নীলা বলল, হ্যাঁ। ভোলাকে পাওয়া যেতে পারে ওখানে?
দেখুন না গিয়ে। আর যাবে কোথায়?
দুপুরে খেতে যায়নি।
তাহলে তো ওদের কারুর সঙ্গে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা গিয়েছে। হোটেলে খেয়ে নিয়েছে।
অমনি স্টেশনের দিকে পা চালাল নীলা। বেসব্রিজ থেকে উলটো ট্রেন ধরে বালিগঞ্জ স্টেশনে যেতে হবে। ফার্নিচারের দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিল রতন। তার দিকে সৌজন্য চোখাচোখি না করেই পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় সে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সেই ব্যাপারে টা খচখচ্ করে। কিন্তু ভোলাকে না পেয়ে তার যে মনের অবস্থা, তার পক্ষে কালক্ষেপ করা আর সম্ভব হল না। যদি এখনই ট্রেন এসে যায়। লাইন টপকাতে গিয়ে পেছন দিকে তাকায়। দেখে ট্রেন আসছে কিনা। দুরে ট্রেরে দেখা পেল না অথচ। প্ল্যাটফরমে ওঠার পরে বুঝতে পারে জোরে হেঁটে আসার ফলে ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার। এই শাসের মধ্যে কেমন ভোলাকে পাবার আবেগ খুঁজে পায় সে। এবং সেই আবেগ গুঁজে দেয় যেন। খুঁজে পায় যেন। যার সঙ্গে তার প্রেম হয়নি। তার ছুটির দিন, ভোলার সঙ্গে কাটানোর আবেগটুকু নিয়েই আন্দোলিত হয় প্রচুর। যে সময়টুকু তার অন্য কোনভাবে কাটতে চায় না, বা কাটাতে চায় না, তার এই ভোলার সঙ্গে সময় কাটানোর, মেলামেশার পছন্দ নিয়ে অভিযান করছে যেন সে। যে সময়টুকু ভোলার সঙ্গে কাটানোর আকাঙক্ষা সে করছে, ভোলাকে খোঁজার ভেল্প দিয়ে সেই সময় থেকে খানিকটা করে খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাকে রোধ করতে পারছে না নীলা। সারা সপ্তাহের ভেতর একটা দুপুর-বিকেলসন্ধ্যার নিজস্বতার অবকাশ বা যাপনকে কাজে লাগাতে পারছে না। সামনের সন্ধ্যাটুকুও খরচ হয়ে গেলে আরও এক সপ্তাহ তাকে অপেক্ষা করতে হবে আর একটা দুটির দিনের দুপুর বিকেল সন্ধ্যার জন্য।
নীলা যেন চেষ্টা করে সময়টাকে বাঁচিয়ে রাখার। যেন শেষ বিকেলের মরা আলো একেবারে মরে যেতে না দিয়ে তার ট্রেন বালিগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছে যাবে, এমন এমন বাসনা মনের ভেতর তৈরী করে সে। কেসব্রিজে ট্রেন পেতে অনেকটা সময় বয়ে গেছে। এখন লেক-গার্ডেন্সে ট্রেন পৌঁছতেই বিকেলের মরা আলো কেমন গাঢ় অন্ধকার নেয়। কেমন ছায়া ছায়া সন্ধ্যা নেমে আসে। কেমন যেন না পাওয়ার বেদনা মনের মধ্যে ছুটে আসে। আজকের দিনে এবং এই মুহূর্তে ভোলার সঙ্গ না পাওয়া তার কাছে কতখানি বেদনার, বিকেলের আলো মরে গিয়ে সন্ধ্যা হবার ভেতর দিয়েই খানিকটা বোঝে নীলা। এই বেদনা বোঝারও তো তার অবকাশ থাকে না! চলন্ত ট্রেনের ভেতর সেই বেদনার। অবকাশ নিয়ে ভরা হয়ে ওঠে নীলা। ভোলাকে সে খুঁজছে। এই খোঁজার প্রক্রিয়ার এক নিজস্বতা আছে। খোঁজার ভেতর দিয়ে ভোলাকে নিয়ে আরও বাসনা তৈরি হয়। এক ধরনের প্রেমার্ত হয়ে পড়ে যেন। সেটা কী ধরনের প্রেম সে নিজেই জানে না। সে শুধু খুজছে, আর ভোলাকে পাওয়ার বাসনা তাকে আছাড়ি-পিছাড়ি মারছে। সে যা চাইছে, পাবে না কেন, এক ধরনের ক্রোধও তৈরি হয় তার।
বালিগঞ্জে নির্দিষ্ট এক সেলুনে ভোলার ঠেক খুঁজে বের করে নীলা।
সেলুনওয়ালা মাঝবয়সী। একজনের দাড়িতে সাবান লাগিয়ে নীলার দিকে সরে এসে বলল ‘ভোলার কি আপনি আত্মীয়?
না, আমার পাড়ার ছেলে।
ও, আপনার নাম নীলা বুঝি?
‘হ্যাঁ’ সেলুনের মালিকের কাছ থেকে নিজের নামটা উচ্চারিত হতে শুনে কেমন। রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে নীলা। এই এইটুকু উচ্চারণে নোকটা অন্য একটা জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। ভোলার সঙ্গে তার সম্পর্কের মধুর একটা খোঁজ পাচ্ছে সে। যা সেলুনওয়ালাকে ভোলা তার সম্পর্ক কিছু বলার ভেত্র দিয়ে তৈরী হয়েছে। তেমন সম্পর্কের এক দোলা। খুঁজে পায় সে। অনুভূতিতে সেই আবেগ তৈরি হয়। ভোলার চাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতার দাবির মধ্যে নীলা এই প্রথম অনু করল ভোলার সে প্রেমিকা আর তারা প্রেম করে। দুজনে দুজনকে ভালবাসে। আর সে কারণেই ভোলাকে খুঁজে মরে। বেসব্রিজের চা দোকান ফার্নিচারের দোকান খুঁজে ট্রেন ধরে চলে আসে বালিগঞ্জ স্টেশনের সেলুন। তার এই অস্থিরভাবে ভোলাকে খোঁজার ভেতর, সেলুনওয়ালাকে জিজ্ঞেস করার ভেতর তেমন কিছু থাকে হয়তো। মুহূর্তে প্রেমিকার মতো মনটা দোলায়িত হয় নীলার।
সেলুনওয়ালা বলল আপনি খোঁজ করতে পারেন ভোলা বলছিল। আজ তো বাড়িতে খেতে যেতেও পারেনি।
ভোলা বলেছে, আমি খোঁজ করতে পারি? বোকার মতো যেন প্রশ্নটা করে নীলা।
সেলুনওয়ালা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
কোথায় ভোলা?
পার্টির বাড়ি গেছে, ফুল দিয়ে গাড়ি সাজাচ্ছে। ফুলের দোকানের মন্টুদাইতো তাকে আটকে দিয়েছে।
ফুলের দোকানটা কোথায়?
ওই তো মাংসের দোকানের পাশেই। লোকটা দাড়ি কামাতে কামাতেই বলে।
ছোট্ট ফুলের দোকানটার ভেতর বসে লোকটা মালা গাঁথছিল। নীলা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা মুখ তুলে তাকায়।
নীলা ছোট্ট করে বলল, ভোলা। আর তাতে যেন অনেকটাই বোঝাল।
ফুল-দোকানদার মন্টু জিভ কেটে ফেলে, আর মুখে আত্মীয়সুলভ সৌজন্য। ভোলাকে আটকে রেখে সে যে ভুল করেছে সেটা বোঝাল। আর ভোলার খোঁজে কে এসেছে তৎক্ষণাৎ বুঝেছে, বুঝতে দিয়েছে। আপনি তো নীলাদি?
হ্যাঁ।
দেখুন তো কি মুশকিল! ভোলাকে চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার এক কর্মচারী না আসায় ভোলা নিজেই পার্টির বাড়ি গেল। গাড়ি সাজাচ্ছে।