ভোলার জন্য অপেক্ষা করে থাকার কোনও মানে হয় না। এখন তো নিটে বাজে, আরও এত সময় কাটাবে কী করে? এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে। ভোলার বন্ধুদের দোকানে দোকানে বা আড্ডার জায়গায় ভোলাকে খুঁজতে বেরোতে হবে তাকে। শুধু ভোলাকেই তার চাই। কেন না ভোলার সঙ্গে কথা বলেই খুশি হয় সে। মিশতে ভাল লাগে তার। বাবুদের বাড়িতে কাজ করার অভ্যস্ততায় মাঝে মাঝে ফোনের কথা মনে আসে। যেন কোথাও কোথাও ফোন করে ভোলার খোঁজ এখুনি পেয়ে যাবে সে। যেমন করে বাবু-দিদিরা সহজ সমাধান করে। ভোলার ক্ষেত্রে অবাস্তব হলেও মনে পড়ে যায় নীলার। বাবুর বাড়ির কাজ করার অভ্যস্ত মন কখনও কখনও এভাবে উঁকি দেয়। ভোলা যদি এমন কোথাও থাকত, যেখানে ফোন আছে, তাহলে নীলার ক্ষেত্রে অসম্ভব ছিল না ফোন করার। সামনে হাউজিংয়ের গেটের সামনেই কয়েন ফেলে ফোন করতে পারত সে।
মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় সেই অভ্যাসের নানা কিছু। প্রতিদিন বাজার করার সমস্যায় ফ্রিজ অথবা লোডশেডিঙে ইনভার্টার। অধ্ব গ্যাস ফুরোলে হিটার। নগদ টাকা না থাকলে খবরের কাগজওয়ালাকেও চেক লিখে দেয়। তেমন কিছু নিজস্ব সমস্যার ভেতর উঁকি দিয়ে চলে নীলার।
একটা জিনরে স্কার্ট পরেছে নীলা। আর গায়ে চড়িয়েছে সাদা গেঞ্জি। ব্যাগি হাতা, গোল গলা। মাথার চুলে ক্লিপ এঁটে পেছনের চুল কিছুটা সামনে এনেছে। বাঁ হাতে ছোট একটা ফোমের ব্যাগ। তার ভেতর কিছু খুচরো টাকা পয়সা। তাছাড়া আছে টিপের পাতা, একটা লিপস্টিক, একটা কাজল পেনসিল আর ছোট একটা সস্তায় কেনা আয়না। এও সে শিখেছে।
টালিগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফরমে উঠে এসে পান সিগারেট গুমটিতে যায়। দোকানের সামনে বাদল আর বিন্দু আড্ডা দিচ্ছিল। ভোলার বন্ধু।
নীলা তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হতচকিত হয় ওরা দুজন। ভেবেছিল অন্য কেউ। বুঝতে পারল নীলা। এমন পোশাকে তাকে মনে হয়নি ওদের। ওদের চোখ ধাধিয়ে দিয়েছে বলা যেতে পারে। আর নীলাও শান্ত ও ভদ্র স্বরে বলল, ভোলা নেই!
না। বলল বাদল। বাদল যেন এই ছোট্ট না-টুকু ছাড়া বেশি কিছু বলার সম্পর্কের স্বচ্ছতা খুঁজে পাচ্ছে না।
অথচ নীলা পেছন ফিরেই একটু ইতস্তত করে, যাতে ওরা আরও কিছু কথা সহজ স্বরে বলতে পারে। সহসা দূরত্ব তৈরি হওয়া বজায় রেখেই যেন ওদের কাছ থেকে ফিরে এসেছেনীলা। সেজন্যই ওরা আন্তরিক স্বরে কথা বলতে পারল না। নীলার ছিল তাগিদ। এখনই ভোলাকে খুঁজে ফেলার তাগিদ। ফলে ওদের কাছ থেকে সরে আসতেই হয়। স্টেশরে আরও সম্ভাব্য জায়গায় খুঁজতে হয়। চোখ চালিয়ে নিতে হয়। এগিয়ে পেছিয়ে দেখতে হয়। তার নিজেরই এই মুহূর্তে মনে হয় একটা রোদের চশমা চোখে পরলে ভাল দেখাত তাকে।
এমনি করে ভোলাকে খুঁজে ফেরার অস্থিরতায় চলতে ফিরতে পেছন থেকে একটা ট্রেন এসে পড়ে। কিছু লোকজন নামে। সেই লোকজনের মধ্যে ভোলাকে খোঁজে নীলা। তারপর গাড়িটা ছাড়ার মুহূর্তে মনে পড়ে যায় বেসব্রিজে একটা আড্ডার ঠেক আছে ভোলার। সেখানে থাকলেও থাকতে পারে। মাঝে মাঝে বেসব্রিজে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় ভোলা। সেখানে একটা ফার্নিচারের দোকান আছে। সেই দোকানের এক কমবয়সী মিস্ত্রির সঙ্গে ভোলার বন্ধুত্ব। তার কাছ থেকেই টুকরো টুকরো কাঠ থেকে নানা কিছু বানানোর কাজ শিখেছে। তার কাজ দেখে শেখা। চা-দোকানের মালিকের সঙ্গেও ভাল বন্ধুত্ব ভোলার। কখনও চায়ের দোকানে বসে সময় কাটায়, কখনও ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতে থাকা বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে থাকে।
এখনও দুপুর ফুরিয়ে যায়নি। কেমন অস্থিরভাবে ট্রেন থেকে নামে নীলা। প্ল্যাটফরম পেরিয়ে রেল লাইন ডিঙোয়। সামনেই ফার্নিচারের দোকান। ভোলার বন্ধু মিস্তিরি একা একা কাজ করছে। ওখানে ভোলা নেই। না নেই। মিস্তিরির বাঁ দিকে একটা শূন্য টুল পড়ে আছে। ভোলার জন্যই হয়তো রেখেছে। ফার্নিচারের দোকান পেরিয়ে চা দোকানের সামনে চলে যায় নীলা গোটা দুই খদ্দের। মালিক গেলাসের চায়ে চামচ নাড়ছে। একটু দাঁড়াল নীলা। দোকানদারকে জিগ্যেস করবে কিনা ইতস্তত করল।
দোকানদার নীলার দিকে মুখ তুলে তাকাল। কাউকে খুঁজছেন!
ভোলা এসেছিল?
কে ভোলা! নাইট গার্ড?
হ্যাঁ।
আজ তো আসেনি ভোলা। মাঝে মাঝে আসে।
কোথায় থাকতে পারে এখন?
দোকানদার একটু ভাবল। তা তো বলতে পারব না।গেলাসে চামচ নাড়া শেষ করে চাটা নিয়ে এগিয়ে আসে, নীলার টেবিলের সামনে গেলাসটা বসিয়ে দিয়ে নিন চা খান।
নীলা সংকোচের মধ্যে সহসা পড়ে। না না।
আরে খান না। ভোলার মাসির ঘরের লাগোয়া আপনাদের ঘর না?
নীলা চায়ে চুমুক দেয়। মাথা কাত করে হ্যাঁ জানায়।
গত বুধ্বারে এসেছিল ভোলা। দোকানদারটা সহসা পাশ ফিরে ডানদিকে এগিয়ে যায়। রতন বলে হাঁকে। ফার্নিচার দোকানের মিস্তিরির কাছ থেকে ভোলার খোঁজখবর নেয়।
অস্থিরভাবে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল নীলা। ভোলাকে না পেলে তার চলছেই না। সময়টা কেমন বদ্ধ হয়ে আছে। এক সঙ্গে হাঁটবে, কথা বলবে, পাশাপাশি বসবে, কখনও মুখোমুখি বসবে। রবিবার ছুটির দিনের সারা বিকেল-সন্ধ্যাটা আনন্দের ভেতর কাটাবে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে নীলা। উন্মুখতায় মরে যাচ্ছে।
চা-দোকানদার ফিরে এসে বলল রতন তো বলছে বালিগঞ্জ স্টেশনের সামনে সেলুনে না হলে আর একটু এগিয়ে ফুলের দোকানে খোঁজ করতে। সেলুনের মালিক নন্দ, তার দোকানে মাঝে মাঝে আড্ডা দেয়। আর মন্টুর ফুলের দোকানে যায়। বিয়ের গাড়ি সাজানোর থাকলে ভোলাও হাত লাগায়। একবার বালিগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে দেখতে পারেন। খুব দরকার বুঝি?