ছিল মহল্লায়। ভোলার সঙ্গে একটা বাচ্চার দল হই-হই করে মহল্লার এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। হাতে কঞ্চি আর শুকনো ডালপালা। শেষে ঘুড়িটা সেদিনের শেষ বিকেলে নীলাদের বাড়ির চালে নেমে পড়ে। নীলা ও নীলার মা বাবা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। আর তাদের চোখের সামনেই চালের উপরে উঠে যায় ভোলা। নীলার বাবা রাগারাগি করতে এগিয়ে গিয়েছিল, নীলার মা তাকে থামিয়ে দেয়। চালাতে একটা ভাঙা টালি ছিল, তাতে টিনের ফালি খুঁজে দিল ভোলা। ভোলাকে বলতেই করে দিল। আর ভোলা নেমে আসতেই ঝর ঝর করে ভোলার সঙ্গে কথা বলতে লেগে গেল নীলা। কেমন নেকি নেকি, লোক দেখানো গালভরা আনন্দিত কথার আবেগ ঝরিয়ে কথা বলা। এবং ভালও লাগছিল কথা বলতে নীলার। সেই থেকে কথা বলা, ভাল লাগা নীলার, ভোলা নিয়ে। ভাল লাগা নিয়েই থেকেছে। প্রেম প্রেম খেলা খেলেনি সে। লোকে এখানে সেখানে। দেখছেও না তাদের। যেমন করে প্রেম করে ধ্বই। না তেমন প্রেম নয়, ভাল লাগা নিয়ে কথা বলে তারা, মেশে।
অথচ সোম থেকে শনি ভোলার সঙ্গে মেশার ও কথা বলার কোনও ফুরসতই থাকে না। তেমন মনেও থাকে না। মনে থাকবার মতো অবসরও খুঁজে পায় না নীলা। কেননা নীলা চাকরি করে। এবং চাকরি করে বলেই একটা দিন ছুটি সে পায়। আর একটা দিন ছুটি কীভাবে কাটাবে, তাকে ভাবতে হয়। সে বাবুর বাড়িতে কাজ করে না, তার চাকরি করাটা তাকে মহল্লার মধ্যে এক বিশেষত্ব দেয়, তেমনই গৌব্বও বাড়ায়। এবং সে যে বাবুর বাড়ি কাজ করতে করতে চাকরি করছে একথা যেমন সত্যি, তেমন এই পারম্পর্য ভুলে যেতে চায় নীলা। বাবুর বাড়ি আগে কাজ করার ব্যাপারটা অস্বীকার করতে চায়। যেমন বাবার বাড়ির মেয়েদের পুরনো পোশাক সে আর পরে না সে কারণে। পুরনো বাড়িতে যাতায়াতও তার তেমন নেই। দশ বছর বয়স থেকে সাততলার ফ্ল্যাটের বাকুর বাড়িতে গত বস্ত্র পর্যন্ত কাজ করেছে। এখন তার বছর কুড়ি বয়স। আর বাকুর বাড়ি কাজ করার দৌলতেই তার এই চাকরি, পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে যে স্কুলে গেছে, তা নয়। বাবুর বাড়ির সকলেই তাকে পড়িয়েছে। লিখতে শিখিয়েছে, পড়তে শিখিয়েছে। তারপর বাবুর বন্ধু শেয়ালদায় জেরক্সের দোকান খুলল, বাবু বলে কয়ে সেখানে চাকরি জুটিয়ে দিল নীলার। চাকরিটা যত নীলার কাছে আত্মসম্ভ্রমের তেমনই চাকরি জোটানোর। প্রক্রিয়া তেমন নয়। নিজের কাছ থেকে বাবুর বাড়ি কাজ করার অতীত মুছে ফেলতে চায় সে। সে এখন চাকরি করে। জেরক্স মেশিন চালায়। নিজের পয়সায় সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে পরে সে। আর এই বস্তি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেই বস্তিটাকে অস্বীকার করে ফেলে নীলা। আর পাঁচটা ভদ্র ও শিক্ষিত ঘরের কমবয়সী মেয়ের মতোই হয়ে ওঠে। পোশাকে তাকে তেমনই দেখায়। চুলে ক্লিপ আঁটার ভেরও। বাঁ কজিতে ঘড়ি আঁটলে তেমনই দেখায়। নিজের কোলটুকুতে বাঁ হাতে ধরে রাখা ছোট্ট ব্যাগটাতে তেমনই মানায়। অন্যদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে নীলা। সেই সতর্কতা, সেই পরম অনুভূতি নিয়ে চঞ্চল হয়ে পড়ে নীলা। আনন্দিত হয়ে থাকে। তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে, ট্রেনের কারায়। জেরক্সের দোকানের কর্মব্যস্ততার ভেত্র আত্মমগ্নতার আনন্দ তৈরি করে নীলা। কাউন্টারের কাছে আয়না আছে। আয়নার সামনে এগিয়ে এলেই প্রতিবিম্বিত হয় নীলা। অন্য নীলা সেখানে ফুটে ওঠে। অন্য নীলা সেখানেই ফুটে উঠুক, কল্পনা করে সে। চমৎকার লাগে এ সব কিছু।