- বইয়ের নামঃ রবিবার ছুটির দিন
- লেখকের নামঃ আফসার আহমেদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
রবিবার ছুটির দিন
গত রাতে ঘুমোতে যাবার সময়ও নীলা ভাবেনি, আজ সারাদিন সে কি করবে। বাড়ি ফিরতে রাত নটা বেজে যায়। তখন তার পরের দিনের পরিকল্পনার কথা মাথায় আসেনি। পরিবারের আর সকলের দিকে চোখাচোখি, প্রশ্নোত্তরে, বিশ্রামের পরিতৃপ্তিতে তখন সে তখনকার মতো ছিল। এখন এই ছুটির দিনে রবিবারে, আর এক রকমভাবে আছে। বস্তির দুপুর যেমন থাকে, তেমনটাই ছিল তার চারপাশে। ধোঁয়া ধুলো-গরম-চিৎকার-চেঁচামেচি।
নোংরা-দুর্গন্ধ যেমন থাকার তেমনই ছিল। কিন্তু নীলা কীভাবে এই ছুটির দিনটা কাটাবে, তার হারে কাছে কিছুই ছিল না। ছুটির দিন বলেই বড়জোর সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল। তারপর থেকে এই দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত যাপনের সংকটের মধ্যে পড়েছে। নীলা। কীভাবে এই এখানে একা একা সারাটা দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা পার করবে? তারপরই পরিবারে আর সকলে ফিরে আসবে। ফিরলই যদি, তাহলেও নীলার সংকট কাটছে না। তারপর তো রান্নার আয়োজন, ঘষা-মাজা, জল তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মাবাবা দাদা-বৌদি বড়দিরা। উনুন ধোঁয়া উগরোবে। নানা কিছু। যে সমস্ত নানাকিছুতে থাকতে ভাল লাগবে না নীলার। অন্য দিনগুলোতে তো থাকে! ছুটির দিরে সন্ধ্যায় তার এ ভাবে কাটানো খুবই অসহ্য মনে হবে।
এই দুপুরই কি সহনীয় তার কাছে? এইভাবে একা একা থাকা? এইভাবে ছুটির দিনটাকে শেষ করতে দেওয়া উচিত হবে না তার। শেষ করতে না দেওয়া, সেটা একটা অন্য জিনিস। এই মহার্ঘ দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যাকে সে না হয় আঁকড়ে ধরে যথার্থ খরচ করতে চাইবে। সেটা হবে তার যথার্থ যাপন। কিন্তু সেই যান খুঁজে না পেলে বিপদ হয় তার। নিমেষে দুপুর বিকেল-সন্ধ্যা উৎরে গেলে বাঁচত সে। তা তো হবার নয়! আর এমন দুটির দিনটা! সারা সপ্তাহের পর একদিন পায় সে। ভোলার সঙ্গ আশা করেছিল সে কাল থেকে। ভোলাকে পায়নি বস্তিতে তার মাসির ঘরে। হয়তো এসে যাবে, এই অপেক্ষায় আড়াইটে বাজিয়েছে নীলা।
সকাল নয়টায় সাবান ঘষে ঘষে স্নান করেছে। চুলে শ্যাম্পু লাগিয়েছে। মাথার ক্লিপ থেকে গার্ডার শৌখিনতার মৃদু আয়োজনে প্রস্তুত রেখেছিল। ভোলা এসে ঘরে দরজার সামনে টুকুতে ছোট ছোট টুল পেতে গল্প করবে, নয়তো প্ল্যাটফরমের বেঞ্চে গিয়ে বসবে, গল্প করবে। কিংবা ভোলা যদি কিছু একটা কাজে ব্যস্ত থাকল তার মাসির ঘরে, তা হলে সে মাসির ঘরের উঠোনে বসে ভোলার সঙ্গে কথার ফুলঝুরি ফোঁটাত। টুকরো টুকরো কাঠ জুড়ে নানা কিছু বানিয়ে দেয় ভোলা তার মাসির। টুল বানায়, সিঁড়ি বানায়, ঠাকুরের আসন বানায়। প্রায় দিনই দেখা যায় ভোলা মাসির ঘরে কিছু না কিছু কাজ করছে। একদিন ওখানে গিয়েই ভোলার সঙ্গে ভাব জমে নীলার। কয়েক পা পরেই ভোলার। মাসির ঘর। ভোলার মাসির রেডিওতে গান বাজছে তাদের ঘর থেকে শুনে গায়ক গায়িকার নাম বলা সম্ভব হয়—এমনই স্পষ্ট শোনা যায়। কত ছেলেই না এ বস্তিতে আছে। কিন্তু কেনই ভোলার সঙ্গে নীলার দেখা হয়, কথা হয়, সেটা একটা রহস্যই। হঠাৎ ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনার ভেত্র দিয়েই এই ঘনিষ্ঠতা। একবার ভো কাটা ঘুড়ি উড়ছিল মহল্লায়। ভোলার সঙ্গে একটা বাচ্চার দল হই-হই করে মহল্লার এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। হাতে কঞ্চি আর শুকনো ডালপালা। শেষে ঘুড়িটা সেদিনের শেষ বিকেলে নীলাদের বাড়ির চালে নেমে পড়ে। নীলা ও নীলার মা বাবা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। আর তাদের চোখের সামনেই চালের উপরে উঠে যায় ভোলা। নীলার বাবা রাগারাগি করতে এগিয়ে গিয়েছিল, নীলার মা তাকে থামিয়ে দেয়। চালাতে একটা ভাঙা টালি ছিল, তাতে টিনের ফালি খুঁজে দিল ভোলা। ভোলাকে বলতেই করে দিল। আর ভোলা নেমে আসতেই ঝর ঝর করে ভোলার সঙ্গে কথা বলতে লেগে গেল নীলা। কেমন নেকি নেকি, লোক দেখানো গালভরা আনন্দিত কথার আবেগ ঝরিয়ে কথা বলা। এবং ভালও লাগছিল কথা বলতে নীলার। সেই থেকে কথা বলা, ভাল লাগা নীলার, ভোলা নিয়ে। ভাল লাগা নিয়েই থেকেছে। প্রেম প্রেম খেলা খেলেনি সে। লোকে এখানে সেখানে। দেখছেও না তাদের। যেমন করে প্রেম করে ধ্বই। না তেমন প্রেম নয়, ভাল লাগা নিয়ে কথা বলে তারা, মেশে।
অথচ সোম থেকে শনি ভোলার সঙ্গে মেশার ও কথা বলার কোনও ফুরসতই থাকে না। তেমন মনেও থাকে না। মনে থাকবার মতো অবসরও খুঁজে পায় না নীলা। কেননা নীলা চাকরি করে। এবং চাকরি করে বলেই একটা দিন ছুটি সে পায়। আর একটা দিন ছুটি কীভাবে কাটাবে, তাকে ভাবতে হয়। সে বাবুর বাড়িতে কাজ করে না, তার চাকরি করাটা তাকে মহল্লার মধ্যে এক বিশেষত্ব দেয়, তেমনই গৌব্বও বাড়ায়। এবং সে যে বাবুর বাড়ি কাজ করতে করতে চাকরি করছে একথা যেমন সত্যি, তেমন এই পারম্পর্য ভুলে যেতে চায় নীলা। বাবুর বাড়ি আগে কাজ করার ব্যাপারটা অস্বীকার করতে চায়। যেমন বাবার বাড়ির মেয়েদের পুরনো পোশাক সে আর পরে না সে কারণে। পুরনো বাড়িতে যাতায়াতও তার তেমন নেই। দশ বছর বয়স থেকে সাততলার ফ্ল্যাটের বাকুর বাড়িতে গত বস্ত্র পর্যন্ত কাজ করেছে। এখন তার বছর কুড়ি বয়স। আর বাকুর বাড়ি কাজ করার দৌলতেই তার এই চাকরি, পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে যে স্কুলে গেছে, তা নয়। বাবুর বাড়ির সকলেই তাকে পড়িয়েছে। লিখতে শিখিয়েছে, পড়তে শিখিয়েছে। তারপর বাবুর বন্ধু শেয়ালদায় জেরক্সের দোকান খুলল, বাবু বলে কয়ে সেখানে চাকরি জুটিয়ে দিল নীলার। চাকরিটা যত নীলার কাছে আত্মসম্ভ্রমের তেমনই চাকরি জোটানোর। প্রক্রিয়া তেমন নয়। নিজের কাছ থেকে বাবুর বাড়ি কাজ করার অতীত মুছে ফেলতে চায় সে। সে এখন চাকরি করে। জেরক্স মেশিন চালায়। নিজের পয়সায় সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে পরে সে। আর এই বস্তি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেই বস্তিটাকে অস্বীকার করে ফেলে নীলা। আর পাঁচটা ভদ্র ও শিক্ষিত ঘরের কমবয়সী মেয়ের মতোই হয়ে ওঠে। পোশাকে তাকে তেমনই দেখায়। চুলে ক্লিপ আঁটার ভেরও। বাঁ কজিতে ঘড়ি আঁটলে তেমনই দেখায়। নিজের কোলটুকুতে বাঁ হাতে ধরে রাখা ছোট্ট ব্যাগটাতে তেমনই মানায়। অন্যদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে নীলা। সেই সতর্কতা, সেই পরম অনুভূতি নিয়ে চঞ্চল হয়ে পড়ে নীলা। আনন্দিত হয়ে থাকে। তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে, ট্রেনের কারায়। জেরক্সের দোকানের কর্মব্যস্ততার ভেত্র আত্মমগ্নতার আনন্দ তৈরি করে নীলা। কাউন্টারের কাছে আয়না আছে। আয়নার সামনে এগিয়ে এলেই প্রতিবিম্বিত হয় নীলা। অন্য নীলা সেখানে ফুটে ওঠে। অন্য নীলা সেখানেই ফুটে উঠুক, কল্পনা করে সে। চমৎকার লাগে এ সব কিছু।
তার এ কাজের যে দীর্ঘ সময়, তাতে বস্তি তার মন থেকে সরে যায়। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত জেরক্স দোকানে কেটে যায় তার। যখন ছুটি হয়, ফেরার সময় মনে পড়ে সে কোথায় থাকে। তখন সে তার বস্তির ঘরে ফেরার জন্য অস্থির। বিশ্রামের জন্য শরীর ও মনের ওপর ফড়িং এসে বসে যেন। আর রাত যত এগিয়ে আসে ততই বস্তির মেয়ে হয়ে ওঠে নীলা। ততই সে সমস্ত ধোঁয়া-ধুলোকালি চেঁচামেচি দুর্গন্ধ সমস্ত কিছুর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে পড়ে। যতক্ষণ না পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ শান্তি নেই। সারাক্ষণই ট্রেনের জানালায় অস্থিরতার চোখ ছুঁয়ে যায়। সকালে বেরোবার সময় আবার অন্য মন। হয়ে ওঠে নীলার। বস্তি থেকে বেরোবার অস্থিরতা। বেরোবার সময়টাও দ্রুত চলে আসে। সকাল হয়ে উঠলেই বেরোবার সময় নিকট হয়ে ওঠে। আর বেরিয়ে পড়তে পারলে বাঁচেও যেন। নীলা তখন ট্রেনের কামরায় বসা শিক্ষিত ঘরের মেয়ের মতো মন নিয়ে খেলে। বস্তিকে অস্বীকার করে বেরিয়ে আসে।
অথচ ছুটির দিনে, বস্তিতেই থাকতে চায় সে। আর ভোলার কাছে গিয়ে বসতে চায়। ছুটির দিন না কাটার সংকটে ভোলাকেই প্রয়োজনীয় মনে করে সে। এই বস্তি থেকেই ভোলাকে সংগ্রহ করে সে। মেলামেশা করতে আনন্দও পায়। এক্ষেত্রে বাবুর বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার কথা ভাবে না সে। বরং অস্বস্তি। বস্তিতে থাকার ভের এক স্বাধীনতা খুঁজে পায় সে, এক নিজস্বতার পরিতৃপ্তি। ছোট বয়স থেকে বাবুর বাড়িতে থেকে এসেছে সে। বাবুর বাড়ির ভাল পরিবেশে ভাল খাবার-দাবার খেয়ে থাকার পর যখন কাজ ছেড়ে বস্তির বাড়িতে ফিরে আসে, বস্তির এই পরিবেশেই শান্তি খুঁজে পায়। মাঝে মাঝেই চলে আসতে হত। এই রকম বিপরীত যাপন নিয়ে সে বড় হয়েছে। বস্তিকে অস্বীকার করার কিছু নেই নীলার। তার যাপনের নানাকিছুতে জড়িয়ে থাকে। ভাল লাগার মধ্যে মেখে যায়।
ভোলার জন্য আর অন্য কোনও দিনগুলোতে তেমন অস্থিরতা থাকে না। রব্বিারে ছুটি কাটানোর সংকটে ভোলা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। ভোলা ও নীলার ছুটি যেন সমার্থক। এই ঘরে একা একা কী করবে সে? পাশে আর একটা ঘর আছে। ভাইপো ভাইঝিরা ও দিদির দুই ছেলে ও ঘরে ঘুমোচ্ছে বা খেলছে। ওরা এভাবেই থাকতে অভ্যস্ত। হয়ে পড়েছে। ওঘরেই রান্না খাওয়ার আয়োজন। একচিলতে ঘর। বাবুদের বাড়িতে মা দিদি-বৌদি ঠিকে কাজ করে। ফাঁকে ফাঁকে কেউ আসে। ও ঘরেই তখন ফেরে। বাচ্চারা তাদের পর্যায়ক্রমে সঙ্গে পায়। কেউ এসে খেতে দেয়। কেউ স্নান করায়। কেউ এসে ঘুম পাড়ায়। মা চার বাড়ির কাজ করে। বৌদি পাঁচটা বাড়িতে। দিদি চার বাড়িতে কাজ করে। এই বস্তির কাছেই সমস্ত বাড়িগুলো। বাবু দিদিরা বস্তির গা ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে রিক্সা করে বাসস্টপে যায়, ফিরে আসে। কোনটা ফ্ল্যাট বাড়ি, কোনটা নিজের বাড়ি, কোনটা ভাড়াবাড়ি। বাড়ির দাদা-বৌদি দুজনেই হয়তো চাকরি করে। ভাল খায়, ভাল কথা বলে। ফোন, মোটর সাইকেল কিংবা নিজস্ব গাড়ি আছে। কোনও বাবু মদ খেয়ে রাতে মাতলামি করে। ঝগড়া চ্যাঁচামেচি হয় খুব। সে সব জীবনের কথা জানে, স্বভাব জানে নীলা। নিয়মনীতি-আদবকায়দা জেনেছে। ওসব বাড়িরই একজন হয়ে থেকেছে। কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে এসেই হাঁফ ছেড়েছে। সে বুঝেছে ও জীবন তার নয়। বরং বস্তির হই-চই নানাকিছু সাধারণ মাতামাতিতে বেশি প্রাণচঞ্চল হতে পেরেছে সে।
আর তার বয়সী মেয়েরা বাবুর বাড়িতেই কাজ করে, সে করে জেরক্সের দোকানে চাকরি, তার এই গৌরব নিয়েও বস্তির থেকে আলাদা কিছু নয়। বস্তি থেকে বেরিয়ে পড়লে যদিও অন্যরকম হয়ে যায় মন তার। তা গা থেকে বস্তি মুছে যায়। সেও মুছে ফেলতে চায়। সে স্বপ্নযাপন বা মিথ্যাপন, সেই আনন্দ নিয়ে এখন আজকের এই ছুটির দিনে আনন্দিত হতে পারে না। এমনই গুরুত্বপূর্ণ এই ছুটির দিনটি। এমনই যাপনের সংকট। নীলা সকাল থেকে খুঁজে ফেরে ভোলাকে। ভোলার মাসির ঘরে গিয়ে গিয়ে। খোঁজ নিয়ে আসে। দশটার পর থেকে খোঁজ নিয়ে এসেছে। যখন তার স্নান হয়ে যায়। এবং চুলে গামছা গোঁজা থাকে। সকাল দশটা পর্যন্ত প্রায় দিন ভোলা ঘুমিয়ে থাকে। কেন হাইড রোডের একটা কারখানায় ভোলা নাইটগার্ড দেয়। ভোরের বেলা ফিরে একটু ঘুমোয়। দশটার পর জেগে ওঠে। এদিক ওদিকেই থাকে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও ভোলার খোঁজ পাওয়া গেল না। সকাল নটার সময়ই বেরিয়ে যায়। কখন ফিরবে, কিছু বলে যায়নি মাসিকে।
সাজতে শুরু করবার আগে একবার ভোলার মাসির ঘরের কাছে যায় নীলা। ও মাসি, ভোলাদা ফিরেছে?
না রে নীলা। খুব দরকার নাকি?
একটু দরকার ছিল।
কতবার খোঁজ নিতে এলি বল, তার মধ্যে ছোঁড়াটা এল কই! ফিরব না বলে যায়নি অথচ।
দুপুরে খায়নি?
না, সেই চা খেয়ে বেরিয়েছে নটার সময়। ভাত ঢেকে রেখেছি।
পেছু ফেরে নীলা, ভোলাদা ফিরলে আমাকে ডাক দেবে মাসি।
ডাকব রে ডাকব।
ঘরে ফিরে নীলার মনে হয় তিনটে বেজে গেল, এখনও ফিরল না তখন খাবার জন্য আর ফিরবে না। বাইরে কিছু খেয়ে নেবে। বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়েছে নিশ্চিত। তারা কোথাও যাবার প্ল্যান করল হয়তো। ভোলা নেই, তাহলে কী করে নীলা! এখন যদি রবিবার ছাড়া অন্যবারের দুপুর হত, তাহলে নীলা জেরক্স মেশিনের সামনে ভাববারও। সময় খুঁজে পেত না। একটার পর একটা কাজ। ভিড়। মেশিনের শব্দ, কথোপকথন, নানা কিছু নিয়ে নিজেকে একটা জায়গায় রেখে দিতে পারত। এখন পারছে না। শুধু ঘর, আর একা সে। চাকরির এই সমস্যা, ছুটি পায় একদিন। বাবুর বাড়ির কাজে ছুটি নেই, এই সমস্যাও ছিল না।
ভোলার জন্য অপেক্ষা করে থাকার কোনও মানে হয় না। এখন তো নিটে বাজে, আরও এত সময় কাটাবে কী করে? এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে। ভোলার বন্ধুদের দোকানে দোকানে বা আড্ডার জায়গায় ভোলাকে খুঁজতে বেরোতে হবে তাকে। শুধু ভোলাকেই তার চাই। কেন না ভোলার সঙ্গে কথা বলেই খুশি হয় সে। মিশতে ভাল লাগে তার। বাবুদের বাড়িতে কাজ করার অভ্যস্ততায় মাঝে মাঝে ফোনের কথা মনে আসে। যেন কোথাও কোথাও ফোন করে ভোলার খোঁজ এখুনি পেয়ে যাবে সে। যেমন করে বাবু-দিদিরা সহজ সমাধান করে। ভোলার ক্ষেত্রে অবাস্তব হলেও মনে পড়ে যায় নীলার। বাবুর বাড়ির কাজ করার অভ্যস্ত মন কখনও কখনও এভাবে উঁকি দেয়। ভোলা যদি এমন কোথাও থাকত, যেখানে ফোন আছে, তাহলে নীলার ক্ষেত্রে অসম্ভব ছিল না ফোন করার। সামনে হাউজিংয়ের গেটের সামনেই কয়েন ফেলে ফোন করতে পারত সে।
মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় সেই অভ্যাসের নানা কিছু। প্রতিদিন বাজার করার সমস্যায় ফ্রিজ অথবা লোডশেডিঙে ইনভার্টার। অধ্ব গ্যাস ফুরোলে হিটার। নগদ টাকা না থাকলে খবরের কাগজওয়ালাকেও চেক লিখে দেয়। তেমন কিছু নিজস্ব সমস্যার ভেতর উঁকি দিয়ে চলে নীলার।
একটা জিনরে স্কার্ট পরেছে নীলা। আর গায়ে চড়িয়েছে সাদা গেঞ্জি। ব্যাগি হাতা, গোল গলা। মাথার চুলে ক্লিপ এঁটে পেছনের চুল কিছুটা সামনে এনেছে। বাঁ হাতে ছোট একটা ফোমের ব্যাগ। তার ভেতর কিছু খুচরো টাকা পয়সা। তাছাড়া আছে টিপের পাতা, একটা লিপস্টিক, একটা কাজল পেনসিল আর ছোট একটা সস্তায় কেনা আয়না। এও সে শিখেছে।
টালিগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফরমে উঠে এসে পান সিগারেট গুমটিতে যায়। দোকানের সামনে বাদল আর বিন্দু আড্ডা দিচ্ছিল। ভোলার বন্ধু।
নীলা তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হতচকিত হয় ওরা দুজন। ভেবেছিল অন্য কেউ। বুঝতে পারল নীলা। এমন পোশাকে তাকে মনে হয়নি ওদের। ওদের চোখ ধাধিয়ে দিয়েছে বলা যেতে পারে। আর নীলাও শান্ত ও ভদ্র স্বরে বলল, ভোলা নেই!
না। বলল বাদল। বাদল যেন এই ছোট্ট না-টুকু ছাড়া বেশি কিছু বলার সম্পর্কের স্বচ্ছতা খুঁজে পাচ্ছে না।
অথচ নীলা পেছন ফিরেই একটু ইতস্তত করে, যাতে ওরা আরও কিছু কথা সহজ স্বরে বলতে পারে। সহসা দূরত্ব তৈরি হওয়া বজায় রেখেই যেন ওদের কাছ থেকে ফিরে এসেছেনীলা। সেজন্যই ওরা আন্তরিক স্বরে কথা বলতে পারল না। নীলার ছিল তাগিদ। এখনই ভোলাকে খুঁজে ফেলার তাগিদ। ফলে ওদের কাছ থেকে সরে আসতেই হয়। স্টেশরে আরও সম্ভাব্য জায়গায় খুঁজতে হয়। চোখ চালিয়ে নিতে হয়। এগিয়ে পেছিয়ে দেখতে হয়। তার নিজেরই এই মুহূর্তে মনে হয় একটা রোদের চশমা চোখে পরলে ভাল দেখাত তাকে।
এমনি করে ভোলাকে খুঁজে ফেরার অস্থিরতায় চলতে ফিরতে পেছন থেকে একটা ট্রেন এসে পড়ে। কিছু লোকজন নামে। সেই লোকজনের মধ্যে ভোলাকে খোঁজে নীলা। তারপর গাড়িটা ছাড়ার মুহূর্তে মনে পড়ে যায় বেসব্রিজে একটা আড্ডার ঠেক আছে ভোলার। সেখানে থাকলেও থাকতে পারে। মাঝে মাঝে বেসব্রিজে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় ভোলা। সেখানে একটা ফার্নিচারের দোকান আছে। সেই দোকানের এক কমবয়সী মিস্ত্রির সঙ্গে ভোলার বন্ধুত্ব। তার কাছ থেকেই টুকরো টুকরো কাঠ থেকে নানা কিছু বানানোর কাজ শিখেছে। তার কাজ দেখে শেখা। চা-দোকানের মালিকের সঙ্গেও ভাল বন্ধুত্ব ভোলার। কখনও চায়ের দোকানে বসে সময় কাটায়, কখনও ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতে থাকা বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে থাকে।
এখনও দুপুর ফুরিয়ে যায়নি। কেমন অস্থিরভাবে ট্রেন থেকে নামে নীলা। প্ল্যাটফরম পেরিয়ে রেল লাইন ডিঙোয়। সামনেই ফার্নিচারের দোকান। ভোলার বন্ধু মিস্তিরি একা একা কাজ করছে। ওখানে ভোলা নেই। না নেই। মিস্তিরির বাঁ দিকে একটা শূন্য টুল পড়ে আছে। ভোলার জন্যই হয়তো রেখেছে। ফার্নিচারের দোকান পেরিয়ে চা দোকানের সামনে চলে যায় নীলা গোটা দুই খদ্দের। মালিক গেলাসের চায়ে চামচ নাড়ছে। একটু দাঁড়াল নীলা। দোকানদারকে জিগ্যেস করবে কিনা ইতস্তত করল।
দোকানদার নীলার দিকে মুখ তুলে তাকাল। কাউকে খুঁজছেন!
ভোলা এসেছিল?
কে ভোলা! নাইট গার্ড?
হ্যাঁ।
আজ তো আসেনি ভোলা। মাঝে মাঝে আসে।
কোথায় থাকতে পারে এখন?
দোকানদার একটু ভাবল। তা তো বলতে পারব না।গেলাসে চামচ নাড়া শেষ করে চাটা নিয়ে এগিয়ে আসে, নীলার টেবিলের সামনে গেলাসটা বসিয়ে দিয়ে নিন চা খান।
নীলা সংকোচের মধ্যে সহসা পড়ে। না না।
আরে খান না। ভোলার মাসির ঘরের লাগোয়া আপনাদের ঘর না?
নীলা চায়ে চুমুক দেয়। মাথা কাত করে হ্যাঁ জানায়।
গত বুধ্বারে এসেছিল ভোলা। দোকানদারটা সহসা পাশ ফিরে ডানদিকে এগিয়ে যায়। রতন বলে হাঁকে। ফার্নিচার দোকানের মিস্তিরির কাছ থেকে ভোলার খোঁজখবর নেয়।
অস্থিরভাবে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল নীলা। ভোলাকে না পেলে তার চলছেই না। সময়টা কেমন বদ্ধ হয়ে আছে। এক সঙ্গে হাঁটবে, কথা বলবে, পাশাপাশি বসবে, কখনও মুখোমুখি বসবে। রবিবার ছুটির দিনের সারা বিকেল-সন্ধ্যাটা আনন্দের ভেতর কাটাবে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে নীলা। উন্মুখতায় মরে যাচ্ছে।
চা-দোকানদার ফিরে এসে বলল রতন তো বলছে বালিগঞ্জ স্টেশনের সামনে সেলুনে না হলে আর একটু এগিয়ে ফুলের দোকানে খোঁজ করতে। সেলুনের মালিক নন্দ, তার দোকানে মাঝে মাঝে আড্ডা দেয়। আর মন্টুর ফুলের দোকানে যায়। বিয়ের গাড়ি সাজানোর থাকলে ভোলাও হাত লাগায়। একবার বালিগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে দেখতে পারেন। খুব দরকার বুঝি?
নীলা বলল, হ্যাঁ। ভোলাকে পাওয়া যেতে পারে ওখানে?
দেখুন না গিয়ে। আর যাবে কোথায়?
দুপুরে খেতে যায়নি।
তাহলে তো ওদের কারুর সঙ্গে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা গিয়েছে। হোটেলে খেয়ে নিয়েছে।
অমনি স্টেশনের দিকে পা চালাল নীলা। বেসব্রিজ থেকে উলটো ট্রেন ধরে বালিগঞ্জ স্টেশনে যেতে হবে। ফার্নিচারের দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিল রতন। তার দিকে সৌজন্য চোখাচোখি না করেই পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় সে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সেই ব্যাপারে টা খচখচ্ করে। কিন্তু ভোলাকে না পেয়ে তার যে মনের অবস্থা, তার পক্ষে কালক্ষেপ করা আর সম্ভব হল না। যদি এখনই ট্রেন এসে যায়। লাইন টপকাতে গিয়ে পেছন দিকে তাকায়। দেখে ট্রেন আসছে কিনা। দুরে ট্রেরে দেখা পেল না অথচ। প্ল্যাটফরমে ওঠার পরে বুঝতে পারে জোরে হেঁটে আসার ফলে ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার। এই শাসের মধ্যে কেমন ভোলাকে পাবার আবেগ খুঁজে পায় সে। এবং সেই আবেগ গুঁজে দেয় যেন। খুঁজে পায় যেন। যার সঙ্গে তার প্রেম হয়নি। তার ছুটির দিন, ভোলার সঙ্গে কাটানোর আবেগটুকু নিয়েই আন্দোলিত হয় প্রচুর। যে সময়টুকু তার অন্য কোনভাবে কাটতে চায় না, বা কাটাতে চায় না, তার এই ভোলার সঙ্গে সময় কাটানোর, মেলামেশার পছন্দ নিয়ে অভিযান করছে যেন সে। যে সময়টুকু ভোলার সঙ্গে কাটানোর আকাঙক্ষা সে করছে, ভোলাকে খোঁজার ভেল্প দিয়ে সেই সময় থেকে খানিকটা করে খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাকে রোধ করতে পারছে না নীলা। সারা সপ্তাহের ভেতর একটা দুপুর-বিকেলসন্ধ্যার নিজস্বতার অবকাশ বা যাপনকে কাজে লাগাতে পারছে না। সামনের সন্ধ্যাটুকুও খরচ হয়ে গেলে আরও এক সপ্তাহ তাকে অপেক্ষা করতে হবে আর একটা দুটির দিনের দুপুর বিকেল সন্ধ্যার জন্য।
নীলা যেন চেষ্টা করে সময়টাকে বাঁচিয়ে রাখার। যেন শেষ বিকেলের মরা আলো একেবারে মরে যেতে না দিয়ে তার ট্রেন বালিগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছে যাবে, এমন এমন বাসনা মনের ভেতর তৈরী করে সে। কেসব্রিজে ট্রেন পেতে অনেকটা সময় বয়ে গেছে। এখন লেক-গার্ডেন্সে ট্রেন পৌঁছতেই বিকেলের মরা আলো কেমন গাঢ় অন্ধকার নেয়। কেমন ছায়া ছায়া সন্ধ্যা নেমে আসে। কেমন যেন না পাওয়ার বেদনা মনের মধ্যে ছুটে আসে। আজকের দিনে এবং এই মুহূর্তে ভোলার সঙ্গ না পাওয়া তার কাছে কতখানি বেদনার, বিকেলের আলো মরে গিয়ে সন্ধ্যা হবার ভেতর দিয়েই খানিকটা বোঝে নীলা। এই বেদনা বোঝারও তো তার অবকাশ থাকে না! চলন্ত ট্রেনের ভেতর সেই বেদনার। অবকাশ নিয়ে ভরা হয়ে ওঠে নীলা। ভোলাকে সে খুঁজছে। এই খোঁজার প্রক্রিয়ার এক নিজস্বতা আছে। খোঁজার ভেতর দিয়ে ভোলাকে নিয়ে আরও বাসনা তৈরি হয়। এক ধরনের প্রেমার্ত হয়ে পড়ে যেন। সেটা কী ধরনের প্রেম সে নিজেই জানে না। সে শুধু খুজছে, আর ভোলাকে পাওয়ার বাসনা তাকে আছাড়ি-পিছাড়ি মারছে। সে যা চাইছে, পাবে না কেন, এক ধরনের ক্রোধও তৈরি হয় তার।
বালিগঞ্জে নির্দিষ্ট এক সেলুনে ভোলার ঠেক খুঁজে বের করে নীলা।
সেলুনওয়ালা মাঝবয়সী। একজনের দাড়িতে সাবান লাগিয়ে নীলার দিকে সরে এসে বলল ‘ভোলার কি আপনি আত্মীয়?
না, আমার পাড়ার ছেলে।
ও, আপনার নাম নীলা বুঝি?
‘হ্যাঁ’ সেলুনের মালিকের কাছ থেকে নিজের নামটা উচ্চারিত হতে শুনে কেমন। রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে নীলা। এই এইটুকু উচ্চারণে নোকটা অন্য একটা জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। ভোলার সঙ্গে তার সম্পর্কের মধুর একটা খোঁজ পাচ্ছে সে। যা সেলুনওয়ালাকে ভোলা তার সম্পর্ক কিছু বলার ভেত্র দিয়ে তৈরী হয়েছে। তেমন সম্পর্কের এক দোলা। খুঁজে পায় সে। অনুভূতিতে সেই আবেগ তৈরি হয়। ভোলার চাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতার দাবির মধ্যে নীলা এই প্রথম অনু করল ভোলার সে প্রেমিকা আর তারা প্রেম করে। দুজনে দুজনকে ভালবাসে। আর সে কারণেই ভোলাকে খুঁজে মরে। বেসব্রিজের চা দোকান ফার্নিচারের দোকান খুঁজে ট্রেন ধরে চলে আসে বালিগঞ্জ স্টেশনের সেলুন। তার এই অস্থিরভাবে ভোলাকে খোঁজার ভেতর, সেলুনওয়ালাকে জিজ্ঞেস করার ভেতর তেমন কিছু থাকে হয়তো। মুহূর্তে প্রেমিকার মতো মনটা দোলায়িত হয় নীলার।
সেলুনওয়ালা বলল আপনি খোঁজ করতে পারেন ভোলা বলছিল। আজ তো বাড়িতে খেতে যেতেও পারেনি।
ভোলা বলেছে, আমি খোঁজ করতে পারি? বোকার মতো যেন প্রশ্নটা করে নীলা।
সেলুনওয়ালা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
কোথায় ভোলা?
পার্টির বাড়ি গেছে, ফুল দিয়ে গাড়ি সাজাচ্ছে। ফুলের দোকানের মন্টুদাইতো তাকে আটকে দিয়েছে।
ফুলের দোকানটা কোথায়?
ওই তো মাংসের দোকানের পাশেই। লোকটা দাড়ি কামাতে কামাতেই বলে।
ছোট্ট ফুলের দোকানটার ভেতর বসে লোকটা মালা গাঁথছিল। নীলা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা মুখ তুলে তাকায়।
নীলা ছোট্ট করে বলল, ভোলা। আর তাতে যেন অনেকটাই বোঝাল।
ফুল-দোকানদার মন্টু জিভ কেটে ফেলে, আর মুখে আত্মীয়সুলভ সৌজন্য। ভোলাকে আটকে রেখে সে যে ভুল করেছে সেটা বোঝাল। আর ভোলার খোঁজে কে এসেছে তৎক্ষণাৎ বুঝেছে, বুঝতে দিয়েছে। আপনি তো নীলাদি?
হ্যাঁ।
দেখুন তো কি মুশকিল! ভোলাকে চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার এক কর্মচারী না আসায় ভোলা নিজেই পার্টির বাড়ি গেল। গাড়ি সাজাচ্ছে।
এখনই আসবে ভোলা?
মন্টু একটা টুল বাড়িয়ে দেয়। হাত থেকে অসমাপ্ত মালা এলিয়ে পড়ে। ফুলগুলোর দলে দলে যেন সাড়া পড়ে। এসে যাবার তো কথা! দেরিও হতে পারে। তখনই বললাম তুই যাস না, দোকান বন্ধ করে আমি নিজেই যাই। শুনল না। আমি বললাম নীলাদি-তোর সঙ্গে যদি কোথাও যেতে চায়! একগুয়ে জানেনই তো!
নীলা টুলে বসে পড়ে। যেন সে ভোলার প্রেমিকার মতই বসে পড়ে। যেন তার উচাটন ভঙ্গি গড়ে তোলে।
আবার জিভ কাটে মন্টু কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হল বলুন তো! আমার জন্যই!
না না বলে সৌজন্য দেখায় নীলা।
আপনার আজ ছুটির দিন–
কি আর করা যাবে—
আপনি আরও কয়েক জায়গায় খুঁজেছে নিশ্চয়?
হ্যাঁ কেসব্রিজে গিয়েছিলাম।
যা ভেবেছি তাই। নন্দদার সেলুনের দোকানে খোঁজ করে এলেন?
উনি তো আপনার দোকানে পাঠিয়ে দিলেন।
মন্টু ফুলের মালা আবার গাঁথতে গাঁথতে মুখ গুঁজে বলে দেখুন বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে পথে আনতে পারেন কিনা। প্রায়দিনই স্নান-খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করে না।
এ ব্যাপারটা ঠিক জানত না নীলা। সে যেন জানে, মন্টুর কাছে এমন ভাব করল এবং জানলও।
ওপারের চা-দোকানে হাত নেড়ে ইশারা করে চায়ের অর্ডার দিল মন্টু। এবং মালা গাঁথতে গাঁথতে নিজের মনে কী ভাবছে। নীলা বুঝতে পারে তার আর ভোলার সম্পর্ক নিয়ে। যে সম্পর্ক সেই জায়গায় পৌঁছয়নি, সেই বাস্তবতার নৈকট্য নিয়ে ভাবছে। ভোলা ও সে প্রেমিক-প্রেমিকা। ভোলার খোঁজে এসেছে, ভোলাকে পেল না। এই ঘটনার সংলগ্ন কিছু নিয়ে ভাবছে। ভোলা একটা ঘরের সন্ধান করছে।
এই কথায় নীলার সমস্ত অাত্মা কেঁপে ওঠে। মধুরতার এক অনুভূতিতে ভরে যায়। সে যদি এখানে কোনও কিছুর একটু আড়াল পেত, তাহলে পার্স খুলে ছোট আয়নাটা বের করে ঠোঁটে লিপস্টিক বুলিয়ে নিত। নিজের চোখের সঙ্গে চোখ রাখত। আর অনেক কথাই ভাবত, যে-সব কথা আগে ভাবেনি।
চা দিয়ে যায় চা-দোকানের ছেলেটা।
নীলা চা খেতে খেতে ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে। একসঙ্গে এত ফুলের সামনে কোনদিন সে থাকেনি। মনোরম লাগে তার এই সৌগন্ধ্য এতসব ফুলের সামনে শুধু আসেনি সে, ভোলার প্রেম নিবেদনের সামনে এসেছে। বিনম্র, লজ্জাবনত হয়ে পড়ে সে। তার ছুটির দিনের শেষ অবশিষ্ট সন্ধ্যাটা খরচ হয়ে গেছে। এখন রাত শুরু হয়েছে। আর সামান্যই সময় তার হাতে আছে।
কমবয়সী একজন দোকানে এল। মন্টু উদ্বেগের সঙ্গে তাকে শুধোয় কী হল ভোলা এল না?
নীলা বুঝল ছেলেটা মন্টুরই কর্মচারী। ছেলেটা বলল, আমাকে পাঠিয়ে দিল। ভোলাদার দেরি হবে আসতে।
মন্টু তাকে হাত তুলে থামায়। তারপর কমবয়সী কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে, তুই তো হেঁটে এলি?
ছেলেটা মাথা কাত করে হা জানায়।
ভোলা হাঁটবে না, বাসেই আসবে। তাহলে এসে পড়বে এখুনি। আপনি আর একটু বসবেন?
না উঠি। এলেই পাঠিয়ে দেবেন।
ঠিক আছে। তারপর মন্টু দুটো বেলফুলের ছোট মালা তুলে নিয়ে নীলার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
নীলা মালা দুটো নেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতে জড়িয়ে নেয়। এই ফুল নেবার ভঙ্গির ভেতর লোভী দেখায় তাকে। মানুষ খাবারের চেয়ে ফুল নেবার ব্যাপারে বেশি লোভ দেখাতে পারে। আর এই মালা দুটো যেন ভোলাই তাকে দিল, এমনটা মনে হয় নীলার এবং রোমাঞ্চ হয়। মনের ভেতর কেমন মগ্নতা তৈরি হয়, আনন্দ তৈরি হয়। মন্টুর দোকান থেকে ফুল নিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফরমে চলে আসে নীলা। এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা ভোলার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।